লেখকঃ
স্বাধীন পারভেজ
তেজগাঁও, ঢাকা।
(ফেব্রুয়ারী’১৮)
……………
ফ্ল্যাটটিতে গুনে গুনে চারটা বেডরুম। আছে সুবিশাল ড্রয়িং স্পেস, এমনকি তিনটি বড় বারান্দাও। তবুও তারা দু’টি দম্পতি একই ঘরে বসবাস করেন, এতগুলো রুম একেবারে ফাঁকা থাকা সত্বেও। যদিও এতে তাদের কারোরই খুব একটা অসুবিধা হয় না। আপত্তিও নাই কোনো।
নকশা তোলা শাল কাঠের পুরনো অথচ নান্দনিক খাটের ওপর গা বিছিয়ে পড়ে থাকেন কুচকানো চামড়ার বিবর্ণ দুজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। এই হলো একটি দম্পতি। অপরটি থাকে এই ঘর থেকে এই ঘর থেকে বারান্দায় বেরোনোর দরজাটার ঠিক ওপরে, ছোট্ট ভেন্টিলেটরের মধ্যিখানে। চড়ুই দম্পতি। এবাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা বলতে গেলে এই চারটি প্রাণীই। দিনের বেলা সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি দু’চারজন কাজের লোকের আনাগোনা এ ফ্ল্যাটে ঘটে বটে, তবে এবাড়ির ইট কাঠ আর কংক্রিটের সাথে আত্মার সম্পর্ক কেবল এই দুটি সম্পতিরই।
দিনের পর দিন এরা একে অপরের প্রতিবেশী হয়ে হয়ে দিব্যি নির্ঝঞ্চাটভাবে বসবাস করে আসছে। বুড়িটি অবশ্য দৃশ্যতঃ পশু পাখি দেখতে পারেন না। বছর তিনেক আগে যখন প্রবাসী ছেলে দুটি দেশে এসেছিল তখন তিন জোড়া ময়না পাখি কিনে দিয়ে গিয়েছিল বাবা মাকে। বুড়োটা সেগুলোর টুকটাক যত্ন আত্তি করলেও বুড়ি ওগুলোকে দুই চক্ষে দেখতে পারতেন না। ফলে তিন মাসও হলো না তাদের সহবাস। কাজের লোকদের দিয়ে দেয়া হলো পাখির খাঁচাগুলো।
তবে চড়ুই দু’টিকে তিনি তাড়ালেন না। কি ভেবে কে জানে? এমনকি প্রায়ই তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে পাখি দুটিকে খাবারও খাওয়াতে। যদিও এসব কাজ তিনি করতেন বুড়োর চোখের আড়ালে। কারণ বুড়োর কাছে তিনি পাখী বিদ্বেষী হিসেবেই পরিচিত। তাই এ ব্যাপারটা নিয়ে তিনি বুড়োর কাছে হাসির পাত্র হতে চান না।
বৃদ্ধ বয়সে বোধহয় মানুষগুলো অভিমানী মনের ভেতর আত্মমর্যাদা বোধটা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে যায়, তাই না? বুড়ো মানুষ্টা প্রায়ই কাজের ছেলেটার হাত ধরে বাইরে হাঁটতে যান। ঘুরে ঘুরে চারপাশের বেঁচে থাকা দুনিয়াটা দেখেন। নির্জীব চোখের শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন অসহায়ের মতন। সারাটা বিকাল এ পাড়ার সরু গলি বেয়ে হেঁটে বেড়ান তিনি। এরপর বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই এ পৃথিবীটা যেন তাকে তাড়িয়ে দেয়। কাজের লোকের হাত ধরে তখন পড়িমরি করে ঘরে ফিরে আসেন তিনি।
ঠিক সেই সময়টাতে ওঁর মনের অবস্থা কি রকম হয়? কে জানে!
কোন কোনো বিকেলে তিনি ঘর থেকে বের হন না। বারান্দায় পেতে রাখা আরাম চেয়ারে বসে বসে বুড়ির সাথে গল্প বলেন। বুড়ি ঘুমিয়ে থাকলে বা সামান্য কারণে বুড়োর সাথে আঁড়ি দিয়ে ড্রয়িং রুমে টিভি দেখতে গেলে তখন চড়ুই দু’টির সাথে কথা বলেন তিনি। দারুণ আপন সে আলাপন। দারুণ আবেগঘন সে কথামালা। পাখি দু’টির দিনকাল কেমন চলছে, থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না? দুজনের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগে থা কে কি না? এসব বিষয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে জিগ্যেস করতে থাকেন বৃদ্ধ। এমনকি বারান্দায় দিয়ে রাখা এতো এতো খাবার থাকতেও রোজ রোজ বাইরে গিয়ে খাবার সংগ্রহের কি এমন দরকার পড়ে এই নিয়ে চড়ুই দুটিকে পুরো দস্তুর দোষারোপও করেন তিনি। শাসান, ধমকান প্রায়ই।
এরই মাঝে মেয়ে চড়ুইটি সন্তান সম্ভবা হলো। চার চারটা ডিমের ওপর পশমে ঢাকা তুলতুলে পেট পিছিয়ে দিয়ে স্থির বসে থাকে সে, সারাদিন। পুরুষ চড়ুইটাও আর খুব একটা বাইরে যায় না আজকাল। প্রায় সারাক্ষণ স্ত্রী চড়ুইটির কাছে কাছেই থাকে। বারান্দার গ্রিলে, চেয়ারে আর ফুলগাছের টবের ওপর লাফিয়ে বেড়ায়। বুড়োও আগের তুলনায় বেশি বেশি খাবারের যোগান দিতে থাকেন। তবে বুড়িকে দেখা যায় বেশ অগ্নিমুর্তিতে। ভাবখানা এমন যেন সারাক্ষণই তিনি ত্যক্ত বিরক্ত থাকেন। এমনকি বুড়ো বাইরে গেলে তিনি স্ত্রী চড়ুইটির সাথে রীতিমত ঝগড়া করতে থাকেন! কে যে হয়েছে তার আজকাল কে জানে।
এভাবেই বয়ে চলে বৈচিত্রহীন বর্ণহীন বিরস সময়গুলো। দুজন পুরনো মানুষের নিঃসঙ্গ জীবন আর দুটি চড়ুইয়ের উদ্ধাস্ত সংসার। নারী চড়ুইটির সাথে বৃদ্ধার অসজ্ঞায়িত বাদানুবাদ, আর জীবনের খোঁজে বৃদ্ধ লোকটির বিকালের দুনিয়া ভ্রমণ। ব্যস, এটুকুই! এরই মাঝে একদিন হাঁটা শেষে ঘরে ফিরে ভীষণ চমকে যান বৃদ্ধলোকটি। শোবার ঘরে চড়ুই দুটির ব্যাপক চিৎকার চেঁচামিচি শোনা যাচ্ছে। দু’টি পাখিই বাসা থেকে বেড়িয়ে এসে ঘরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর ত্বরস্বরে চেঁচামিচি করছে। অন্যদিকে খাটের এক প্রান্তে বৃদ্ধা মহিলাটি মুখ গোমরা করে গুম হয়ে বসে আছেন। সবদেখে সে তো অবাক! বারবার জিগ্যেস করেও এই হুলস্থুল কান্ড সম্পর্কে স্ত্রীর মুখ থেকে কোনো উত্তর পান না ভদ্রলোক। আবার বাসা ছেড়ে চড়ুই দুটি নেমে আসাতেও অবাক হন ভীষণ। কোনকিছুই ভেবে পান না। বাড়িতে আজ কি হলো এইটুকু সময়ের মধ্যে? অগত্যা খানিকটা সন্দেহের বশেই চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে চড়ুই নিবাসে উঁকি মারেন তিনি। ভেন্টিলেটারস্থ বাসাটিকে ভালোভাবে পরখ করে দেখে নিয়ে আরেক দফা চমকে যান।
বাসায় একটা ডিমও নাই। কি অবাক কাণ্ড! এই তাহলে চড়ুই দু’টির অস্থির হওয়ার হেতু? কিন্তু ডিমগুলো গেল কোথায়? আশেপাশে ভালো করে খুঁজেও ডিমগুলোর কোনো হদিস পান না তিনি। আবার বাসাটিও পুরোপুরি অক্ষত আছে। ফলে কোন দুষ্টু প্রাণীর আক্রমণে ডিমগুলো বেহাত হয়েগেছে এমন আশংকাও করা যাচ্ছে না। বুড়ো দারুণ ধন্ধে পড়ে যান।
হঠাৎ একটা ভাবনাতে বিদ্যুৎ খেলে যায় বুড়োর মাথায়। এমনটি তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি। আশ্চর্য চোখ বড় বড় করে তিনি বুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকেন। বেশ অনেক্ষণ। তার যেন বিশ্বাসই হতে চায় না ব্যাপারটা। বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধাগ্রস্থ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে সন্তর্পনে এগিয়ে গিয়ে বিছানায়; বুড়ির পাশে গিয়ে বসেন তিনি।
তারও খানিকটা পরে অবাক হওয়া সরু গলায় বলেন – এটা কি করলে তুমি ……?
আর কিছু বলার সুযোগ তিনি পান না। অভাবনীয় একটা কাণ্ড ঘটে যায়। আচমকা দুম করে বুড়ি তাকে জড়িয়ে ধরে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেন এবং হাউ মাউ করে বলতে থাকেন- কি লাভ হইবো বাচ্চা ফুটাইয়া? বাচ্চা কি আর অগো লগে থাকবো? এতো কষ্ট কইরা বাচ্চা ফোটাইবো, বড় কইরা তুলবো, তারপর বড় হইলেই বাচ্চাগুলান বাপ মা’রে থুইয়া ফুরুত কইরা উইড়া যাইবো। কি দরকার এতো কষ্ট করনের? কি দরকার অমানুষ গুলানরে দুনিয়ায় আনোনের? বাচ্চাদের মতো গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকেন তিনি!
শুধু বৃদ্ধ কেন? পুরো পৃথিবীই সেদিন থমকে গিয়েছিল ঘটনার আকষ্মিকতায়। বোবা হয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে না পারার অক্ষমতায়। তবে বৃদ্ধাও বোধহয় বুঝতে একটু ভুল করেছিলেন। তিনি বোধ হয় ভেবে দেখেন নি যে, অমানুষ শুধু মানুষের বাচ্চাই হয়। পশুপাখির বাচ্চারা কখনও এতোটা নিচে নামে না।
০ Comments