ভয়
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০১৭
লেখকঃ vickycherry05

 2,391 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ vickycherry05

ভয়

লেখক:  নূর এ জাহান বিলকিস

আলহাজ্ব আবু বক্কর খান সাহেবের মনটা খুবই বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তিনি এই এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। আসলে তিনি “আলহাজ্ব” না, তার নামের শেষে “খান”ও ছিল না, সিদ্দিকী ছিল, কিন্তু যুদ্ধের শুরুতেই তিনি পাকিস্তানি মনিবদের খুশি করার জন্য নাম পালটে “খান” হয়ে গেছেন। একবার উমরাহ করেছিলেন, সেইটাই গ্রামে হজ্ব বলে প্রচার করে আলহাজ্ব হয়ে গেছেন। পাকিস্তান ভেঙ্গে দুইভাগ করার যে ষড়যন্ত্র চলছে, তিনি তার ঘোর বিরোধী। কেন একটি মুসলমান দেশ ভেঙ্গে দুই টুকরা করা হবে তিনি তা ভেবে পান না। এটা যে হিন্দু দেশ ভারতের একটা চাল এটা বাঙালি বুঝতে পারছে না, বড়ই আফসোস। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিশেষ করে গতকাল রাতে রহিম মোল্লার কথা শুনে তিনি কিছুটা হলেও ভড়কে গেছেন। আসলেই কি মুক্তিযোদ্ধা নামের বাঙালিগুলো পাকিস্তানি কোনো ক্যাম্পে আক্রমণ করার সাহস করবে?

তিনি তার বাড়ির সামনের বড় আমগাছটার নিচে একটা মোড়ায় বসে আছেন আর তার স্ত্রী রাজিয়া তার চুল আর দাড়িতে মেহেদি মাখিয়ে দিচ্ছেন। তাকে ফেনী ক্যাম্পের বড় সাহেব লেফটেন্যান্ট কর্নেল তিরবিজ খান ডেকে পাঠিয়েছেন, সেজন্যই এই প্রস্তুতি। এর আগে কখনোই একা তাকে যেতে বলা হয়নি, অন্যান্য শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মিটিং এ কয়েকবার তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। অত্যন্ত বদমেজাজি এই কর্নেল পুরো এলাকায় একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। আশেপাশের কোন গ্রামেই কোন মানুষজন নেই, অধিকাংশ বাড়িঘরই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, শত শত অল্পবয়সী মেয়েদের ধরে এনে বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

খুঁজে পাচ্ছেন না, তবে রহিমের কথাগুলোই তার মনে ভাসছে। হয়ত এব্যাপারেই কিছু জানতে চাইবে কর্নেল সাহেব। সাথে রহিম মোল্লাকে নিতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু তাকে খবর দিলেও সে আসেনি। সে নাকি শিমুলতলী থেকে এখনো ফিরে আসেনি। আসলে সেটা যে মিথ্যা, সেটা তিনি ঠিকই বুঝতে পারছেন। তার চিন্তাটা এজন্যই আরো বেড়েছে। বিপদে আপদে কাছের মানুষ দু’একটা সাথে থাকলেও ভরসা পাওয়া যায়।

তিনি যে বিচলিতবোধ করছেন সেটা তার আচরণে বোঝা যাচ্ছে। সারাক্ষণ উসখুস করছেন, ঠিক আরাম পাচ্ছেন না। হঠাৎ করেই রেগে গিয়ে তিনি উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “কী কর, ঠিকমতো মেন্দিটাও লাগাইতে পারো না?”

রাজিয়া তার অস্বস্তিটা টের পাচ্ছেন, তিনি নরম সুরে বললেন, “আফনে কী নিয়া এতো চিন্তা করতেছেন?”

রাজিয়ার নরম স্বরটা শুনে তিনি তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলেন, “না, তেমন কিছু না। বর সাব যে কেন ডাইক্যা পাডাইল, ঠিক বুঝতাম পারতাছি না।“

“মুক্তিবাহিনীগর কাজ কাম দেইখ্যা বর সাবের মাথা বিগরাইয়া গ্যাছে।“ বলার সময় তার স্ত্রী মুখের হাসিটা লুকাতে পারলেন না।

“হাসো ক্যান, হ্যাঁ, এর মইধ্যে আনন্দের কী পাইলা? ওই দুই পইসার মুক্তি শালারা মনে করতেছো আমাগো পাক বাহিনীরে হারাইয়া দিব?”

“হারাইয়া দিবো না, কাচা খাইয়া ফালাইবো।“ খুবই দৃঢ়স্বরে রাজিয়া বলে তার মেহেদি লাগানো বন্ধ করে তার স্বামীর দিকে তাকালেন।

আবু বক্কর সাহেব বিস্মিত হয়ে তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তিনি জানেন, তার শান্তি কমিটির কাজ তার স্ত্রীর পছন্দ না। তবে সেটাকে তিনি মোটেও তোয়াক্কা করেন না। মেয়েমানুষের বুদ্ধিতে দুনিয়া চলে না।

তিনি খুবই বিরক্ত হয়ে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, “মুক্তিরা যুদি এগোর উপরে আক্রমণ করে, তুমি মনে হয় খুশি হইবা?”

রাজিয়া কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।

“কী ব্যাপার, কতা কওনা ক্যা, খুশি হইবা?”

কিছুটা ঝুঁকে তার স্বামীর কাছে মুখটা এনে ধীর কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে রাজিয়া বললেন, “চেয়ারম্যান সাব, যুদি বাচতে চান, পালান। যত দূরে পারেন যান গিয়া। এরা আফনারে হেগোর চাইতেও বেশি টুকরা কইরা কাটবো।“ বলে তিনি মেহেদি লাগানো শেষ না করেই উলটো ঘুরে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলেন।

“খারাও রাজিয়া… তুমি কী কইলা? খারাও কইতেছি… ওই শালার মুক্তিরা আমার বা** ডাও ছিরতে পারব না। শুইন্যা যাও…”

কিন্তু রাজিয়া তার কথায় মোটেও কান না দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। আবু বক্কর সাহেব এবার রীতিমত একটা দ্বন্দে পড়ে গেলেন। ঘরের ভেতরেই যদি এমন অবস্থা হয়, গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে মুক্তিবাহিনীর ছেলেগুলো তার কর্মকাণ্ডের কিছুই জানে না এটা হতে পারে না। তারা যদি সত্যিই পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে আক্রমণ করার সাহস পেয়ে থাকে, তাকে ধরলে কী অবস্থা করবে? এবার তিনি সত্যিই ভয় পেলেন। লক্ষ্য করলেন, তার হাতের আঙ্গুলগুলি তির তির করে কাঁপছে আর কোনো নোটিশ ছাড়াই তার খুব বাথরুম পেয়েছে।

*

আলহাজ্জ আবু বক্কর খান সাহেব একটা কাঠের চেয়ারে বসে ঘামছেন। অক্টোবর মাসের এই চমৎকার বিকালে গরম লাগার কথা না, কিন্তু তার লাগছে। কর্ণেল সাহেবের আসার অপেক্ষায় তিনি বসে আছেন। ফেনী শহরের ভেতরেই ফেনী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পাকিস্তানিদের এই ক্যাম্প বসানো হয়েছে। তাকে একটা বড় ক্লাসরুমের ভেতরে বসানো হয়েছে। ক্লাসের বেঞ্চিগুলো একদিকে জড়ো করে অন্য দিকটা খালি করে বসার জায়গা করা হয়েছে। একপাশের দেয়ালে একটা কাঠের ব্ল্যাকবোর্ড ঝুলানো। ওখানে সাদা চকে এখনো একটা অংক লেখা আছেঃ

“{(৮৪ x ২৭) + (২৮০৭-১২৩)} – {(১৯০৭ + ২৩২) + (৪৮৭ ÷ ১৬)}=?“

বেশ কঠিন একটা সরল অংক, ভাবলেন বক্কর সাহেব, মনে হয় নাইন টেনের নিচে হবে না ক্লাশ রুমটা। সাথে সাথেই ভাবলেন, বাহ দারুণ একটা কথা তো, “কঠিন-সরল”! এরপরে তিনি অবাক হয়ে দেখলেন যে, তিনি মনে মনে অংকটা সমাধান করার চেষ্টা করছেন! কাগজ কলম দিলেও তিনি পারবেন কি না সন্দেহ, আর মনে মনে? তিনি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন।

খট খট বুটের শব্দে বক্কর সাহেব সচকিত হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে ঝট করে দাঁড়িয়ে গেলেন। কর্নেল সাহেবের মুখ ভর্তি হাসি দেখেও তিনি বিভ্রান্ত হলেন না, তিনি জানেন, ওখানে কতোটা ক্রুরতা লুকিয়ে আছে। তিনি বেশ জোরে বলে উঠলেন,

”আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।“

“আরে খান সাহেব, কেমন আছেন,“ বলে সালামের উত্তর না দিয়েই কর্নেল সাহেব এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার মুখের হাসি মুহুর্তের জন্যও থামল না। তার পেছনেই আরেকজন উর্দি পরা অফিসার, সম্ভবতঃ ক্যাপ্টেন, তিনি তাদের কাঁধের উপরের এসব চাঁদ-তারার অর্থ এখনো বুঝে উঠতে পারেননি।

“তো বলেন দেখি দেশের অবস্থা টবস্থা কেমন।“ সরাসরি তিনি মূল প্রসঙ্গে চলে এলেন বলে মনে হলো।

বক্কর সাহব ভালো উর্দু রপ্ত করে নিয়েছেন। আগেই কিছুটা জানতেন, এখন একেবার ওদের মতই বলতে পারেন। “মাশা আল্লাহ, দেশের অবস্থা তো আপনারা ঠিকই রেখেছেন জনাব।“

কর্নেল সাহেবের হাসি হঠাৎ করেই মুখ থেকে চলে গেল, একটা চেয়ারে বসে, বক্কর সাহেবকে আরেকটা চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করে বেশ ধীর স্বরে বললেন, “আমি আপনাদের মুক্তিবাহিনীর কথা জিজ্ঞেস করছি।“

বক্কর সাহেব “আপনাদের” কথাটায় বেশ অস্বস্তি বোধ করে আবার ঘামা শুরু করলেন। তিনি শুধু মনে মনে দোয়া পড়ছেন, আজকে যেন ভালোয় ভালোয় এখান থেকে বাড়ি ফিরতে পারেন। তিনিও বেশ নরম সুরে বললেন, “না স্যার, মুক্তিরা আর কী করবে। আপনাদের এত আধুনিক অস্ত্র আর প্রশিক্ষিত সৈনিকদের সামনে …”

“খান সাহেব!” হঠাৎ করেই যেন খেঁকিয়ে উঠলেন কর্নেল সাহেব, “মুক্তিরা বিভিন্ন ক্যাম্পে আক্রমণ করছে, ঠিক কি না বলুন?”

বক্কর সাহেব মাথা নিচু করে বসে ঘামতে থাকলেন, যেন আক্রমণগুলি উনিই করে এসেছেন। কোন কিছু বলার সাহস করলেন না।

“আমি আপনাকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। আপনার এইসব রাজাকার, আল বদর আর আস শামসরা কী করছে, হ্যাঁ? শুধু বসে বসে আরাম করা? আপনার লোকদের দ্রুত নিয়োগ করুন। আমি মিরেশ্বরাই থেকে চৌমুহনী থেকে কুমিল্লা, এর মাঝে মুক্তিদের কোন চলাচল দেখা গেলেই যেন আধা ঘণ্টার মধ্যে খবর পাই। বুঝেছেন আমার কথা? আর তা না হলে আমি এবার আপনাদেরকে ধরে ধরে এনে শেষ করা শুরু করব, বুঝেছেন? ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা।” বলে কর্নেল সাহেব রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হাঁপাতে শুরু করলেন।

বক্কর সাহেব মাথা দোলালেন, তিনি বুঝেছেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।

“ক্যাপ্টেন শাহী, খানা লাগাও। খান সাহেবকে ভালো মতো খানা খাওয়াও।“ বলে আবার তিনি হাসতে লাগলেন।

একটু আগের সেই রুদ্রমূর্তির ছিটেফোঁটাও তার চেহারায় নেই।

সম্পর্কিত পোস্ট

মা

মা

ইশু মণি বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে তাসবিহ্ ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে ঘরের এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে।টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ায় অনবরত শব্দ হচ্ছে, বাসার সাথে লাগানো পেয়ারা গাছটার বিশাল বড় ডালপালা গুলো চালের উপর চলে এসেছে বারবার সেগুলো বারি খাচ্ছে যার কারণে শব্দ...

শখের পাখি

শখের পাখি

লেখিকা-উম্মে কুলসুম সুবর্ণা এই তো সেদিন মেলা থেকে বাসার ছোট্ট ছেলেটা আমাকে কিনে এনেছিলো। তখন তো ছানা পাখি ছিলাম এখন বুড়ো হয়েছি। বাসায় মোট ছয়জন থাকে। আগে ভাবতাম দুই রুমের ক্ষুদ্র ফ্ল্যাট এ এত গুলো মানুষ কিভাবে থাকতে পারে। পরে বুঝলাম এই সব কিছু ছেলের বউয়ের চমৎকার। অনেক...

নীল কমলিনী

নীল কমলিনী

অনুগল্প: নীল কমলিনী লেখা: অনুষ্কা সাহা ঋতু . চন্দনের শেষ ফোঁটাটা দিয়েই মা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। ছোট বেলায় এমন কত সাজিয়েছেন আমাকে। তখন মুচকি মুচকি হাসতেন, আর আজ কাঁদছেন। মা টাও ভারি অদ্ভুত। আচ্ছা, তবে কি দুটো সাজের অর্থ ভিন্ন! কি জানি? . হঠাৎ শঙ্খ আর উলুধ্বনি ভেসে...

০ Comments

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *