নাম: সে এক আজব শহর আহারে!
লিখা: মাহফুজা সালওয়া।
বেশীকাল আগের ঘটনা নয় অবশ্য।
সাল ২০১৬, ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ ।
বাবা ঘোষণা করলেন, ”এবার তবে সালওয়া কে নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছি!”
আমার খুশি দেখে কে!
সামান্য ঢাকা যাওয়া নিয়ে এতো উচ্ছ্বাসের যৌক্তিক কারণ আপনারা খোঁজে পাওয়ার কথা নয়, স্বাভাবিক। আসলে ব্যাপার টা ঐ “হাবড়া’র পুল” পার না হতে পারার মতোই। সিলেটেই জন্ম, এখানেই মানুষ, আর অভিজ্ঞতার পরিধি ও এই সিলেটেই সীমাবদ্ধ!
তাই স্বাভাবিক ভাবেই অদেখা শহর নিয়ে কৌতূহল ছিলো।
আর বই-পত্রিকায় নিত্য এই ব্যস্ত শহর নিয়ে এত এত পড়তাম যে, রবীঠাকুরের ভাষায় আমাকে এভাবে বিষেশায়িত করা যাবে , “আর আমি ছিলাম তৃষ্ণার্ত”।
আসলে ঠিক ভ্রমণের জন্য না, এক জরুরী কাজ বলা যায়!
সেবার গণিত অলিম্পিয়াডে যখন সেকেন্ডারি লেভেলে আঞ্চলিক থেকে নির্বাচিতদের মাঝে আমিও একজন ছিলাম, তখন আমার খাতির বেশ বেড়ে গিয়েছিল! সেই সাথে এক টানটান উত্তেজনা!
” সেন্ট জোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল ” এ অনুষ্ঠিত গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠানে ডাক পড়েছে!
নাহ, ওতো বড় প্লাটফর্মে আমার মতো ক্ষুদ্র কেউ অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে, সেটাই অনেক। তাই আন্তর্জাতিকের জন্য নির্বাচিত হওয়াটা আমার জন্য মুখ্য ছিলনা। প্রস্তুতি ও নাই বললেই চলে আরকি!
আমি তখন এক আজব শহর দেখার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত ষোড়শী এক!
যাইহোক, আমার দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর অপেক্ষার প্রহর যখন শেষ হলো, খুব সম্ভব ৯ ফেব্রুয়ারী রওয়ানা দিলাম আমরা।
আমি এবং আমার বাবা।
অবশ্য বাড়ি হতে স্টেশন পর্যন্ত প্রায় দেড় ঘন্টার বাস জার্নিতে আমাদের সহযাত্রী ছিলেন, আমার প্রাণপ্রিয় কয়েকজন শিক্ষক (স্বপরিবারে) এবং একডজন জুনিয়র!
তাঁরা অবশ্য কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন।
যাইহোক, আমাদের বাস আনুমানিক সন্ধ্যা ৭.৩০ নাগাদ “কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশন ” এ পৌঁছাল।
ঢাকাগামী ট্রেন রাত ১০ টায় আসার কথা।
অপেক্ষায় ছিলাম আমরা।
এরই মাঝে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে অন্য ট্রেনটা মাত্র স্টেশন ছেড়েছে।
ভীষণ একা লাগছিল।
অপেক্ষা করা কতটা বিরক্তিকর একটা জিনিস, সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম।
শীতের রাত।
১০.৩০ বাজে, ট্রেন আসার গন্ধ নেই কোনো। বারবার ঐ রেলপথ ধরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছি , ট্রেন আসছে কিনা?
কিন্তু শীতের কুয়াশার কারনে অল্পদূরের কিছুও দেখা সম্ভব হচ্ছেনা।
খাতা-কলম পাশে থাকলে হয়তো লিখে ফেলতাম, “ঐ অল্প দূরের টিমটিম করে জ্বলে থাকা বাতিটা সাক্ষী, প্লাটফর্মের তুলনামূলক নিরব জায়গায় শুয়ে থাকা কুকুরটা ও তৃষ্ণার্ত। তার ও দুঃখ আছে, হাসি আছে, আবেগ আছে৷ তারও একবুক ইচ্ছে আছে, হঠাৎ করেই হারিয়ে যাবার। যেখানে গেলে আর কখনো ক্ষুধায় তাকে কাতর হতে হবেনা। থাকবেনা কোনো জবাবদিহিতার ভয়। তারও হয়তো বড্ড বেশী ইচ্ছে হয়, হুট করে ট্রেনের বগিতে উঠে পড়তে, আর তারপর…..
তারপর হঠাৎ করেই ট্রেন এলো, আমার ধ্যান কাটলো, তড়িঘড়ি করে ট্রেনে উঠে পড়লাম।
পাশাপাশি সিটে আমি আর বাবা বসে আছি।
বাবা সেই তখন থেকে উনার মুঠি তে আমার হাত ধরে আছেন।
কি জানি, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় দানা বেঁধেছে হয়তো!
আমার ভীষণ ভালো লাগছে।
বলতে গেলে সেই প্রথমবার দূরপাল্লার ট্রেন চড়লাম!
জানালার পাশের সিটে বসে রাতের প্রকৃতি উপভোগ করা, সে এক স্নিগ্ধ অনুভূতি!
একে একে নদী-পাহাড়, গ্রাম-নগর পাড়ি দিয়ে অবশেষে এসে পৌঁছলাম স্বপ্নের শহরে।
তখনো ফজরের আজান হয়নি।
ট্রেন এসে থামলো কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। আহ্, কত্তো বড়ো স্টেশন। এ মাথা ও মাথা দেখতেই যেনো সব তালগোল পাকিয়ে যায়।
তারপর দেখতে পেলাম, স্টেশনের প্লাটফর্মে শুয়ে আছে সারি সারি মানুষ।
এদের কেউবা এতিম শিশু, কেউ বিধবা নারী, কেউ হয়তো ভাগ্যের অতি নির্মমতায় পাগল বলে খেতাব পেয়েছে।
খারাপ লাগলো ভীষণ, এছাড়া আর কিইবা করার ছিলো আমার?
যাইহোক স্টেশন থেকে বেড়িয়েছি মাত্র। বাবার হাত ধরে ধরে হাঁটছি ঢাকার রাজপথে।
এমন সময় শুনলাম, “আসসালাতু খাইরু মিনান না’ উম “।
এক পরম প্রশান্তি যেন আমার চোখ-মুখ, সমস্ত অন্তরাত্না স্পর্শ করল।
বাবা বললেন, ” চলো আম্মা, আমরা নামাজ আদায় করি”।
আমি বললাম “জ্বি না, এ কি করে হয়? আমি একজন মহিলা আর সেখানে মহিলাদের নামাজের কোনো ব্যবস্হা নেই”।
বাবা: ” তা বলে নামাজ ক্বাযা করবে?”
অগত্যা মসজিদের ওযুখানায় ওযু সেরে মসজিদের বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে আমার মহান প্রভূর শোকর গুজার করলাম।
ঘড়িতে তখন হয়তো ভোর ছয়টা বাজে।
নাসিমা মেম খবর দিচ্ছেন, যেতেই হবে উনার বাসায়। বেশী দূর না অবশ্য। হেঁটে গেলে স্টেশন থেকে মিনিট তিন-চার লাগবে হয়তো।
তিনি বলেছিলেন, “সালওয়া তোমার বাবাকে নিয়ে চলে আসো৷ এখানকার সবথেকে বহুতল ভবনের নয় তলায় আমাদের বাসা।আশা করি চিনতে কষ্ট হবেনা।”
সেদিন আমি মেমে’র বাসার বেলকুনি থেকে প্রথম সূর্য উঠা, সকাল হওয়া দেখেছিলাম ।
আমার মনে হচ্ছিলো লিখে ফেলি, “এ শহরের পরতে পরতে আছে কেবল মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা! ”
তারপর হয়তো আমাকে লিখতেই হতো, “নাসিমা মেমে’র মতো মানুষ হয়না। আচ্ছা, এ মানুষটা আমাকে কেন এত ঋণী করে দিচ্ছে?”
তখন আপন মনকে বুঝ দিতাম, “আমি তার খুব প্রিয় ছাত্রী বলেই হয়তো! ”
তারপর সকাল ৮.০০ টার আগেই রওয়ানা দিলাম মোহাম্মদপুরের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য “সেন্ট জোসেফ স্কুল “।
স্বীকার করতেই হবে, মোহাম্মদপুরে কাটানো সেই দু’টি দিন আমার এই স্বল্প জীবনের অনেক স্বরনীয় দিনগুলোর একজোড়া!
আমার এখনো মনে পড়ে, সেদিন এক্সাম হলে বসে আছি৷
১০০ জন হবে হয়তো এক রুমে। অথচ কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছেনা, সবাই একমনে খাতার দিকে চেয়ে জটিল জটিল সব অঙ্ক করে যাচ্ছে ই!
আমার সিট আবার সবার সামনে পড়েছিল। তো, একজন ভাইয়া (যিনি হল গার্ডে ছিলেন) উনি এসে আমার সাথে অনেক্ষণ কথা বললেন, অনেক কিছু জানতে চাইলেন। চার ঘণ্টার পরিক্ষায় যখন স্টুডেন্ট দুই ঘণ্টায় পরিক্ষা শেষ ঘোষণা করে তখন স্যারেরা বিশেষ অবাক হয় বটে!
ছুটে এলেন সেই ভাইয়া, আমাকে বললেন, ” এখানে নির্ধারিত সময়ের আগে কারও খাতা নেয়ার নিয়ম নেই। তুমি বরং রিভাইজ দাও।”
তারপর, আমার খাতা খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে বললেন, “আমার মনে হয় খারাপ দাওনি তুমি।”
আমি হাসলাম, আসলে যে কয়টা অঙ্ক পাড়তাম, সেগুলা অবশ্যই কষেছি, এবং বাকিগুলোর ব্যপারে কেবল এতোটুকুই জানতাম, “এতো কঠিন অঙ্ক বোধহয় আমার দাদা ও দেখেনি। ”
তারপর পরিক্ষা শেষ হওয়ার কতক্ষণ আগে সেই ভাইয়া আমার কাছে এলেন, কি জানি কি ভেবে আমাকে বললেন, “সালওয়া, তুমি কখনো বদলে যেওনা, যেরকম আছো, ওরকম ভালো মেয়ে হয়েই থেকো।”
আমি বুঝতে পারিনি আমার কি বলা উচিত?
শুধু অল্প হেসে বলেছিলাম, “কখনো সিলেট গেলে আমার বাড়িতে আসবেন।”
যাইহোক, সেবার ঢাকা অভিজ্ঞতার আরেক পাওয়া ছিলো , দেশবরেণ্য অনেককে দেখার সুযোগ হয়েছিলো আমার। দেখা হয়েছিল বড় বড় ভার্সিটির প্রফেসরদের সাথে।
দেখা হয়েছিলো ড. জাফর ইকবালের সাথে।
দেখেছিলাম বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কতক খেলোয়াড়, মহিলা খেলোয়াড়দের।
উপভোগ করেছিলাম রোবিকস কিউব প্রতিযোগীতা, সাইক্লিং আরও কত কি!
তারপর আমার প্রিয় “সিসিমপুর” এর হালুম, টুকটুকি, শিকু, ইগরি এদের সরাসরি দেখে তো আমি প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলাম!
যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে৷ মোহাম্মদপুরের একটা আবাসিক হোটেলে কাটিয়ে দিলাম একটি রাত। পরদিন সকাল হতেই বাবা আর আমি হাঁটা শুরু করলাম। সে হাঁটা, যার মাঝে নেই কোনো ক্লান্তি। যে হাঁটার মাঝে আছে কেবল কিছু নির্মল প্রশান্তি!
ঢাকা শহরের কত গলি ধরে হাঁটলাম আমরা। আরও কিছু প্রোগ্রামে এটেন্ড করতে হলো।
তারপর জাতীয় সংসদ, জাতীয় মিউজিয়াম… সবকিছুর নামও আমার স্মৃতিতে রয় নি।অনেক অনেক অভিজ্ঞতা জমলো আমার। সব হয়তো লিখে প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তারপর এক ঝুলি গল্প নিয়ে আমি ফিরতি ট্রেনে চড়ে বসলাম।
নিঃসন্দেহে আমার জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে এটিও একটা।
ভ্রমণ পিপাসা আমার রন্ধ্রে গেঁথে রয়েছে।
আর আমার সুপার হিরো বাবা নিজেই যেখানে সফরসঙ্গী, তবে তো আর কথাই নেই!
আজও সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই অজান্তে গুনগুনিয়ে গান ধরি, ” সে এক যাদুর শহর আহারে….”
‘১০.৩০ বাজে, ট্রেন আসার গন্ধ নেই কোনো।’ এই লাইনটা এমন হলে ভালো হতো, ‘১০.৩০ বাজে, ট্রেন আসার সাড়াও নেই কোনো।’
নিরব — নীরব
কুকুরটা ও — কুকুরটাও
তার ও — তারও
মুঠি তে — মুঠিতে
বেড়িয়েছি — বেরিয়েছি
অনেক্ষণ — অনেকক্ষণ
পরিক্ষা — পরীক্ষা
দাদা ও — দাদাও
ঢাকা শহর নিয়ে লেখা ভ্রমণ কাহিনীটা আমার হৃদয়ের মাঝে জায়গা করে নিলো। আজীবন মনে থাকবে এই লেখাটির কথা। অসাধারণ লিখেছেন।
শুভ কামনা।
অনেক ভালো ছিলো কাহিনীটি।সহজ এবং সাবলীল।তবে তবে লেখার মাঝে শহর সম্পর্কে আজব কোনো তথ্য পাইনি।তাই শিরোনাম অন্যকিছু ভাবলেও ভাবতে পারেন। শুভকামনা নিরন্তর।
আপনার নতুন পাঠক আমি; প্রশংসার বৃষ্টিতে ভাসাতে ইচ্ছে করলেও ভান্ডারে পর্যাপ্ত শব্দ না থাকায় শুধু “অসাধারণ”লিখেই ক্ষান্ত হলাম।
বুঝে নিয়েন প্লিজ????