#চিঠি
ফারহা নূর
প্রিয় মা,
পত্রের প্রথমে আমার সালাম নিও। কেমন আছো? আমি জানি আমাকে ছেড়ে তুমি ভালো নেই। ফোনে যখন কথা বলো তোমার চুপচাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলা কথাতেই বুঝি, আমার হেসে হেসে কথা বলা তোমার মন ভেজাতে পারে না। বাড়ি কবে আসবি এইটা আর বলো না, আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। তোমাকে আমার অনেক অনেক কথা বলা বাকি আছে তা এই চিঠিতে লিখে শেষ করা যাবে না, ফোনে বললেও হবে না৷ আমার ভীষণ ইচ্ছে করে তোমার বুকে মাথা রেখে কাঁদি, তুমি তখন বলবে বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদছিস কেন? তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারলেই আমার না বলা কথাগুলো বলা হয়ে যাবে। কতদিন তোমার হাতের রান্না খাই না! কতদিন না কত বছর। নানু বাড়ি গেলে তোমায় ছাড়া ভাত খাব না বলে কী কান্নাকাটি করতাম। আমার জেদের কাছে হার মেনে বাবা তখন তোমার কাছে নিয়ে যেত। বাস্তব এমন কেন মা? তুমি যখন বলো, ” খেয়েছিস খোকা?” তখন আমি হাসি হাসি মুখে বলি, “কত কী সব খাবার খেয়েছি। মা জানো, এসবের নামও পড়তে জানি না”। দামি দামি খাবার বুঝলে, কিন্তু তোমায় কখনো বলা হয়নি আলু, ডালের ভাত খেয়ে দিন পার করা, রাতে উপোস থাকা। তুমি জানলে বলবে, ” চলে আয় খোকা আমার টাকা লাগবে না।” বাবার বন্ধক রাখার জমির টাকা শোধ করব কীভাবে বলো? নীলুর বিয়ে দিতে হবে। তোমার ওষুধ খরচা। বাবার চা দোকান আর কতদিনই বা চলবে! আমাকে আর অত শত বুঝিয়ো না। আমি এখন ছোট খোকা নেই, বড় খোকা হয়েছি। কীভাবে কষ্ট আড়াল করে হাসতে হয় আমি এখন জানি। আমি এখন আর অংকে কাঁচা নেই, অনেক হিসাব কষতে শিখে গেছি। গত ছয়টা ঈদ তোমাদের ছাড়া করেছি। তোমার হাতের সেমাই খাওয়া, কবে আবার খেতে পারব বলো তো? এখানে ঈদ বলে কিছু নেই। ঈদের দিন তুমি যখন বলতে, “কী খেয়েছিস? ঘুরছিস বুঝি?” আমিও তোমায় খুশি করতে বলতাম, “এখন ব্যস্ত আছি, ঘুরতে বের হয়েছি।” কিন্তু জানো মা সারাদিন ডিউটি করতে হতো, প্রবাসে ঈদ বলতে যে কিছু নেই। রাত জেগে ডিউটি করি একটু বেশি টাকার জন্য, বাড়িতে যাতে তোমাদের কষ্ট না হয়। এক বেলা না খেয়ে থাকতে পারলে এক বেলা খাবারের টাকা বেচে যাবে। নীলুর জন্য চকলেট কেনা যাবে। দু’টো জামায় বছর পার করে দিতে পারলে তোমার জন্য বাড়তি টাকা দেয়া যাবে, এগুলো হিসাবের খাতায় কখনো লেখা থাকবে না। এগুলো তোমাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য একটু চেষ্টা। বাড়িতে সবাই বলবে না, ” তোমার খোকা বিদেশ থাকে অনেক টাকা উপার্জন করে। তাহলে তোমাদের এত কষ্ট কেন?” বলবে তো তোমাদের জন্য টাকা পাঠাই না। সবাইতো বলে কবে আসবো দেশে। দেশে আসলে অনেক টাকা লাগবে না বলো। সবাই তো বলবে, “কী এনেছে বিদেশ থেকে?” এখানে আমার ভালো লাগে না মা, কখনো বলিনি তোমায়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, চোখে ভাসে তোমাদের স্মৃতি। এই বিদেশে থাকার চেয়ে দেশে মাটি কেটে খাওয়াও অনেক ভালো মা। অসুখ হলে কেউ নেই দেখার, জ্বরের ঘোরে মা মা বলে ডাকতাম। মাকে পাশে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছেটা কবর দিয়ে চলতে হয়। এখন আর কেউ বলে না খোকা ওষুধ খেয়ে নে, খোকা আমার কাছে আয়। এখন নিজেই নিজেকে ভালো রাখতে শিখে গেছি। এখন বুঝতে শিখে গেছি আমি ভালো না থাকলে কাজ কিভাবে করব, কাজ করতে না পারলে টাকা কিভাবে পাব, টাকা না পেলে তোমাদের সংসার কিভাবে চলবে। এখন অনেক গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারি। শায়েলা কখনো বুঝতেই পারে না আমার মিথ্যে অভিনয়। শায়েলার কত কত আবদার সেসব পূরণ করার জন্য না খেয়েও বলতে হয় খেয়েছি, না ঘুমিয়েও বলতে হয় মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। বাবা হয়ে সন্তানকে দেখার আকুতি কতটা যন্ত্রনার জানি তা শুধু তুমি বুঝবে মা। শায়েলার সাথে ঝগড়া করে কাজ করতে ইচ্ছে হয় না তবু করতে হচ্ছে। তোমাকে ভুল বুঝে কতবার কষ্ট দিয়ে ফেলি মাফ করে দিও মা। একমাত্র স্বার্থহীন ভালোবাসায় তুমি আগলে রেখেছো তা বুঝি তোমার চোখের জলে। বাবাকে কতবার বলেছি এই বয়সে দোকানটা ছেড়ে দিতে। তুমি একটু বুঝিয়ে বলো, আমি আছিতো। আর কত করবে তোমরা? মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে দিয়ে চলে আসি তোমার কাছে। কিন্তু পারি না, দায়িত্বের কাছে এখন বন্দী হয়ে গেলাম বাস্তবতায়। কত কত কথা বলার আছে মা! আমি সব বলবো তোমায়। ডিউটির সময় হয়ে গেছে আজ এখানে শেষ করছি। দোয়া করো তোমার খোকার জন্য।
ইতি,
তোমার খোকা।
অনেক ভালো লিখেছেন ফারহা আপু।
সংসারের জন্য বিদেশ পাড়ি দেয়।
কতো শত আবদার পূরণ করে পরিবারের সবার।
নিজে প্রবাসে শত কষ্ট হলেও কাজ করে,বুঝতে দেয় না।
তবুও পরিবারের সবার মন রাখতে পারে না।
বউকে খুশি করাতে পারে না।
অনেকেই টাকার জন্য দেশে আসতে পারে না।
বিদেশ থেকে দেশে আসলে সবাই জিজ্ঞেস করে কি এনেছো?
সন্তানের হাসি মাখা মুখটা সবারই দেখতে ইচ্ছে করে।
তবুও দেখতে পারে না।
একমাত্র মা ই বুঝে প্রবাসে থাকা সন্তানের কষ্ট।
শুভ কামনা আপনার জন্য।
এতো সুন্দর করে কিভাবে লিখে চিঠি! আমাকে পুরো কাঁদিয়ে দিল। সামনে আব্বু বসে ছিল হাত দিয়ে চোখের পানিটাও মুছতে পারছিলাম না, পাছে দেখে ফেলবে বলে।
পুরো প্রবাসী ভাইদের কষ্ট আয়নার মতো চোখের সামনে তুলে ধরলেন। আমরা দেখছি তারা বিদেশে আছে ভাবছি কতো সুখেই না আছে, বিদেশী টাকা হাতে পেয়ে তারা কতো খুশি। কিন্তু তাদের এই হাসির আড়ালে কান্নাটা আমরা ক’জন জানতে চাই? কত চাপা আর্তনাদ তাদের বুকের ভিতর! চিঠিটা পুরো বাস্তব দিয়ে লিখলেন।
বেচে- বেঁচে।
অনেক অনেক শুভ কামনা আপু।
ওষুধ-ঔষধ
ঈদ-ইদ(বর্তমানে বাংলা একাডেমি ঈদকে ইদ করে ফেলেছে)
সবাইতো-সবাই তো(হয়তো আর নয়তো শব্দ বাদে তো আলাদা বসে)
কিভাবে-কীভাবে(তিন জায়গাতে একই ভুল)
যন্ত্রনার-যন্ত্রণার
আছিতো-আছি তো
বাহ্ বেশ ভালো লিখেছেন বলতে গেলে ।পড়ে অনেক ভালো লেগেছে। আসলে প্রতিটির প্রবাসীর কথা যেন চিঠিতে ফুটে তুলেছেন মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই, একটু সুখে রাখার আশায় আপনজন মানুষকে প্রবাসে পড়ে থাকতে হয় । প্রবাস জীবন যে বড্ড কষ্টের আপনার চিঠিই তার প্রমাণ।তবে চিঠির শিরোনামটা দেওয়ার উচিত ছিল আর শেষে নাম। যাইহোক বানানের দিকে আগামীতে খেয়াল রাখবেন আশা করি আর অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।