টিলার ওপারে একদিন
প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 2,759 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

লেখা: ফারিয়া কাউছার
.
চেয়ারের ওপর হাত ঠেসে পাশ ফিরে দেখলাম ছোটভাই মোবাইলে গেমস খেলছে।
‘কী ব্যাপার? আজ লেখাপড়া করছ না?’ রাতুলকে উদ্দেশ্য করে বললাম।
রাতুল ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘আজ না পড়লেও চলবে।’
‘মা তোমাদের আজ ছুটি দিয়েছে? সম্ভবই নয়।’
‘আরে কাল বেড়াতে যেতে হবে। স্কুলে যাব না, ছুটি নিয়ে এলাম। তাই আজ অল্প কিছুক্ষণ পড়েই উঠে গেলাম।’
‘তা কোথায় বেড়াতে যাচ্ছ?’
‘কেন? তুমি জানো না।’
‘মা হয়তো আমাকে বলতে ভুলে গেছেন। আমি তো খুব কমই ঘুরতে যাই।’
‘তুমিও যাবে আমাদের সাথে। ইসমাইল ভাইয়া সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন তাঁর গ্রামে।’
‘ইয়াসিননগর?’
‘হ্যাঁ’
‘সেই বছর আটেক আগে গিয়েছিলাম ওই জায়গায়।’ উত্তেজনার বশে বললাম, ‘পাহাড়, টিলা, অসমতল সব জায়গা এখনও ভুলতে পারি না। মজা হবে বেশ।’
‘আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যেতে বলা হলে আমার একদমই ভালো লাগে না।’
‘লাগবে ভালো। খেলা ছাড়াও পৃথিবীতে বহু কিছু আছে।’
‘দেখা যাক।’
তার সাথে কথা বলে এসে পড়ার টেবিলে বসে পড়লাম।
.
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ সকলে তৈরি হয়ে গেলাম। মামিদেরও দাওয়াত দিয়েছেন খালাতো ভাইয়া ইসমাইল। আমার বাসা থেকে আনুমানিক এক মাইল দূরেই নানার বাসা। ওই জায়গা থেকে ইউনিয়নের দূরত্ব এক মাইল। ইউনিয়ন গহিরার ইন্টারসেকশনে মামিদের এসে মিলিত হওয়ার প্রস্তাব রাখলেন মা। এরপর একসাথেই সকলে রওনা দেব। বড় মামাতো বোনের স্কুলের ছুটি এখনও হয়নি। কাজেই সে বাসায় ফিরলেই মামি বেরুতে পারবে। উভয়পক্ষের লোক অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঘড়িতে দশ নাম্বারে মুখিয়ে থাকা কাটাটা এগারোতে এলে মামির ফোন এলো। তানজিলা স্কুল থেকে ফিরেছে। এখান থেকে ইয়াসিননগরের পথ বহুদূর। যেতে যেতে দুপুর গড়াবে ভেবে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম। খালামণি হয়তো আমাদের আশায় বসে আছেন। যদিও ঢের মানুষ আসবে, আমরা অনেকদিন পরই যাচ্ছি তাঁর কাছে।
.
যথারীতিতে আমরা গহিরায় পৌঁছালাম। মামিদের জন্য অপেক্ষা করতে হলো না। ঘাড় ফেরাতেই তাঁদের দেখতে পেলাম। সদলবলে দুটো গাড়ি ভাড়া করে ফেললাম আমরা। আমি, মা, ছোট মামাতো বোন তানহা আর রাতুল কতিপয় ক’জন এক গাড়িতে বসলাম। মামিরা অন্যটাতে বসলেন। যথারীতিতে রাউজানের উদ্দেশ্যে গাড়িদুটো ইন্টারসেকশনের বামদিক দিয়ে রওনা দিল। পাড়ি জমালাম গন্তব্য ইয়াসিননগরের উদ্দেশ্যে।
এইচএসসি পরীক্ষার আজ বহুদিন পর ভ্রমণে বেরিয়েছি। পরীক্ষার আগে পড়ার চাপে কোনোদিকে যাওয়া হয়ে উঠত না। মাও ভ্রমণ কম করেন বলা বাহুল্য। গেলেও দিন শেষেই ফিরে আসেন। আজ খালামণির বাসায় একরাত থাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি। তার জন্য ভাইদের আজ স্কুলে যাওয়া হয়ে উঠল না। বিশেষ অনুরোধ ছিল খালামণির। যাইহোক, রাউজান পেরিয়ে সরু একটি রাস্তায় ঢুকে পড়ল গাড়িদুটো। কিছু জায়গায় রাস্তার একপাশ ভাঙা। যানবাহনের চলাচলে বেশ বিপত্তি বাঁধে সম্ভবত। রাস্তার মোড় ঘুরতেই থাকে। গাড়ি যতই রাস্তা পেরুয়, চেয়ে দেখি এখানে চলাচলকারী মানুষের সংখ্যা নেহায়েত নগণ্য। বাড়িঘরের উচ্চতাও ক্রমে ছোট হয়ে আসছে। যদিও বা আমি স্বয়ং গ্রামে থাকি। কিন্তু এই জায়গাকে দেখেই উপলব্ধি করছি আসল গ্রামীণ পরিবেশ কেমনটা হয়। আমাদের গ্রাম অনেকটাই উন্নত। চাষবাস কম, সেই সাথে জায়গাজমিও। এখানে একেক বাড়ির সাথে সংলগ্ন বিশাল বিশাল জায়গা। এক বিল পেরিয়ে না যেতেই একটা পুকুর। গুণতে গেলে একঘণ্টায় পেরিয়ে আসা রাস্তাটায় কমে ত্রিশের গণ্ডি পেরুবে পুকুরের সংখ্যা। সেই ঘণ্টাখানেক আগে পেরিয়ে আসা উপজেলার একমাত্র নামকরা স্কুল এবং কলেজের পর থেকে এদিকের সবকিছুই অনুন্নত। আরেকটি ঘণ্টা পেরুলে রাস্তা থেকে সুদূর দূরে একটা বড় টিলা দেখতে পেলাম। তার মানে ইয়াছিননগরের সেবাকোলা জায়গাটায় এসে পড়েছি। অনেক মানুষই সাধারণত অপরিচিত দূর্গম একটি জায়গাকে চেনে রাখার জন্য একটা চিহ্ন রাখে। আমার কাছে চিহ্ন হিসেবে আছে, এই টিলাটিই। এই রাস্তার পাশের বিলের বহুদূরে অবস্থিত এই টিলাটিই আমি খালামণির বাসার কাছে পৌঁছার চিহ্ন ধরে থাকি সেই ছোট বেলা থেকেই। এখানে বড় টিলাগুলোর বিশেষ নাম থাকে। মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পেলাম, এটির নাম ‘আঁড়াইসা টিলা’। গাড়ি থামলে যখন ভাইয়েরা জিনিস নামাতে ব্যস্ত, তখন আমি চেয়ে দেখি, টিলাটা আর আগের মতো নেই। অর্ধেক অংশের গাছ কেটেই ফেলা হয়েছে। ছোট বেলায় এটিকে ‘ছোট পাহাড়’ বলে বিবেচনা করতাম, যেটিতে অবস্থিত গাছগুলো জায়গাটিকে জঙ্গলের রূপ দান করেছে। ক্রমে বড় হলে বুঝতে পারি এই ‘ছোট পাহাড়’ পরিচিত ‘বড় টিলা’ নামে। সেবাকোলা জায়গাটায় একটা পুরনো মসজিদ আছে। তার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে একটি সরু রাস্তা, যেদিকে গাড়ি সহজেই যেতে পারে না। আমরা সকলে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তাটা ধরে বহুদূরে এলাম। দৃষ্টিসীমার রাস্তাটা পার করে মোড় ঘুরতেই ছোটখাটো টিলা চোখে পড়ে। রাস্তাগুলো কোথাও উঁচু আর কোথাও নিচু। ক্রমে গাছে ঘেরা একটি রাস্তায় এসে পড়লাম। আমি শেষবার যখন এসেছিলাম, তখন ইসমাইল ভাইয়াদের সাথে এই গাছগুলোতে ধরা শক্ত কিছু সবুজ বীচি দিয়ে খেলা করতাম। ভাইয়াদের বানানো এক ধরনের কাঠের খেলনাতে এই বীচি ঢুকিয়ে খেলনাটির একপাশের ডাঁটা দিয়ে সামনের ডাঁটাতে সজোরে চাপ দিলে ওই শক্ত বীচি বিকট এক শব্দ করে বেরুয়। সেই শব্দ বন্দুক থেকে নিঃসৃত গুলির করা আওয়াজের মতোই। একজনের ওপর অন্যজন বীচিগুলো মেরে বহু আনন্দের একটা খেলা খেলতাম। মামি বললেন, এই ‘আচারগুলা’ বীচি খাওয়াও যায়। মামি খেয়ে দেখলেন, আমি খেলাম না। জায়গাটা খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল। উঁচু একটা রাস্তা থেকে যখন নিচে নেমে একটা সরু রাস্তায় এলাম, তখন আশেপাশে গাছ আর ছিল না। দুইপাশে ছিল সুপ্রশস্ত ক্ষেত। এইখান থেকেই দেখা যাচ্ছে খালামণির বাড়ি, তা যেন সাগরের বুকে একটা ছোট দ্বীপের মতোই। দূরদূরান্তে আর কোনো বাড়িই নেই। সবুজ ক্ষেতের মাঝের এই বাড়ি সত্যিই এখান থেকে খুব আকর্ষণীয় ঠেকছে। দীর্ঘ আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম। জায়গাটা আগের মতোই রয়েছে এখনও। লম্বা একটি সংলগ্ন বাড়ি, যেটির তিনভাগে তিন পরিবার থাকে, তার সামনে সুপ্রশস্ত একটা বড় উঠান। উঠানের বাম পাশের গরুর গোয়ালটা এখনও আছে। ডান পাশের জায়গাটা একটা টিলা পর্যন্ত বিস্তৃত। ওইদিকে যাওয়া রাস্তাটা উঠান থেকেই অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। আমরা ভেতরে ঢুকে গেলাম। খালামণির সাথে দেখা হলো। আমরা একটি ঘরে গিয়ে বসলাম। খালাতো ভাইদের সাথেও দেখা হয়েছে ইতোমধ্যে। ভাবলাম, যাত্রায় যেটুকু মজা হয়েছে, তার কিঞ্চিতও এখানে এসে হবে না। কারণ এখানে ঘরভরা মেহমান থাকবে, বাচ্চাদের ছোটাছুটি, সবার খাওয়া-দাওয়া, এসবে মজা লুপে নেওয়া যায় না। কিন্তু তা হলো না। মামাতো ভাই-বোনদের সাথে বেশ ভালো সময় কাটছে। চোখ বন্ধ করেই আমরা একে অপরকে কোলবালিশ ছুঁড়ে মারছি। যার কাছে গিয়ে সেটি পড়ছে, সে আমাদের বিনোদন দিচ্ছে। যখন আমার কাছে এসে পড়ল, রাতুলের বলায় একটা কৌতুক শোনালাম:
‘ছেলে বাবাকে বলল, বাবা, বাবা, ভাইয়া না একটা পোকা খেয়ে ফেলেছে।
বাবা বলেন, কী বলিস? সর্বনাশ!
ছেলে বলে উঠল, আরে বাবা, ভয় পেয়ো না। আমি সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়াকে পোকা মারার বিষ খাইয়ে দিয়েছি।’
আশেপাশের সকলে হেসে উঠল। আরেকটা বলে বসলাম:
‘যাত্রী বলল, এই যে ভাই, আমার পকেটে হাত ঢুকাচ্ছেন কেন?
ছিনতাইকারী বলল, দুঃখিত ভাই, আমি মনে করেছিলাম এটা আমার পকেট।
যাত্রী ছিনতাইকারীর গালে ঠাস করে চড় বসালো।
ছিনতাইকারী বলে উঠল, আপনি আমার গালে থাপ্পড় মারলেন ক্যান?
যাত্রী বলল, দুঃখিত ভাই, আমি মনে করেছিলাম এটা আমার গাল।’
.
আরেকবার হাসির প্রতিধ্বনি চারিদিকে খেলে গেল। ছোট মামাতো ভাই-বোনরা কী এমন বুঝতে পেরেছে জানি না, হাসতে হাসতে তারা লুটেই পড়েছে। হয়তো বড়দের হাসিতে বুঝতে পেরেছে, আপু এক্সাইটিং কিছু বলেছে। এইভাবেই সময়টা অর্ধেক কেটে গেল। আমরা খাওয়ার পর্ব শেষ করে পুনরায় ঘরে ফিরে এলাম। মায়েরা আসার পর খেলাটা আর খেলা হয়নি। তখন ওদের কথাবার্তায় মনোনিবেশ করলাম। যখন আমার বিরক্তিকর লাগতে শুরু করে, মা বলে উঠেন, তোর ভাই, মামাতো ভাই-বোন সকলেই কোথায় যেন গিয়েছে। তুইও যা না।
‘আমি তো বড় হয়ে গেছি।’ বলায় সকলে হেসে উঠল।
নিজের কথায় নিজেই লজ্জাবোধ করলাম। মা ঠিকই বলেছেন। নিজের বাসায় থেকে বেরুই না বলেই সহজে বাহিরে বেরুনোর সাহস হয় না। কাজেই সামান্য সাহস নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উঠান থেকে নেমে এসে সরু রাস্তাটায় এলে দেখলাম, মামাতো বোনেরা ফিরে আসছে। ওরা আসার পর জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় গেলে?
তানজিলা একটা উঁচু টিলার দিকে আঙুল তাক করে বলল, ‘ওই জায়গায় গিয়েছিলাম।’
টিলার ছায়াঘন সবুজ জায়গাটা দেখে মনের ভেতর একটা ইচ্ছা উঁকি দিয়ে উঠল। বললাম, ‘চলো, আমার সাথে আরেকবার চল।’
বাম পাশের সরু রাস্তাটা ধরে অনেকদূর এগিয়ে গেলাম। রাস্তাটার আশেপাশে অনেক মাটির ঘরবাড়ি রয়েছে। এগুলো দূর থেকে দেখলে বক্সের মতোই বোধ হবে, যার মাঝখানে একটি দরজা, দুইপাশে দুটো ছোটখাটো জানালা। এই ঘরগুলোর মানুষ খুব সুখেই থাকে, তাই না? তাদের কোনো চুরির ভয় নেই, না আছে কোনো দুর্যোগের ভয়। আমাদের বাড়িতে ভূমিকম্প হলে আমরা তাড়াতাড়ি তিনতলার বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। এক্ষেত্রে ওরা সচেতন না থাকলেও ঘরগুলো তাদের ওপর তেমন আঘাত হানবে না। আমরা যতই উন্নত হচ্ছি, সামান্য সুবিধার জন্য যতই বিশাল বিশাল বাসায় থাকছি, তাতে আমাদের নিজের জীবনই বরঞ্চ অধিকতর ঝুঁকিতে পড়ছে। সেই হিসেবে এই মানুষগুলোর অনুন্নত হওয়াটা আমার মাথা লজ্জায় নোয়ায়। দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে তাকিয়ে দেখলাম, টিলাটায় এসে পড়েছি। এখন জায়গাটা পুরোপুরিই দেখছি, যা দূর থেকে দেখা যায়নি। বেশ সুন্দর পরিপাটি জায়গা। টিলার উপরে একদিকে অনেক ঘরবাড়ি, অন্যদিকে একটি রাস্তা কবরস্থান পেরিয়ে চলে গিয়েছে একটা ছোট্ট মনোমুগ্ধকর পুকুরের দিকে। মাঝখানের জায়গাটা খোলামেলা। টিলা ক্রমশ নিচের দিকে ঢালু হয়ে গিয়েছে। নিচের জায়গাটাকে অনেক বড় বড় গাছ সুন্দর একটা ছায়াতল করে রেখেছে। ছোট ছোট মামাতো ভাই-বোন গা এলিয়ে টিলার উপর থেকে গড়িয়ে নিচের দিকে পড়ছে। আমার কোলে থাকা পিচ্চি মামাতো বোন আফরাও তাদের দেখে উত্তেজিত হয়ে ‘ইয়ে’ করে চিৎকার দিয়ে উঠল। তারও প্রবল ইচ্ছে জাগায়, তার তিন বছর বয়সী শরীরটাকে ঘাসের উপর ধরে রেখে সামান্য করে তাকে গড়া দিয়ে নিজেই তাকে ধরে ফেললাম। এভাবে সবাই আনন্দ করছে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া রাতুল বিরসমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মনোভাবনা বুঝে বলে উঠলাম, এই সময়গুলো সহজেই পাওয়া যায় না রাতুল। যাস্ট এঞ্জয়।
বড় কারো সম্মতি পেয়ে সে লজ্জা আর করল না। ছোটদের সাথে গড়াগড়ি খেতে লাগল। তখন আমার নিজের মাঝেও একটা বাচ্চা ভাব জেগে উঠে। তবু নিজেকে সংযত করলাম, কারণ আমি তাদের সবার মাঝের বড়জন। মামাতো বোনদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। বাকি খালাতো ভাইরা এলে রাতুলরা তাদের সাথে গাছে উঠতে শুরু করল। বেশ মজা করছে তারা। আমি এখানে বসেই ভাবতে লাগলাম, গ্রামের পরিবেশে এতো সুন্দর একটা পরিবেশে এতো সুন্দর একটি জায়গা থাকতে পারে তা কল্পনারই বাইরে। তার ওপর বাসায় সর্বদা একগুঁয়ে ভাবে থাকা বাচ্চারাও না কীভাবে মেতে উঠেছে এই মনোরম পরিবেশে। কে বলে, আনন্দ শুধু সি-বীচ বা কক্সবাজারে? গ্রামে আসার এই মুহূর্তগুলোকে অনুভূতির সাথে প্রকাশ করতে গেলে দশ হাজার শব্দও কম পড়বে। আমার মতো একগুঁয়ে মেয়েটিও এখন কতটাই না প্রফুল্লিত! ভাবলাম, একটু আগে ভাইটিকে তো বললাম, সময়গুলো নাও আসতে পারে। তবে আমি কিসের এতো লজ্জা রাখছি? ভেবেই একা আর বসে রইলাম না। গিয়ে ওদের সাথে যোগ দিলাম। মেজো ভাই মিশাদ আমাকে বড় একটা গাছে উঠতে সাহায্য করল। আমি গাছে উঠে যখন নিচের দিকে তাকালাম, তখন বিশ্বাসই করতে পারলাম না, আমি একটা গাছে উঠেছি। নিচ থেকে এখানের উচ্চতা দেখে গাছে উঠতে পারায় গর্বে বুক আমার ফুলে উঠে। আফরাকে মিশাদ আমার কোলে দিয়ে দিলো। সেও সময়টাকে অবাক হয়ে উপলব্ধি করছে। গাছে উঠার ভিন্ন একটা অভিজ্ঞতা শেষে আমরা টিলার ডানদিকের রাস্তাটা ধরে যেতে লাগলাম। জায়গাটা ইয়াছিননগরে থাকা ‘রাবার বাগান’ এর জায়গার মতোই, গাছপালায় ঘেরা। আমি সংক্ষেপে সেই জায়গায় অর্জিত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিই। শেষে ভয় দেখাতে বলে উঠি, ‘ফুফাতো ভাই আমাদের ৭ নং সেক্টরে নিয়ে যায়নি। কেন জানো? ওখানে নাকি বাঘ থাকে।’ ছোট মামাতো ভাই ইফতি জায়গাটা থেকে পালিয়ে রাতুলদের কাছে চলে গেল। বাকিরা হাসতে হাসতে এসে পুকুরের পাশে বসে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে ফিরে এলাম। যেখানে দশ মিনিট মা’দের সাথে কথা বলতে গিয়ে একঘণ্টার মতো লেগেছে, তার স্থলে ওই টিলায় কাটানো দুটো ঘণ্টা যেন ঘণ্টার হিসেবেই কম পড়ে গেল। আসলেই আনন্দের মুহূর্তগুলো বেশ দ্রুতই কেটে যায়। টিলাটা ‘গলাচিপা টিলা’ নামেই পরিচিত। মায়ের কথামতে এখানের ইতিহাসটা এমন; টিলার ডানপাশে থাকা কবরস্থানটা একসময় খুব ভয়ানক ছিল। সেখানে যেই যেত, ফিরে আসত না। সেই সূত্র ধরেই হয়তো নামকরণটা এতটা ‘অদ্ভুত’। এই ধরনের ইতিহাসগুলো শুনতে বেশ ভালোই লাগে। আসার পর শুনতে পেলাম, মামিরা সকলে আজই চলে যাবে। কেবল আমরাই রাতটা থাকব। মুখটাই পাংশুটে হয়ে গেল সকলের। আমরা ভেবেছিলাম, সকলেই থাকব এবং সকালেও গলাচিপা টিলায় যাব। কিন্তু এমন হচ্ছে না দেখে মনটা খারাপ বনে গেল। আমরা উন্নত পরিবেশের সন্তান হয়ে এমন একটা অনুন্নত জায়গায় মাত্র কয়েকটা ঘণ্টায় এতটা খাপ খেয়ে ফেলব কল্পনাই করতে পারিনি। রাফা রীতিমতো কান্না করছে। মামি বলছেন, তার পরীক্ষা। যেতেই হবে।
আমি কিছু বললাম না। সবাই চলে গেলে ভারাক্রান্ত মনে কেবল রয়ে গেলাম, আমি, মা এবং দু’জন ভাই। সন্ধ্যার দিকে বাকি দুই পরিবারের আপুগুলোর সাথে বহুদূরে ঘুরতে যাই তাদের এক আত্মীয়ের কাছে। এরপর রাতটা কোনোভাবে টিভি দেখেই কাটিয়ে দিলাম। সকালের দিকে মনটা আবারও ভার হয়ে গেল। মামাতো ভাই-বোনদের জলসিক্ত চোখগুলোই কেবল মনে পড়ছে। কতই না আশা রেখেছিল, এই সময়ে এই জায়গাটা সম্পূর্ণ ঘুরে দেখে পুনরায় সেই টিলায় যাবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। কারও মন বসছে না। তিনজনই উদাসীন হয়ে দুপুর পর্যন্ত সময় বসেই কাটিয়ে দিলাম। এরপর আমরাও রওনা হলাম বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। সেবাকোলায় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটি গাড়ি পেলাম; তাতে উঠে পড়লাম। বেশ গরম লাগছিল। মুখের নিকাবটা ঘামের কারণে ভিজেই যাচ্ছে। মা বললেন, ড্রাইভার ছাড়া তো কেউই নেই। খুলে ফেল সমস্যা নেই।
আমি নিকাব খুলে মুখে বাতাস লাগতে দিলাম। বাতাসটাও বেশ মনোমুগ্ধকর। হয়তো এই প্রথমবার কোনো এক যাত্রায় মুখে কাপড় না থাকায় অনুভূতিটাই ভিন্ন ঠেকছে। পাশে বসে থাকা রাতুল প্রশংসার সুরে বলে উঠল, ‘আপু, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।’
এই দারুণ অনুভূতির সাথে রাতুলের কথায়ও আরেকটা অজ্ঞাত অনুভূতি উঁকি দিলো। বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভাবে গাড়িতে বসে রইলাম। শূন্য ফুটপাত পেরিয়ে গাড়ি একটা জনবহুল রাস্তায় এসে থামল। কিছু ছেলে উঁকি দিলো ভেতরে। একজন একপলক আমার দিকে তাকানোর পর বাকি বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, চল না, সবাই এই গাড়িতে করে যাই। ঠাট্টা শেষে এক বন্ধুকে গাড়িতে তুলে দিল সে। গাড়ি পুনরায় নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। রাতুলকে বলে উঠলাম, আরে, এই জায়গাটা খুব চেনা লাগছে।
‘আমারও।’
‘আরে হ্যাঁ, আমাদের বাড়ির সেদিকে তো এমন একটা জায়গা আছে।’
সে বলল, আরে এই যে, ওই দেখ, তোমার মতো সারাক্ষণ গোমড়ামুখো থাকা একটা মেয়ে কলসি কোমরে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
আমি ওর পিঠে আলতো একটা ছাপড় দিয়ে বসলাম। মা বলল, ইরিন্তা, চুপ কর। আমার ভালো লাগছে না।
আমরা বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলাম। এম.পি-এর প্রতিষ্ঠিত কলেজটি অতিক্রম করার সময় বলে উঠলাম, রাতুল, এই কলেজেরই বিজ্ঞান মেলায় আমরা এসেছিলাম।
‘কোন বিজ্ঞান মেলা?’
‘ওই যে, ইন্টার প্রথম বর্ষে এসেছিলাম। সেইদিন আমাদের কলেজের স্টলটা খুব জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। তবু আমরা পুরস্কৃত হইনি। কারণ এম.পি-এর পরিকল্পিত ‘গ্রিন সিটি’ প্রস্তাবের ভিত্তিতে এই কলেজের টিমই কর্কশিট দিয়ে হাতে বানিয়ে একটা প্রজেক্ট প্রদর্শন করেছিল। বিচারকরা এই জিনিসের ঊর্ধ্বে বিজ্ঞানসম্মত কিছু দেখতে পারেনি। আমাদের চয়েজ করা সাবজেক্টের স্যার আশ্বাস দিলেন, না জিতলেও একটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা তো হলো পরবর্তীতে ভিন্ন কিছু করার।’
অভিজ্ঞতার বর্ণনা শেষে রাতুল এক স্কুল দেখিয়ে বলে উঠল, আরে এই স্কুলেই আমি গতবার বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম।
‘এটাও এম.পি ফজলে করিমের নামে।’ একটা স্কুলের সামনে কিছু ছেলেদের খেলতে দেখে বলে উঠলাম, ‘জানো, একবার আমার পড়া স্কুলের সামনের মাঠে ছেলেরা ফুটবল নিয়ে খেলছিল। আমার বান্ধবীর একটা দল তার পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। ওখানের একটা মেয়ে সাদিয়া ছিল খুব বোকা। ফুটবল এসে গায়ে পড়ায় তাল সামলাতে না পেরে সে রাস্তার পাশের নিচু মাঠে পড়ে যায়। বান্ধবীরা যখন নামতে ব্যস্ত সে হা করে চেয়ে থাকে তাদের দিকে।’ বলে হাসতে হাসতে আমি লুটিয়ে পড়লাম।
রাতুল একটা জায়গা দেখিয়ে বলে উঠল, জানো এইখানে কী হয়েছে?
‘কী হয়েছে?’ আমি জবাবের জন্য মুখিয়ে রইলাম।
‘আমিও জানি না। হা হা হা।’
আমার পর্যায়ক্রমে ঘটনা বলাকে ব্যঙ্গ করায় তার পিঠে হাসতে হাসতে আবারও ছাপড় মারলাম। আসলে দৈনন্দিন জীবন থেকে বেরিয়ে ভিন্ন একটা অভিজ্ঞতা অর্জন করায় মনটাই ফুরফুরে হয়ে গিয়েছে। আর ভাইদের সাথে খুনসুটির এই পর্বটা দৈনন্দিন জীবনের পাঠ্য বইয়ের অধ্যায়ের আড়ালেই চাপা পড়ে যায় বলে সুযোগ আর সময়টা আমার মুখে তালা লাগাতে পারল না। সবশেষে সম্পূর্ণ একটা দিনের অভিজ্ঞতা শেষে এবং নানা শিক্ষা সাথে করে পুনরায় ফিরে এলাম নিত্য দৈনন্দিনের সেই পুরনো জীবন-যাপনে।

সম্পর্কিত পোস্ট

যদি পাশে থাকো

যদি পাশে থাকো

তাসফিয়া শারমিন ** আজকের সকালটা অন্য রকম। সাত সকালে আম্মু বকা দিলো। মানুষের ঘুম একটু দেরিতে ভাঙতেই পারে। তাই বলে এত রাগার কী আছে ?একেবারে যে দোষ আমারও তাও নয়। মানুষ ঘুম থেকে উঠে ফোনে বা দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখে। কিন্তু আমি উঠি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের আলো দেখে।কে জানে...

কুড়িয়ে পাওয়া রত্ন

কুড়িয়ে পাওয়া রত্ন

অনন্যা অনু 'আমিনা বেগম' মেমোরিয়াল এতিমখানার গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই ওমরের বুকটা ধুক ধুক করতে শুরু করে। ওমর ধীর গতিতে ভেতরে প্রবেশ করে। চারদিকে তখন সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ওমর গত রাতের ফ্লাইটে আমেরিকা থেকে এসেছে। সে এসেই সোজা আমিনা বেগম মেমোরিয়াল এতিমখানায়...

দাদাভাইকে চিঠি

দাদাভাইকে চিঠি

প্রিয় দাদাভাই, শুরুতে তোকে শরতের শিউলি ফুলের নরম নরম ভালোবাসা। কেমন আছিস দাদাভাই? জানি তুই ভালো নেই, তবুও দাঁতগুলো বের করে বলবি ভালো আছি রে পাগলী! দাদাভাই তুই কেন মিথ্যা ভালো থাকার কথা লেখিস প্রতিবার চিঠিতে? তুই কি মনে করিস আমি তোর মিথ্যা হাসি বুঝি না? তুই ভুলে গেছিস,...

৫ Comments

  1. Naeemul Islam Gulzar

    চমৎকার ভ্রমণকাহিনী।ভালো লেগেছে।শুভকামনা♥

    Reply
  2. shahrulislamsayem@gmail.com

    আশেপাশের খুঁটিনাটি বর্ণনা খুব সুন্দরভাবে দিয়েছেন, তবে ইসমাইল নামের ব্যক্তির ক্ষেত্রে ‘তাঁর’ সর্বনামের ব্যবহার না করে ‘তার’ সর্বনাম ব্যবহার করা উচিৎবনা, মানে চন্দ্রবিন্দুটা দেয়া উচিৎ হয়নি

    Reply
  3. Rifat

    খুব সুন্দরভাবে কাহিনীটি উপস্থাপন করেছেন। পড়ে মনে তৃপ্তি পেলাম।
    যাত্রার সময় ঘটনাগুলোও অনেক চমৎকার।
    শুভ কামনা।

    Reply
  4. Tasnim Rime

    সুন্দর সাবলীল বর্ননা ছিল।
    শুভ কামনা

    Reply
  5. Fahiaa

    ভালো লিখেছেন৷ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা যেহেতু, আমার কাছে মনে হলো ভ্রমণের বর্ণনার আগে সেটার পটভূমির বিশদ বর্ণনার দরকার ছিলনা। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনায় এটা গৌণ। আর সংলাপের ব্যবহার বেশি হয় গল্পে, ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় সংলাপের ব্যবহার সীমিত রাখা উচিত। শুভকামনা৷

    Reply

Leave a Reply to shahrulislamsayem@gmail.com Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *