আত্মার বন্ধন
প্রকাশিত: জুলাই ২১, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 2,087 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

লিখা:ইমতিয়াজ আহম্মেদ

আপুর স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ স্কুলটাতে শিক্ষকতা করে আপু৷ গতকাল থেকে রাগ করে আছে আমার উপর৷ রাগ করে একটা দানা ও মুখে দেয় নি৷ প্রতিবার এমনটা করে৷ গতকাল রাগটা একটু বেশিই করে ফেলেছে৷ দোষটা আমারই ছিল৷ আর সেই রাগ ভাঙাতেই আজকে আপুর স্কুল পর্যন্ত আসা৷
ভাই-বোন মিলে রিকশা করে ঘুরবো সারা শহর৷ আপুর ফুচকা পছন্দ খুব৷ ঘুরে ঘুরে সেরা সেরা ফুচকার দোকানগুলো থেকেই ফুচকা খাবো৷ এতেই আপুর রাগ গলে যাবে৷ যদিও আপু বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না৷ বিশেষ করে আমার উপর৷ “রাগ” বলাটা ভুল হবে৷ অভিমান বলা যায়৷
অথচ এই মানুষটার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই৷ তারপরও কি নিঃস্বার্থভাবেই না আমাকে ভালোবাসে৷ শুধু আমার জন্যই জীবনটাকে আর সাজায়নি আমার আপুটা৷ আমার মুখের দিকে তাকিয়েই স্বামী হারানো মেয়েটা আর ফিরে যায়নি বাবার বাড়ি৷

– মায়ের আদর কেমন হয়? সেটা জানা হয়নি কখনো৷ মায়ের হাতের ভালোবাসাময় পরশটা পাই নি কখনো৷ সৃষ্টিকর্তা হয়তো চাই নি সেটা৷ আমাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়েই মায়ের জীবনটা বিসর্জন দিয়েছেন৷
স্নেহ-ভালোবাসা যা পেয়েছি সবই আব্বু আর বড় ভাইয়ার কাছে৷ মা হারালেও পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা বাবা আর সেরা ভাইটা আল্লাহ আমাকেই দিয়েছিলেন৷ ভাইয়া আমার চাইতে ৮বছরের বড় ছিল৷ শিশুকালটা ভাইয়ের হাতেই কেটেছে আমার৷ তিল তিল করে আদর,স্নেহ,মমতায় গড়ে তুলেছে এই আমাকে৷
-আর আব্বু ছিল অন্যরকম একটা মানুষ৷ আমার নাম ধরে কখনো ডাকে নি৷ সবসময় “আব্বাজান” বলেই ডাকতেন৷ নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন৷ রোজ সকালবেলা কপালে চুমু দিয়ে ঘুম ভাঙাতেন৷ আব্বুর বুকে মাথা রেখে চুপ করে থাকতাম৷ আর আব্বু কি সুন্দর করেই না রূপকথার গল্প শোনাতেন৷ মাঝে মাঝে আব্বুর কাছে বায়না ধরতাম “আম্মুর গল্প শুনাও”৷
বুঝতে পারতাম আব্বুর গলাটা ধরে আসতো৷ চোখগুলো জলে টলমল করতো৷ আমি আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম আব্বুকে৷

-তারপর আরেকটু বড় হলাম৷ আব্বু স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন৷ সব বন্ধুরা আম্মু অথবা বোনের হাত ধরে স্কুলে আসতো৷ কেবল আমিই আব্বু অথবা ভাইয়ার হাত ধরে স্কুলে যেতাম৷ এত ভালোবাসার পরও আম্মুকে মিস করতাম৷ অভাব বোধ করতাম একটা বোনের৷
বন্ধুরা যখন বলতো, আমার মা আমাকে কত্ত আদর করে৷
আমার আপু আমাকে অনেক আদর করে৷
কথাগুলো শুনে আমার ভিতরটা হু হু করে কেঁদে উঠতো৷ কন্ঠনালীতে এসে কষ্টগুলো ভীড় জমাতো৷ দাঁত মুখ শক্ত করে কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করতাম৷
বাসায় এসে প্রচন্ড মন খারাপ হতো, ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম।
ভাইয়াও হয়তো বুঝতে পারতো আমার কষ্টটা৷ মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করতো না কখনো৷ চুপ করে থাকতো৷ আমি ফুঁপিয়ে কান্না করতাম৷ ভাইয়া পরম মমতায় আমাকে জড়িয়ে ধরে দু’গালে চুমু খেতো৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো৷

-আব্বুকে যখন বলতাম “আম্মুরা খুব ভালো হয় , তাই না আব্বু?”
আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন,
-না রে বাপ! আম্মুগুলো খুব খারাপ হয়৷ একদম খারাপ হয়৷
তখন আব্বুর কথাগুলোই বিশ্বাস করে নিতাম৷ মন খারাপের আভাটা কেটে যেতো৷ নেচে নেচে ভাইয়ার কাছে গিয়ে বলতাম,
-জানো ভাইয়া, আম্মুরা খুব খারাপ হয়৷ একদম খারাপ৷ আমাদের আম্মু নেই ভালোই হয়েছে৷
কিন্তু পরেরদিন স্কুলে গেলেই, আব্বুর কথাটা মিথ্যে মিথ্যে লাগতো৷ সবার মা সবাইকে এত্ত ভালোবাসে৷ আম্মুরা কখনো খারাপ হতেই পারে না৷
মিথ্যে বলার শাস্তি হিসেবে বাসায় এসে আব্বুকে বকা দিতাম৷ কানে ধরিয়ে উঠবস করাতাম৷ আব্বুকে ঘোড়া বানিয়ে আমি রাজকুমার সাজতাম৷ আমার কান্ড দেখে আব্বু আর ভাইয়া হাসতো৷ আমার রাগ হতো৷ স্কুলের ম্যামরা কাউকে শাস্তি দিলে সে কাঁদে৷ কিন্তু আব্বু হাসে কেন? আব্বুরা এমন কেন?

-আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম৷ আগের মত পাগলামোগুলো ততদিনে হারিয়ে গেছে৷ আব্বুর কাছে বায়না ধরি না৷ ভাইয়াকে জ্বালিয়ে মারি না৷ আব্বু মাঝে মাঝে শাসন করে৷ বকা দেয়৷ তখন ভাইয়ার বুকে গিয়ে মুখ লুকোতাম৷ ভাইয়া মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাতেন৷
মাঝে মাঝে ভাইয়াও রাগ করতো৷ আমি চুপ করে থাকতাম৷ ছাদে গিয়ে একা একা কাঁদতাম৷ নীল মেঘের মধ্যে আম্মুকে কল্পণা করতাম৷ আম্মু থাকলে কেমন হতো৷ আম্মুর হাস্যোজ্জল একটা ছবি ছিল৷ ছবিটা ফ্রেম বাঁধিয়ে রেখেছিলাম৷ ঐ ছবিটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম৷ চুমু খেতাম৷ ছবিটা জড়িয়ে ধরলেই মনটা ভালো হয়ে যেত৷
ততদিনে আব্বু আর ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে ঘুমানো ছেড়ে দিয়েছি৷ আমি যে বুঝতে শিখেছি ততদিনে৷ হাউমাউ করে কাঁদিনা আর৷ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদি৷ প্রতিরাতে বালিশ ভেজায়৷ রাত হলেই মা কে মিস করতাম৷

-সেবার ১০ম শ্রেণীতে উঠলাম৷ স্কুলে অভিভাবক সমাবেশ দিলেন৷ আব্বু অসুস্থ ছিল৷ ভাইয়া অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলো৷ ভাইয়ার চাকরী হয়ে গেছে ততদিনে৷ বন্ধুদের কেউ মা, কেউ বাবা আর কেউ বোনকে নিয়ে এসেছিল৷ সেইবার হেডস্যার খুব জোর দিয়েই বলেছিলেন, সবার যেন অভিভাবক আসে৷
আমি কাউকে নিয়ে যেতে পারিনি৷ শাস্তি হিসেবে কয়েক বেত পরেছিলো পিটে৷
চুপচাপ হজম করে এসেছিলাম৷ স্কুলে যাইনি অনেকদিন৷ সারাক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থাকতাম৷ একটু চাপা স্বভাবের ছিলাম৷ কাউকে মন খুলে কিছু বলতাম না৷
আব্বু বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা৷ মাথায় হাত বুলিয়ে যখন জিজ্ঞেস করলেন,
-কি হয়েছে রে খোকা?
আমি আব্বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলাম৷ অনেকদিন কাঁদিনি এভাবে৷ আব্বু বাঁধা দেয়নি৷ শুধু পিটে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,
-সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা৷


-আব্বু ও আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলেন৷ ঐদিকে ভাইয়া মোটামুটি ভালো অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছে৷ আব্বু উঠেপড়ে লাগলেন ভাইয়াকে বিয়ে করানোর জন্য৷ ঘরে নতুন কাউকে দরকার৷ যে এসে ঘরটাকে প্রাণবন্ত করে তুলবে৷ সবকিছু ঘুছিয়ে নিবে নিজের মত করে৷ বাবার খুব শখ ছিল, তার ছেলের জন্য এমন একটা মেয়ে আনবেন৷ যে একদম ঘরের মেয়ের মতই হয়ে থাকবে৷
কিন্তু ভাইয়া রাজি হচ্ছিলো না কিছুতেই৷ নাস্তার টেবিলে বাবা যখন ভাইয়াকে বিয়ের কথা বলতো৷ ভাইয়া আমার দিকে তাকাতো৷ তার চোখে স্পষ্ট শংকা দেখতে পেতাম আমি৷

-সেদিন শরতের বিকেল ছিল৷ ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশপানে চেয়ে ছিলাম৷ দীর্ঘশ্বাসগুলো বের করার জন্য আদর্শ সময় এই গৌধূলী বিকেল৷
পেছনে ভাইয়া এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারিনি আমি৷ কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
-আব্বুর কথা শুনেছিস তো৷ তুই আব্বুকে বলে দিস আমি বিয়ে করবনা৷
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
-কেন রে ভাইয়া?
-আমি বিয়ে করলে তোর কি হবে? বাবার কি হবে?
-বিয়েইতো করবি৷ মরবি তো না৷ আর সব মেয়ে কি খারাপ নাকি?
-তারপরও৷
-তারপরও কি হ্যা? দেখিস তোর বৌ টা একদম লক্ষী হবে৷
-তুই বলছিস তো?
আমি ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
-হ্যা বলছি৷


-কিছুদিনের মধ্যেই ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে গেল৷ ভাইয়াকে ভরসা দিলেও আমার মনের মধ্যে একটা শংকা ছিল৷ মেয়েটা মানিয়ে নিতে পারবেতো আমাদের সাথে?
প্রথম দু’একদিন ভাবির সাথে কথা হয়নি৷ ব্যস্ততার কারণে সাথে একটু সংকোচ আর লজ্জা কাজ করতো৷
ব্যস্ততা কাটিয়ে উঠার পরও তেমন একটা কথা হতো না৷ ঐ যে চাপা স্বভাবের ছিলাম একটু৷ আব্বু ততদিনে মহাখুশী৷ ছেলের বৌ নয় যেন মেয়ে পেয়েছে৷
আমি তখনো মানিয়ে নিতে পারিনি৷ একপ্রকার পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম৷

-দুপুর বেলা বসে বসে টিভি দেখছিলাম৷ ভাইয়া অফিসে আর আব্বু ঘুমাচ্ছিলেন৷ হঠাৎ পেছন থেকে কেউ এসে আমার গালগুলো টেনে ধরলো৷ আমি চিৎকার দেয়ার আগেই মুখটা চেপে ধরে বলল,
-গুলুগুলু একদম চুপ৷ বাবা ঘুমাচ্ছে৷
গুলুগুলু নামটা ভাইয়ার দেয়া৷ ভাইয়া এই নামেই ডাকে আমাকে৷ ভাবিকেও নিশ্চয় ভাইয়া বলেছে৷
ভাবি আমার পাশে এসে বসলো৷ তারপর আমার হাতটা তার হাতের মুঠোই নিয়ে বলল,
-আমি জানি তুই চাপা স্বভাবের৷ তোর ভাইয়া বলেছে৷
দেখ, মায়ের ভালোবাসার সাথে কিছুর তুলনা হয় না৷ অতুলনীয় ভালোবাসা৷ কিন্তু আমি তোকে নিজের ভাইয়ের মত ভালোবাসবো৷ আমারতো কোনো ভাই ছিল না৷ কিন্তু আজ থেকে তুই আমার ছোট ভাই৷ আর তুই আমাকে আপু বলেই ডাকবি৷ “ভাবি” বলে ডাকবিনা কখনো৷ তোর না একটা বোনের অভাব ছিল?
আজ থেকে সেই অভাব আর থাকবেনা৷ তোর সবকিছুই আমার সাথে শেয়ার করবি৷ ভালোলাগা, মন্দলাগা সব সবকিছুই৷
-আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি৷ অল্পতেই আপন করে নিলো মানুষটা৷ মুখ দিয়ে শব্দ বেরোয় না আমার৷ চোখ দিয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পরছে৷ এক মূহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে আমি সুখী৷ খুব সুখী৷
আপু মুচকি হেসে আমার চোখের জল মুছে দেয়৷ গালগুলো হালকা টেনে বলে,
-কাঁদেনা একদম৷ আমার লক্ষী গুলুগুলু ভাইটা৷
আমি কিছু বলতে পারি না৷ জড়িয়ে ধরি আপুকে৷ পেছনে আব্বু এসে দাঁড়িয়েছে৷ আব্বুর মুখে হাসি চোখে জল৷ আমার হাসিমাখা মুখ এই মানুষটার কাছে এক টুকরো স্বর্গের মতই৷

-তারপরের দিনগুলো ছিল আমার জীবনের সেরা দিন৷ অতীতের দুঃখ বেদনাগুলো ধুঁয়ে মুছে গিয়েছিল আমার বোনের ভালোবাসায়৷ পরিবারটা এক টুকরো স্বর্গে পরিণত হল৷ ভাইয়া মাঝে মাঝে মেকি অভিমান করে ভাবিকে বলতো,
-আমার গুলুগুলু আর বাবাটাকে তো নিজের করে নিছো৷ আমিতো কেউ না৷
ভাবি হাতে খুন্তি নিয়ে সেটা নেড়ে নেড়ে বলতো,
-“আমার ভাই, আমার বাবা” এসব যদি আর শুনি! তাইলে চোখ গেলে দিব একদম৷
আমি আর আব্বু হাসতাম এসব কান্ড দেখে৷ আমাদের পরিবারটাকে প্রাণবন্ত করে রাখতো৷ চন্ঞ্চল একটা মেয়ে ছিল৷ আমাকে মনমরা থাকতে দেখলেই, খবর করে দিতো৷ মাঝে মাঝে রাত করে বাসায় ফিরতাম৷ আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকতো৷ রাত জেগে ফোন টিপতাম৷ কিন্তু আপু আসার পর থেকে সেটাও বন্ধ৷ রাত ১২টার পর ফোন নিয়ে নিতো৷ ঘুম না আসা পর্যন্ত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো৷ সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়া৷ সময়মত নামাজ পড়ানো৷ সবকিছুই আপু করতো৷ অসুখের সময় রাতজেগে আমার শিয়রে বসে থাকতো৷ নফল নামাজ পড়তো৷

-বিধাতা হয়তো আরো কিছু পরীক্ষা বাকি রেখেছিলেন৷ আমাদের ছোট্ট সুখের পৃথিবীটা ফাকা করে ভাইয়াকে নিয়ে গেলেন৷ রোড এক্সিডেন্ট এ মৃত্যুটা হয়েছিল৷ মূহূর্তেই থমকে গেল সুখের পৃথিবীটা৷ প্রাণোচ্ছল পরিবারটা শোকের মাতম তখন৷
বোনটার মুখের দিকে তাকানোর সাহস হয়না আমার৷ চন্ঞ্চল মানুষটা একদম নির্জীব হয়ে গেছে৷ ঘরের কোণটাকে একান্ত ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছে৷ আমিও সুখে নেই৷ কলিজার টুকরা ভাইটা এভাবে চলে যাবে ভাবিনি কখনো৷
কিন্তু ভেঙে পরিনি আমি৷ অনূভব করলাম, আমার ও দায়িত্ব অনেক৷ ভাই আর ভাবি নামক বোনটার ভালোবাসার প্রতিদান দেয়ার৷

-আপুকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতাম৷ নিজের হাতে খাইয়ে দিতাম৷ অবুঝ চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে৷ মাঝে মাঝে ঘুরতে বেরোতাম৷ রিকশায় করে সারা শহর ঘুরে বেড়াতাম৷ ফুচকার দোকানগুলো বাদ যায়নি কোনোটা৷ চুলে তেল দিয়ে দিতাম৷ লুডু খেলতাম৷ রাত হলে আমার একটা হাত জড়িয়ে ধরেই ঘুমাতো৷ আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হতে লাগলো৷ কিন্তু আগের চন্ঞ্চলতাটা আর ফিরে আসেনি৷

-একদিন সকাল ঘুম ভাঙতেই পাশে তাকিয়ে দেখি আপু নেই৷ বুকটা ধপ করে ধরে গেল৷ আমাকে না জাগিয়ে আপু উঠেনা কখনো৷
সামনের রুমের সোফাটাতে আপুর মা-বাবা বসে আছে৷ আমার আব্বুর সাথে গল্পে মেতেছে৷ আমার মনটা হু হু করে উঠলো৷ মনে হল, কিছু একটা হারাতে যাচ্ছি আমি৷ তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, আপুকে নিয়ে যেতে এসেছে এরা৷ আমার আব্বু না চাইতেও রাজি হয়ে গেল৷ যাইহোক, মেয়েরতো একটা ভবিষ্যৎ আছে৷ সব বাবা-মা’রাই এটা চাইবে৷ তারপর ও আমার মনকে বুঝ দিতে পারলাম না৷
সারা ঘর খুঁজেও আপুকে পেলাম না৷ নিশ্চয় ছাদে৷
ছাদের কোণটাতে আপু দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ আপু একবার তাকালো আমার দিকে৷ আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
-ওরা কেন এসেছে?
-আমাকে নিয়ে যেতে৷
-ও৷ চলে যাবে তাইলে আমাদের ছেড়ে?
-হ্যা যাবইতো।
আপুর কথাটা একদম ভিতরে গিয়ে লাগলো আমার৷ আর এক মূহূর্ত দাঁড়াইনি আমি৷ কলিজাটা ফেটে যাচ্ছিলো৷ আমার সামনে আমার আপুটা চলে যাবে! এটা মেনে নিতে পারবোনা আমি৷
বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম৷ ফোনটা বন্ধ করে রেখেছি৷ চাইলেও যোগাযোগ করতে পারবেনা৷ অভিমানে ভরে গেল মনটা৷ গৌধূলী বিকেলটা বিষণ্ন বিকেল মনে হচ্ছে৷ মনের আকাশে মেঘের ঘনঘটা৷ একটু পরেই ঝড়ে পরবে৷ চোখের জলগুলো আটকে রাখিনি৷ বাঁধাহীনভাবে গড়িয়ে পরছে৷

-কোনোমতে বাসায় ফিরলাম৷ আব্বু দরজাটা খুলে দিলেন৷ কোনো কথা বলল না৷ রুমে গিয়ে শুয়ে পরলাম৷ আপুর স্মৃতিগুলো খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে৷ অন্যদিন এত রাতে বাসায় ফিরলে বকুনি খেতাম৷ আজ বকুনি দেয়ার কেউ নেই৷
চোখগুলো লেগে আসছে৷ হঠাৎ রুমের লাইটটা জ্বলে উঠলো৷ আব্বু জ্বালিয়েছে বোধ হয়৷ কিন্তু কারো নাক টানার শব্দে চমকে উঠলাম৷
আপু!!!!
অনেকখানি চমকে গেলাম৷ আচমকা দু’টো চড় লাগিয়ে দিলো৷ কিছু বলতেই না দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো৷
কান্নাজড়ানো গলায় বলল,
-কি ভেবেছিস হ্যা? তোকে ছেড়ে চলে যাবো আমি? সবাই তোরমত স্বার্থপর না বুঝলি৷ আমার জীবন থাকতে আমার গুলুগুলুকে ছেড়ে আমি যাব না৷
আমি কিছু বলতে পারিনি৷ শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছি৷

রক্তের সম্পর্কের বাইরে কিছু সম্পর্ক থাকে৷ সেটা আত্মার বন্ধন৷ এই বন্ধনগুলো মাঝে মাঝে রক্তের সম্পর্ক কে ছাড়িয়ে যায়৷
বেঁচে থাকুক আত্মার বন্ধনগুলো৷ বেঁচে থাকুক ভালোবাসাগুলো৷ ভালোবাসা চিরন্তন হোক৷
রক্তের সম্পর্কের বাইরে কিছু সম্পর্ক থাকে৷ সেটা আত্মার সম্পর্ক৷ এই সম্পর্কগুলো রক্তের সম্পর্ক কে ছাড়িয়ে যায়৷
বেঁচে থাকুক আত্মার বন্ধনগুলো৷ বেঁচে থাকুক ভালোবাসাগুলো৷ ভালোবাসা চিরন্তন হোক৷


“সুন্দর সাজানো গোছানো একটা পরিবার ভাঙার পেছনে , পরের ঘরের মেয়েরাই দায়ী” এমন একটা ধারনা আমাদের বর্তমান সমাজে রয়েই গেছে৷
সবকিছুর জন্যই পরের মেয়েটাই দায়ী হয়৷
“হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান নয়, তেমনি সব মেয়েরাই এক নয়৷”
কেউ হয়তো সুখের সংসার ভাঙে, আবার কেউ হয়তো অগোছালো একটা পরিবারকে নিজ হাতে গড়ে তুলে ৷

সম্পর্কিত পোস্ট

যদি পাশে থাকো

যদি পাশে থাকো

তাসফিয়া শারমিন ** আজকের সকালটা অন্য রকম। সাত সকালে আম্মু বকা দিলো। মানুষের ঘুম একটু দেরিতে ভাঙতেই পারে। তাই বলে এত রাগার কী আছে ?একেবারে যে দোষ আমারও তাও নয়। মানুষ ঘুম থেকে উঠে ফোনে বা দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখে। কিন্তু আমি উঠি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের আলো দেখে।কে জানে...

কুড়িয়ে পাওয়া রত্ন

কুড়িয়ে পাওয়া রত্ন

অনন্যা অনু 'আমিনা বেগম' মেমোরিয়াল এতিমখানার গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই ওমরের বুকটা ধুক ধুক করতে শুরু করে। ওমর ধীর গতিতে ভেতরে প্রবেশ করে। চারদিকে তখন সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ওমর গত রাতের ফ্লাইটে আমেরিকা থেকে এসেছে। সে এসেই সোজা আমিনা বেগম মেমোরিয়াল এতিমখানায়...

দাদাভাইকে চিঠি

দাদাভাইকে চিঠি

প্রিয় দাদাভাই, শুরুতে তোকে শরতের শিউলি ফুলের নরম নরম ভালোবাসা। কেমন আছিস দাদাভাই? জানি তুই ভালো নেই, তবুও দাঁতগুলো বের করে বলবি ভালো আছি রে পাগলী! দাদাভাই তুই কেন মিথ্যা ভালো থাকার কথা লেখিস প্রতিবার চিঠিতে? তুই কি মনে করিস আমি তোর মিথ্যা হাসি বুঝি না? তুই ভুলে গেছিস,...

২ Comments

  1. Anamika Rimjhim

    অনূভব-অনুভব*
    খুঁড়ে খুঁড়ে -কুঁড়ে কুঁড়ে *
    সত্যিই যার মা নেই, এই পৃথিবীটা তার জন্য অন্ধকার।শিক্ষণীয় বিষয়টা ভাল ছিল। শুভ কামনা।

    Reply
  2. Halima Tus Sadia

    সত্যিই ভালো লাগলো।
    চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন।
    থিমটা ভালো ছিলো।আর সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন।

    কিছু মেয়ের কারণেই সংসারের সুখ বিলীন হয়ে যায়।আবার কিছু মেয়ের জন্যই সংসারে সুখ আসে।

    সবাইকে বুঝতে হবে।

    তবে মেয়েটার কপালে সুখ সইলো না।
    অল্প বয়সেই স্বামী হারা হলো।

    স্বামীর সংসারে লক্ষ্মীর মতো চললে সবাই আদর করে।আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়।
    আপন বোন হতে হয় না।

    ভালো লাগলো

    বানান ভুল আছে

    চাই নি–চায়নি

    শ্রেণীতে-শ্রেণিতে

    কন্ঠনালীতে–কণ্ঠনালীতে

    চনঞ্চল-চঞ্চল

    শংকা–শঙ্কা

    ফুপিয়ে ফুপিয়ে -ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে

    অনূভব–অনুভব

    হ্যা -হ্যাঁ

    খুঁড়ে খুঁড়ে–কুঁড়ে কুঁড়ে

    হাস্যেজ্জল-হাস্যেজ্জ্বল

    শুভ কামনা রইলো।

    Reply

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *