চিঠি
প্রকাশিত: জানুয়ারী ১১, ২০১৯
লেখকঃ

 2,356 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ

-চিঠি-
লেখা: মাহবুবা শাওলীন স্বপ্নীল

প্রিয় মা,

সালাম নিও। সম্বোধন লিখতে কিছুক্ষণ ভাবতে হয়েছে। ‘মা’ রা তো সবসময় প্রিয় হয়। আলাদা করে ‘প্রিয়’ বিশেষণ কেন লিখতে হবে? কিন্তু আমরা নিয়ম মানতে পছন্দ করি কিংবা নিয়ম মেনে নিতে হয় মেনে নেওয়ার তাগিদে। এই যে আমি তোমার কাছ থেকে শত শত মাইল দূরে বসে চিঠি লিখছি, এই যে আমি খুব করে চেয়েও তোমায় ছুঁয়ে দেখতে পারছি না, এই নিয়মটাও তো কত অদ্ভুতভাবে মেনে নিয়েছি! ওই তো সেদিন! প্রচুর ভিড়ের মাঝেও খুব চেনা একটা কণ্ঠ যখন ডেকে বললো, “নুহা মা, তোর ইনহেলার টা নিয়েছিস তো?”, তখনই ছুটে গিয়ে সেই চির পরিচিত কণ্ঠের মানুষটাকে জাপটে ধরার প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তো পারিনি। কনের সাজে ঘোমটা টেনে একদল নতুন মুখের সাথে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে নতুন জীবনের। জগত সংসারের এই কঠিন নিয়মটাও তো সেদিন মেনে নিতে হয়েছে মা।

মা তোমার মনে পড়ে? ছোটবেলায় ছাদে উঠে লুকিয়ে বরই পেড়ে খেতাম; কিন্তু তুমি ঠিক-ই বুঝে ফেলতে। গাছে অসংখ্য বরই এর ভেতর মাত্র কয়েকটা নেই, এটা তুমি ঠিক কীভাবে বুঝতে আজও ভেবে অবাক হই! সংসারের সবকিছুর হিসেব তোমার জানা ছিল। আবার যখন তোমার হাতে বানানো জলপাই আচার চুরি করে খেয়ে ফেলার পর ধরা খেতাম, তুমি চোখ লাল করে রাগি স্বরে বকে দিতে। কিন্তু ঠিক তখনই আবার আমাকে আর ভাইকে ডেকে পাশে বসিয়ে সব আচার খেতে দিতে! জলপাই আচার খাওয়ার কী ভীষণ লোভ ছিল আমার! এখানেও এখন নানান নামের নানান স্বাদের আচার কিনতে পাওয়া যায় জানো? কিন্তু কোথাও তোমার হাতের বানানো সে জলপাই আচার আর পাওয়া যায় না মা। খুব মন চায় আবার তোমার পাশে বসে সারা গালে লাগিয়ে সে আচার চেটে খাই আর তুমি পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকো।

তোমায় কত জ্বালাতাম মা! এটা খাবো না, ওটা খাবো না, এটা লাগবে, ওটা এনে দাও করে বাসা মাথায় তুলতাম। বড় হওয়ার পরও তো সেসব অভ্যাস যায়নি। এত অদ্ভুত রকমের সহ্য ক্ষমতা ছিল কী করে তোমার? কী করে পারতে সব মেনে নিতে? শুধু খানিকটা হেসে বলতে “যখন মা হবি, তখন বুঝবি।”। তখন এই কথাটার মানে না বুঝলেও আজ খুব বুঝি। হ্যাঁ মা, এখন আমি বুঝি মায়েদের ত্যাগ, কষ্ট, মেনে নেয়ার ক্ষমতা। এখন আমি জানি সন্তানের মুখের দিকে তাকালে মায়েরা সব কষ্ট ভুলে যায়। সন্তানের হাসি মায়েদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিস। কারণ দশ মাস পেটে ধরে আমিও সন্তান জন্ম দিয়েছি। এই দশটা মাসের প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত তোমার অভাব কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে মা। তুমি জানো আমি অল্পতেই ভেঙে পড়ি। সামান্য কিছুতেই কেঁদে অস্থির হয়ে যাই। কিন্তু এখন কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও তোমার মতো কেউ এসে কোনো এক অদ্ভুত নিয়মে ভরসা দেয় না, জড়িয়ে ধরে সব অসুখ সারিয়ে দেয় না। এখন জ্বরের ঘোরে ‘মা’ বলে ডাকলেও কেউ পাশে বসে মাথায় পানি দিতে দিতে সাড়া দিয়ে বলে না, “আমি আছি রে মা।” তোমার সেই মেয়েটা এখনো শক্তপোক্ত হতে পারেনি যে! এখনো নিরুত্তাপ হলদে আলোয় বসে খুব একা লাগলে তোমার কাছে চলে আসতে চায়। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে খালি বাসায় হন্যে হয়ে তোমাকেই খুঁজে।

জানো মা? তোমার ছোট্ট নাতনিটা নাকি ঠিক তোমার মতো দেখতে হয়েছে। তার বাবা সবসময় অভিমান নিয়ে বলে মেয়ে তার বাবার মতো কেন হলো না! মেয়ে একদম তার নানুমণির মতো। আর মেয়ে তখন হাত নেড়ে নেড়ে বাবার কথায় সায় দেয়। বাবা, মেয়ে দুজনই তোমাকে কী হিংসা করে দেখেছো মা? তুমি থাকলে এর ঠিক ঠিক জবাব দিতে পারতে ওদের। কেন নেই তুমি? কেন এত দূর করে দিলে ? আমি তো চাইনি তোমাদের ছেড়ে এত দূরে চলে আসতে। তুমি বলেছিলে আমি এখানে সুখে থাকবো। বিশ্বাস করো, আমার কোনোকিছুর অভাব নেই । এদেশে সব আছে। সুখে থাকার জন্য যা কিছুর প্রয়োজন। কিন্তু কোথাও তোমার গায়ের গন্ধটা নেই, সেই পরিচিত চেনা গন্ধটার বড্ড বেশি অভাব। আমি সেই গন্ধ গায়ে মেখে সুখ খুঁজে নিতে পারি না। সেই মমতাময়ী মানুষটার বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি না।

আচ্ছা মা, তোমার সেই অল্পতে ভেঙে পড়া মেয়ে একা কী করে সংসার সামলায়, তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না একবারও? ফোনে কথা বলে আর চিঠি লিখেই কি মন ভরে? কই! একবারও তো বলোনি তুমি আসবে। আমি তো জানি প্রতি রাতে আমার মতো তোমারও মনের অসুখের সাক্ষী হয়ে থাকে অশ্রু ভেজা বালিশ। দেখো না, আমাদের একই আকাশ, একটাই ছাদ। তাও এই বিশাল ছাদের নিচে কেউ কাউকে দেখতে পারছি না, কারোর হাত শক্ত করে ধরতে পারছি না, খুব খুব কাছে বসে অশ্রু ছুঁয়ে ক্ষত সারাতে পারছি না। এত এত না পারার মাঝেও তো বেঁচে থাকতে হচ্ছে। এই ধৈর্য্য, এই মেনে নেয়ার অভ্যাসগুলোই তো তুমি শেখাতে। কখনো বুঝিনি তুমি ছোটবেলা থেকেই বাকি জীবন বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেকটা জিনিস শিখিয়ে এসেছো। অথচ সেই তুমিই জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পাশে নেই। তোমার উপর ভীষণ রাগ হয়, জেদ হয়। মাঝেমাঝে মন চায় সব ছেড়েছুড়ে কোথাও চলে যাই। কিন্তু নিয়ম বড় নিষ্ঠুর, তাই না মা?

যেদিন প্রথম প্রেগনেন্সি রিপোর্টটা হাতে পাই, সেদিন সবার আগে দৌড়ে তোমায় জড়িয়ে জানাতে ইচ্ছে করেছিল। সেই আনন্দের ক্ষণ, আনন্দ অশ্রু, সারা শরীরে শিহরণ জাগানো মুহূর্ত, সবকিছুতে তোমাকে পাশে পাওয়ার তীব্র আকুলতা আমিই তো চেপে রেখেছি। অথচ সেই আমিই তো ছোটবেলায় বৃত্তি পেলে সবার আগে দৌড়ে এসে তোমায় জানাতাম। আর তুমি সারা গালে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিতে। তারপর যখন তুমি রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকতে, আমি তোমার আঁচল ধরে পেছন পেছন হেঁটে তোমায় জ্বালাতাম। রান্নাঘরে ক্লান্ত আর ঘর্মাক্ত মুখেও তোমায় কী সুন্দর লাগতো! আমি আরো একবার মুগ্ধ হয়ে সে দৃশ্য দেখতে চাই মা। ছোটবেলার সেই দিনগুলো আর কখনো ফিরে আসবে না ভাবতেই বুকের বাঁ পাশে চিনচিনে ব্যথা হয়।

যেই মেয়েটাকে তুমি হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় করেছো, সে আজ প্রবাস জীবনে তোমার কাছ থেকে শত মাইল দূরে অন্য কাউকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় করার তাড়ায় ব্যস্ত। যে মেয়ে রাতে বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেয়ে তোমায় শক্ত করে জড়িয়ে রাখতো, সে এখন বজ্রপাতের শব্দে অন্য কাউকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে। তোমার সেই ছোট্ট নুহাটা কত বড় হয়ে গেছে মা। তার একুশ বছরের জীবনে প্রত্যেকটা দিন তুমি তার পাশে ছিলে। শুধু আজ আর নেই। এই চারটা বছর তুমি তার পাশে নেই। হয়তো সব অপূর্ণতা পূরণ হতে নেই। হয়তো মেয়েরা আজীবন মায়ের সাথে থাকতে পারবে না, এটাই নিয়ম। চোখমুখ শক্ত করে আমাকে সেই নিয়ম প্রতিনিয়ত মেনে যেতে হচ্ছে। তুমি ভালো থেকো, মনে করে প্রতিদিন ওষুধ খেও, ইনসুলিনটা নিয়ম করে দিও। বাবার যত্ন নিও।

ইতি
তোমার কলিজার নুহা

বি:দ্র: বাবার আর ভাই এর জন্য আলাদা চিঠি দিয়েছি বলে এই চিঠিতে তাদের কথা লিখিনি। আর শোনো, তোমার নাতনি সেদিন নানু বলেছে জানো? এখন রোজ নিয়ম করে নানা, নানু বলে যায়। তার কিছু ছবি পাঠালাম চিঠির সাথে। ছবিগুলো তার বাবার তোলা প্রিয় ছবি।

পুনশ্চ: তুমি আমার কাছে না আসলেও আমি আর বেশি দিন থাকছি না মা, খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবো তোমার কাছে। প্রিয় দেশ, প্রিয় মাটি আর তোমার গায়ের গন্ধ ছাড়া এখানে আর বেশি দিন থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। সেই দিনের অপেক্ষায়..।

সম্পর্কিত পোস্ট

যদি পাশে থাকো

যদি পাশে থাকো

তাসফিয়া শারমিন ** আজকের সকালটা অন্য রকম। সাত সকালে আম্মু বকা দিলো। মানুষের ঘুম একটু দেরিতে ভাঙতেই পারে। তাই বলে এত রাগার কী আছে ?একেবারে যে দোষ আমারও তাও নয়। মানুষ ঘুম থেকে উঠে ফোনে বা দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখে। কিন্তু আমি উঠি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের আলো দেখে।কে জানে...

কুড়িয়ে পাওয়া রত্ন

কুড়িয়ে পাওয়া রত্ন

অনন্যা অনু 'আমিনা বেগম' মেমোরিয়াল এতিমখানার গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই ওমরের বুকটা ধুক ধুক করতে শুরু করে। ওমর ধীর গতিতে ভেতরে প্রবেশ করে। চারদিকে তখন সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ওমর গত রাতের ফ্লাইটে আমেরিকা থেকে এসেছে। সে এসেই সোজা আমিনা বেগম মেমোরিয়াল এতিমখানায়...

দাদাভাইকে চিঠি

দাদাভাইকে চিঠি

প্রিয় দাদাভাই, শুরুতে তোকে শরতের শিউলি ফুলের নরম নরম ভালোবাসা। কেমন আছিস দাদাভাই? জানি তুই ভালো নেই, তবুও দাঁতগুলো বের করে বলবি ভালো আছি রে পাগলী! দাদাভাই তুই কেন মিথ্যা ভালো থাকার কথা লেখিস প্রতিবার চিঠিতে? তুই কি মনে করিস আমি তোর মিথ্যা হাসি বুঝি না? তুই ভুলে গেছিস,...

৫ Comments

  1. আফরোজা আক্তার ইতি

    নিঃসন্দেহে অনেক সুন্দর লিখেছেন। মায়ের স্নেহের কোনো তুলনাই হয় না কিছুর সাথে। আর স্নেহময়ী মা যদি কাছে থেকেও দূরে থাকে, তবে তার মায়া হতে দূরে থাকার কষ্ট বলে বুঝানোর মত হয় না। পৃথিবীর সব মা ভালো থাকুক এটাই প্রার্থনা। চিঠিটা চোখে পানি এনে দিল।
    অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।

    Reply
  2. Md Rahim Miah

    প্রথমে বলি চিঠির শিরোনামটা দেওয়ার উচিত ছিল।
    চায়-চাই(যেহেতু নিজের কথা বলা হয়েছে আঁচার খেতে)
    যায়নি-যাইনি(নিজের বেলা ই হয়)
    ছোট্ট-ছোট(ছোট্ট শুধু নামের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়)
    চায়-চাই(নিজের মেলা ই হয়)
    ছোট্ট-ছোট
    ওষুধ-ঔষধ

    বাহ্ অসাধারণ লিখেছেন। পড়ে অনেক অনেক ভালো লেগেছে। মায়ের কাছে মেয়ের অব্যক্ত কথাগুলো ফুটে উঠেছে চিঠির মাঝে। আসলে মা এমন জিনিস যার কথা বলে শেষ করা যাবে না। তবে শিরোনাম না দেওয়ার কারণে চিঠিটা অসম্পূর্ণ লাগছে। যাইহোক অনেক অনেক শুভ কামনা রইল আর কিছু ভুল ছিল সেগুলো প্রতি আগামীতে খেয়াল রাখবেন আশা করি।

    Reply
    • মাহবুবা শাওলীন স্বপ্নীল

      ধন্যবাদ রহিম ভাই। কিন্তু আপনার মন্তব্যে কিছু ভুল ছিল, মন #চায়। এখানে আমি নই, মন চাচ্ছে। সুতরাং চাই হবে না। অভ্যাস যায়নি হবে, যাইনি নয়। ওষুধ এবং ঔষুধ যে কোনোটাই সঠিক এবং শুদ্ধ। ছোট্ট যদি শুধু নামের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তো আমি ঠিকই লিখেছে “ছোট্ট নুহা”। নুহা অবশ্যই কারোর নাম। আর শিরোনামের কথা বলেছেন, চিঠিতে শিরোনাম থাকতে কোথাও দেখিনি।
      যাইহোক, আবারও ধন্যবাদ আপনার মতামত প্রকাশের জন্য।

      Reply
  3. Halima tus sadia

    অনেক সুন্দর একটি চিঠি পড়লাম।

    বিদেশে গিয়ে মায়ের জন্য পরাণ কাঁদে।
    মায়েরর তুলনাই হয় না।
    সন্তানের সব আবদার পূরণ করে।
    অন্যায় করলেও সহ্য করে।
    কিন্তু সেই সন্তান যখন মা হয় তখন বুঝে কতো কষ্ট,যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে তার মা’র।

    সকল মাকে ভালো রাখুক।
    শুভ কামনা রইলো।

    Reply
  4. মাহবুবা শাওলীন স্বপ্নীল

    ভালোবাসা নিও ইতি ❤

    Reply

Leave a Reply to আফরোজা আক্তার ইতি Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *