বিনয়, নম্রতা এবং সততা
মাহবুবা শাওলীন স্বপ্নীল
একজন পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্য যে নৈতিক গুণগুলোর সংমিশ্রণ থাকা জরুরী, বিনয়, নম্রতা এব্য সততা সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। একজন মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলূকাত’ অর্থাৎ ‘সৃষ্টির সেরা’ হিসেবে তখন-ই গণ্য করা হয়, যখন সে এই অন্যতম গুণগুলোর অধিকারী হয়৷ নয়তো মানুষ এবং পশুর মাঝে কোনো তফাত থাকে না। কথা বলার সময় নিজের আচরণের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে বোঝা যায় একজন মানুষ কতটা বিনয়ী এবং নম্র। আর সমাজের সবার চোখে ‘প্রিয় এবং আদর্শ ব্যক্তি’ উপাধি পাওয়ার যোগ্যতা সবার থাকেনা, কেবল সৎ ব্যক্তিদের থাকে যারা যুগে যুগে নিজের সততায় মুগ্ধ করে এসেছেন পরিবারের ব্যক্তিবর্গ, সহপাঠী, সহকর্মীকে এবং চারপাশের মানুষকে।
শিক্ষিত ব্যক্তি মানেই সুশিক্ষিত নয়। শিক্ষার প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে একজন মানুষকে বিনয়ী করে তোলা। একজন ব্যক্তি নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবি করতে পারবে তখন-ই যখন সে নিজেকে বিনয়ী হিসেবে প্রমাণ করতে পারবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেয়েও একটা মানুষ বিনয়ী হতে পারে। কারণ নম্রতা শেখানো হয় পরিবার থেকেই। একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিও হেরে যায় একজন অশিক্ষিত রিকশাওয়ালার ব্যবহারের কাছে। আমরা একাডেমিক লেখাপড়ায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে অহংকার ধারণ করি, ভুলে যাই নিজেদের অবস্থান, আমরা ভুলে যাই সবাই লাল রক্তের মানুষ, ভুলে গিয়ে বড় হতে চাই। তাইতো কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলেছেন “বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে..”
আমরা কতটুকু বিনয়ী সেটা আমাদের কথাবার্তায়-ই প্রকাশ পায়। একটা মানুষকে অন্যদের থেকে আলাদা করবে তার কথাবার্তা, আচার-আচরণ। অন্যদের থেকে বিশেষ করে তুলবে তার বিনয়ী ব্যবহার। জন্মের পর আমরা সবার কাছেই প্রিয় থাকি। সবার আন্তরিকতা, ভালোবাসা পাই। কিন্তু বড় হওয়ার পর সবার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা থাকেনা। এই যোগ্যতাই তৈরী হয় নৈতিক গুণাবলী থেকে, এই যোগ্যতাই তাকে ‘মানুষ’ করে গড়ে তোলে।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ সম্পর্কে মূল্যবান কিছু কথা বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো মানুষ তারা, যাদের আচার ব্যবহার সবচেয়ে ভালো।” ১
“উত্তম চরিত্রের চাইতে বড় মর্যাদা আর নেই।” ২
তিনি আরো বলেন, “মহত চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্যে আমার আগমন।” ৩
হুট করে কোনো মানুষকে আঘাত করে কথা বলে নিজের শিক্ষা কিংবা পারিবারিক মর্যাদা জাহির করে কেউ কখনো বড় হতে পারেনা। ‘আত্মসম্মান’ দেখানোর জিনিস নয়, ‘আত্মসম্মান’ পাওয়ার জিনিস। তুমি অন্যের কাছে নিজেকে সম্মানিত করে প্রকাশ করতে হবে না, অন্যরাই তোমাকে শ্রদ্ধা দেবে যদি তোমার সে যোগ্যতা থাকে। সবার খোঁজ খবর নেওয়া, সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলা, ভালো ব্যবহার করা, বিনয়ী হওয়া, এই গুণগুলো সবার থাকেনা। যে এই গুণগুলো একবার নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারে, শত্রুও তাকে দেখে মুগ্ধ হয়, তার কাছ থেকে মূল্যবোধ শিখে। ইমাম শাফেই (রাঃ) বলেছেন, “বিনয় এমন এক সম্পদ , যা দেখে কেউ হিংসা করতে পারেনা।” ৪
কোনো মানুষকে মূল্যায়ন করার প্রথম ধাপ হচ্ছে মানুষটির ব্যবহারে নম্রতা। কাউকে ছোট করে কটু কথা বলা কিংবা কাউকে মেজাজ দেখিয়ে খারাপ বিশেষণ দিয়ে ফেলা নম্রতার উদাহরণ নয়। নম্র হতে হলে আগের নিজের আচরণে হও। নিজেকে এমনভাবে গড়ে তোলো, যাতে লোকে তোমাকে মুগ্ধ হয়ে দেখে, তোমার কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনে, তোমার কাছ থেকে শিখে এবং সর্বোপরি তোমাকে আদর্শ হিসেবে মানে।
কটু কথা বলে অথবা খারাপ ব্যবহার করে অন্যকে ছোট করে জিতে গেছো ভেবে নিলে ভুল করছো। বরং নিজের মনুষ্যত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে ছোট করছো নিজেকেই। এই ধ্রুব সত্য কথাটা আমরা জানি, কিন্তু মনে রাখিনা। মহান আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন, “আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে। অতঃপর তাকে নামিয়ে দিয়েছি নীচ থেকে নীচে।” ৫
পৃথিবীতে অনেক উচ্চ পদস্থ, সুদর্শন ব্যক্তি রয়েছে কিন্তু তাদের সবাই আশরাফুল মাখলূকাত হতে পারেনি। কারণ আশরাফুল মাখলূকাত চেহারা কিংবা পদ দিয়ে বিচার করা হয়না, শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা হয় বিনয়ী ব্যবহার এবং নম্রতা দিয়ে। একজন কর্কশ ব্যক্তি সুশ্রী হলেও একজন বিনয়ী কুৎসিত লোকের চেয়ে তার স্থান অনেক নিচে। আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে জ্ঞান আহরণের জন্য যে তাড়া দিই, সে তাড়া তাদের বিনয় শেখার জন্য দিলে প্রজন্ম শুধু শিক্ষিত নয়, সুশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেত! আল হাদীসে আছে, “যে ব্যক্তির স্বভাবে নম্রতা নেই সে সব রকমের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।”
অন্যের মন খারাপে সহানুভূতি না দেখানো, না জেনেশুনে কাউকে অপ্রিয় শব্দ বলা, অন্যের উপর মেজাজ খাটানো, খারাপ ব্যবহারে অন্যের মনে আঘাত দেয়া, এই আচরণগুলো আমাদের পশুর সমতুল্য করে তোলে। আমরা খুব সহজে চটে যাই, অন্যকে কথার তীর ছুঁড়ে আনন্দ পাই, অথচ আমরা ভুলে যাই এই ব্যবহার আমাদের নামিয়ে দিচ্ছে নিচে, আমরা অপ্রিয় এবং ঘৃণার পাত্র হচ্ছি অন্যের কাছে।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বিশেষ করে ফেসবুক নামক সামাজিক মাধ্যমে ঢুঁ মারলেই দেখা যায় কিছু মানুষ নিজেকে বড় জাহির করতে অন্যের গুণগুলোকে হেয় করে যাচ্ছে। বড় ক্রিকেটার কিংবা বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের পোস্টে অশ্লীল এবং অসম্মানজনক মন্তব্য করছে। এই ছোট ছোট জিনিসগুলোই একটা মানুষের পরিচয় বহন করে। যে লোক ছোটবেলা থেকেই মিষ্টভাষী, বিনয়ী সে কখনো অকারণে খারাপ শব্দ উচ্চারণ করে অন্যদের অসম্মান করতে পারেনা। বরং তার বিনয়, নম্রতা দিয়ে অন্যের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অর্জন করে নেয় খুব সহজেই। নিজে ভীষণ সাধারণ হয়ে থেকেও অন্যদের কাছে অসাধারণ হয়ে থাকার ক্ষমতা সবার থাকেনা, কেবল বিনয়ী এবং নম্র মানুষের সে ক্ষমতা থাকে। এই প্রিয় সত্যের সাক্ষী হয়ে গেছেন জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ।
সততা মানব চরিত্রের আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক গুণ, যে গুণ সমাজে বাস করতে গেলে অন্যকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে , পৃথক করে তোলে অন্য দশজন থেকে। সৎ লোক মানেই যে লোকের মাঝে মিথ্যার কোনো আশ্রয় নেই। বর্তমানে আমরা সৎ থাকাকে কঠিনতম কাজের একটি বলে মনে করি। অথচ একটু একটু করে চেষ্টা করলেই দেখা যাবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমাদের খুব বেশি কষ্ট হয়নি!
পরিবার, কর্মক্ষেত্র কিংবা পৃথিবীর যেকোনো স্থানে যেকোনো মানুষের সাথে সত্য বলে সততা ধরে রাখতে সবাই পারেনা। যে একবার এই গুণ নিজের অধিকারে নিয়ে নিতে পারে, তাকে আর কখনো পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। সবার শ্রদ্ধার আসনে জায়গা করে নেয় আজীবনের জন্য। মৃত্যুর পরও মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকা যায় অমর হয়ে। আল্লাহ তাআ’লার কাছেও প্রিয় বান্দা হয়ে থাকে ইহকাল এবং পরকালে। আল্লাহ তাআ’লা এ সম্পর্কে বলেন, “যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্যে রয়েছে অশেষ পুরস্কার।”
পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে, “সৎ কর্ম অবশ্যই অসৎ কর্মকে দূর করে দেয়।”
এছাড়াও বিখ্যাত বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেন, “সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।” ৬
আমাদের ক্ষণিকের জীবনে যেটুকু প্রাপ্তি, যেটুকু সন্তুষ্টি থাকে, তার সবটুকুই নিহিত থাকে অন্যের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাওয়ার মাঝে। আর এই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পাওয়ার মূল অস্ত্র হচ্ছে বিনয়, নম্রতা এবং সততা। আমরা অপ্রিয় শব্দকে তীর বানিয়ে অন্যদের আঘাত না করে বিনয়ী ও মিষ্টভাষী হয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারি খুব সহজেই। এতেই একজন মানুষের সার্থকতা, এতেই একজন মানুষের কৃতিত্ব! জীবনে মানুষ পাওয়া সহজ, কিন্তু সে মানুষ ধরে রাখা কঠিন। মানুষ হারাতে পারে সবাই, ধরে রাখতে পারে কেবল অল্প ক’জন। যারা পারে, তারা-ই সার্থক, যুগ যুগ ধরে সফলতা তাদের দরজায়-ই কড়া নেড়ে গেছে, কড়া নেড়ে যাবে। একটু চেষ্টা করলে আমরাও সে সফলতা ছুঁতে পারি, হতে পারি সুশিক্ষিত, হতে পারি মানুষ, আশরাফুল মাখলূকাত!
তথ্যসূত্রঃ
১. সহীহ বুখারী
২. ইবনে হিব্বান
৩. মুআত্তায়ে মালিক
৪. উইকিপিডিয়া
৫. সুরা আত ত্বীনঃ ৪-৫
৬. উইকিপিডিয়া
অসাধারণ লেখনি।বর্ণনাভঙ্গি ভালো।পড়ে ভালো লাগলো
মনোমুগ্ধকর লেখা।
শিক্ষিত হলেই হয় না।বিনয়ী ও নম্রতা হতে হয়।বিনয়ী না হলে শিক্ষার কোন দাম নেই।
সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে।ভদ্রভাবে কথা বলতে হবে।তবেই না মানুষ হিসেবে গণ্য করা হবে।
শুভ কামনা রইলো।
বিনয়, নম্রতা মানুষকে সমাজের চোখে ছোট নয় বরং বড় হরে তোলে।
সুন্দর একটা লেখা পড়লাম।
শুভ কামনা
বিনয় ও নম্রতা প্রত্যেকের মধ্যে ধারণ করা উচিৎ। এই দুটো মানুষকে অনেক উপরে নিয়ে যেতে পারে।
এব্য-এবং
থাকেনা-থাকে না(না আলেদা বসে)
যাই-যায়(অন্যের ক্ষেত্রে য় হয়)
পাই-পায়
থাকেনা-থাকে না
মহত-মহৎ
পারেনা-পারে না
থাকেনা-থাকে না
পারেনা-পারে না
রাখিনা-রাখি না
দিই-দেয়
যাই-যায়
পারেনা-পারে না
থাকেনা-থাকে না
পারেনা-পারে না
বাহ্ অনেক ভালো লেখা ছিল
বিনয়, নম্রতা ও সততা নিয়ে। তবে লেখিকা একটা জিনিস বেশি ভুল করে ফেলেছে না শব্দের সাথে একসাথে বসিয়ে আর অন্যের ক্ষেত্রে ই ব্যবহার করে। যাইহোক আসলে বিনয়, নম্রতা ও সততাই মানুষের জীবন সুন্দর করে তুলে। নিজের মাঝে আছে কিনা জানি না, তবে রাখার চেষ্টা করি সব সময়। ভালো লিখেছেন, শুভ কামনা রইল।
সুন্দর একটা প্রবন্ধ লিখেছে। একজন মানুষের চরিত্রের সবথেকে উত্তম পন্থা টা তুলে ধরেছেন। সাথে কোরান হাদিসও যুক্ত করেছেন।
বিনয় নম্রতার অভাবে আজ আমরা আশরাফুল মাখলুকাত থেকে নিকৃষ্ট মাখলুকাতে পরিনত হয়ে যাচ্ছি।