মাহবুবা শাওলীন স্বপ্নীল
ঘড়িতে তখন ৪.৩০, শেষরাত বলা যায়। এলার্মের শব্দে তড়িঘড়ি করে উঠেই ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিলাম। আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে স্টাডি ট্যুরে যাচ্ছিলাম, খাগড়াছড়ি ট্যুর। প্রচণ্ড আগ্রহ, উৎসাহ আর উত্তেজনা নিয়ে চা খেয়ে আধ ঘন্টার ভেতর বের হয়ে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে। বাকি বন্ধুরা ওখানেই অপেক্ষা করছিল। আমাদের তিনজন শিক্ষকসহ মোট ৩০ জন যাত্রা শুরু করলাম। প্রভাতবেলায় শীতল বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছিল সবার শরীর, মন। সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য আমার প্রতিদিন হয়না। সেদিন হয়েছিল, খুব করে হয়েছিল। মিষ্টি আলোর রেখায় দু’চোখ জুড়িয়ে নিয়েছিলাম। চলন্ত বাসে আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিল হলদে সূর্যটা, যেন খাগড়াছড়ি ঘুরতে যাওয়ার তাড়া তারও কম নয়! সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমি ব্যস্ত সেই শীতল হাওয়া আর নিরুত্তাপ হলদে আলোয় নতুন যাত্রার স্বাদ গ্রহণে।
সকাল ৭.৩০। আমরা নাস্তা সেরে নিলাম বাসেই। “ও আমার দেশের মাটি” গানটা দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর ভ্রমণের গানসহ সবরকম গান একের পর এক বাজতে লাগলো। আর আমরা তলিয়ে যেতে লাগলাম ভ্রমণ আনন্দে। ছুটে চলা বাসের সাথে জানালার বাইরের ছুটে চলা প্রকৃতি যেন আমায় নতুনভাবে বাঁচার তাগিদ দিচ্ছিল, নতুন উল্লাসে। বন্ধুরা কেউ খালি গলায়, কেউ দলীয়ভাবে গান গেয়ে যাচ্ছিল। আবার কেউ ব্যস্ত ছিল অন্যদের ইচ্ছেমতো পঁচানোতে। বন্ধু মানেই হাসি, আনন্দ, আড্ডা, খুনসুটি। আমাকে মাইক্রোফোন এনে দেয়ার পর আমি “দুঃখটাকে দিলাম ছুটি..” গানটা গেয়ে সব দুঃখকে ছুটি দিয়ে দিয়েছিলাম, আমার সাথে সবাই সুর মেলালো। এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরী হয়েছিল।
সবার আনন্দ, মাতামাতিকে দ্বিগুণ করে দিল স্যারের কিছু কথা; আমাদের ডিপার্টমেন্ট হেন্ড যিনি, উনি দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, “আজ আমরা তোমাদের শিক্ষক নই, আজ আমরাও তোমাদের বন্ধু৷ কেউ কোনো জড়তা রেখোনা নিজেদের মাঝে।” স্যারের কথা শুনে আমরা আমাদের বহুদিনের মরিচা পড়া অব্যবহৃত মনের দরজা খুলে দিলাম এক নিমিষেই, উড়িয়ে দিলাম সকল অবসাদ। সেই খুশিতে যোগ দিল শিক্ষকগণও।
সকাল ১১টায় পৌঁছালাম রামগড় চা বাগানে। এর আগে কখনো স্বশরীরে এত বিশাল চা বাগানের সাথে পরিচিত হইনি। একরাশ মুগ্ধতায় মুড়িয়ে যাচ্ছিলাম আমি। চারপাশে সবুজের সমারোহ। দিগন্তে যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজ চা বাগান। নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল প্রকৃতির সেই বিশালতার কাছে, নিজের জ্ঞানকে তুচ্ছ মনে হচ্ছিল সেই অপার সৌন্দর্যের কাছে। সবাই সবুজের মাঝে ডুবে গিয়ে নিজেদের ক্যাপচার করে নিচ্ছিল ক্যামেরায়। আমিও ক্যামেরাবন্দী হলাম স্মৃতি করে রাখার জন্য।
এরপর গেলাম রামগড় সীমান্তে যেখানে বাংলাদেশ ভারত পৃথক হয়েছে একটি সরু খালের ব্যবধানে। খালের এ পাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশে, খাল ক্রস করে ওপাড়ে গেলে ভারতে। মাঝখানে জলরাশি খেলছে মনের মতো। সবাই বেশ হৈ-চৈ করছিল দুই দেশের এই ছোট্ট ফারাক দেখে, অদ্ভুত অথচ সুন্দর দূরত্ব! খালের পাশ দিয়ে হেঁটে দুই পাশের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম আমরা। সেখান থেকেই প্রায় ১ কিলোমিটার হেঁটে গেলাম রামগড় লেক পার্কে। রামগড় শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত লেক পার্কটি সে অঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণ। চমৎকার লেকের দুই পাশে ছিল যানবাহন চলাচলের রাস্তা, আর মাঝখানে একটি কৃত্তিম ঝুলন্ত ব্রিজ। বাংলাদেশে মোট তিনটি ঝুলন্ত ব্রিজের কথা জানা ছিল আমার। একটি রামগড়ে, একটি খাগড়াছড়িতে এবং বাকিটি রাঙ্গামাটিতে। আমি তখন রামগড় ঝুলন্ত ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে। গরমও নয়, শীতও নয়, নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশের একটি চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ দিন ছিল সেদিন।
রামগড় থেকে ফিরে আমরা যাত্রা শুরু করলাম খাগড়াছড়ি শহরের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে বাসের কোনো একটা সমস্যার কারণে প্রায় এক ঘন্টা বাস দাঁড়িয়ে ছিল ওখানেই। জায়গাটি বেশ নির্জন ছিল, চারপাশে সুনসান নীরবতা। একটু দূরে বড় বড় টিলার উপর ছোটছোট টিনের চালের কিংবা মাটির তৈরী ঘরবাড়ি। রাস্তার দুইপাশে ঘন নিবিড় বনের মতো গাছপালা ছেয়ে আছে। সে রাস্তায় কেউ একা থাকলে নিশ্চিত তার শরীরে হিমশীতল স্রোত বয়ে যেত। ফোনে নেটওয়ার্ক ছিলনা। ভাবছিলাম কি করে এই নেটওয়ার্কবিহীন জনমানবশূন্য জায়গার আশেপাশে মানুষ বসতি গড়ে তুলেছে!
আমরা বাস থেকে নেমে কাছেই একটা টং এর দোকান খুঁজে বের করলাম, সবাই বেশ আয়েস করে রংচা খেতে খেতে আড্ডা দিলাম। কয়েকজন বন্ধুসহ শিক্ষকগণ ক্যারাম খেলা শুরু করলো দোকানের অন্য পাশে। আর কয়েকজন বন্ধু এদিক সেদিক হেঁটে চারপাশ দেখে মুগ্ধ হচ্ছিল। আমি গেলাম একটু দূরে টিলাগুলোতে স্থানীয় মানুষজনের জীবনযাত্রা দেখতে।
টিনের চালের একটা আধভাঙা ঘরের সামনে যেতেই এক মহিলার সাথে দেখা হয়, বাংলাতেই বেশ সাবলীলভাবে কথা বলেছিল বলে বুঝলাম তারা উপজাতি ছিল না। ঘরের মাত্র দশহাত দূরেই গভীর গর্ত! শত শত ফুট নিচে ঘনজঙ্গলে পড়ে যাবার আশঙ্কা! অথচ সে জায়গাতেই তারা দিব্যি জীবন চালিয়ে নিচ্ছে জীবনের প্রয়োজনে, সংগ্রাম করে যাচ্ছে বেঁচে থাকার তাগিদে। ওখানে না গেলে হয়তো দেশের এই পার্বত্য অঞ্চলে বাস করা সংগ্রামী মানুষের কথা জানা হতো না কখনো!
কাছের কোনো একটা পানির ঝর্ণা থেকে তারা ফ্রেশ পানি রিজার্ভ করতো বড় একটি পাত্রে। আমি তৃপ্তি নিয়ে পানির পিপাসা নিবারণ করলাম। হঠাৎ বেশ হৈচৈ শোনা গেল, আমার নাম ধরে বন্ধুরা ডাকছে বুঝতে পারলাম। তাড়াতাড়ি টিলা থেকে নেমে দেখলাম আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী কাঁদছে অঝোরে আর বাকিরা আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি দৌড়ে কাছে যেতেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো। প্রথমে ঘটনা বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরেছি ওরা আমায় না দেখে ভেবেছে হারিয়ে গেছি কোথাও। আমার প্রতি ওর ভালোবাসা, আন্তরিকতা, টান দেখে চোখ ভিজে গেছিল আমারও। আনন্দ ভ্রমণে ছোট এটুকু মুহূর্ত আমার জীবনে সেরা মুহূর্তগুলোর মাঝে একটি হয়ে থাকবে।
বাস ঠিক হওয়ার পর আমরা ফের যাত্রা শুরু করলাম। সংকীর্ণ রাস্তার দুইপাশে কোথাও বড় ডিবি, কোথাও মাঝারি, কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও বা বিশাল বাঁশঝাড়। বড় বড় গর্তও হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছিল রাস্তার দুই ধারে। মনে হচ্ছিল যেন পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলেছি আমরা। ড্রাইভার একটু অসতর্ক হলেই যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমরা নিরপদেই পৌঁছালাম খাগড়াছড়ি শহরে। খাগড়াছড়ি সরকারি মহিলা কলেজে প্রবেশ করে মুগ্ধ হলাম। দেশের ঠিক এই প্রান্তে এত অসাধারণ ক্যাম্পাস আছে, না আসলে হয়তো সেটা জানা হতোনা কখনো। প্রথম দেখায় যে কারোর মনে হবে কোনো পার্কে এসে পড়েছে। চারপাশে সারি সারি গোলাপসহ নাম না জানা বিভিন্ন ফুলের বাগান, মাঝখানে রাস্তা চলে গেছে তিন পাশে। ক্যাম্পাসের সর্ব উত্তরে চমৎকার শহীদ মিনার। সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
দুপুরের খাবার সেরে নিলাম আমরা শহরেই, ছোট্ট একটি হোটেল, বেড়ার তৈরী সুরুচিসম্পন্ন গঠন। প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে তৃপ্তিসহ খেলাম সে অঞ্চলের রান্না। অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো আমার। হোটেলের প্রত্যেকটা মানুষ যথেষ্ট বিনয়ী ছিল। খাগড়াছড়ি শহর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে জিরোমাইল এলাকায় পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত নয়নাভিরাম খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ পার্ক।
বিকাল ৪টায় আমারা পৌঁছালাম জেলা পরিষদ পার্কে, যেখানে আমাদের ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ অপেক্ষা করছিল। পাহাড়ের উপর উঠে গেছে পিচঢালা পথ৷ সবাই টিকেট কেটে উঠে গেলাম সে পথে। আমি দৌড়ে সবার আগে উঠার চেষ্টা করলাম। আমাকে হারিয়ে আরেকটা বন্ধু প্রথমে উঁচুতে উঠে গেল। আমি দ্বিতীয় হলাম এই ছোটখাট প্রতিযোগিতায়। উঠেই সবাই হাঁপাতে লাগলাম। পাহাড়ের চূড়ায় ছোটছোট কিছু দোকানসহ বিশ্রাম নেয়ার চেয়ার টেবিল ছিল। আমরা পানি খেয়ে বিশ্রাম নিলাম। কেউ কেউ দোকান থেকে আচারসহ বিভিন্ন জিনিস কিনছিল। এর ঠিক অন্য পাশে নিচ দিয়ে চলে গেছে সেই বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রিজ। দু’টি পাহাড়কে সংযুক্ত করে ব্রিজটি ২২ একর জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। পার্কটির পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে আছে হ্রদ। সেখানে নৌ ভ্রমণের ব্যবস্থাও রয়েছে। পর্যটকরা নানান জায়গা থেকে এসে ভিড় জমিয়েছিল জেলা পরিষদ পার্কে।
আমরা স্যারের কাছ থেকে জানতে পারলাম ব্রিজটি ৪ ফুট চওড়া ও প্রায় ২৫০ ফুট লম্বা। ব্রিজের রেলিং ছিল নাইলনের নেট দিয়ে তৈরী। দারুণ এক্সাইটমেন্ট কাজ করছিল আমার। ব্রিজে উঠে পড়তেই মনে হলো পড়ে যাচ্ছি। ব্রিজ দুলছিল প্রচণ্ডভাবে। এক্সাইটমেন্ট পরিণত হলো ভয়ে। কিন্তু ভয়টা কেটে গেল খানিক সময় পরেই। বিকেলের ঠান্ডা বাতাস এসে শরীর মন জুড়িয়ে দিল। ব্রিজের এপাশ থেকে ওপাশে আসা যাওয়া করতে লাগলাম নির্ভয়ে। ব্রিজে উঠলে যে কারোর মনে হবে “এই বুঝি পড়ে যাচ্ছি!” কিন্তু পড়বেনা কেউ, সেইফ্টি কনফার্ম করা। বন্ধুরা সবাই আরো জোরে নাড়ালো ব্রিজ। যার ফলে ব্রিজটি দোল খেতে লাগলো আগের চেয়ে বেশিবার। সবাই হৈচৈ করে ব্রিজভীতি দূর করে বাতাস গায়ে মেখে নিল পরমানন্দে। সেই মনোরম দৃশ্য ভোলা যায়না। সে দৃশ্য অক্ষত হয়ে থাকবে আমার হৃদয়পটে।
ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে আমরা দ্বিতীয় পাহাড়ে গেলাম। সেখানে রয়েছে বাচ্চাদের জন্য একটি কিডস কর্ণার ও একটি ট্রেন। দ্বিতীয় পাহাড়ের কোলঘেঁষে যাওয়ার পথে পশ্চিমদিকে হেলানো রক্তিম সূর্যকে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন বাঙালি শাড়ি পরা নারীর কপালের লাল টিপ, মনে হচ্ছিল একটু পরেই সে সূর্য ডুবে যাবে পাহাড়ের ওপাশে। পাহাড়ের উপর উঠার সময় জমাকৃত স্থিতিশক্তি কাজে লাগলো পিচঢালা পথে নেমে যাওয়ার সময়। সবাই হুড়হুড় করে স্থিতিশক্তির প্রভাবে নেমে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই।
দিনের শেষভাগ, আমাদের ফেরার সময়। কিন্তু ভ্রমণপিপাসু সবার মনে অতৃপ্তি রয়ে গেল আরো একটা জায়গা দেখার। জায়গার নাম “আলুটিলা গুহা”। স্থানীয়রা একে বলে ‘মাতাই হাকড়’ বা ‘দেবতার গুহা’। স্যাররাও মিস করতে চাইলেন না সেই গুহার রহস্য। তাই সূর্য ডুবে যাচ্ছে জেনেও আমরা চললাম আলুটিলা গুহা দেখার উদ্দেশ্যে। বাসে করে সেখানে ৭ কিলোমিটার রাস্তা পার হয়ে পৌঁছালাম প্রায় ১৫ মিনিটের মধ্যে। বাস থেকে যখন নামলাম, তখন কুয়াশার চাদর গায়ে মুড়িয়ে ফেলেছিল প্রকৃতি৷ চারপাশে অস্পষ্ট ধোঁয়াটে পরিবেশ। একটা শিহরণ জাগায় শরীরে। গুহাতে যাওয়ার আগে অরুনিমা রিসোর্ট নামে অসাধারণ জায়গায় দাঁড়ালাম আমরা, ভূমি থেকে প্রায় ১০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। নিচে তাকিয়ে শরীর হিম হয়ে গেল। কিন্তু এর অপার সৌন্দর্য দেখে সেই ভীতি নিমিষেই দূর হয়ে গিয়েছিল।
সূর্য ডুবে গেছে তখন। চারপাশে নিয়ন আলোর ছড়াছড়ি। আমরা আলুটিলা গুহাতে প্রবেশের জন্য দুই পাশে সবুজ গাছগাছালি রেখে নেমে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে। সবাই গাছের ডাল ভেঙ্গে মশাল বানালাম সেই রহস্যময় গুহাতে প্রবেশের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে। এক হাতে মশাল, অন্য হাতে জুতো খুলে নিয়ে খালি পায়ে ঢুকলাম আলুটিলা গুহায়। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো জগতে কিংবা সভ্যতার আদিযুগে চলে এসেছি যেখানে গুহা ছিল মানুষের বসবাসের অবলম্বন। গুহার ভেতরে কোথাও উপরের দেয়াল নিচে নামানো, কোথাও খানিকটা উপরে উঠানো; নিচে ভেজা, কোথাও কাদাপানি, কোথাও বালিপানির অসম্পৃক্ত মিশ্রণ। মাঝেমধ্যে পড়ছে বড় কিংবা মাঝারি আকারের পাথর। পাথরে ওঠার সময় অসতর্কতায় পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সন্তর্পণে গুটি গুটি পা রেখে মাথা নিঁচু করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
সবকিছু ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দী করে রাখছিল আমাদের-ই একজন। একটা অ্যাডভেঞ্চারাস রোমাঞ্চকর পরিবেশ। মনে হচ্ছিল কোনো মুভি’র শ্যুটিং চলছে। মুভির নাম, “মশাল হাতে আমরা ক’জন তরুন।” পুরো ভ্রমণের আনন্দ শতগুনে বাড়িয়ে দিয়েছিল এই রহস্যে ঘেরা গুহা। গুহার দেয়ালে কোথাও কোথাও কেউ কিছু লিখে গেছিল। সাংকেতিক ভাষায়। কিশোরবেলায় তিন গোয়েন্দা পড়ার সময় কিংবা বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড় পড়ে যে দৃশ্যগুলো কল্পনা করে নিতাম, সেদিন গুহার ভেতর যেন সে দৃশ্যই সামনে এসে বাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সেই মুহূর্ত, সেই গায়ে শিহরণ জাগানো গুহা, আমি এবং আমরা আজীবন সযত্নে গেঁথে রাখবো হৃদয়ে।
ভ্রমণ শেষে আমরা সন্ধ্যা সাতটায় রওণা দিলাম ঘরে ফেরার উদ্দেশ্য। বারবার মনে হচ্ছিল থেকে যাই, এই সৌন্দর্য ছেড়ে ফিরতে মন চাচ্ছিলনা। কবিগুরুর ওই পংক্তি ক’টা মাথায় ঘুরছিল,
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।”
পথিমধ্যে সবাই সন্ধ্যার নাস্তা সেরে নিয়েছিলাম চিটাগাং শহরের একটা স্থানীয় রেস্তোরাঁয়। এরপর আবার যাত্রা শুরু। বাসের ভেতর লটারির আয়োজন করা হলো। কারো কাছে গান, কারোর কাছে কবিতা কিংবা কৌতুক গেল। যে যেটা লটারিতে পাবে, তাকে সেটা পারফর্ম করতে হবে। সবাই গান, কবিতা, কৌতুকে জমিয়ে রাখলো আড্ডা। ক্লান্তি যেন আর কখনো ছুঁতে পারবেনা আমাদের। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণও অসাধারণ গান শুনিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করলো। ফিরলাম রাত ১২টায়। যাওয়ার সময় বাস ভ্রমণের সময় না কাটলেও ফেরার পথে মনে হলো খুব তাড়াতাড়ি চলে এলাম। ভ্রমণ তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে আমরা ফিরলাম ঢের তৃষ্ণার্ত হয়ে।
আমার জীবনে স্মরনীয় দিন হয়ে থাকবে খাগড়াছড়ি ভ্রমণ, সেরা মুহূর্ত হয়ে থাকবে মৃত্যু অবধি।
ওয়াও।
ভ্রমন কাহিনীটি পড়ার সময় মনে হলো আমি বাসায় বসেই খাগড়াছড়ি ভ্রমন করছি।
লেখিকার মনোভাব স্পষ্ট ও সাবলীলভাবে প্রতিটা বাক্যে ফুটে উঠেছে।
আমি বানান ভুল ধরাকে প্রধান্য দেই না এটা লেখার স্বাভাবিক পর্যায়ের মধ্যই পরে।
তবে সবচেয়ে বড় কথা ভ্রমন কাহিনীটি ‘রচনার’ মতো লেখা হয়েছে গল্প আকারে ফুটিয়ে তোলা হয় নি।
এজন্য লেখিকাকে বিশেষভাবে সাহিত্য চর্চার আহবান জানাবো।
বাহ চমৎকার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় সাধারণত নিজের এক্সপ্রেশন টাই মুখ্য। কি ঘটেছিল, দেখার কি ছিল, সেসবের বিশদ বর্ণনা। এই লেখায় দু’টোর সংমিশ্রণ ছিল। দারুন লাগলো পড়ার সময় মনে হচ্ছিল আমিও সে স্থানে আছি, চোখের সামনে দেখছি। ধন্যবাদ আপনাকে এরকম অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আমারও খাগড়াছড়ির তৃষ্ণা জাগানোর জন্য।
অসাধারণ ????খাগড়াছড়ি আমি এখনও যাই নাই।কিন্তু এই ভ্রমনের বর্ননা পড়ছিলাম আর মনে হচ্ছিলো আমার চোখের সামনে সব ভেসে উঠছে।কি যে চমৎকার বর্ণনা করেছো বাহ্????????লেখাটি এতোটাই জীবন্ত যে চোখের সামনে সব ভেসে উঠছে।অনেক ধন্যবাদ স্বপ্নীল কে এতো সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করার জন্য।
ওয়াও! চমৎকার লাগলো লেখাটি। মন ছুঁয়ে গেল। বিশেষ করে গুহার বর্ণনাটা বেস্ট ছিল। খাগড়াছড়ি গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। সেই গুহায় না গেলে বুঝতাম না প্রকৃতির রহস্য! সত্যিই ভুলার মতো না। কিন্তু আপনার লেখা পড়ে এখন আবার যেতে ইচ্ছে করছে। কয়েকটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় দেখেছি অভিজ্ঞতা বর্ণনার চেয়ে লেখক ব্যস্ত সেটাকে গল্প আকারে ফুটিয়ে তুলতে। একজন পাঠক হিসেবে আমার কাছে মনে হয় গল্প এবং ভ্রমণ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনার লেখায় সেই ভিন্নতা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে গল্পের আকার দেন নি। ভালো লেগেছে ব্যাপারটা। শুভকামনা৷
এক কথায় চমৎকার প্রকাশ। লেখিকার অভিজ্ঞতা পড়ে মনে হচ্ছে আমিও সব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। গায়ে শিহরন জাগানো গুহার বর্ণনা মুগ্ধ করেছে। খাগড়াছড়ি যাওয়ার রাস্তার দু’পাশের বর্ণনাটাও দারুন লাগলো। সিলেট না গিয়েও রামগড়ের চা বাগান দেখার সুযোগ মিস করবোনা। সবমিলিয়ে ভালো লেগেছে আমার।