গঙ্গাসাগর পাড়
প্রকাশিত: মার্চ ৬, ২০১৮
লেখকঃ vickycherry05

 2,139 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ vickycherry05

গল্প লেখকঃ
মো:ইকবাল মাহমুদ বাবু
(মার্চ – ২০১৮)
……………

আকাশটা তখন আবছা কালো মেঘে ঢাকা। সূর্যটা ঠিক মাথার উপর থেকে লুকোচুরি খেলছে। একবার মেঘের কোলে হারিয়ে যায়, আবার মেঘের কোল থেকে ফিরে আসে। এর সাথে বইছে উত্তরের বায়ুপ্রবাহ, এ যেন উত্তর দিক থেকে তেড়ে আসছে। গঙ্গাসাগরের পানিগুলো বাতাসের সাথে সাথে যেন তাদের প্রাণ ফিরে পেয়েছে। স্তব্ধ থাকা পানিগুলো বাতাসের সাথে আনন্দের সহিত ঢেউ খেলছে।এদিকে ওপারের কাশফুলগুলো বাতাসের সাথে নাচ করছে, একবার এদিক আবার ওদিক আপনমনে হেলে পড়ছে। সব মিলিয়ে এক চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে গঙ্গাসাগর পাড়। এদিকে দ্বিপ্রহর বেলা গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে স্নান করছে। এখানে নারী ও পুরুষ সবাই স্নান করে থাকে। এরকম একটা বৈরী আবহাওয়ার মুগ্ধতায় মায়া গঙ্গাসাগর পাড় দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে ওপারের আকাশে চেয়ে কি যেন ভাবছে। পড়নে তার আধা ছেড়া পাতলা কাপড়। বাতাস এসে তার এই কাপড়টাও ছিনিয়ে নিতে চাইছে। কেশগুলো তার অগোছালো ভাবে ছাড়া আছে এবং আর কিছু চুল জটলা বেধে আছে। কারণ কবে যে একবার তেল দিয়েছিল চুলে ঠিক মনে পড়ছেনা। আর কিছু চুল বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে উড়ছে। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া ছাত্রী মায়া। তার গায়ের রং শ্যামলা এবং মাত্র নয় বছরের একটি কিশোরী মেয়ে। পুরো মুখমণ্ডল জুড়ে এক গভীর মায়া মিশে আছে। কি ভাবছে মায়া আনমনা হয়ে? তার চোখ-মুখ জুড়ে একরাশ কষ্ট ভেসে উঠেছে। কি এত কষ্ট এই কিশোরী মেয়ে মায়ার?

মায়ার মা জুলেখা বেগম মায়াকে খুঁজে খুঁজে অস্থির। পরক্ষনেই জুলেখা বেগম গঙ্গাসাগরের কাছে এসে মায়া মায়া বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। মায়া শ্রবণ করেই দৌড়ে মায়ের কাছে ফিরে এল। জুলেখা বেগম বলল,
=কিরে তুই একলা একলা এইহানে খাড়াইয়া রইলি ক্যান?
=কি করুম তাইলে? স্কুল থেইকা আইয়া দেহি তুমি বাইত নাই, একলা একলা বাইত ভাল্লাগেনা।
=গোসল করছস?
= হ
=ভাত খাইছস?
=না, তুমি ছাড়া কি আমি খাইছি?
=আইচ্চা চল এবার, খাইয়া নেই।
=আইচ্চা লও।
গঙ্গাসাগরটি আসলে একটি মনোমুগ্ধকর দিঘী। এর চারদিকেই গোসল করার ঘাট রয়েছে। এটি ব্রাহ্মনবাড়ীয়া জেলায় অবস্থিত। পূর্বে ত্রিপুরা রাজা এই দিঘীটি খনন করেন। আর গঙ্গা দেবীর নামানুসারে এর নামকরন করা হয় গঙ্গাসাগর। এর চারপাশের পরিবেশ একেবারে ছবির মত। সবুজে সবুজে ঘিরে আছে এই দিঘীটিকে। আর এই গঙ্গাসাগরের পাড়েই মায়ার গ্রাম। অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা গ্রামটি। কিন্তু এখানের মানুষগুলো একটু অন্যরকম।

মা ও মেয়ে ঘরে এসে খেতে বসল। খেতে খেতে ছোট্ট মায়ার জিজ্ঞাসা,
=আইচ্চা মা,আমার বাপেরে আমি দেখি নাই ক্যান?
=হঠাৎ এই প্রশ্ন করলি ক্যান রে মা?
মায়া টল টল করে চোখের পানি ছেড়ে দিল।
=কিরে তুই কান্দস ক্যান?
=মা দিঘীতে যহন গোসল করতে গেছিলাম তহন দেখলাম পোলা-মাইয়ারা হেগো বাপের লগে মজা কইরা গোসল করতাছে। আমি শুধু চাইয়া রইছি মা। আর আমার বাপের কথা খুব মনে পড়তাছে। বাপজানরে আমি দেখি নাই তবুও এত কষ্ট লাগে ক্যান মা?(কাঁদছে আর বলছে)
=জুলেখা বেগমও কেঁদে দিল আর বলল, কি করবি রে মা? সবই আমগো কপাল।তর বাপেও তরে দেইখা যাইতে পারল না, আর তুইও তর বাপরে দেখলি না।
=ক্যান মা?
=দেখবো কেমনে? উনিতো তুই ছয় মাসের পেটে থাকতেই চলে গেছে।
এবার মা ও মেয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। দু:খী তাদের সংসার, কোনোরকম স্বামীর একটু জমিতে একটি ছনের ঘর করে মা ও মেয়ে বাস করে।মায়া পাশের গ্রামের স্কুলটিতে পড়ে। ওখান থেকে চাল-ডাল যা পায় তা দিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে মা ও মেয়ের জীবন চলতে থাকে। এদিকে জুলেখা বেগম একজন ধাত্রীমাতা, যাকে গ্রামের ভাষায় ধাইমা বলা হয়। রাত নেই দিন নেই যখন যে ডাক দেয় তার ডাকে সাড়া দিয়ে মেয়েকে একা রেখেই চলে যায়। এ বিদ্যা উনার শাশুড়ি দিয়ে গেছেন এবং বিনিময়ে কারও কাছ থেকে কিছু না নিতে মানা করেছেন। আর জুলেখা বেগম সেটাই করে যাচ্ছেন। যতই তারা দু:খী থাকুক, নি:স্বার্থে মানুষের উপকারে এগিয়ে আসেন। মায়ার সংসারে অভাবের কারণে কোনো কষ্ট হয়না। তার যত দু:খ-কষ্ট সব তার বাবাকে না দেখতে পেরে। আর সবার বাবার মাঝে তার বাবাকে খুঁজে পায়,আর নীরবে কেঁদে যায়।

ধীরে ধীরে সূর্যটা বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পড়ন্ত বিকেল নেমে আসল। গ্রামের কর্মজীবী মানুষেরা সব গুছিয়ে নিয়ে নিজ নিজ বাড়ি ফিরছে। মায়া উঠোনে বসে আছে এবং জুলেখা বেগম মেয়ের মাথার উকুন খুলছে। এদিকে একজন লোক পাশের গ্রাম থেকে আসল এবং বাড়ির বাহিরে থেকে ডাক দিল,
=মায়ার মা কি বাড়িতে আছে?
=কে?
=আমি রহিম, পাশের গ্রাম থেকে।
=ও, আসেন।
=জুলেখা ভাবি, আমার স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠছে, একটু যদি আইতেন।
=আইচ্চা আইচ্চা ঠিক আছে, আপনে যান আমি এক্ষুনি আইতাছি।
এরপর জুলেখা বেগম মেয়েকে বলল,”মা রে তুই তাইলে থাক,আমি যামু আর আমু।”এই বলে মেয়েকে সান্তনা দিয়ে মানুষের উপকারে চলে গেল। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই ঘরে ফিরে যাচ্ছে। চারদিকে ঘোর অন্ধকার নেমে এলো। পুরো গ্রামখানি নীরব হয়ে গেল, রাস্তায় দু’একটা টর্চ লাইটের আলো দেখা যায়। সচরাচর আমাদের দেশের গ্রামগুলোতে সন্ধ্যা নামতেই সবাই যে ঘরে ঢুকে, আর বাহিরে বের হয়না। গ্রামটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। দূর প্রান্ত থেকে শেয়ালের ডাক কানে আসছে। কেউ কেউ ঘুমিয়ে গেছে আর কিছু বাড়িতে প্রদীপের আলো জ্বলছে। গঙ্গা সাগরের পাড়ের ঘরটি শুধু মায়াদের। ওদের গ্রামের আর অন্য ঘরগুলো ওদের ঘর থেকে ১কি.মি. দূরে রয়েছে। তাই মায়াদের ঘরটা মোটামুটি একলা। মায়ার ঘরের আশপাশ আরো নীরব। শুধু একটা প্রদীপ মিটমিট করে জ্বলছে ও গুনগুন শব্দ হচ্ছে। আসলে গুনগুন শব্দ করে মায়া পড়ছে। ঘরের আর চারদিকটা অন্ধকার। শুধু বইয়ের পাশে একটু আলো জ্বলছে। চারদিকটা নীরবের মাঝে হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দ।মায়া ভয়ে কাঁপা কন্ঠে বলল,
=কে?
=আরে আমি,তোর মা।
=মায়া একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। এরপর গিয়ে দরজাটা খুলে দিল।
=কিরে এত দেই করলি ক্যান?
=আমি হঠাৎ ডরাইছিলাম, মা।
=আরে ধুর পাগলি ভয় কিসের? এইহানে আমি ছাড়া কেউ আইবো না। গরীবের ঘরে মানুষ উপকার নিতে আসে, উপকার করতে আসেনা।
=রহিম চাচার কেমন বাচ্চা হইছে?
=ফুটফুটা একটা মেয়ে হইছে। আইচ্চা মনে অয়তো এহোনো ভাত খাস নাই, চল আমরা খাইয়া নেই।
এরপর মায়া বই গুছিয়ে রেখে মায়ের সাথে খেতে বসে পড়ল। খাওয়া শেষে এবার দুজনে ঘুমোতে গেল। ঘুমোনোর আগে মায়া বলল,
=মা তুমি যে এই কাজ কর, বিনিময়ে মাইনষের কাছ থেইকা কিছু নেওনা ক্যান?
=ক্যান রে মা?
=সবাই তো দেহি বিনিময় ছাড়া কাজ করেনা।
=দুনিয়ার সবাই এক না রে মা। দুনিয়ার সবাই যদি এক অইত, তাইলে দুনিয়াডা অন্যরকম হইত।
=আইচ্চা তুমি নেওনা ক্যান?
=দেখ মা, আল্লাহ কি আমগোরে না খাওয়াইয়া রাখছে? যেকোনো অছিলায় তো দু’বেলা দু’মুঠো খাইতে পারতাছি, এইডাই অনেক। নি:স্বার্থে মাইনষের উপকার কইরা যামু, আল্লাহই আমগোরে দেখব। বেশি চাই চাই করলে একদিন লোভ হইয়া যাইব,পরে লোভ না সামলাইতে পারলে ইহকাল-পরকাল দু’কালেই অশান্তি। ল মা বহুত কথা অইছে এবার ঘুমাই।
=তুমি খুব ভাল মা, তুমি আমার শ্রেষ্ঠ মা।
=তুইও আমার লক্ষী মেয়ে।
এরপর তারা ঘুমিয়ে গেল এবং ধীরে ধীরে মিটমিট করে জ্বলা প্রদীপটাও নিভে গেল।

তিন মাস পর

আগের দিনগুলোর মতই মা ও মেয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। কিন্তু হঠাৎ এমন এক ঝড় নেমে এলো তাদের উপর, সুখ আর বেশিদিন তাদের জীবনে থাকতে পারল না। যার দৌলতে এই গ্রামের মানুষগুলো যে একটু অন্যরকম তা প্রকাশ পেয়ে গেল।
প্রত্যেকবারের মত এবারও জুলেখা বেগম মেয়েকে একা রেখে চলে গেলেন। দেখতে দেখতে গভীর রাত হয়ে গেল। কিন্তু এখোনো আসার নাম নেই জুলেখা বেগমের। এদিকে মায়ার বিশ্বাস তার মা আজ রাতেই ফিরবে। সেই অপেক্ষায় মেয়েটা কিছু খায়নি এবং ঘুমায়ও নি। মায়া এখন আর আগের মত ভয় পায় না।কারণ মায়ার ভয় কেটে গেছে। প্রায় প্রত্যেকবারই তার মায়ের জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করতে হয়,আর তার মা ফিরে আসে বলেই তার ভয় করেনা। তাই আজও তার মা ফিরে আসবে এই ভেবে আর ভয় করছেনা মায়ার।
চারদিক নীরবের মাঝে হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দ। মায়ার আর ভয় করল না।মায়া খুশিতে এগিয়ে গেল দরজা খুলতে, এই বুঝি তার মা এলো। দরজাটা খোলার পরই মায়া অবাক। এরকম পরিস্থিতির জন্য মায়া একদম প্রস্তুত ছিলনা। এবার সারাজীবনেও মায়া যা ভয় পায়নি, আজ এর দ্বীগুন ভয় পুরোপুরিভাবে মায়াকে গ্রাস করেছে। মায়ার পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করল। কারণ এই সময় মায়ার সামনে দাড়িয়ে আছে তিনজন নরপশু। তাদের নাভীর উপরটায় পড়নে কিছু নাই।পুরো মুখমণ্ডল কালো মুখোশ দিয়ে ঢাকা। শুধু রাতের আধারে সাদা দাঁতগুলো বের করে অদ্ভুতভাবে হাসছে তারা। মায়া ভাবল ডাকাত দল হবে। মায়া কাঁপতে কাঁপতে বলল,”কে আপনেরা? আমরা গরীব,আমাদের কাছে কিছুই নেই। শুধু দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়ার জন্য কিছু চাল আছে।”
নরপশুরা কিছু না বলেই ঘরে ঢুকছে। আর মায়া তাদের এগুতে দেখে ধীরে ধীরে পিছু হটছে। ছোট্ট মেয়ে ভয় আর কান্না ছাড়া তার আর কিছু বলার নাই।
পরক্ষনেই নরপশুরা মায়াকে ধরে বসল। তিনজন নরপশু মিলে মায়াকে ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। মায়ার গলা ফাটিয়ে আর্তনাদে রাতের আকাশটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।মায়া স্বজোরে কান্না করছে কিন্তু কেউ শুনতে পায়না। আর বলছে,”আমার সর্বনাশ কইরেন না,আমি এতিম,গরীব, অসহায় মেয়ে। আমার এত বড় ক্ষতি কইরেন না আপনেরা। আপনাগো মা-বোনের দোহাই লাগে, আপনাগো আল্লাহর দোহাই লাগে আমারে ছাইড়া দেন, আমারে ছাইড়া দেন।” কে কার কথা শুনে,নরপশুদের তো কোনো ধর্ম-কর্ম,মায়া-মমতা,মা-বোন বলতে কিছু থাকেনা। মায়ার চিৎকারে যেন রাতের আকাশ, চাঁদ-তারা,গাছপালাসহ পুরো প্রকৃতিই কাঁদতে শুরু করল কিন্তু শুধু তাদেরই দয়া হল না। ধীরে ধীরে রাতের স্তব্ধ আঁধারের মত মায়াও নীরব হয়ে গেল।অসহায় মায়াকে তারা রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে চলে গেল।
ফজরের আযান দিতেই জুলেখা বেগম বাড়িতে এসে হাজির। এসেই দেখে ঘরের দরজাটা খোলা। জুলেখা বেগম অবাক হয়ে গেলে এবং মনে মনে বললেন,”এই সময় দরজা খোলা,ব্যাপার কি? ও মনে অয় মায়া নামায পড়তে উঠছে। বাহিরেই মনে অয় অজু করতাছে।”জুলেখা বেগম কিছুক্ষন বাহিরে মায়াকে খোঁজ করলেন।কিন্তু কারো সাড়া শব্দ মিললো না। এবার একটু ভয় পেয়ে গেলেন এবং দৌড়ে ঘরে ঢুকে মায়াকে ডাকছে। অন্ধকার ঘরেও মায়ার শব্দ নেই। আর এমনিতেই অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাই প্রদীপ নিতে এগুতেই জুলেখা বেগমের পায়ের সাথে
মায়ার পড়ে থাকা রক্তাক্ত দেহখানির স্পর্শ লাগে। জুলেখা বেগম ভয়ে এবার চিৎকার করে উঠলেন।

এরপর প্রদীপটা হাতে নিয়ে জ্বালাতেই দেখে মায়ার করুন অবস্থা। তিনি দৃশ্যটি দেখে এবার আরো জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। মায়ার আধা ছেড়া কাপড়টিকে তারা একেবারে গায়ে জড়ানোর অযোগ্য করে ফেললো। মুখমণ্ডল ও গলায় নরপশুর হিংস্র কামড়ের দাগ এবং ক্ষত স্থান গুলো থেকে রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়ছে। জুলেখা বেগম মেয়েকে দুহাত দিয়ে নাড়াচ্ছে আর বলছে,”কিরে মা, তোর কি অইল? এই অবস্থা করছে কারা,ক মা ক?”
মায়া কিছু বলছেনা,শুধু তার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারার মত অশ্রু ঝরছে।
ধীরে ধীরে প্রভাতের আলো ফুটলো।আজকের সকালটা অন্যদের জন্য মিষ্টি হলেও মা ও মেয়ের জন্য রাতটা কালরাত আর ভোরটা হল সেই রাতের কালো ভোর।ভোর হতেই রাস্তায় মানুষের সমাগম বাড়তে শুরু করল। এদিকে জুলেখা বেগম মেয়েকে কোলে নিয়ে দৌড়ে কবিরাজের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় মানুষ সব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কবিরাজ চিকিৎসা করল এবং বলল,
=মায়া তার বাকশক্তি হারাই ফেলছে।
=কি কইতাছেন কবিরাজ ভাই?
=হ, আমি ঠিকই কইতাছি।
=তাইলে এইডার কি কোনো সমাধান নাই?
=এইডার একটাই উপায় আছে। মায়া যেই রকম একটা যে জঘন্য আঘাতে বাকশক্তি হারাইছে। আবার যদি সেইরকম ভয় ও আঘাত পায় তাইলে হয়তো ঠিক অইয়া যাইতে পারে।
জুলেখা বেগম আবার চিৎকার শুরু করে এবং বলে, “হায় আল্লাহ এইডাই কি
হইল? ক্যান তুমি গরীবের এতো শাস্তি দাও,ক্যান দাও, ক্যান দাও? এগুলো বলে জুলেখা বেগম কাঁদছে। এরপর মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাবার পর,বাড়ির আশেপাশে গ্রামের মানুষের সমাগম বেড়ে গেল। সবাই জিজ্ঞাসা করল, “আসলে ঘটনা টা কি?” জুলেখা বেগম লজ্জায় কিছু বলছেনা। তবুও গ্রামের মানুষ গুলো মায়ার ক্ষত স্থানগুলো দেখে বুঝে ফেলে এবং বুঝেই সমবেদনার বদলে অপবিত্র ও পাপী বলে ঘৃণা শুরু করল। অদ্ভুত এই গ্রামের মানুষগুলো, না বুঝেই মেয়েটিকে মিথ্যে অপবাদ দেয়া শুরু করল। গ্রামের মানুষগুলো এরকমই, কিভাবে একজনের নামে দুর্নাম রটাবে সেই চিন্তায়ই সারাক্ষণ থাকে। অথচ মেয়েটিকে যে নরপশুরা ধর্ষণ করেছে তার কোনো হুশ নেই এবং তা বুঝতেও চেষ্টা করেনা। কেউ কেউ বলে,”টাকার অভাবে শরীর বিক্রি করতে গিয়ে এমন হয়েছে। অভাবে স্বভাব নষ্ট, এবার শরীরের একটু ক্ষতি অইছে,কান্দা-কান্দি শুরু কইরা দিছে,হেগো ঢং দেইখা আর বাচিনা।”
এরপর জুলেখা বেগম গ্রামের মোড়লের কাছে বিচার নিয়ে গেছে। কিন্তু গরীব অসহায় বলে গ্রামের মোড়লও এর কোনো গুরুত্ব দিল না। মোড়ল বলল,”আরে মায়ার মা, যা হওয়ার হইয়া গেছে। এর বিচার চাইয়া আর লাভ কি। মাইনষের মুখ কি বন্ধ করতে পারবা। এদিকে আবার পুলিশি ঝামেলা, এইখানে বহুত খরচ হইতে পারে যা তুমি বহন করতে পারবা না। তাই এই চিন্তা মাথা থেইকা ফালাইয়া দাও।আবার আগের মত বসবাস শুরু কর যাও।”
এভাবে গ্রমের মোড়লও তাদের তাড়িয়ে দিল। গরীবের জন্য ভবে ন্যায় বিচার নেই।এরপর জুলেখা বেগম মেয়েকে নিয়ে আবার আগের মত বসবাস করার চিন্তা করল, কিন্তু গ্রামের মানুষের জন্য তাও পারল না। বাহিরে বের হলে মানুষের কত কথা শুনতে হয়। গঙ্গাসাগর পাড়েও কোনো কাজ করতে গেলে কতরকম কথা শ্রবণ করতে হয়। অসহায় গরীব বলে কাউকে কিছু বলার ক্ষমতা নাই। গ্রামের কেউ তাদের পক্ষে রইল না। জুলেখা বেগম মনে মনে বলছে, “কাগো এত উপকার করলাম?”
এই গ্রামের মানুষগুলো পুরোই অদ্ভুত ধরনের। তারা একটু ধর্ম সম্পর্কে অতিরিক্ত বোঝে। তাই ধর্ষণ একটা খারাপ কাজ তাই খারাপটাকে খারাপই বলে বিবেচনা করে আসছে। কিন্তু এটা যে ধর্ষিতার অনিচ্ছায় হয়েছে সেটা তারা আর দেখবেনা।ধর্ষিতাকেই পাপী বলে গন্য করে যাচ্ছে। ধর্ম সম্পর্কে অল্প বিদ্যা নিলেই এরকম হাল অবস্থা হয়। আর তাই হয়েছে গ্রামবাসীর, একটু অতিরিক্ত বুঝে ফেলেছে।যাকে এককথায় বলা হয় ধর্মান্ধ।
এদিকে মায়ার ধর্ষণের ব্যাপারটা আজ বদনাম হয়ে পুরো গ্রাম জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। নির্বাক মায়া কিছুই বলতে পারছেনা, শুধু দুচোখের জল ফেলে যাচ্ছে। জুলেখা বেগম আর সহ্য করতে পারছেনা। তিনি মনে মনে বলল,”আমার জন্যই আইজ আমার মাইয়ার এই অবস্থা। আইজ যাগো ভালা করতে যাইয়া নিজের মাইয়ার ক্ষতি অইছে,হেই ক্ষতিটারে তারাই দোষ কইয়া বেড়াইতাছে,আর তারাই আমার ও আমার মাইয়ার বদনাম কইতাছে। না আমি আর বাইচ্চা থাকুম না, বাইচ্চা থাকলে এইসব মাইনষের উপকার না কইরা পারুম না। হেগো বিপদে পড়া আবদার ফালাইয়া দিতে পারুম না। হেল্লাইগা যেহেতু হেগো উপকার করতে চাইনা, সেহেতু আর বাইচ্চা থাকুম না। আল্লাহ তোমার বান্দাকে তোমার দুনিয়ায় রাইখা গেলাম। তুমি তার বাকশক্তি ফিরাইয়া দিও ও তারে তোমার হেফাযতে রাইখো।”
প্রতিদিনের মত আজও মায়া তার মায়ের সাথে ঘুমালো। ঘুমের মাঝেই তার মায়ের উপর হাত রাখতেই দেখে তার মা বিছানায় নাই। লাফ দিয়ে উঠে পড়ল মায়া। তখন ভোর হয়ে গেছে,”নাকি মা আবার কারো বাড়িতে গেল উপকার করতে?” মনে মনে বলছে আর খুঁজছে।

খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ দেখে বাড়ির পেছনের বটগাছটায় তার মা ফাঁসি দিয়ে ঝুলে আছে। মায়া তা দেখে ততক্ষণাত চিৎকার দিয়ে মা বলে ডাকতেই তার বাকশক্তি ফিরে এলো। মায়া মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল এবং বলল, “ও মা, মাগো তুমি কই চইলা গেলা, ক্যান চইলা গেলা, অহন কার লগে থাকুম,কারে নিয়া বাঁচুম,তুমি আমারে নিয়া গেলা না ক্যান? মা,মা দেখ আমি কথা কইতে পারতাছি।তুমি শুনবা না আমার কথা,তুমি বিচার চাইবা না মা? মা, ও মা, কথা ক মা, এমনে চাইয়া রইলা ক্যান, কথা ক মা? বাবাও নাই, আইজ তুমি চইলা গেলা, একা আমি কেমনে থাকুম মা, আমার তো ভয় করব মা, আমার তো ভয় করব।”
মায়ার চিৎকারে গ্রামের ছেলে-বুড়ো সব জড়ো হয়ে গেল। এবারও সবাই মায়াকেই দোষারোপ করছে। গ্রামবাসীর কথা হল,”এই সর্বনাশী, পাপী মাইয়ার লাইগা আইজ আমাগো জুলেখা মারা গেছে। আহ হা রে জুলেখাডা আমগো কত উপকার করতো, যহনই ডাকতাম তহনই চইল্লা আইতো। এহন আমগো উপকার করব কে? তুই সর্বনাশী মরতে পারছ নাই?”
এগুলো শুনে মায়া কিছু বলছে না, শুধু কাঁদছে। মায়া তার মায়ের শোকে বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এরপর তার মায়ের দাফনের কাজ সেরে,মায়ের কবরের পাশেই বসে আছে। উপরের সূর্যটা খাড়াভাবে আলো দিলেও, মায়া দু’চোখে অথই অন্ধকার দেখছে। এক বেদনাময় আঁধার যেন তার জীবনকেই গ্রাস করেছে। জন্মেই আগেই বাবাকে হারিয়েছে। বাবাকে না দেখা ও হারানোর কষ্টটুকু মাকে দিয়ে ভুলার চেষ্টা করত। মায়ের মধ্যেই তার বাবাকে খুঁজে পেত,তাই কিছুটা হলেও বাবার অভাব টা মুছতে পারত। কিন্তু আজ তার মা টাও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। এখন আর কাকে নিয়ে বাঁচবে এই ছোট্ট মেয়েটা। এত গভীর বেদনা কিভাবে সহ্য করবে এই কিশোরী মেয়ে মায়া। তাই মায়ের কবরের পাশেই বসে কাঁদছে। সে ভাবছে তার মা তার কাছেই শুয়ে আছে। গ্রামের কেউ তার খবর নিল না। শুধু কবরস্থানের পাশে মসজিদের ঈমাম সাহেব মায়ার মাথায় হাত রাখল। মায়াকে সান্তনা দিল এবং তাকে বোঝালো। এবার মায়া হুজুরের কথা শুনে বাড়ির দিকে রওনা হল,আর রইলনা কবরস্থান।
বাড়ি ফিরে দেখল সব ফাঁকা লাগছে, আবার কান্না শুরু করল মায়া। জীবনে আর কি আছে ছোট্ট মেয়েটার। যেন সে কোনো ডাল-পাতাহীন মৃত বৃক্ষের মত ফাটা ভূমিতে দাড়িয়ে আছে, যার আশেপাশে প্রচুর গাছপালা থাকা সত্বেও সে একটাই মরা গাছ। জীবনে তেমন কোনো ভোগ-বিলাস চায় নি মায়া, শুধু তার মাকে নিয়ে একটু সুখে থাকতে চেয়েছিল। আর তার মাকে নিয়ে সেই সুখটাকেই আপন করে নিয়েছিল মায়া। কিন্তু সেই সুখটা আর মায়াকে আপন করে নিতে পারল না। সুখটাও তার মায়ের সাথে অনেকদূর পাড়ি জমালো।
এবার মায়া সিদ্ধান্ত নিল যে এই গ্রামেই আর থাকবেনা। সে কোনো এক অচীনপুরের উদ্দেশ্যে অচেনা পথ পাড়ি দিবে। সেদিন দ্বীপ্রহর বেলাতেই মায়া বেরিয়ে পড়ল।যাওয়ার আগে গঙ্গাসাগরটিতে একবার স্নান করে গেল এবং দিঘীটির কাছ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নিয়ে গেল। চলতে চলতে গ্রামের পথ শেষ, এবার দু’পাশে থাকা ধানক্ষেতের মাঝের সরু পথ দিয়ে চলছে মায়া। ধীরে ধীরে যেতে যেতে আর মায়াকে আর দেখা যায় না। এরপর থেকে মায়াকে আর দেখা গেল না গ্রামটিতে।
দীর্ঘ দশ বছর পর জানা যায় মায়া দেশের উত্তরাঞ্চলের এক গ্রামের বৈরাগী। ঘুরে ঘুরে মানুষকে মিষ্টি মিষ্টি কথা শোনায় এবং মধুর কন্ঠে গান করে থাকে। এভাবেই মনের কষ্টটাকে দূর করে, বৈরাগী সাজ টা কে আপন করে নিয়ে জীবনটাকে উপভোগ করছে।

সম্পর্কিত পোস্ট

অঘোষিত মায়া

অঘোষিত মায়া

বইয়ের প্রিভিউ ,, বই : অঘোষিত মায়া লেখক :মাহবুবা শাওলীন স্বপ্নিল . ১.প্রিয়জনের মায়ায় আটকানোর ক্ষমতা সবার থাকে না। ২.মানুষ কখনো প্রয়োজনীয় কথা অন্যদের জানাতে ভুল করে না। তবে অপ্রয়োজনীয় কথা মানুষ না জানাতে চাইলেও কীভাবে যেন কেউ না কেউ জেনে যায়। ৩. জগতে দুই ধরণের মানুষ...

আমার জামি

আমার জামি

জান্নাতুল না'ঈমা জীবনের খাতায় রোজ রোজ হাজারো গল্প জমা হয়। কিছু গল্প ব্যর্থতার,কিছু গল্প সফলতার। কিছু আনন্দের,কিছু বা হতাশার। গল্প যেমনই হোক,আমরা ইরেজার দিয়ে সেটা মুছে ফেলতে পারি না। চলার পথে ফ্ল্যাশব্যাক হয়। অতীতটা মুহূর্তেই জোনাই পরীর ডানার মতো জ্বলজ্বলিয়ে নাচতে...

ভাইয়া

ভাইয়া

ভাইয়া! আবেগের এক সিক্ত ছোঁয়া, ভালবাসার এক উদ্দীপনা, ভাইয়া! ভুলের মাঝে ভুল কে খোঁজা, আর ভালবাসার মাঝে ভাইকে খোঁজা, দুটোই এক কথা! ভুল তো ভুল ই তার মাঝে ভুল কে খোঁজা যেমন মূর্খতা বা বোকামি। ঠিক তেমনি ভালবাসার মাঝে ভাইকে খোজাও মূর্খতা! আমার কাছে ভাইয়া শব্দটাই ভালবাসার...

০ Comments

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *