স্বপ্ন সফর ‘কাপ্তাই লেক, রাঙামাটি’
লেখক: আরিফ আকবর
দেড় ঘণ্টা হলো জ্যামে আটকা পড়ে আছি। যতটা ভাল মন নিয়ে বের হয়েছিলাম এখন ঠিক ততটাই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। মনে হচ্ছে বাস থেকে নেমে সামনের প্রত্যেকটা গাড়ী রাস্তা থেকে নিজ হাতে সরিয়ে ফেলি। কিন্তু এটা পারছি না। হলিউড মুভির ‘হাল্ক’ হলে এটা সম্ভব হতো। আমি তো আর ‘হাল্ক’ না, আমি মানুষ। সেকারণেই নিজেকে দমিয়ে রাখতে হচ্ছে।
যাচ্ছি শিক্ষা সফর। অবশ্য আমার ক্ষেত্রে এটা ‘শিক্ষা সফর’ না বলে ‘স্বপ্ন সফর’ বললে সবচেয়ে মানানসই হবে। সেই ছেলেবেলা থেকে আমার কয়েকটা স্বপ্নের একটা স্বপ্ন হলো পার্বত্য অঞ্চল ভ্রমণ। লোকমুখে যত শুনতাম, টেলিভিশনের পর্দায় যত দেখতাম সেখানে যাওয়ার ইচ্ছেটা ততই তীব্র হত। অবশেষে স্বপ্নটা এবার সত্যি হতে যাচ্ছে। গতকাল রাজশাহী থেকে বিকেল ৫ টায় বাস ছেড়েছে। যদিও বাস ছাড়ার কথা ছিল ৩ টায়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে শুরুতেই প্রায় দুঘণ্টা বিলম্ব হয়ে যায়। আর সেই বিলম্বের কারণে এখন জ্যামের মত অসহ্য কিছুর যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে।
আমাদের উদ্দেশ্য হলো, রাঙামাটি হয়ে কাপ্তাই লেক। গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বাস ছুটে চলেছে তার নিজ গতিতে।
এখন সকাল ১০ টা বাজে। এপর্যন্ত কোন পাহাড় চোখে পড়েনি। আমরা সকলেই পাহাড় দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। হঠাৎ স্যার সবাইকে ডেকে বললেন,
‘আমরা এখন বায়জিদ বোস্তামীর মাজারের পাশ দিয়ে যাবো। তোমরা যদি চাও, তবে এখানে ১০ মিনিটের জন্য বাস দাঁড় করাবো। তাহলে মাজার পূজারিদের কিছু কর্মকাণ্ড দেখতে পাবে আর একটু হাটাহাটি করলে শরীরের অবসাদও দূর হবে।’
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘অবশ্যই স্যার!’
যথাস্থানে আমরা দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়লাম। এতো দীর্ঘ সময় বাসে থাকায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমাদের সবারই। আর এখন মুক্ত বাতাস গায়ে মাখতে পেরে আনন্দে মনটা নেচে উঠল। সবাই দ্রুত মাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। একটু যেতেই দেখি সুবিশাল একটা দীঘি। নারী-পুরুষ সবাই দেখি দীঘির পারে কী যেন করছে। আমরাও গেলাম। দীঘির পাড়ে যেতে না যেতেই আমার এক ফ্রেন্ড বলে উঠল, ‘ও আল্লাহ! এসব কী!?
‘কচ্ছপ, এগুলো হলো কচ্ছপ। আগে বোধহয় দেখিসনি, তাই না?’ এমন একটা ভাব নিয়ে বললাম যেন আমি একটুও অবাক হইনি। সবাই দেখি বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। এভাবে তাকানোটা খুবই স্বাভাবিক। প্রথম কোন মানুষ এতো বড় কচ্ছপ দেখবে আর অবাক হবে না, তা অসম্ভব। পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। ধারণা করা হয়, বর্তমানে মাজার প্রাঙ্গন সংলগ্ন এই দীঘিতে দেড়শ থেকে সাড়ে তিনশ কচ্ছপের আবাস রয়েছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এখানে যে প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে, সে প্রজাতির কচ্ছপ পৃথিবীর আর অন্য কোথাও নেই!
আবার লোকমুখে শোনা যায়, এগুলো আসলে কচ্ছপ না; এগুলো মূলত খারাপ জিন ও অশুভ আত্মা ছিল। তাই বায়জিদ বোস্তামী (রহ:) এদের শাস্তি স্বরূপ আমৃত্যু কচ্ছপ বানিয়ে রেখেছেন।
একজন মানুষকে দেখলাম, প্যান্ট ভিজিয়ে একহাঁটু পানিতে নেমে একটা কচ্ছপকে টেনে আনলো পারে। তারপর দেখি হাত দিয়ে তাকে আদর করছে, পায়ের নখগুলো নিজ হাত দিয়ে অতি যত্নে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। আমারও একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো। একটা মেয়ে দেখি আদর করে মাংস খাওয়াচ্ছে। আমি দরাজ কণ্ঠে বললাম, ‘আর কত! আমাদেরও তো একটু সুযোগ দেবেন নাকি?’
মেয়েটি শেষবারের মত কচ্ছপটিকে আদর করে আসতে আসতে পিছনে সরে আসল। আমি কাছে গেলাম। হাত দিতে রুচিতে বাধছে। কিন্তু এতো বড় কচ্ছপ ছুঁয়ে দেখবো তাও আবার ফ্রিতে! এই সুযোগ কি মিস করা যায়? খান জাহান আলী’র মাজারে কুমির ছুঁতে চাইলে ১০ টাকার নোট দেওয়া লাগে। এখানে তো একটাকাও লাগছে না। তাই আমি মিস করলাম না।
আমাকে দেখে কচ্ছপ দূরে সরে যাচ্ছে। হয়তো বুঝে গেছে আমি তাকে ওদের মত আদর করব না, ওর কাছে কোন প্রার্থনাও করব না। কিন্তু আমি তো ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। হাত বাড়িয়ে গলার ঝুলে যাওয়া চামড়া ধরে টেনে কাছে নিয়ে এসে ছেড়ে দিলাম। আমার গা ঘিনঘিন করছে।
সেখান থেকে উঠে এসে মাজারে ঢুকবো বলে গেলাম। মাটি থেকে বেশ উঁচুতে সিঁড়ি বেয়ে খালি পায়ে উঠতে হলো। সেখানেই মাজার। সম্ভবত এটা ছোটখাটো একটা পাহাড় ছিল।
পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলি, উপরের উঠতে হয় খালি পায়ে অর্থাৎ জুতো-স্যান্ডেল নিচে খুলে রাখতে হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। এসব জায়গায় জুতো চুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুব বেশি। তাই নিজ দায়িত্বে এসব রাখবেন। অথবা, আমাদের মতও করতে পারেন— আমরা কয়েকজনকে রেখে উপরে গেছিলাম। আমাদের দেখা হলে ওরা উঠেছে আর আমরা নিচে জুতো পাহারা দিয়েছি।
উপরে উঠতেই দেখি ইয়ে বড় বড় দাড়ি-গোফ ওয়ালা মানুষ বড় বড় তসবিহ হাতে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। ভিতরে ঢুকতে যাবো ঠিক সেসময় তসবিহ ওয়ালাদের একজন বলল, ‘মাথা নিচু করে ভেতরে প্রবেশ কর। বাবার কাছে প্রাণ খুলে প্রার্থনা কর।’
আমরা মাথা একটু উঁচু করেই ভেতরে ঢুকলাম। চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। কিন্তু কিছু বলছে না। সম্ভবত এক সঙ্গে অনেকজন আছি বলে। উঁচু করে বাঁধাই করা কবর। ভিতরে দামি কার্পেট বিছানো। কবরের উপরে বিছানো রয়েছে দামি চাদর। ফুল আর রঙিন বাতি দিয়ে সাজানো। মনে হচ্ছে যেন, এটা কবর নয়, বাসরঘর!
মাজারের বাইরে একটা গাছ আছে। আদৌ কি ওটা গাছ! ওটাকে গাছ বলতে আমার বেশ আপত্তি আছে। গাছে তো পাতা থাকে, লাল-হলুদ সুতা বা ফিতা নয়! শুধু পাতা না, গাছের ছালও আমার চোখে পড়েনি। সবখানেই সুতা-ফিতা বেঁধে পুরোটা ঢেকে রেখেছে।
এসব মাজারে না গেলে বুঝবেন না, মানুষ কত ভয়াবহ শির্কে লিপ্ত। বুঝবেন না, ইসলামকে পুঁজি করে স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থ হাসিলের কত অভিনব কৌশল! সত্যিই এসবে আমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা! একারণেই হয়তো মহান আল্লাহ কুরআনের একাধিক জায়গায় সফর করার কথা বলেছেন।
এই মাজার নিয়ে মজার একটা ঘটনা আছে। এখানে আদৌ বায়জিদ বোস্তামী আছেন কি না সে বিষয়টা স্পষ্ট না। লোকমুখে শোনা যায়, ইরানের বিখ্যাত পার্সিয়ান সুফি বায়জিদ বোস্তামী এখানে ইসলাম প্রচার কার্য শেষ করে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করেন। কিন্তু তাঁর ভক্তকূল তাঁকে কোনভাবেই যেতে দিতে চায় না। ভক্তদের এমন ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁর কনিষ্ঠ আঙ্গুল কেটে মাটিতে কয়েক ফোটা রক্ত ফেলেন। এবং ঐ স্থান মাজার নির্মাণের কথা বলে যান।
দশ মিনিটের জায়গায় আমারা সময় নিয়েছি প্রায় ত্রিশ মিনিট। সবাই বাসে উঠলাম। স্যার একটু রেগে গেছেন, কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছেন না।
সময় গুনছি গন্তব্যে পৌঁছার। ফোনটা বের করে গুগোল ম্যাপে মাঝেমাঝেই দূরত্ব দেখছি। জানালা দিয়ে হঠাৎ অবাক হওয়ার মত কিছু একটা দেখলাম। কী ছিল এটা! পাহাড়! এটাই সেই স্বপ্নের পাহাড়? ভালভাবে দেখার আগেই পার হয়ে গেলাম।
সামনে থাকা এক ভাই বললেন, ‘আরে এটা আর কী দেখলে! অপেক্ষা করো…’
তার কথা শুনে বেশ অবাক হলাম আমি। তার মানে কি এরচেয়ে বড় পাহাড় দেখতে পাবো সামনে? যত এগুচ্ছি ততই যেন হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বাড়ছে। এখন জানালা দিয়ে মাঝেমাঝেই ছোটবড় পাহাড় চোখে পড়ছে। ভাই বললেন, ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যেই রাঙামাটি প্রবেশ করব। আর তখন থেকেই শুরু হবে পাহাড় আর পাহাড়।’
একথা শুনে আমি নিজেকে প্রস্তুত করলাম প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে নিজেকে মুগ্ধ করার জন্য। জানালা দিয়ে তৃপ্তি সহকারে দেখতে পাবো না বলে আমি আর এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে বাসের একদম সামনে চলে গেলাম। দূর থেকে আবছা আবছা আকাশছোঁয়া কিছু দেখা যাচ্ছে। আরে হ্যাঁ! এগুলোই তো পাহাড়। যেদিকে চোখ যাচ্ছে, যতদূরে চোখ যাচ্ছে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখছি। আকাশছোঁয়া পাহাড়ের চূড়া যেন মেঘের সাথে খেলা করছে! যতই ভেতরে যাচ্ছি ততোই মুগ্ধ হচ্ছি। মনের অজান্তেই মুখ দিয়ে আল্লাহু আকবার, সুবহানআল্লাহ শব্দ বের হচ্ছে।
মাঝেমধ্যেই পাহাড়ের চূড়ায় দেখা যাচ্ছে ছোটছোট ঘর। কিছু সংগ্রামী মানুষ এসব ঘরে বসবাস করে। যারা প্রতিনিয়ত জীবন যুদ্ধ করে টিকে আছে সেখানে। যারা হেরে যায় তাদের নিউজ আমরা টেলিভিশনের পর্দায় বা পত্রিকার পাতায় দেখতে পায় কিছুটা। মানুষ বাঁচার জন্য কতটা সংগ্রাম করতে পারে সেটা সেখানে গেলেই অনুধাবন করা সম্ভব। জীবিকা নির্বাহের জন্য কত কষ্টই না তারা করে! ফসল উৎপাদনের জন্য পাহাড় কেটে জমি চাষযোগ্য করে তোলে। কলা, আনারস, কাঠ ইত্যাদি রপ্তানি করে তারা অর্থ উপার্জন করে। আম, জাম, কলা ও লিচু এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ফলে। আর হ্যাঁ, এরা কাজুবাদামও চাষ করে।
মাঝেমাঝেই সেনাবাহিনীদের দেখা যাচ্ছে। হয়তো রাস্তায় টহল দিচ্ছে নয়তো পাহাড়ের চূড়ায় ছোট্ট খুপরি করে বসে থেকে দুচোখ দিয়ে চারিদিক পরখ করছেন। তাদের জীবনটাও কত সংগ্রামী! দেশকে রক্ষার জন্য, দেশের শান্তিশৃঙ্খলার জন্য নিজের পরিবারপরিজন সব ত্যাগ করে এই পার্বত্য অঞ্চলে পড়ে আছেন।
রাঙামাটির সবচেয়ে বিস্ময়কর জিনিস হলো, রাঙামাটির রাস্তা। আকাশছোঁয়া পাহাড় কেটে যেভাবে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে, তা দেখে সত্যিই অবাক না হয়ে থাকতে পারবেন না।
প্রায় ২৩৬১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই জেলায় মানুষ বসবাস করে প্রায় ৬,২০,২১৪ জন। যার ৫৬.০৬% অংশ বৌদ্ধ, ৩৬.৮২% অংশ মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বাকি অংশ। এ জেলায় চাকমা, মার্মা, তঞ্চঙ্গা, বম, চাক, মুরং, ত্রিপুরা, খেয়াং, খুমি, লুসাই, ম্রো, পাংখোয়া, সাঁওতাল, মণিপুরী প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
এদের সরকারি ভাষা হলো বাংলা। এখানকার স্থানীয়রা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। যা শুনে আপনি মজা পাবেন কিন্তু কিছুই বুঝবেন না।
আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পথে বাস চলছে মন্থর গতিতে। উপরে ওঠার সময় বাস হঠাৎ থেমে গেল। উপরের দিকে আর উঠছে না! সবার হাস্যোজ্জ্বল মুখ মলিন হয়ে গেল। সবার মুখে একটাই বাক্য— ‘আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করুন!’
আমি পাশ দিয়ে নিচের দিকে তাকালাম। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন যেন থেমে গেল! আমরা এতো উপরে উঠেছি! ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কোন রকমে একবার এদিকওদিক কিছু একটা হয়ে গেলে কারো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।
‘কত গিয়ারে দেওয়া আছে?’ একরকম ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন উপর থেকে নিচে নামার জন্য ট্রাক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক-ড্রাইভার।
‘দুই…’ করুণ স্বরে আমাদের বাস-ড্রাইভার বললেন।
‘এক গিয়ার দিয়া ধীরেধীরে টান দ্যান।’
ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে তাই করলেন। আল্লাহ অশেষ কৃপায় আমরা সবাই বেঁচে যায়। এখান থেকে বুঝলাম, পাহাড়ে গাড়ি ওঠার সময় এক গিয়ার দিয়ে চালাতে হবে। এই বিষয়টা ড্রাইভারের সাথে সাথে প্রত্যেক পর্যটকদেরও জানা জরুরী বলে আমি মনে করি। কেননা, ড্রাইভার ভুলে যেতেই পারে বা না জানা থাকতেও পারে যে প্রথম গিয়ারেই গাড়ি চালাতে হবে। সুতরাং এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পর্যটক যদি ড্রাইভারকে মনে করিয়ে দেয়, তাহলে কতটা কল্যাণকর হবে সেটা বুঝতেই পারছেন।
রাঙামাটির চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বিকেল তিনটা নাগাদ আমরা কাপ্তাই লেকে পৌঁছি। প্রায় ২১-২২ ঘণ্টা বাস জার্নি আমাদের সবাইকে পরিশ্রান্ত করে দিয়েছে। কাপ্তাই লেকের নীল পানি দেখে আমরা যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। সবাই পারে নেমে হাত-মুখ ধুলাম। কেউ কেউ তড়িঘড়ি করে গোসলও সেরে নিলো।
এর মাঝেই আমাদের জন্য রিজার্ভ করা হলো দুটো ট্রলার। উল্লেখ্য যে, ঘণ্টায় জন প্রতি ১০০-১৫০ টাকা চুক্তি করেও ঘুরে আসা যায়। যেহেতু আমাদের সদস্য সংখ্যা ছিল ১০৩ জন। তাই রিজার্ভ করা আমাদের জন্য সাশ্রয়ী হয়েছে। সবাই আয়োজন করে ট্রলারে উঠলাম। সবুজ পানির বুক চিড়ে ছুটে চললাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
কাপ্তাই লেক রাঙামাটি জেলার একটি কৃত্রিম হ্রদ। এর অববাহিকা প্রায় এগারো হাজার বর্গকিলোমিটার। কর্ণফুলি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলি নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে রাঙামাটি জেলার প্রায় ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি ডুবে যাওয়ার ফলে এই হ্রদের সৃষ্টি হয়। হ্রদের মাঝ দিয়েই ছুটে চলেছি শুভলং জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে। চারিদিকে পানি আর পানি। পূব দিকে আবছা সবুজ পাহাড় দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছি সেদিকেই। মাথার উপর উত্তপ্ত সূর্য। মনে হচ্ছে যেন আমাদের মাথায় ঢেলে দিচ্ছে তার সমস্ত উত্তাপ!
হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য থ বনে গেলাম! আমি এখন যা দেখছি তা কি সত্যিই নাকি সব স্বপ্ন? পৃথিবীতে এমন জায়গা থাকতে পারে? নিচে নীল জল, উপরে নীল আকাশ, চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে চিরহরিৎ বৃক্ষরাজির চোখ ধাঁধানো সবুজ। নীল-সবুজের মাঝে একদম হারিয়ে ফেললাম নিজেকে। মুহূর্তের মধ্যে শরীরের সমস্ত গ্লানি দূর হয়ে গেল।
দুদিকে চিরহরিৎ বৃক্ষরাজি বেষ্টিত চোখ ধাঁধানো সবুজ পাহাড়, মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে হ্রদ। যেদিকে তাকায় শুধু বিমুগ্ধ হওয়ার মত দৃশ্য! বসে থেকে এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হাজার বছর পার করে দেওয়া যায়! কী বিশ্বাস হচ্ছে না? না হওয়ারই কথা। হয়তো আমিও না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। প্রকৃতি এতো সুন্দর হতে পারে, সেটা কল্পনাও করিনি কখনো! টিভির পর্দায় দেখে, পত্রিকার কলামে পড়ে, বইয়ের পৃষ্ঠায় পড়ে বা লোকমুখে শুনে যে কল্পনার জগৎ তৈরি করা যায়, তা আসলে বাস্তবার সাথে বহু ফারাক। স্বচক্ষে যখন দেখবেন তখন কল্পনার সেই জগৎকে বড়ো তুচ্ছ মনে হবে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে শুভলং জলপ্রপাতের কাছে এসে পৌঁছে গেছি। ট্রলার থেকে নামলাম পাহাড়ের পারে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম ঝর্ণাধারা দেখে চোখকে পরিতৃপ্ত করব; কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না। পাহাড় আপাতত তার কান্না বন্ধ রেখেছে! শুনলাম তার নাকি চোখের জল শুকিয়ে গেছে। একদম শুকিয়ে গেছে বললে ভুল হবে, আমরা পাহাড়ের গা চুয়ে জল পড়তে দেখেছি। বর্ষার সময় আবার তার চোখে জল আসবে। আবার শুরু হবে কান্না। শরৎকালেও বেশ কান্না করে সে। যেহেতু সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ, শীতের প্রায় শেষ দিকে অর্থাৎ আরো আগে তার পানি প্রায় শেষ হয়ে গেছে। তাই সেই সৌভাগ্য আমাদের আর হয়ে ওঠেনি।
মর্মাহত হয়ে সেখান থেকে ফেরার জন্য আবার ট্রলারে উঠলাম। ততক্ষণে সূর্য লাল আকার ধারণ করেছে। পাহাড়ের চূড়ার উপর দিয়ে সূর্য যেন আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলছে! এমন দৃশ্য দেখে কেউ যদি বলে, “আমার মনের সব দুঃখ মুছে যায়নি” তাহলে ধরে নিতে হবে সে রসিকতা করছে নয়তো মিথ্যে বলছে।
সূর্যের কিরণ লেগে সোনালী বর্ণের পাহাড়ের চূড়ার বৌদ্ধমূর্তিটা চিকচিক করছে। হ্যাঁ, এখানে বৌদ্ধমন্দির রয়েছে। রয়েছে মসজিদ ও গির্জাও। এমনকি পাহাড়ের মধ্যে উপজেলাও রয়েছে! যার নাম ‘বরকল উপজেলা’। এর আয়তন প্রায় ৭৬০ বর্গকিলোমিটার। এই উপজেলায় প্রায় ৩৯৭৮১ জন মানুষ বসবাস করে।
কিন্তু যেখানে বড় করে লেখা ছিল ‘ব র ক ল উ প জে লা’ সেখানে একটা মানুষও আমাদের চোখে পড়েনি। কিন্তু সেখানে পনেরো-বিশেক বানর দেখেছিলাম। যারা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে বসে ছিল। সম্ভবত কোন বিষয় নিয়ে তাদের কারো মাঝে ঝামেলা হয়েছে। আর সে ঝামেলা মিটমাট করতে তারা এমন গোল হয়ে মুখোমুখি বসে আলোচনা করছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যাস্ত হবে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারিপাশ। অন্ধকার হলেও কিন্তু আমরা এখনি ফিরছি না। যাচ্ছি ‘ঝুলন্ত সেতু’। যাকে ‘Symbol of Rangamati’ বলা হয়।
ট্রলার যেতে যেতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আঁধার নেমেছে। বাল্ব জ্বালিয়ে তখনো দুটো নৌকো আনারস, তেঁতুল, বাদাম ইত্যাদি নিয়ে বসে আছে। মনে হলো যেন আমাদের জন্যই ওরা অপেক্ষা করছে! ট্রলার থেকে পারে নামলাম। মোবাইলের ফ্লাশ দিয়ে যতটুকু সম্ভব দেখার চেষ্টা করলাম। ৩৩৫ ফুট লম্বা এই সেতুর এপার থেকে ওপার গেলাম। হাঁটার সময় ব্রিজে একরকম কাঁপুনির সৃষ্টি হয়। এই কাঁপুনিতে আতংক ও আনন্দ একত্রে মিলে ভিতরে অন্যরকম এক অনুভূতি সৃষ্টি করে। যা আপনাকে অনুভব করাবে অন্যরকম ভালোলাগা।
ওপার থেকে ফিরেই দেখি সবাই আনারস খেতে ব্যস্ত। আমরাও অর্ডার দিলাম। প্রতি পিচ বিশ টাকা। আনারসে একটা কামড় দিয়েই সারাদিনের ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গেল! আনারস এতো স্বাদেরও হয়? ছোট্ট একটা আনারসে কত স্বাদই না লুকিয়ে আছে! এই আনারস সারাদিন রাত খেতে থাকলেও পরিতৃপ্ত হওয়া সম্ভব না।
রাঙামাটির আনারসের সুনাম নিশ্চয় শুনে থাকবেন। কিন্তু এই আনারস না খেলে ধারণা করতে পারবেন না, আনারস কতটা স্বাদের হতে পারে। দ্রুত খেয়ে আরেকটা অর্ডার করতে যাবো, তখনই দেখি ট্রলারে সবাই উঠতে বলছে। এখনি ছেড়ে যাবে। অগত্যা ট্রলারে উঠতে হলো। আনারস আর নেওয়া হলো না।
ট্রলারের ছাদে বসে ভাবছি, ‘রাতের অন্ধকারে যে সেতু এতো সুন্দর, দিনের আলোয় সে সেতু আরো কতই না সুন্দর দেখাবে! এই ব্রিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাপ্তাই লেকের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে নিশ্চয়ই অসম্ভব ভালো লাগবে।’
অনেক কিছুই বাঁকি থেকে গেল। শুভলং ঝর্ণাধারা দেখা হলো না, দেখা হলো না ঝুলন্ত সেতুর আসল সৌন্দর্য। এমনকি কাপ্তাই বাঁধও দেখা হয়নি। দেখা হলো না কাপ্তাই উপজেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান। যেমন, লেক ভিউ পিকনিক কর্নার, কর্ণফুলি কাগজ কল, কর্ণফুলি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি।
সময় স্বল্পতার কারণে তুলনামূলক সামান্যই দেখা হয়েছে। কিন্তু এই সামান্যকিছুই মনের ভেতরে এমন ভাবে স্থান করে নিবে, সেটা অকল্পনীয়।
পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনারাও আমাদের মত ভুল করবেন না। অন্তত হাতে পুরো একদিন সময় নিয়ে যাবেন। দুই দিন হলে সবচেয়ে ভালো হয়। অবশ্য ঐরকম সৌন্দর্যের মাঝে শুধু দুএক দিন নয়; বরং বসে থেকেই কয়েক বছর পার করে দিলেও হয়তো পরিতৃপ্ত হওয়া সম্ভব না!
অতঃপর রাঙামাটির সেই পাহাড়ি পথ ধরেই রাত সাড়ে ৮ টায় হলো ফিরতি যাত্রা।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া
সুন্দর গোছানো একটা লেখা। ভালো লাগলো বেশ। অনেক কিছু জানতে পারলাম লেখাটা থেকে। ধন্যবাদ। অাপনার জন্য শুভ কামনা।
পারে- পাড়ে
অসংখ্য ধন্যবাদ Tasnim Rime আপু।
সম্ভবত “পার” বানানটিই সঠিক। আমি অভিধানে তো তাই দেখলাম।
পার= কিনারা, কূল, নদী দীঘি পুকুর প্রভৃতির তট ইত্যাদি।