গল্প লেখকঃ
#রোকসানা_রশিদ_লিলি
আজ আমি আপনাদের একটা গল্প শোনাবো। সেটা অবশ্য আমার নিজেরই গল্প।চলুন আগে বরং পরিচিত হওয়া যাক। আমি সেজান। সেজান মাহমুদ। আগে আমি আহাসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশল নিয়ে পড়তাম। এখন কিছু করি না। সারাদিন বাড়িতে থাকি। বই পড়ি, টিভি দেখি কিংবা অলস সময় কাটাই। জানেন আমার না বাইরে বেরুতে ভীষণ ইচ্ছে করে। কিন্তু কি করবো বলুন? দেখতেই তো পাচ্ছেন আমার অবস্থা। আচ্ছা বাদ দিন মূল গল্পে আসি। তখন আমি সবেমাত্র কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি।চোখে স্বপ্ন, দেহে তারুণ্য, মনে উচ্ছ্বাস সব মিলিয়ে আমি তো আমিই। জানেন ছোটবেলা থেকে কখনও মা বাবাকে কাছে পাইনি। ওরা কোনোদিন বাড়িতে ফিরতো আর কোনোদিন ফিরতো না। আমার খুব খারাপ লাগত। কাদঁতাম। কিন্তু এই ব্যাপারটাই একটা সময় খুব ভালো লাগতে শুরু করলো। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম বাবা-মা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা মানেই আমার স্বাধীনতা নষ্ট হওয়া। ও আপনাদের তো বলা হয়নি; আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী। আর মায়েরও নিজস্ব ফার্ম আছে সাথে লোক দেখানো সমাজসেবীও বটে। লোক দেখানো শব্দটা বলার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। মূলত নিজের স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্যই বিভিন্ন এনজিওর সাথে তিনি যুক্ত হন। ওরা দুজন আমায় সময় না দিলেও অঢেল টাকা-পয়সা, সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। কিছু চাইবার আগেই দশগুন পেয়েছি। একদিন হঠাৎ আমাদের বসার ঘরে এক জলজ্যান্ত ভূতকে আবিষ্কার করলাম। পা থেকে মাথা অবাধি কালো কাপড় দিয়ে মোড়া। কি অদ্ভূত লাগছে দেখতে।
-এক্সিজ মি। আপনি কারো সাথে দেখা করতে এসেছেন?
-জ্বী না। আমি মিসেস মিতা মাহমুদের সাথে এসেছি।
-ওহ আচ্ছা। প্লিজ বসুন।
[কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম।]
-সুজন বাবা চা।
-চাচা কতবার বলেছি এসব নামে ডাকবে না। নামটা শুদ্ধ করে বলতে না পারলে ডাকার দরকার নেই।
-আরে বাজান একখান নামে ডাকলিই তো হইলো।
-না মোটেও হলো না। আচ্ছা ড্রয়িং রুমে একজন অদ্ভূত মহিলা বসে আছেন। কে বলোতো?
-জানি নে। মেমসাবের সাত আসিচে। একন থাকি একানেই থাকবি। ওই গেস্ট রুমখানা পরিষ্কার করা হইয়ে গেলিই উঠবে নে।
-এ বাড়িতেই থাকবে মানে? আমাকে তো কেউ কিছু জানালো না। মা বাড়িতে আছে?
-না গো। এই একটু আগে বেরিয়েচেন। মেমসাবকে ফোন করো দেকি।
-দাড়াও করছি।
-হ্যালো মা
-স্যার আমি ম্যাডামের পিএস বলছি। ম্যাডাম মিটিংয়ে আছেন। কোনো জরুরি দরকার হলে আমায় বলতে পারেন।
-বাড়িতে একজন মহিলাকে দেখলাম। উনি কে?
-স্যার উনি একজন এসিড নিক্ষেপের শিকার হওয়া নারী। ম্যাডামদের এনজিও থেকে ম্যাডাম মেয়েটির দায়িত্ব নিয়েছে।
-বাট আই ওয়ান্ট টু নো ওয়াই?
-ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড স্যার….ম্যাডাম এবার এনজিওর সভাপতি পদে নমিনেটর।এখন ম্যাডামের একটা আলাদা ইমেজ দরকার। তাছাড়া ম্যামের প্রতিপক্ষ বেশ শক্তিশালী।
-তাই বলে……
-স্যার ম্যাডাম যেকোনো মূল্যে চেয়ারটা চান।
[বাড়িতে বারতি লোকের আনাগোনা কখনই আমার পচ্ছন্দ ছিলো না। তাছাড়া এমন একটা মেয়ে। নিশ্চয়ই মুখের কোনো অংশ ঝলসানো। কি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বুঝতে পারছেন? তার উপর গেস্টরুমটা আমার রুমের পাশেই। রাতে মা আমায় ডেকে পাঠালেন।]
-বাড়িতে নতুন যে মেয়েটা এসেছে তার সাথে পরিচিত হয়েছো?
-নাহ। আচ্ছা মা এরকম একটা মেয়েকে বাড়িতে রাখার মানে কি?
-তুমি বুঝবে না। ওই মেয়েটাই এখন আমার সবচেয়ে বড় ট্রাম কার্ড। আর শোনো মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখবে, নৈতিবাচক আচরণ তো দূরে থাক বরং তোমরা এমন আচরণ করবে যেন ও আমাদের প্রতি প্রচন্ড ইমপ্রেস হয়। আমাদের বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা সমন্ধে এনজিওর কাছে ও পজেটিভ রিপোর্ট করা মানে এনজিও আমার হাতে থাকা।
-ওয়াট আ ইমোশনাল গেম!
-সাট আপ। যা বললাম তাই কর। যাও। নিজের ঘরে যাও।
ব্যাপারটা খুব অল্পতেই মিটে যেত যদি কাঁকন প্রথমদিনের মতো সবসময় কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখত। কিন্তু না কাঁকন তা করেনি। ও প্রচন্ড নারীবাদী। ও মনে করে আট/দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করার অধিকার ওরও আছে। এ ব্যাপারে আমি যতবারই ওকে কিছু বলতে গেছি ততবারই ও বড় বড় লেকচার ঝেড়েছে কিংবা অমুক আইন, তমুক আইন, অধিকার এসব টেনে এনেছে। মারাত্নক অসভ্য একটা মেয়ে। আমরা সবাই ভেবেছিলাম ওর মুখের কোনো একটা অংশ হয়তো ঝলসানো হবে। কিন্তু না, ওর পুরো মুখ, গলা, হাত সব ঝলসানো। মাংসগুলো পুড়ে এবরো-থেবরো হয়ে গেছে। এমনকি একটা চোখ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। ওকে এই অবস্থায় প্রথম যখন মনু চাচা দেখেছিল, ভয়ে সিড়ি গড়িয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। দুদিন হাসপাতালে ভর্তি রাখতে হয়েছিলো। ওকে দেখে কাজে মেয়েটা ভয়ে আর কাজ করতেই আসে নি। আমার বন্ধুরাও বাড়িতে আসা বাদ দিয়ে দিয়েছে। কতবার বলেছি আমার বন্ধুরা থাকাকালীন নিচে নামবেন না। ওর নামতেই হলো। পিংকি আর বাধনের তো চিৎকার করতে করতে দম বন্ধ হবার অবস্থা হয়েছিলো। এতকিছুর পরেও কাঁকনকে থামানো যায় নি। ওর জন্য আমি পর্যন্ত বাড়ি ছাড়া হবার মত অবস্থা। ইদানিং স্বপ্নে বারবার কাঁকননের মুখ দেখছি। আর ভয়ে কুকড়ে উঠছি। ছিঃ কি জগন্য আর ভয়ংকর বিশ্রী অবয়ব। আমি সত্যিই ওকে আর নিতে পারছিলাম না। ওকে দেখলে আমার যতটা না শরীর জ্বালা করত তার থেকে বেশি শরীর জ্বালা করত ওর মুখে খই ফুটতে দেখে।
-আপনি কিন্তু দিন দিন আপনার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
-কি বোঝাতে চাইছেন, ঠিক বুঝলাম না।
-আপনার মধ্যে যে নূন্যতম আত্নমর্যাদা বোধ নেই তা ভালই বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
-উহু। ভুল বলছেন। আমার চেহারার এই অবস্থা হবার পর মানুষ যখন সম্মানের বদলে ঘৃণা করতে শুরু করলো তখন সেই শূন্য স্থানটুকু পূরণের জন্য আমি নিজেকে নিজে সম্মান করতে শুরু করলাম। এভাবে আমার ঘৃণা করার লোক যত বাড়ছে আমার আত্নসম্মানবোধ ততই বাড়ছে।
-আচ্ছা একজন পরনির্ভরশীল মানুষ কিভাবে নিজেকে আত্নসম্মান সম্পন্ন মানুষ হিসেবে দাবি করতে পারে বলুন তো!
-আপনাদের বাড়িতে থাকছি বলে বললেন? এটা আপনার ভুল ধারণা। আমি মোটেও পরনির্ভরশীল নই।
[ও শুধু অসভ্য নয় অকৃতজ্ঞও বটে। আমাদের বাড়িতে থেকে খেয়ে শিকারই করলো না যে ও পরনির্ভরশীল। ছিঃ। সেদিন আমি ফেসবুকে ওর আইডি খুঁজে পেয়েছিলাম।সেখান থেকে অদ্ভূত কিছু তথ্য পেলাম। ও বাংলাদেশী নয় ভারতীয়। এদেশে এসেছিল ডাক্তারী পড়তে। এক সহপাঠী দ্বারাই এসিড সন্ত্রাসে শিকার হয়। এই ঘটনা নিয়ে দুদেশেই বহু আলোড়ন তৈরি হয়েছে। প্রধান আসামী এখন পুলিশ হেফাজতে আছে। কিছুদিনের মধ্যেই বিচারের রায় হবে। এরপর কাঁকন নিজ দেশে ফিরে যাবে।ততদিন ওর সেফ কাস্টুরীতে থাকার কথা। কিন্তু এনজিওর আবেদন এবং সঠিক নিরাপত্তার দেয়ার প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ওকে আমাদের বাড়িতে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে। ওর আইডিটা যতই ঘাটছিলাম আমি ততই বেশি অবাক হচ্ছিলাম। টাইমলাইন ভর্তি ঝলসানো মুখের হাস্যউজ্জ্বল ছবি। সবগুলো ছবিতেই কয়েক হাজারের উপর লাইক। নারীবাদী পোস্টে ভরপুর। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সেলিব্রেটি বটে।অনেককে দেখলাম ওকে নারী জগতের রোল মডেল ভেবে বসে আছে। এক লক্ষের মতো ফলোয়ার। ওর পোস্টগুলো ঘাটতে ঘাটতে একটা পোস্টে আমার চোখ আটকালো
27/08/2013
আপনি নাকমুখ কুচকে আমায় বললেন “আপনার মুখটা অন্ত্যত বয়স্ক মানুষটার কথা ভেবে ঢেকে রাখা উচিত। আর অমন একটা মুখ আপনি লোককে দেখানইবা কি করে? ঘেন্না করে না?” শুনে আমার খারাপ লেগেছিলো বটেই। কিন্তু হ্যাঁ, সত্যিই আমি মুখ ঢেকে রাখতাম যদি না ঘাগুলো আরো দগদগে হতো। নিজেকে ঘেন্না করা কতটা কঠিন জানেন? শরীরের পোড়া জায়গা কখনো কাপড় দিয়ে মুড়ে দেখবেন,কেমন লাগে!]
[যথা সম্ভব এটা আমায় উদ্দেশ্য করে লিখেছে। ও আমাকে বরাবরই নিচু মন মানসিকতার প্রমাণ করতে চেয়েছে। কিন্তু কথাটা আমি নেহাতই মনু চাচার কথা ভেবে বলেছিলাম ওকে। যাই হোক ওকে নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাইছিলাম না। কারণ আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম আপদটা আর কিছুদিনের মধ্যেই বিদায় হচ্ছে।সেদিনরাতেই নিশ্চিন্ত মনে ল্যাপটপটা পায়ের উপর রেখে আধশোয়া অবস্থায় একটা জরুরি কাজ করছিলাম। মনে হচ্ছিলো অন্যদিনের তুলনায় ল্যাপটপটা বেশিই গরম হয়ে যাচ্ছে। হঠ্যাৎ একটা শব্দ। এরপর আর কিচ্ছু মনে নেই। ঘোর কখন কেটেছিলো ঠিক জানি না। চোখ খুলতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। হা-পা নাড়ানোর খুব চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারি নি। দেখলাম আমার পুরো বেডটা মোটা কাচ দিয়ে ঢাকা। বাবা- মা, মনু চাচা হালকা নীল রংয়ের পোশাক, মুখে মাক্স পরে দাড়িয়ে ছিলো। উবু হয়ে কি যেন দেখছিল। বোধয় আমাকেই। কোনো কথা বলছে না শুধু কাদঁছে। আমি ওদের ডাকার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। কিছুক্ষণ পর ওরা চলে গিয়েছিলো। একটু পর আরেকজন এল। মুখ থেকে মাক্সটা সরিয়ে আস্তে আস্তে আমার কানের কাছে মুখ আনল। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গরম হাওয়া আমার খুব অসহ্য লাগছিল। বোধ করি মৃদ্যু বিদ্রুপের হাসি হাসলো, “আমায় চিনতে পারেছেন? আমি কাঁকন। আমার কাজ শেষ, দেশে ফিরে যাচ্ছি, তাই বিদায় নিতে এলাম। আচ্ছা একটা কথা বড়ো জানতে হচ্ছে এখন নিজেকে কিভাবে ঘৃণা করবেন? জানেন তো আজ পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে পাশাপাশি কলামে দুটো খবর বেড়িয়েছে। একটি হলো “অবশেষে ন্যায় বিচার পেলো কাঁকন। “আরেকটি কি জানেন? বলছি…..”ল্যাপটপ বিস্ফোরণে দেহের চল্লিশ শতাংশ পুড়ে গেলো যুবকের!”
০ Comments