ফাহমিদা জামান
ভার্সিটি জীবন শুরু করার পর সবচাইতে বেশি অপেক্ষা করছিলাম কখন ট্যুরের সময় হবে! ছোটবেলা থেকে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে কোথাও খুব একটা যাওয়া হয়নি। তাই স্বপ্ন দেখতাম কবে ভার্সিটিতে উঠবো, কবে স্বাধীন হবো আর দূরে কোথাও একটা ট্যুর দেব।
অপেক্ষার প্রহর শেষে এ বছরের শুরুর দিকে, আমরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে চারটি ব্যাচের সর্বমোট ৮০ জন আর ২ জন শিক্ষক মিলে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, ‘সুন্দরবন’ গিয়েছিলাম।
‘সুন্দরবন’ শব্দটি শুনলেই মনের ক্যানভাসে খুব সহজেই ভেসে ওঠে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সুন্দরী গাছ আর হরিণের ছবি। পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার ব-দ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি। প্রায় ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গার মধ্যে ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা জেলায়।
পুরো সুন্দরবনে জালের মতো জড়িয়ে আছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। ১৮৭৮ সালে প্রথমবারের মতো সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৮৭৯ সালে সুন্দরবনের দায়-দায়িত্ব বন বিভাগের উপর ন্যস্ত করা হয়। বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ১৯৯৭ সালে UNESCO সুন্দরবনকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
সুন্দরবনে সাধারণত দু’ভাবে যাওয়া যায়। নিজ উদ্যোগে এবং কোন ট্রাভেল এজেন্সির সাথে। আমরা একটি ট্র্যাভেল এজেন্সির সাথে গিয়েছিলাম। ট্র্যাভেল এজেন্সিটির নাম ছিলো ‘সুন্দরবন হলিডেজ’।
আমরা কুমিল্লা থেকে দুইটি ‘বোগদাদ’ বাস রিজার্ভ করে নিয়েছিলাম খুলনা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। মূলত ঝামেলা এড়ানোর জন্যই। ভ্রমণের শুরুর দিন সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের বাস ভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে ছাড়ে। রাত ৯ টায় আমরা বাসের মধ্যেই খিচুড়ি আর ডিম দিয়ে রাতের খাবার সেরে নিই। আমাদের কপাল খারাপ হবার কারণে সে রাতে আর আমরা ফেরী পাড় হতে পারিনি, তাই পুরো রাতটিই আমাদেরকে মংলা ঘাটে বাসের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল। ভোর হতেই মংলার অপরূপ সৌন্দর্য আর সাথে ১ কাপ চা নিয়ে যখন ফেরীর উপরে উঠে বসলাম তখনি সারা রাতের অপেক্ষার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। সকাল ১১ টায় বাস আমাদেরকে খুলনা স্টেশনে নামিয়ে দেয়। রাস্তা পাড় হয়ে আমরা খুলনা লঞ্চ ঘাটে পৌঁছে আমাদের বুকিং করা এজেন্সির লঞ্চ ‘এম ভি খেয়াপার’ এ উঠে পড়লাম। ১০ মিনিটের মধ্যেই লঞ্চ সুন্দরবনের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করলো পশুর নদী ধরে।
ফ্রেশ হয়েই সকালের নাস্তা খেয়ে নিলাম লঞ্চে। তারপর লঞ্চের ডেকে বসে দু’পাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে অবশেষে প্রায় ১১-১২ ঘন্টা পর শুনতে পেলাম আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এসে পৌঁছেছি।
পরদিন সকাল ৬ টায় সর্বপ্রথম আমাদের দল নিয়ে ‘কটকা অভয়ারণ্য’ দেখতে গেলাম। সুন্দরবন ঘুরতে সাধারণত অনেক নিরাপত্তা মেনে চলতে হয়। অনেক প্রকারের অনুমতি লাগে। বন বিভাগ থেকে দুইজন গার্ড দেওয়া হয়। তারপর ঘুরার অনুমতি দেওয়া হয়। আমাদের এসব কিছু আগে থেকেই ম্যানেজ করে রাখা ছিল।
বনের ভেতর দিয়ে অনেকখানি পথ হেঁটে যখন একদল হরিণের দেখা পেলাম সবাই খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ চারপাশে ঘুরাঘুরি করে আবার লঞ্চে ফিরে এলাম। খিচুড়ি, ডিম, বেগুন ভাজা দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে ‘কটকা সমুদ্র সৈকত’ এর উদ্দেশ্য বের হয়ে পড়লাম। লঞ্চ থেকে আমাদেরকে একটি আপেল ও এক বোতল পানি দিয়ে দিয়েছিল। তখন কারণটা না বুঝলেও নৌকা থেকে নেমে যখন হাঁটা ধরলাম তখনিই বুঝলাম। আমরা যেখানে নেমেছি সেখান থেকে প্রায় ৫০-৬০ মিনিটের মতো হেঁটে কটকা সমুদ্র সৈকতে যেতে হয়।
বনের ভেতরে যদি হঠাৎ করে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পান বিষয়টা কেমন লাগবে? সমুদ্রের কাছাকাছি এসেই যখন গর্জন শুনতে পেলাম বিশ্বাস করুন উত্তেজনায় আর দেরী সইতে পারছিলাম না। সমুদ্রের গর্জন কার না ভালো লাগে, আর তা যদি হয় ভয়ংকর সুন্দরবন কে পিছনে রেখে তাহলে তো কথাই নেই। প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনের কটকা সমুদ্র সৈকত। এর অপর নাম জামতলা সী বীচ। পিছনে সুন্দরবন আর সামনে বিশাল এ সমুদ্র সৈকতটিই সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ।
পুরো সুন্দরবন ভ্রমণে এই জায়গাটির কথা আপনাকে বিশেষভাবে মাথায় রাখতে হবে। গাইড বললো, এই জায়গায় হরিণ, বাঘের আনাগোনাও নাকি প্রবল। আমরা বাঘ না দেখতে পেলেও এখানে বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম। সমুদ্রের তীরে কেউ ফুটবল খেললো, কেউ বা সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। ঘন্টাখানেক এই অসাধারণ পরিবেশে থেকে আবার ফিরে এলাম নৌকায়। ও হ্যাঁ, লঞ্চ থেকে নৌকা করেই আমরা সবগুলো দর্শনীয় জায়গায় গিয়েছিলাম। লঞ্চে ফিরে কাচ্চি বিরিয়ানি খেলাম দুপুরের খাবার হিসেবে। আসলে সুন্দরবন ট্যুরের দুইটি উপভোগ্য বিষয় হলো প্রকৃতি আর খাবার। খাবার নিয়ে কোন অসন্তুষ্টি ছিলো না আমাদের।
খাওয়া শেষে সবাই মিলে আড্ডা দিলাম, কেউ কেউ বিশ্রাম নিলো। ৪ টার সময় আমরা আবার বের হলাম। এবার গন্তব্য ‘শুটকি পল্লী’ বা ‘দুবলার চর’। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে তৈরি এই শুটকির বাজার। হরেক রকমের শুটকির সমাহার এখানে। দামেও অনেক সস্তা। আমরা অনেকেই শুটকি কিনলাম, সময় নিয়ে তীরে হেঁটে বেড়ালাম। সূর্যাস্ত দেখে আবার লঞ্চে ফিরে এলাম। সন্ধ্যায় সবাই মিলে একসাথে নাচ, গান, খেলা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মাধ্যমে সন্ধ্যাটা উপভোগ করে রাতের খাবারের জন্য যখন নিচে গেলাম, যেয়ে পুরোই অবাক হয়ে গেলাম। রাতের খাবারের জন্য গ্রিল আর পরোটা রয়েছে। নিজের পছন্দের খাবার দেখে আনন্দের আর সীমা রইলো না।
খাওয়া শেষ করে লঞ্চের ডেকে বসে প্রকৃতির বাতাস উপভোগ করছিলাম। ঝড় আসবে আসবে করছিলো। আহা, সেই রাতটা! খুব বেশিই উপভোগ্য ছিল। সারাদিন দৌড়াদৌড়িতে সবাই কম বেশি ক্লান্ত থাকায় তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে লুচি, সবজি, ডিম দিয়ে নাস্তা খেয়ে বের হয়ে গেলাম ‘হিরণ পয়েন্ট’র উদ্দেশ্য।
এই জায়গাটি মূলত নৌবাহিনীর অধীনে। শুরুতেই একটি রিসোর্ট রয়েছে। একটি পাড় বাঁধানো পুকুর ঘাট আর ভেতরে হাঁটলে চোখে পড়বে সুন্দরবনের সমস্ত জানা – না জানা অনেক ইতিহাস। হিরণ পয়েন্ট থেকে ফিরে লঞ্চের ছাদে উঠে বসলাম সবাই। পুরো ভ্রমণ নিয়ে সবাই কথা বলছিলাম। কেউ কেউ গান শুনছিলো। তার ফাকে লটারি ও হলো। কেউ কেউ আবার সেই লটারির কল্যাণে গিফটও পেয়েছিলো। আমিও বেলুন খেলা দিয়ে একটি গিফট পেয়েছিলাম।
দুপুরের খাবার শেষে আমরা করমজল গেলাম। করমজল না গেলে বানরের বান্দরামি কি জিনিস আমরা হয়তো বুঝতে পারতাম না। অনেক বেশি বানর ছিল এখানে। বানরকে ভয় দেখাতে গিয়ে আমাদের এক বন্ধু নিজেই ভয়ে দৌঁড়! এক আপু তো ভয়ে কান্নাই শুরু করে দিয়েছিল। করমজলে একটা চিড়িয়াখানা রয়েছে। এই চিড়িয়াখানাতে আছে হরিণ, কুমির আর অসংখ্য বানর। করমজলে মাংকি ট্রেইল পাড় হয়ে একটা ওয়াচ টাওয়ার গেলাম, যেখানে উঠে আমরা পুরো সুন্দরবনকেই যেন এক নজরে দেখে ফেললাম।
সূর্যাস্ত দেখে আবার ফিরে এলাম লঞ্চে। সুন্দরবন ভ্রমণ মূলত এখানেই শেষ। এবার আমাদের খুলনার দিকে ছুটে যাওয়ার পালা। আসার সময় যেই পথ শেষই হচ্ছিলো না আর ফিরার সময় মনে হলো সেই পথ খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। সবার মন খারাপও লাগছিলো খুব। ইচ্ছে করছিলো আর একটা রাত যদি থাকতে পারতাম। কিছুতেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। তবুও কি আর করার। ফিরতে তো হবেই।
রাত ১০ টা নাগাদ আমরা খুলনা লঞ্চ ঘাটে পৌঁছালাম। আমাদের বুকিং করা বাস আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিল। রাতের খাবার লঞ্চ থেকে দিয়ে দিয়েছিল সবার জন্য। খাবার নিয়ে আমরা বাসে উঠে পড়লাম কুমিল্লার জন্য। আবারো মাওয়া ঘাটের ফেরীর জন্য অপেক্ষা। পুরো ১৬ ঘন্টা ঠায় বাসে বসে থেকে আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল তখন। কিন্তু সন্ধ্যায় যখন মাওয়া ঘাটের গরম গরম ইলিশ ভাজা আর বেগুন ভাজা সাথে পোড়া শুকনো মরিচ দিয়ে গরম ভাত খেতে বসলাম… আহা! কোথায় গেল সেই ১৬ ঘন্টা বাসে বসে থাকার ক্লান্তি, টেরই পেলাম না।
খাওয়া শেষ করে বাসে আবারো উঠে পড়লাম সবাই। রাত তখন প্রায় রাত ১১ টা। কুমিল্লা পৌঁছে গেলাম আমরা।
যদি কেউ সুন্দরবন যান, দয়া করে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না। কটকা বীচ আর পানিতে অনেক প্লাস্টিকের বোতল, প্যাকেট দেখেছিলাম। সুন্দরবন আমাদের সম্পদ, এই সম্পদ রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের। আরেকটা অনুরোধ, দয়া করে কোথায় লিখালিখি করবেন না বাচ্চাদের মতোন। সুন্দরবন ওয়াচ টাওয়ারের আঁকাআঁকি গুলো দেখে সবার সামনে নিজেই খুব লজ্জা পেয়েছিলাম।
আসলে, সুন্দরবন নিয়ে বলতে গেলে বলবো ‘সুন্দরবন’ একটি নেশার নাম। এর কাছাকাছি গেলেই ঘোরে পড়ে যেতে হয়। আরো কয়েকবার সুন্দরবন গেলেও হয়তো এর রূপ প্রাণভরে দেখার স্বাদ আমার মিটবে না।
সুন্দরবন তার রূপ আপনাকে প্রাণভরে দেখানোর পাশাপাশি আপনার অনুভবের দরজাটাও যেন উদারহস্তে খুলে দেয়, আর এটাই সুন্দরবনের বিশালতা। সুন্দরবনের অসামান্য সব মুহূর্তের গল্প গোটা জীবনেও বলে শেষ করতে পারবোনা কিংবা সুন্দরবনে হয়তোবা আমার কোন গল্পই নেই। শুধুমাত্র সুন্দরবনের ঐ আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তগুলোর মাঝেই তৃপ্ত হয়ে আমি বেঁচে ছিলাম কয়েকটা দিনের জন্য।
লিখাটা সুন্দর হয়েছে।অনেকদিন ধরে ইচ্ছা সুন্দরবন বেড়াতে যাব।এটা পড়ার পর ইচ্ছাটা আরও বেড়ে গেল।
অসাধারন লেখনি। লেখককে ধন্যবাদ।
একেবারে মনোমুগ্ধকর একটা ভ্রমণকাহিনী পড়লাম। লেখিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এত্তো সুন্দর একটা ভ্রমণকাহিনী আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। খুবই সুন্দর লিখেছেন। লেখনী অসাধারণ ছিল। পড়তে পড়তে আমি ডুবেই গিয়েছিলাম সুন্দরবনের বিচিত্র সৌন্দর্যে, চমৎকাত এক্তা ভ্রমণে। অবশ্য খাওয়ার কথাগুলো পড়ার সময়ও বেশ লোভ লেগেছিল। সবই লোভনীয় আর আমার পছন্দের হাববার ছিল। হি হি হি।
এতোবড় লেখায় বানানের কোনো ভুল প্রায় নেই বললেই চলে। লেখিকা তার লেখার প্রতি খুবই যত্নশীল তা বোঝাই যাচ্ছে।
ফাকে- ফাঁকে।
শুভ কামনা রইল।
ভ্রমনকাহিনীটা বেশ মজারই ছিলো।
পুরো গল্পে আমি যেটা লক্ষ করেছি সেটা হলো লেখিকার বাক্য বিশ্লেষণীর প্রতিভা। এরকম সহজ সাবলীল এবং সুশৃঙ্খলভাবে রচিত ভ্রমনকাহিনীগুলো বেশ প্রশংসার দাবি রাখে।
সবিশেষ যেটা বলবো সেটা হলো,লেখায় বানান ভুল ধরা আমার কর্ম নয়।
শুভ কামনা রইলো।
লেখাটি প্রশংসার দাবিদার। লেখিকা তার লেখার প্রতি যত্নশীল ছিল তা লেখনী দেখলেই বুঝা যায়।
ধন্যবাদ লেখিকাকে এমন সুন্দর একটি লেখা উপহার দেবার জন্য।
বেশ ভালো লাগলো। তবে কিছু তথ্য দেয়া ছিল যেটার তথ্যসূত্র ছিলনা। তাছাড়া স্থানটির ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্য নিজের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়েনা। আর কিছু সাধারণ বানানে সতর্ক থাকা উচিত।
ফেরী পাড় ~ ফেরী পার
রাস্তা পাড় ~ রাস্তা পার
শুরুরদিন ~ শুরুর দিন
সী বীচ ~ সি বিচ [ইংরেজী শব্দের বাংলা উচ্চারণে ই-কার হয়]
তখনিই ~ তখন-ই/তখনি
বান্দরামি ~ বাঁদরামি