গল্প লেখক:
সোহেল রানা শামী
(মার্চ – ২০১৮)
……………
সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙতেই একটা হাই তুলে উঠে বসলাম বেডে। খোলা জানালা দিয়ে শীতল হাওয়া প্রবেশ করতেই শরীরটা হালকা কেঁপে উঠলো আমার। বেড থেকে নেমে জ্যাকেটটা পরলাম, তারপর ব্রাশ করতে করতে বাইরে এলাম ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে। কুয়াশা তখনও সম্পূর্ণ কাটেনি।
আমাকে বের হতে দেখে ফুফু জিজ্ঞেস করলো, ‘কী রে রানা, ঘুম হলো তো রাতে? কোনো অসুবিধে হয়নি তো?’
-না ফুফু, কোনো অসুবিধে হয়নি। বলতে বলতে হাঁটা শুরু করলাম। পেছন থেকে ফুফু জিজ্ঞেস করলো আবার, ‘কোথায় যাচ্ছিস এই ঠাণ্ডায়?’
-অনেকদিন পর এসেছি, তোমাদের এলাকাটা একটু ঘুরে দেখি….’ হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলাম।
শীতকালে গ্রামের পরিবেশটা আসলেই সুন্দর। গাছের আড়াল থেকে পাখির কিচিরমিচির ডাক কানে যেন সুরের ঝঙ্কার তুলছে। একটা টিউবওয়েল থেকে হাত-মুখ ধুয়ে কুলি করে নিলাম আমি। ব্রাশটা জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে ক্যামেরাটা নিয়ে গ্রামের পরিবেশের ছবি তুলতে লাগলাম। কুয়াশার কারণে ছবিগুলোও ঝাপসা ঝাপসা উঠছে। ছবি তোলার সময় হঠাৎ মনে পড়লো সামনে একটা শহীদ মিনার আছে। ওদিকেই হাঁটতে শুরু করলাম আমি।
শহীদ মিনারের পাশে এসে অবাক না হয়ে পারলাম না। অযত্নে, অবহেলায় পড়ে আছে শহীদ মিনারটি। গাছ থেকে পাতা পড়ছে, গরু-ছাগল মলত্যাগ করে গেছে, কিন্তু পরিষ্কার করার মতো কেউ নেই। অথচ এমন তো থাকার কথা না। এখানে একটা বৃদ্ধা ছিলো, যিনি রোজ সকালে এসে শহীদ মিনারটি পরিষ্কার করে যেতেন, ঐ বৃদ্ধাটা কোথায়? কয়েক বছর আগে যখন এই এলাকায় বেড়াতে এসেছিলাম, তখন এরকম ছিলো না শহীদ মিনারটি। সেদিনও আমি হঠাৎ ছবি তুলতে তুলতে এদিকে এসেছিলাম। দেখলাম, ৮০/৮৫ বছরের একজন বৃদ্ধা শহীদ মিনারে ঝাড়ু দিচ্ছে শীতের ভেজা হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে। অপূর্ব ছিলো সেই দৃশ্য। দৃশ্যটা আমি হাতছাড়া করতে চাইনি, তাই আড়ালে বৃদ্ধার কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। ঝাড়ু দেয়া শেষ করে বৃদ্ধা নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মিনারের মেঝে পরিষ্কার করলো, তারপর লাল বৃত্তটির উপর চুমু খেয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটতে লাগলেন উল্টোদিকে। বুঝলাম বয়সের ভারে উনি ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। আমি ক্যামেরাটা তখন গলায় ঝুলিয়ে বৃদ্ধার কাছে গিয়ে ডাক দিলাম, ‘দাদিমনি…..’
আমার ডাক শুনে বৃদ্ধা ঘুরে তাকালেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে বাছা তুমি?’
আমি হেসে জবাব দিলাম,’আমাকে চিনবেন না আপনি। আমি এই এলাকায় বেড়াতে এসেছি আমার ফুফুর বাসায়। ভোরবেলায় আমার হাঁটাহাঁটির অভ্যাস আছে, তাই হাটতে বের হলাম। হঠাৎ আপনাকে দেখলাম, আপনার কাজ দেখে খুব আগ্রহ জন্মালো আপনার সাথে কথা বলতে।’
বৃদ্ধাও হেসে বললো, ‘ঐ একটাই তো কাজ আমার, রোজ সকালে উঠে শহীদ মিনারটি পরিষ্কার করা।’ বৃদ্ধার সামনের পাটির কয়েকটা দাঁত পড়ে গেছে। তাই কথাগুলো অস্পষ্ট শোনা গেলো, কিন্তু বুঝতে কষ্ট হলো না আমার। আমি বললাম, ‘আপনাকে আমি পৌঁছে দিই আপনার বাসা পর্যন্ত?’
-আমি যেতে পারবো।
-আসলে দাদি আপনার সাথে বসে কিছুক্ষণ কথা বলার খুব ইচ্ছে হচ্ছে তাই। আপনার নাতি মনে করতে পারেন আমাকে।’
বৃদ্ধা হেসে বললেন, ‘আচ্ছা দাদুভাই, আমার সাথেই এসো।’
আমি বৃদ্ধাকে ধরে উনার সাথে হাঁটতে লাগলাম। একটা গলিতে প্রবেশ করলাম আমরা। গলির শেষ মাথায় একটা মাটির ঘরে উনি থাকেন। বৃদ্ধার সাথে আমাকেও আসতে দেখে অশেপাশের বাড়ির সবাই অবাক হয়ে তাকাতে লাগলো। বৃদ্ধা আমাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসতে দিলেন, তারপর উনি ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একটা বিশ/একুশ বছরের মেয়ে ট্রেতে করে চা নিয়ে এসে আমার সামনে রাখলো। ট্রে থেকে সে চায়ের কাপটা নিয়ে আমার হাতে দিতে দিতে বললো, ‘চা খান, দাদি একটু পর আসবে।’ বলার সময় মেয়েটার ঠোঁট হালকা কেঁপে উঠলো। মুখে তার লজুকভাব স্পষ্ট। অপরিচিত কোনো ছেলের সামনে এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। মেয়েটা চলে যেতেই আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। মনে মনে বললাম, কী অমায়িক ব্যবহার এদের! চেনা নেই, জানা নেই, একটা অপরিচিত ছেলে আসলো বাসায়, কিন্তু ওরা মেহমানের মতো সম্মান দিচ্ছে!’
চা খেয়ে কাপটা সামনের টেবিলে রাখলাম। তখন মেয়েটা আবার এলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদি আসবেন না?’
মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো, ‘আসবে। দাদি ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। প্রতিদিনের রুটিনের মধ্যে এটাও দাদির একটা কাজ।’
-ছবির সাথে কথা বলছে? মানে?’ কিছুটা অবাক হলাম।
-হ্যাঁ, ৬০ বছর ধরে দাদি এই রুটিনে চলে।
-৬০ বছর! প্লিজ বসুন না? আমার জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে দাদির সম্পর্কে।’ কৌতূহলী হয়ে বললাম।
মেয়েটা আরেকটা চেয়ারে বসে মাথার ওড়নাটা ঠিক করে নিলো। নিচু হয়েই বলতে শুরু করলো, ‘দাদি প্রতিদিন ভোরে উঠে বের হয়ে যায়। শহীদ মিনারে গিয়ে মিনার পরিষ্কার করে আসে, তারপর বাসায় এসে রুমের দরজা বন্ধ করে একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা বলে।’
-ছবিটা কার?
-দাদির কাছ থেকেই শুনেন সব, ঐ যে দাদি আসছে।’
দাদি আসতেই মেয়েটা চায়ের কাপ আর ট্রে নিয়ে চলে গেলো। দাদি এসে বসলো চেয়ারটাতে। আমি বললাম, ‘দাদি, কিছু মনে করবেন না, একটা জিনিস জানতে খুব ইচ্ছে করছে…..’
দাদি হেসে বললেন, ‘জানি কী জানতে চাও। আসলে শহীদ মিনারটা অপরিষ্কার দেখলে আমার বুকের ভেতরটা খুব ছটফট করে, মনে হয় যেন আমরা ভাষা শহীদদের লাশের উপর ময়লা আবর্জনা ফেলছি, গরু-ছাগল দিয়ে মলত্যাগ করাচ্ছি। তাই প্রতিদিন ভোরে উঠে আমি শহীদ মিনারটা পরিষ্কার করে আসি। যারা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের মুখের ভাষা দিয়ে গেছে, তাদের তো সম্মান জানাতে হবে দাদুভাই। কিন্তু আজকাল আমরা এমন বাঙালি, বাংলা ভাষায় কথা বলি, কিন্তু কারা এই বাংলা ভাষা এনে দিয়ে গেছে সেই কথা ভুলে গেছি। শুধু ২১ শে ফেব্রুয়ারি এলে লোক দেখানো কিছু অনুষ্ঠান করে নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিই আমরা। সেখানেও অনেকে ইংরেজিতে বড় বড় বক্তব্য দেয়। কেন শুধু শুধু এতগুলো প্রাণ হারালো ভাষার জন্য, যদি আমরাই বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব না দিই? শহীদ মিনারটার যত্ন কেউ নেয় না, ওটাকে অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখলে আমার সহ্য হয় না। আমার কান্না পায় খুব…’ এতটুকু বলার পর থামলেন বৃদ্ধা। বলার সময় হাসি দিয়ে শুরু করলেও থামার পর উনার চোখদুটো অশ্রুতে ভিজে উঠলো। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে উনি আবার বললেন, ‘যারা বাংলা ভাষার জন্য স্বজন হারিয়েছে তারাই বুঝে বাংলা ভাষার মর্ম, শহীদ মিনারের মর্ম।’ আবারও থামলেন বৃদ্ধা। উনার কথায় বুঝা গেলো, উনিও তার কোনো স্বজনকে হারিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের সময়।
পরম কৌতূহলে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদিমনি, আপনি কি কোনো স্বজন হারিয়েছেন ঐ সময়?’
বৃদ্ধার মুখটা হঠাৎ কালো হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন উনি। ভেতর থেকে তার নাতনীটা এসে তার পাশে একই চেয়ারে বসলো। বৃদ্ধার চোখের কোণের অশ্রুকণাটুকু মুছে দিয়ে সে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো উনাকে। আমি আমার প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। বৃদ্ধা বাইরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলতে শুরু করলেন, ‘১৯৫২ সালের কথা। আমি তখন সদ্য যুবতী। চারদিকে তখন আন্দোলনের রেশ বেড়েই চলেছে। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিলো। কোনো মিছিল বের হলে আমি কেবল বাসার জানালা দিয়ে দেখতাম। আমাকে বাসা থেকে বের হতে দিতো না আমার মা-বাবা। কিন্তু, যখন দেখতাম আমার মতো মেয়েরা তীব্র আন্দোলন করে মিছিলে বের হয়েছে, তখন আমারও খুব ইচ্ছে হতো ওদের মতো আন্দোলন করতে।
একদিন দেখলাম আমার মতো অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রী মিছিলে শ্লোগান দিচ্ছে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না……’
সেদিন আমি বাসায় থাকতে পারলাম না, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে, বন্দি ভাইদের মুক্তির দাবিতে আমিও বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে, মিশে গেলাম আমার মতো শতশত নারী আন্দোলনকারীর মিছিলের সাথে। তারপর সবার মতো আমিও গলার জোর বাড়িয়ে শ্লোগান দিতে শুরু করলাম। হঠাৎ শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি আমরা। পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালাতে শুরু করলাম। হঠাৎ আমি হোচট খেয়ে নিচে পড়ে যাই। কয়েকজন পুলিশ আমার দিকে লাঠি নিয়ে তাড়া করতে করতে আসতে লাগলো। তখন কোথা থেকে যেন একটা ছেলে এসে আমার হাত ধরে তুললো। ছেলেটাকে দেখেই আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কারণ ও আমার খুব পরিচিত, আমরা পরস্পরকে ভালোবাসতাম, ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। ওর নাম মাহফুজ। ও আমার হাত ধরেই আমাকে নিয়ে পালিয়ে আসে। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জে অনেক মেয়েই সেখানে মারা যায়।
পরদিন মাহফুজ তার বন্ধুদের নিয়ে লোকজনের কাছে চাঁদা তুলতে গিয়েছিলো। আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য বেশকিছু লিফলেট তৈরি করতে টাকার দরকার ছিলো। কিন্তু চাঁদা তোলার সময় আবারও পুলিশ ওদের তাড়া করে। গুলিও চালায়। একটা গুলি তখন মাহফুজের পায়ে এসে লাগে। কোনোমতে আমাদের বাসায় ঢুকে পড়ে সে। আমি তাকে আমাদের বাসার আলমারির পেছনে লুকিয়ে রাখি, কয়েক জায়গায় রক্তের চিহ্ন ছিলো, ওগুলো মুছে দিই। পুলিশ এসে যখন বাইরে কড়া নাড়ে, আমার বুকটা ছটফট করা শুরু করলো তখন। আল্লাহর কাছে মনে মনে প্রার্থনা করলাম, ‘আল্লাহ, তুমি আমার মাহফুজকে বাঁচিয়ে দাও।’
ওদিকে দরজায় পুলিশ বারবার ঠোকা দিচ্ছিলো, আর আমি কাঁপতে শুরু করলাম। আমার মা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। পুলিশ আম্মুকে জিজ্ঞেস করলো কেউ পালিয়ে বাসায় ঢুকেছে কি না। আম্মু জবাব দিলো, ‘না।’
ভাগ্য সেদিন ভালোই ছিলো বলতে হবে। বাসায় ঢুকে সার্চ করেনি পুলিশ। ওরা চলে যেতেই আমার ভয়টা কমে গেলো। দৌড়ে গিয়ে মাহফুজকে আলমারির পেছন থেকে বের করলাম, তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। আবেগটা হঠাৎ এতো বেড়ে গিয়েছিলো, ওর পায়ের আঘাতটার কথা ভুলে গেলাম। হঠাৎ ও ব্যথায় ককিয়ে উঠে, তখন ওকে ছেড়ে দিয়ে ভেতর থেকে ব্যান্ডেজ নিয়ে আসলাম। গুলিটা ভেতরে আটকে ছিলো না, তাই বেশি কষ্ট করতে হয়নি। তবে ব্যথায় ও অনেক কষ্ট পেয়েছিলো সেদিন।
কয়েকদিন পর আমাদের বিয়ের দিন আসে। সেদিন ছিলো ২১ শে ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার। আগেরদিন কারফিউ জারি করা হয়, ভাষা আন্দোলন তীব্রভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে। কিন্তু বাংলার দামাল ছেলেরা থেমে থাকেনি তবুও। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে নেমে পড়ে রাজপথে। মাহফুজও যায় মিছিলে। বিয়েটা আর হয়নি।
সেদিন পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি করে ওদের মিছিলে। এবার ভাগ্যটা আর ততোটা ভালো ছিলো না। পুলিশের গুলিতে অনেকে নিহত হয়। মাহফুজও তাদের মধ্যে একজন……’ বলতে বলতে বৃদ্ধা থামলেন। শেষের কথাটা বলার সময় উনার গলাটা কেঁপে উঠলো। চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল ঝরতে লাগলো। বুঝলাম শোকটা বৃদ্ধার বুকে এখনও পাথরের মতো জমাট বেঁধে আছে। আমি এসে পুরোনো শোকটা নতুন করে যেন জাগিয়ে দিলাম উনার মনে।
এরপর বৃদ্ধা আমাকে রুমে নিয়ে গিয়ে ফ্রেমে বাঁধাই করা একটা ছবি দেখালেন। টগবগে এক যুবকের ছবি, দেখেই বুঝা যায় অসীম সাহসিকতার এক মূর্ত প্রতীক। ইনিই সেই মাহফুজ, যিনি ভাষার জন্য নিজের জীবনের পরোয়া করেননি। বৃদ্ধা আজও তার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে চোখের অশ্রু ঝরিয়ে যাচ্ছেন।
সেদিন বৃদ্ধার বাসা থেকে চলে আসার সময় তার নাতনির কাছে একটা কথা শুনে অনেক বেশি অবাক হলাম। বৃদ্ধার নাতনি তখন আমাকে এগিয়ে দিতে এসেছিলো। ওর নাম লাবণী। হঠাৎ সে বললো, ‘জানেন, দাদি এখনো পর্যন্ত বিয়ে করেনি….’
-হোয়াট? তাহলে ‘নাতনি’ আসলো কীভাবে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-উনি আমার আসল দাদি না। একটা বৃদ্ধাশ্রম থেকে উনাকে আমার বাবা এনেছিলেন আজ থেকে অনেক বছর আগে। শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় উনার বাব মাকেও মেরে ফেলে পাকিস্তানিরা।’
আমি কিছুই বলতে পারিনি সেদিন লাবণীর কথার জবাবে, কেবল অবাক হয়ে রইলাম। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত একটা মানুষ কেবল হারিয়েই গেছে স্বজনদের।
আজ আবারও হাঁটতে হাঁটতে এলাম বৃদ্ধার বাসার কাছে। চারপাশটা আর আগের মতো নেই, কেমন জানি বদলে গেছে। বৃদ্ধার নাতনি বাইরে কাপড় শুকাতে দিচ্ছিলো, আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। যেন অনেকদিন পর খুব আপন কাউকে দেখেছে সে এমনভাবে বললো, ‘রানা ভাই আপনি?’
আমি বললাম, ‘হুমমমম…. ভালো আছেন?’
-ভালো। আপনি কেমন আছেন?
-আমিও ভালো। দাদি কোথায়?’
হঠাৎ লাবণীর মুখটা কালো হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে বললো, ‘দাদি মারা গেছে দুই বছর আগে।’
-ইন্নানিল্লাহি…..রাজেউন।’ বলেই কিছুক্ষণ মুখ দিয়ে কথা বের হলো না আমার। দাদি মারা গেছে তাইতো অযত্নে, অবহেলায় পড়ে আছে শহীদ মিনারটা। পরিষ্কার করারও কেউ নেই।
-আচ্ছা, দাদির কবরটা দেখাতে নিয়ে যাবেন আমাকে?’ নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলাম।
-চলুন…..’
একটা নদী পার হলাম আমরা। নদীর ওপারেই একটা কবরস্থানে দাদির কবর। লাবণী বাইরে দাঁড়িয়েছিলো, আমি কবরস্থানের ভেতরে গিয়ে দাদির কবরটা জিয়ারত করে এলাম। তারপর দুজন আবার ফিরে চললাম। নৌকাতে চড়ে নদী পার হওয়ার সময় নৌকার মাঝি উচু গলায় একটা ভাটিয়ালি গান ধরলো। তার গান শেষ হতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাঝি, তুমি কি জানো, তুমি যে ভাষায় গান গেয়েছো সেই ভাষার ইতিহাস কী?’
আমার প্রশ্ন শুনে মাঝি চেয়ে থাকে হা করে, বোকার মতো হাসে। মাঝি জানে না বাংলা ভাষার ইতিহাস, জানে না ভাষা আন্দোলনের কথা, হয়তো চিনেও না ভাষা আন্দোলন কী…..’
০ Comments