প্রিয়
দাদাভাই,
শুরুতে তোকে শরতের শিউলি ফুলের নরম নরম ভালোবাসা। কেমন আছিস দাদাভাই? জানি তুই ভালো নেই, তবুও দাঁতগুলো বের করে বলবি ভালো আছি রে পাগলী! দাদাভাই তুই কেন মিথ্যা ভালো থাকার কথা লেখিস প্রতিবার চিঠিতে? তুই কি মনে করিস আমি তোর মিথ্যা হাসি বুঝি না? তুই ভুলে গেছিস, তুই আমাকে তোর আত্মা বলতি। আত্মা হয়ে তোর মনের কথা বুঝবো না! থাক আর দাঁত বের করে হাসতে হবে না, আগে চিঠিটা মন দিয়ে পড়। তোর জন্য রাত জেগে না ঘুমিয়ে চিঠি লিখছি। তাই বলে মনে করিস না তোকে খুব মিস করছি। তুই নেই বলে আমি খুব ভালোই আছি। এখন আর আমার রোস্টে কেউ ভাগ বসায় না। আমার আচার কেউ চুরি করে খায় না। আমার ব্যাগ থেকে আর কেউ টাকা চুরি করে নেয় না। এই দাদাভাই তোকে ছাড়া আমি খুব ভালো আছি রে! এখন আমায় আর কেউ পাবনার হিমু পাগলী বলে রাগায় না। তবে সত্যি কথা বলতে কী জানিস দাদাভাই? তোর মুখে হিমু পাগলী ডাকটা খুব শুনতে ইচ্ছা করছে।
দাদাভাই তুই তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আয় না! আমি তোর এই জ্বালাতনগুলো খুব মিস করছি। দাদাভাই আমি তোকে সবসময় অনেক মিস করি। আয় না দেশে দাদাভাই। তোর শাসন, তোর বকা, তোর সাথে কথায় কথায় ঝগড়া আমি খুব মিস করছি দাদাভাই। তোকে খুব মনে পড়ে যখন পাড়ার মোড়ে তোর বন্ধুদের আড্ডা চোখে পড়ে। শরিফ ভাই, রতন ভাই তো আমাকে দেখলেই তোর কথা জানতে চায়। জানতে চায় তুই কবে দেশে ফিরবি? ওরা তো বলে তুই নাকি ওদের আড্ডার প্রাণ। ওরা এখন আর পাশের গ্রামে ক্রিকেট খেলতে যায় না। যাবে কী করে? ওদের ক্যাপ্টেন যে এখন দূর প্রবাসে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেশের মাটিতে কবর দিয়ে কনস্ট্রাকশনের ইট-বালুর মাঝে পরিবারের জন্য স্বপ্ন বুনে!
দাদাভাই তোর মনে আছে, তুই যখন স্কুলে খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে কাপ নিয়ে বাড়ি ফিরতি তখন আমি তোর কাপটা নিয়ে আমার রুমে রেখে দিতাম। আর তুই আমাকে রাগ দেখিয়ে বলতি, কাপ তুই কষ্ট করে খেলে জিতেছিস। তাই কাপ তোর রুমে থাকবে। এই নিয়ে আমাদের মাঝে লেগে যেতো তুমুলভাবে ঝগড়া। আপু তখন বলতো, অনুর বিয়ে হলে দেখবো কার সাথে ঝগড়া করিস। আমার বিয়ের কথা বললেই তোর মুখটা কালো মেঘে ঢেকে যেতো। তুই তখন আমার রুমে কাপটা রেখে আপুকে বলতি, আপু আমি অনুকে কাপ দিয়ে দিছি। তুমি আর ওর বিয়ে দিবে না তো? তোর বোকা বোকা কথা শুনে সবাই হেসে দিতো।
দাদাভাই এখন কেমন করে থাকিস তোর অনুকে ছেড়ে দূর প্রবাসে? দাদাভাই শুধু তোকে ছাড়া একা একা স্কুলে যেতে পারব না বলে তোর থেকে পাঁচ বছরের ছোট হয়েও তোর সাথে সিক্সে ভর্তি হয়েছিলাম। তোর কাছে আমার প্রথম হাতে খড়ি। আমি পড়তে পারতাম না, তুই আমাকে শিখিয়েছিস পড়া। তুই শিখিয়েছিস মানুষকে ভালোবাসা, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। দাদাভাই আমি তোর আদর্শে এখনো তোর দেখানো পথে চলার চেষ্টা করি। দাদাভাই গত মাসে তোকে চিঠি লিখতে পারিনি। কারণ আমি অসুস্থ ছিলাম। আপু আমাকে আর তোকে নিয়ে খুব চিন্তা করছিল। কারণ আমরা যে কোনো একজন অসুস্থ হলে যে, আরেকজনও অসুস্থ হয়ে যাই। দাদাভাই সত্যি করে বলবি তুই কি অসুস্থ? চিঠির উত্তরে অবশ্যই বলবি কিন্তু।
দাদাভাই আপু বলছিল সংসারের অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। আসলে আমার পড়াশোনায়ও অনেক খরচ হয়ে যাচ্ছে। দাদাভাই তোকে এসব লিখতে আমার একটুও ইচ্ছা করে না তবুও লিখতে হচ্ছে। তুই তো সবই জানিস পরিবারের অবস্থা। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আমাদের কোনো খবরই নেয় না। তাই তো তোর মতো মেধাবী স্টুডেন্টকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে পাহাড় সমান ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে যেতে হলো সিঙ্গাপুর। সেখানে যেতেও তোকে একদিন একরাত এয়ারপোর্টে আটকে রেখেছিল পারমিট হয়নি বলে। একদিন একরাত না খেয়ে পড়ে ছিলি সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে কষ্টে বুকটা ফেটে যায় রে দাদাভাই।
দাদাভাই আমি তোর কষ্টটা বুঝি, তবুও কিছু করতে পারি না। গতকাল রাতে আপুও অনেক কেঁদেছে তোর কথা মনে করে। আসলে টিভিতে দেখাচ্ছিল এক বাংলাদেশী ভাই কাজ করতে অনেক উঁচু বিল্ডিং থেকে পড়ে মারা গেছেন। আরও দেখিয়েছে প্রবাসীরা কীভাবে তপ্ত রোদে পিচঢালা রাস্তায় শুয়ে থাকে। দাদাভাই তুইও এমন কষ্ট করেই রাস্তায় রাস্তায় রাত কাটিয়ে আমাদের জন্য টাকা পাঠাস আমি জানি। দাদাভাই তোর পাঠানো টাকায় আমরা ঈদ করি। সবার জন্য নতুন নতুন জামাকাপড় কিনি। কত রকমের রান্না হয় আমাদের বাড়িতে। আর তুই ঈদের দিনটা নামাজ পড়েই শুরু করিস কাজ। দিন শেষে জোটে কিছু পড়ে থাকা খাবার।
দাদাভাই তোর প্রতি ফোঁটা পবিত্র ঘামের মূল্য আমার গায়ের সমস্ত রক্ত দিয়ে তোর পা ধুয়ে দিলেও যে, সে ঋণ শোধ হবে না। তোর গা থেকে ঝরে পড়া রক্ত পানি করা ঘাম শুধু আমার, আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থাই উন্নত করেনি, করেছে দেশের উন্নয়ন। তোর মতো আরও হাজার হাজার প্রবাসী ভাই-বোনদের স্বপ্ন, রক্ত এমনকি জীবনের বিনিময়ে গড়ে উঠছে আমাদের পরিবারের স্বচ্ছলতা ও দেশের অর্থনীতি। তার বিনিময়ে প্রবাসী ভাইরা পাচ্ছে ডিপ্রেশন, টেনশন, পরিবার পরিজনের অপমান, রাগ, অভিমান। এমনকি ক্যান্সার, হৃদরোগের মতো মারাত্মক রোগও। অবশেষে মৃত্যু।
দাদাভাই তোকে ও প্রবাসী সকল ভাইকে আমার পক্ষ থেকে জানাই লাল সালাম। তোরাই আমাদের দেশের অর্থনীতির একটা শক্ত বীম। দাদাভাই সারাদিন কাজ করেছিস এখন আর রাত জেগে আমার হিজিবিজি লেখা পড়তে হবে না। এখন ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়। সকাল হলেই তো তোকে ছুটতে হবে জীবিকার টানে, পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে। দাদাভাই আজ আর না, নিজের খেয়াল রাখিস। আর সময় করে চিঠির উত্তর দিস। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোর পাবনার হিমু পাগলী
যদি পাশে থাকো
তাসফিয়া শারমিন ** আজকের সকালটা অন্য রকম। সাত সকালে আম্মু বকা দিলো। মানুষের ঘুম একটু দেরিতে ভাঙতেই পারে। তাই বলে এত রাগার কী আছে ?একেবারে যে দোষ আমারও তাও নয়। মানুষ ঘুম থেকে উঠে ফোনে বা দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখে। কিন্তু আমি উঠি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের আলো দেখে।কে জানে...
চিঠিতে ভাইয়ের প্রতি বোনের ভালোবাসা ফুটে উঠেছে।
দূরে গেলেই বুঝা যায় কার প্রতি কেমন ভালোবাসা।
প্রবাসের সকল ভাইগুলোকে ভালো রাখুক আল্লাহ।
ভাই বোন একসাথে থাকলে খুনসুটি,ঝগড়া হবেই।
তবুও এ ভালোবাসা পরিমাপ করা যায় না।
লেখাটায় লেখককের নাম না লেখা থাকলেও এটা যে ইফফাত ইরা আপুর তা খুব সহজেই বুঝতে পারছি। চিঠিটা পড়তে পড়তে একবারে চোখে পানি চলে এলো। কত পরিবারের কত সন্তান তাদের পিতামাতা ভাইবোন ছেড়ে প্রবাসে যায় অর্থ উপার্জনের জন্য। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না তাদের এই উপার্জনের জন্য যে কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয়। মানুষের বেঁচে যাওয়া খাবার, ময়লা পানি খেয়ে আর রাস্তার উপর শুয়ে, দিনরাত পরিশ্রম করে দিন কাটে সেকথা আমরা কতজন জানি?
অনেক সুন্দর লিখেছেন। ভাইবোনের খুনসুটি, ভালোবাসা সবই ফুটে উঠেছে চিঠিতে।
শুভ কামনা অজস্র।
শুনে-শোনে
হাতে-হাতের
যাই-যায়(যেহেতু অন্যজনের কথা বলা হয়েছে)
যায়-যাই(যেহেতু নিজের কথা বলেছে)
ঈদ-ইদ (বর্তমানে বাংলা একাডেমি ঈদকে ইদ বানিয়ে ফেলেছে)
বাহ্ অসাধারণ লিখেছেন। আসলে চিঠির দাদাভাই এর মতো প্রায় অনেক বাঙালি এইরকম বিদেশে পড়ে থাকে। তবে চিঠির শেষে শুধু ‘তোর পাবনার হিমু পাগলী ‘না দিয়ে নামও উল্লেখ করে দিলে ভালো হতো। এতে চিঠি পূর্ণতা পেতো। আর যাইহোক ভালো লিখেছেন আর পড়েও অনেক ভালো লেগেছে। ভুলের দিকে আগামীতে খেয়াল রাখবেন আশা করি। অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।