সময়ের ফের
প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 2,915 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

লেখা: ফারহা নূর

বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। রাশু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ রিনরিনে একটা সুর তুলে মনের মাঝে। তার এখন ভিজতে ইচ্ছে করছে কিন্তু মায়ের কড়া শাসনে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষাকাল  যতটা আনন্দের ঠিক ততটাই কষ্টদায়ক।  বৃষ্টি সবার জন্য প্রেমময় হয় না। ছোট্ট রাশু মায়ের কড়া শাসনের অবাধ্য হয়ে উঠোনে চলে গেল ভিজতে। রাশু মনের তৃপ্তি নিয়ে ভিজছে। তার বাবা মনসুর আলী বটতলার হাট থেকে এখনো ফেরেনি।  মা আমেনা বেগম ঘরে বৃষ্টির পানি পড়া বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। তাদের ঘরের টিনের চাল অনেক পুরনো হয়ে গেছে। টিনের চালে বেশকিছু ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি এলেই ফুটো দিয়ে ঘরে পানি পড়ে। মাটির ঘর হওয়ায় পানি পড়লেই স্যাঁতসেঁতে হয়ে যায়। কাদাজল এক হয়ে ঘরে পা রাখার অবস্থা থাকে না। আমেনা বেগম হাড়ি  পাতিল বসিয়ে রাখেন পানি পড়ার জায়গায়। এত বেশি পানি পড়ে যে পাতিল বসালেও কাজ হয় না। বর্ষাকাল এলেই আমেনা বেগমের চোখে অভিমানের তীব্রতা বেড়ে যায়। মনসুর আলীকে বললে বলবেন, আর কয়টা দিন ধৈর্য ধর দেখি কি করা যায়। আমেনা বেগম এই মিথ্যে সান্ত্বনা গত দশবছর ধরেই শুনে আসছে। কিছুদিন করতে করতে বছর শেষ হয়ে যায়। আমেনা বেগমের মলিন মুখের অভিমানের সুর শুনতে হবে বলে মনসুর আলী বৃষ্টির দিন বাড়িতে থাকে না। আমেনা বেগম রান্না করতে গেলে আরও বেশি রাগান্বিত হোন। রান্নাঘর না থাকায় উপরে ছনের বেড়া দিয়ে রান্নার জন্য জায়গা করেছিল। বর্ষাকালে এই জায়গায় রান্না করতে খুব অসুবিধা হয়। তিনি মাটির চুলা বসিয়েছেন পুরনো বালতিতে।  বৃষ্টি এলে এতে করে সহজে চুলা সরিয়ে রাখা যায়। তিনি বৃষ্টিতে ভিজে রান্না করতে বসেছেন। আগুন জ্বালাতে ব্যর্থ হয়ে বসে রইলেন।  বৃষ্টির জন্য ভিজে থাকা জ্বালানী খড়কুটোয় আগুন জ্বলে না। রাশু ভিজতে ভিজতে উঠোন পেরিয়ে নদীর পারে চলে গেল। নদীর পারে গ্রামে তার সমবয়সী  ছেলেরা ফুটবল খেলছে। রাশু এগিয়ে এসে তাদের সাথে খেলায় যোগ দিল। কাদাজলে ভিজে একাকার হয়ে আছে ছেলেরা। রাশু মনে মনে ভাবছে তার গায়ের শার্টটা খুলে রেখে আসলে ভালো হত। কাদাজলে জামা নষ্ট হয়ে গেছে। বাড়িতে গেলে মায়ের বকুনি খেতে হবে। গতকয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় গতকালের গেঞ্জিটাও শুকায়নি। আজও ভিজে গেল। গোসল করে আজ খালি গায়ে থাকতে হবে। এদিকে যদি জ্বর বেঁধে যায় তো মায়ের বকুনি খেতে হবে। মায়ের কড়া নিষেধ  উপেক্ষা করেছে মন খচখচ করছে। সে চায় না মায়ের অবাধ্য হতে। কিন্তু মন মানাতে পারে না দুরন্ত শৈশব থেকে। বৃষ্টি যখন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে তাদের খেলার গতিও কমে আসছে। রাশু বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো। কিন্তু সমবয়সী সবাই নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পরলো। নদীর তীর ঘেঁষে  অসংখ্য গাছ আছে।  আমগাছের ডালগুলো নদীর পানির উপরে বেয়ে গেছে। ডাল থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পরার মজাই আলাদা। সেও নিজের মন মানাতে পারলো না।  গাছের ডালে উঠে সবার সাথে ঝাঁপিয়ে পরলো নদীতে। সাঁতার কেটে সবাই মজা করছে পানিতে। তাদের শৈশব কাটে এভাবে দুরন্তপনায়। রাশু বেশকিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাড়িতে ফিরছে। পথে তার মনে হতে লাগলো বাড়িতে আজ মায়ের বকুনি তো খাবেই আরও খারাপ কিছুও হতে পারে। ভয়ে গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢুকলো। ভেজা শরীর বেয়ে পানি ছুঁইয়ে পরছে। আমেনা বেগম  রাশু’কে দেখেই বলতে লাগলেন, “সারাদিন শেষে এই তোর আসা হলো? তোর বাপে যাইয়াও সারাদিনে আসে না। খাওন পরন কিছু লাগব না। মরন আমার। জ্বর হইলে টেকা কই পামু শুনি।” সে অপরাধী চোখে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের সামনে। রাশু জানে এখন তাকে সব শুনে যেতে হবে। মা যা বলছে সবই সত্যি। কতটা কষ্ট করে রান্না করে তা সে জানে। জন্মের পর থেকেই সে অভাব দারিদ্রের সাথে বসবাস করছে। বুঝার বয়স হওয়ার আগেই সে অনেক কিছু বুঝে যায়।  আমেনা বেগম রাগের স্বরে রাশু’কে বকতে বকতেই তার ভেজা শরীর মুছে দিলেন শাড়ির আঁচলে। খালি গায়ে কাঁপছে দেখে আমেনা বেগম তার একটা শাড়ি জড়িয়ে দিল শরীরে। রাশু জানে সারাদিন বৃষ্টির জন্য আজ রান্না করতে পারেনি। আমেনা বেগম এখন রান্না করবেন।  রাশু তাকিয়ে আছে তার চাচাদের ঘরে। ঘরের বারান্দায় খেলছে তার চাচাতো ভাই জামিল।
.
আছরের আযান শেষে মনসুর আলী বটতলার মসজিদে গিয়ে নামাজ পরলেন। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরলেন। শূন্য হাতে ফিরল দেখে  মুখটা মলিন হয়ে গেল রাশুর। বাবা বলেছে আসার সময় ইলিশ মাছ নিয়ে আসবে। প্রতিদিন নিরামিষ আলু ভাত খেতে তার ভালো লাগে না। কতদিন মাছ খেতে পায় না। শেষ মাছ খেয়েছিল জামিলের জন্মদিনের দিন। রুই মাছের এক টুকরো মাছ খেতে দিয়েছিল। সে জানে না তার জন্মদিন কবে। কখনো তার জন্মদিনে মাছ খেতে পায়নি। জামিলের জন্মদিনে অনেক বড় অনুষ্ঠান করা হয়। বিশাল কেক কাটা হয়। কত মানুষজন আসে অনেক রঙিন খাবারের আয়োজন করা হয়। মা তাকে যেতে বারণ করলেও রাশু মায়ের কথার অবাধ্য হয়। এমন খাবার খাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না রাশু। মা’কে জিজ্ঞাস করেছিল তার জন্মদিন কি নেই। আমেনা বেগম বলেছেন,  তোর জন্মদিন আছে কিন্তু জন্মদিন পালন করা জায়েজ না। রাশু গাঢ় স্বরে বলল, “তাইলে জামিলের যে জন্মদিন করা হয়।  আমেনা বেগম রাশুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তাদের আল্লাহ গুণাহ দিবেন।”  সেদিন মায়ের কথা শুনেছিল বাধ্য ছেলের মতো। রাশুদের ঘরে হারিকেনের নিয়ন আলোয় অন্ধকারটা বুঝা যায়। টিনের জানালার ফাক গলে তাকিয়ে আছে জামিলদের ঘরে। জামিলদের ঘরে লাল,  নীল,  ধবধবে ফর্সা রঙের আলো জ্বলছে। রঙিন আলোয় তাদের ঘরটা জ্বলজ্বল করছে। মনসুর আলী ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি জানেন ছেলের চোখে রঙিন আলোর ঝলকানি রঙিন স্বপ্ন দেখায়। রাশু রোজ এভাবে তাকিয়ে দেখে। ভাবে তাদের ঘরটা যদি এমন হতো। রাশু একদিন মনসুর আলীকে জিজ্ঞাস করেছিলো, “বাবা আমাদের ঘরটা জামিলদের মতো রঙিন নয় ক্যান? জামিলের কত রঙিন  জামা।  জানো বাবা জামিল রোজ নিয়ম করে তিন- চারবার পরনের জামা বদলায়। আচ্ছা বাবা জামিলদের মতো তোমার এত টেকা নাই ক্যান?” তিনি ছেলের দীর্ঘ দিনের জমিয়ে রাখা প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হোন। তিনি জানেন তার ছেলে যখন বড় হবে এসব প্রশ্নের উত্তর সে নিজেই জানবে। মনসুর আলী রাশু’কে নিয়ে ঘর থেকে উঠোনে আসলেন। বাইরে চাঁদের আলোয় অন্ধকারটা মিলিয়ে গেছে । জোছনার আলোয় হাত ধরে হেঁটে যায় বাবা ও ছেলে। তারা নদীর পারে চলে আসে। রাশু নদীর পারে অপরূপ এক দৃশ্য দেখে বিমোহিত হয়। হিমেল বাতাস সাথে চাঁদের রূপালি আলো আর এক ঝাঁক ঝিঁঝিঁ পোকা। এমন দৃশ্যে তাকিয়ে থাকা যায় বহুযুগ। শ্যামবর্ণের গোলগাল মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ির অবয়বে বাবা নামক মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে রাশু। বাবা হয়ে ছেলেকে রঙিন আলো কিনে দিতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু প্রকৃতির এমন আলোয় ছেলের জীবনটায় রাঙিয়ে দিয়েছেন। রাশু যখন বড় হবে এমন মুহূর্তের কথা ভেবে তার বাবার হাত ধরে রাখতে চাইবে বহুযুগ।  বাবা- ছেলের জোছনা বিলাসের এই মূহুর্ত কোন অর্থ দিয়ে কেনা যাবে না। জগৎ সংসারে এর থেকে বড্ড মায়াময় দৃশ্য আর হয় না। সেই রাতে রাশু আর মনে মনে আক্ষেপ করলো না জামিলদের ঘরের রঙিন আলোর জন্য। রাশু এখন রোজ তাকায় জানালার পাশে তবে সে এখন দেখে অন্ধকার প্রকৃতি।  অন্ধকারে খুঁজে নেয় জোছনা, খুঁজে নেয় ঝিঁঝিঁ পোকার আলো।
.
রাশু উঠোনে একা একা কুতকুত খেলছে। জামিল স্কুলে যাচ্ছে। জামিল যে স্কুলে যাচ্ছে এটা তার পরনের জামা দেখে বুঝে। জামিলের বাবা খুব যত্নে ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে। রাশু তাকিয়ে আছে তাদের পথ চলার দিকে। রাশুর স্কুলে ভর্তি হওয়ার এক বছর পার হয়ে গেছে। জানে না সে কবে স্কুলে পড়তে যাবে। আমেনা বেগম রোজ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আশা দিবেন সামনের বছর ভর্তি করাবে। রাশু সে আশায় দিন গুণে কবে সামনের বছর আসবে। রাশুর চাচা হচ্ছেন গ্রামের চেয়ারম্যান  মাসুদ আলী। তার পয়সাকড়ির অভাব নেই। রাশু সবসময় হিসাব কষে  তার আপন চাচার এতো টাকা তাহলে তার বাবার কেনো নেই। রাশু তার অঙ্কের হিসাবটা মেলাতে পারে না। রাশু ভাবে সে অঙ্কে কাঁচা। বিকেলে বটতলার হাটে চেয়ারম্যান’কে দেখে ডাক দিলেন স্কুলের হেডমাস্টার। হেডমাস্টার সালাম দিয়ে চেয়ারম্যানের কুশলসংবাদ জানতে চাইলেন। হেডমাস্টার কথার প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, “চেয়ারম্যান  সাব আপনার এতো পয়সাকড়ি গ্রামের স্কুলের জন্য কিছু দান করতে পারেন। গ্রামের অনেক ছেলে-মেয়ে অর্থের জন্য স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না। তাদের দিকে যদি একটু দেখতেন। আপনার ভাতিজা রাশু মাশাল্লা ছেলের জ্ঞান বুদ্ধি খুবই ভালো। মনসুর আলী দুবেলা খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খায়। ছেলের পড়ার খরচ কিভাবে দিবে।  চাচা হয়েও তো একটু তার দিকে দেখতে পারেন।” হেডমাস্টার আরও কিছু বলতে চাইলেও মাঝপথে থামিয়ে দিলেন চেয়ারম্যান । চেয়ারম্যান  চোখে বিরক্তি নিয়ে বললেন,  “মাস্টার সাহেব আপনি মাস্টার মানুষ মাস্টারি করবেন। ছেলেমেয়েদের জ্ঞান দিবেন। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে জ্ঞান দিতে আসবেন না। এতে আমার ও আপনার সময় নষ্ট হবে।  আমি হলাম এই রসুলপুর  গ্রামের চেয়ারম্যান । আমার থেকে কি গ্রামের সুবিধা অসুবিধা আপনে বেশি বোঝেন?” হেডমাস্টার জানেন এমন ধরনের কথা শুনাবে চেয়ারম্যান । এর আগেও কয়েকবার মাস্টারকে এভাবে অপমান হতে হয়েছে চেয়ারম্যানের কাছে। হেডমাস্টার আর কোন কথা না বাড়িয়ে বিপরীত পথে হাঁটা ধরলেন। চেয়ারম্যান  যে গ্রামের কেমন সুবিধা অসুবিধা বোঝে তা সকলের জানা হয়ে গেছে। একবার ক্ষমতায় বসে এখন নিজের আসন পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। পরেরবার ভোটে মাসুদ আলী আর জয় পাবে না তা জানে হেডমাস্টার। নিজের অগাধ টাকাপয়সা অসৎ উপায়ে জমিয়ে রাখছে। গ্রামের মানুষের টাকা মেরে খেয়ে কোটিপতি হচ্ছে।  এর হিসাব তো তাকে দিতেই হবে।
.
রাশু চুপিচুপি জামিলদের ঘরে গিয়েছে। আমেনা বেগমের কড়া নিষেধ জামিলদের ঘরে যাওয়া যাবে না। রাশু সবসময় মুখিয়ে থাকে জামিলদের ঘরে যাওয়ার জন্য। জামিল টিভি দেখছে। রঙিন টিভি। কার্টুন দেখছে। হিন্দিতে কথা বলছে। রাশু এসে জামিলের পাশে বসলো। মাঝেমাঝে জামিল হিন্দিতে কথা বলে উঠে। রাশু হা হয়ে তাকিয়ে থাকে জামিলের মুখের দিকে। রাশু কিছু বুঝে না  কি কথা বলে। টিভিতে কার্টুন দেখতে বেশ ভালো লাগছে কিন্তু সে খুব হতাশ কথা বুঝতে পারে না বলে। জামিলদের পাকা ফ্লোর  মুছছে রঙিন জামা দিয়ে। রাশু তাকিয়ে সেই জামার দিকে। খয়েরি রঙের শার্টটা একদম চকচক করছে। রাশুর মোটে একটা শার্ট আর জামিলের কত শার্ট। রাশু নির্লিপ্ত ভাবে বলতে চেয়েছিলো জামাটা নষ্ট না করে তাকে দিলেই পারতো। রাশু বলতে পারেনি।  রাশু মায়ের কথা মনে করে। রাশু যখন বলতো জামিলদের কত জামাকাপড় নষ্ট করে ফেলে দেয়। আমেনা বেগম তখন বলতেন, “অপচয় করা ভালা না বাবা। অপচয় করে শয়তানের ভাই। অপচয় করলে আল্লাহ শাস্তি দিবেন।” রাশু মায়ের কথা বিশ্বাস করে। রাশু মনে মনে ভাবে জামিলদের আল্লাহ শাস্তি দিবে কঠিন শাস্তি।
.
ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে। মনসুর আলী নামাজ পড়ছেন। নামাজ শেষে রাশু’কে বারদুয়েক ডাক দিল। রাশু বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কয়েকবার আলতো ধাক্কা দিলে চোখ কচলে উঠে বসলো রাশু। বাইরে এখনো আলো ফোটেনি। তারা হেঁটে যাচ্ছে নদীর পারে। একটা নৌকার বাঁধ খুলে মনসুর আলী উঠে পড়লো। রাশু নৌকার পাটাতনে বসে আছে। মনসুর আলী দাঁড় টানছে। নদীতে জাল ফেললো মনসুর আলী। রাশু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে জালে মাছ আটকালো কিনা। রাশু জানে বাবার নৌকা নেই জালও নেই। করিম চাচার নৌকা এটা। মাঝেমাঝে করিম চাচা বলেন তার নৌকা নিয়ে যেতে।  মাছ পেলে অবশ্য করিম চাচা নেয় না। ভোরের মিহিন আলোয় চারদিক স্পষ্ট দেখা যায় প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপ। খুব বেশি মাছ না পেলেও যা পেয়েছে তাতে কিছুদিন চলে যাবে। ঘাটে নৌকা রেখে তারা নদীর পারে উঠলো। রাশু মনে মনে খুশি বহুদিন পর মাছ খাওয়া হবে বলে। মনসুর আলী বটতলার হাটে করিম চাচার সাথে বসে রইলো।  রাশু মাছ নিয়ে একা বাড়ি ফিরলো।
দুপুরে একসাথে ভাত খেতে বসলো।  রাশু মনের তৃপ্তি নিয়ে ভাত খেল। বিকালে জামিলের সাথে উঠোনে খেলছে। জামিল বলল, ‘জানিস আব্বা কইছে আমরা ঢাকা শহর যামু। ঢাকা শহরের বিশাল স্কুলে আমারে পড়াইব। আমাদের বিশাল বাড়ি কিনছে ঢাকায়।’  রাশু চোখ বড় বড় করে জামিলকে বলল, ‘তোদের এত সুন্দর বাড়ি রেখে চলে যাবি? এর থেকে বিশাল বাড়ি আছে!’ জামিল হেসে বলল, ‘টিভিতে দেখিসনি ঢাকায় কত বিশাল বাড়ি গাড়ি। তা অবশ্য তুই কোথায় দেখবি।  তোদেরতো টিভি নেই। টিভি থাকবে কি করে তোদেরতো বিদ্যুৎ এ নেই।’ জামিলের ব্যাঙ্গাত্নক কথা শুনে রাশু মেকি হেসে চলে এল। রাশু তার সমবয়সীদের থেকে ঢাকা শহরের অনেক গল্প শুনেছে। ঢাকা শহর রঙের শহর। ঢাকা শহর স্বপ্নের শহর। রাশু হা হয়ে সেসব গল্প শুনে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে তাদের মুখের দিকে। রাশু ঢাকা শহরের এত গল্প শুনে ভুল করেই ইচ্ছে পুষে সেও একদিন ঢাকা শহর যাবে।
.
রাশু বাড়ি এসে বলল,  “জানো মা জামিলরা ঢাকা শহর যাইব।”
আমেনা বেগম শুনে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন, “ওসব কালো টাকার বাহাদুরি  থাকবে না বেশিদিন।” রাশু টাকা বুঝলো কিন্তু কালো টাকা কি সেটা বুঝলো না। রাশু মায়ের রাগী  মুখ দেখে কিছু জিজ্ঞাস করলো না। বটতলার হাটে মানুষজন বসে গল্প করে রতন মিয়ার টং ঘরের চায়ের দোকানে। ধোয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সবার আলোচনা চলে। কখনো রাজনীতি কখনো গ্রামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তুমুল আলোচনা চলে। আজ আলোচনা হচ্ছে গ্রামের চেয়ারম্যান  মাসুদ আলীকে নিয়ে। দিন দিন মাসুদ আলীর অর্থ বৃদ্ধির কারণ নিয়ে সবার মতবিরোধ আছে। তবে সবাই আঁচ করতে পারছে চেয়ারম্যানের দিন শেষ হতে যাচ্ছে। গ্রামের কোন মানুষের অসুবিধায় তাকে সাহায্য করতে দেখা যায় না। সবার কথার সাথে তাল মিলিয়ে রতন মিয়া বলে উঠেন, “চাচা ঠিক কইছেন দেইখেন শাস্তি সে পাইবে।” মনসুর আলীও কথাগুলো শুনছিলেন কোন প্রতিক্রিয়া ছাড়া।
.
সকালে জামিলের মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনে রাশু দৌড়ে আসলো ঘরে। রান্নাঘরে এসে রাশু বলল,  “মা জামিলদের ঘরে পুলিশ আসছে।  জামিল  কানতাছে, চাচীও কানতাছে।”  আমেনা বেগম কিছুটা অবাক হয়ে উঠোনে বেরিয়ে এলেন। জামিলের মা’কে সবাই এই প্রথম কাঁদতে দেখছে।  পুলিশ আসলো সাথে গ্রামের মানুষজনও এসেছে। চেয়ারম্যানের বাড়িতে বড়সড়  একটা জটলা বেঁধেছে। পুলিশ এসেছে চেয়ারম্যানের হাতে হাত কড়া পরাতে। জামিলের মা পুলিশের হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করেছে। চেয়ারম্যানের নামে দুদকের মামলা হয়েছে । দুর্নীতির অভিযোগে চেয়ারম্যান  এখন জেলখানায় বন্দী হবে।  গ্রামের মানুষজন কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পুরো প্রক্রিয়াটির দিকে। রাশু বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। জামিলদের ঘরে টিভিতে একবার এমন দৃশ্য দেখেছিলো। সে কথা মনে করে রাশু ভাবছে সে এখন তেমন একটা ছবি দেখছে। পুলিশের গাড়িতে করে চেয়ারম্যানকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।  গ্রামের মানুষজন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলতে লাগলো নানান কথা। মাস্টার বলল, “আগেই কইছিলাম শুনলা না আমার কথা। রতন মিয়া বলল, উচিত শিক্ষা হইছে মাতবর হইয়া বাহাদুরি দেখায়। করিম চাচা বলল, দুর্নীতির মামলা সহজে ছাড় পাইব না।”  রাশু সবার কথা শুনে মায়ের বলা কথাটার মানে বোঝার চেষ্টা করলো, কালো টাকার রাজত্ব বেশিদিন থাকে না।

    (সমাপ্ত)

সম্পর্কিত পোস্ট

যদি পাশে থাকো

যদি পাশে থাকো

তাসফিয়া শারমিন ** আজকের সকালটা অন্য রকম। সাত সকালে আম্মু বকা দিলো। মানুষের ঘুম একটু দেরিতে ভাঙতেই পারে। তাই বলে এত রাগার কী আছে ?একেবারে যে দোষ আমারও তাও নয়। মানুষ ঘুম থেকে উঠে ফোনে বা দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখে। কিন্তু আমি উঠি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের আলো দেখে।কে জানে...

কুড়িয়ে পাওয়া রত্ন

কুড়িয়ে পাওয়া রত্ন

অনন্যা অনু 'আমিনা বেগম' মেমোরিয়াল এতিমখানার গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই ওমরের বুকটা ধুক ধুক করতে শুরু করে। ওমর ধীর গতিতে ভেতরে প্রবেশ করে। চারদিকে তখন সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ওমর গত রাতের ফ্লাইটে আমেরিকা থেকে এসেছে। সে এসেই সোজা আমিনা বেগম মেমোরিয়াল এতিমখানায়...

দাদাভাইকে চিঠি

দাদাভাইকে চিঠি

প্রিয় দাদাভাই, শুরুতে তোকে শরতের শিউলি ফুলের নরম নরম ভালোবাসা। কেমন আছিস দাদাভাই? জানি তুই ভালো নেই, তবুও দাঁতগুলো বের করে বলবি ভালো আছি রে পাগলী! দাদাভাই তুই কেন মিথ্যা ভালো থাকার কথা লেখিস প্রতিবার চিঠিতে? তুই কি মনে করিস আমি তোর মিথ্যা হাসি বুঝি না? তুই ভুলে গেছিস,...

১০ Comments

  1. Anamika Rimjhim

    ছুঁইয়ে-চুঁইয়ে*
    হলাম-হোলাম*
    কেনো-কেন*
    জিজ্ঞাস-জিজ্ঞেস/জিজ্ঞাসা*
    ধোয়া-ধোঁয়া*
    রাশুর চাচার ধরা পরার জন্য কোন একটা সুন্দর কারণ দিতে হতো। তাহলে শেষটা আরও সুন্দর আর শিক্ষামূলক হতো।শুভ কামনা।

    Reply
    • farha nur

      ধন্যবাদ

      Reply
  2. A Rakib

    ক্ষুরধার লিখনি শক্তি

    Reply
    • farha nur

      থ্যাংকস

      Reply
  3. Jannatul Ferdousi

    মাকে জিজ্ঞাস করেছিল তার জন্মদিন কি নেই→ জিজ্ঞেস, কি নেই? প্রশ্নবোধক চিহ্ন হবে।

    ফাক→ ফাঁক

    অনেক বড় গল্প হলেও চমৎকার ছিল লেখনী। একদিকে বাস্তব চিত্র অন্যদিকে শিক্ষণীয় ছিল গল্পটি । লেখিকার লেখার হাত যথেষ্ট ভালো। ভালোভাবে চর্চা করলে অনেকদূর এগিয়ে যাবে।
    এমন লেখা পড়ার জন্য আপনার কলম চালাতেই হবে।
    আগামী দিনগুলোতে আরো ভালো লেখা পেতে চাই।
    শুভ কামনা লেখিকা।

    Reply
    • farha nur

      অনেক ধন্যবাদ jannatul আপুনি,

      Reply
  4. Sajjad alam

    তুমি সবসময় অনেক সুন্দর লেখ। তবে এ গল্পটায় ইসলামীক দিক্ষা থাকলেও রসকস কিছুটা কম পেয়েছি। পরেরবার অারো ভালো গল্প চাই।

    Reply
  5. Halima Tus Sadia

    চমৎকার লেখনী আপু।
    গল্পে আমাদের সমাজে কিছু চেয়ারম্যানের দুর্নীতির চরিত্র ফুঠে উঠেছে।

    নির্বাচন হওয়ার আগে চেয়ারম্যানরা মানুষের কাছে এসে বলে ভোট দিতে।
    পাশ করার পর আর খোঁজ থাকে না।গ্রামের গরীব মানুষদের খেয়াল রাখে না।

    রাশুর চাচা চেয়ারম্যান হয়েও কতো কষ্ট করে রাশুরা চলাফেরা করছে।তবু ও সাহায্য করে নাই।অথচ নিজে কালো টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে।আরাম আয়েশ করে চলে।

    এমন চেয়ারম্যানদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়াই হোক।

    ভিজতে–ভিঁজতে
    ধোয়া-ধোঁয়া
    মূহুর্ত-মুহূর্ত
    জিজ্ঞাস-জিজ্ঞেস
    ফাক-ফাঁক

    কালো টাকার রাজত্ব বেশি দিন থাকে না।
    কথাটা ভালো লেগেছে।

    শুভ কামনা রইলো।

    Reply
  6. Imran khan

    দারুণ গল্প খুব ভালো লিখেছো আপুনি

    Reply
  7. নিশি

    দারুণ গল্প, খুব ভালো লিখেছো আপুনি

    Reply

Leave a Reply to farha nur Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *