জাকারিয়া আল হোসাইন
–
“কালোর আধার ঠেলে
আলোর প্রদীপ জেলে
এই ধরাতে ফুটেছিলো,একটি ফুল
কাবার দু’চোখ জুড়ে
তাওহীদের সুরে সুরে
জাগাতে যে এসেছিলো,শত ভুল।”
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীর সেরা মানুষ। মানবজাতির জন্য তিনি অনুপম আদর্শ। তাঁর ৬৩ বছরের জীবনে আমাদের জন্য রয়েছে চলার পাথেয়। মহানবী (সা.) এর শিক্ষা ও সহচর্যে যারা নিজেদেরকে গঠন করেছেন, তারা হচ্ছেন সাহাবী বা সাথী। সমগ্র মানুষের জন্য তাঁরা আদর্শ মডেল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেই বলেছেন,
‘আমার সাহাবীগণ হচ্ছেন আকাশের তারকাস্বরূপ’।
আজকের শিশু-কিশোরদের কাছে মহানবী (সা.)-এর জীবন ও চরিত্র তুলে ধরার প্রয়োজন অনেক বেশি। কেননা প্রচলিত অপসংস্কতি আমাদের শিশু-কিশোরদের চরিত্র এবং নৈতিকতা ধ্বংষের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে প্রস্তুত। বড়রা এই বিষয়টি উপলব্ধি করলে মঙ্গল।
মহান রাববুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন :
‘রাসূলের জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।’
এ জন্যই তো আল্লাহ পাক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী করে হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে পাঠিয়েছিলেন মানবতার কল্যাণে। বিশ্ব মানবের ইতিহাসে মহানবী (সা.) এর স্থান সবার ওপরে। তাঁর তাকওয়া, অনুপম ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র মাধুর্য আমাদের সকলের জন্য অনুসরণযোগ্য। শিশু-কিশোররাও মহানবী (সা.) এর প্রোজ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল।
মহানবী (সা.) বলেছেন,
‘যারা ছোটদেরকে আদর করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, তারা আমাদের (মুসলমানের) আদর্শের অনুসারী নয়।’
ফলে মহানবী (সা.) দুনিয়ায় এসেই বন্ধুত্ব করলেন ছোটদের সাথে। তাঁর বন্ধু হলেন হযরত আলী (রা.), খালিদ বিন ওয়ালিদের মতো ছোট্ট শিশু-কিশোররা। তাদের নিয়ে তিনি কিশোর বয়সেই গঠন করেন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে একটি সংগঠন।
আগেই বলেছি, শিশু-কিশোরদের প্রিয় বন্ধু ছিলেন মহানবী (সা.) ছিলেন খেলার সাথী। তিনি শিশুদের খুব আদর করতেন। খাবার তুলে দিতেন তাদের মুখে। মাথায় হাত বুলাতেন। কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেতেন। একদিন মহানবী (সা.) তার নাতি হাসান (রা.)কে আদর করে চুমু খাচ্ছিলেন। তা দেখে হযরত আকবা ইবনে হারিস নবীজীকে বললেন, ‘ওগো নবী (সা.) আপনি কি এমনিভাবে শিশুদের আনন্দ দান ও আনন্দ উপভোগ করেন? আমি তো আমার ছোট শিশু-সন্তানদের এতো আদর করি না। নবীজী তার জবাবে বললেন,
‘তোমার অন্তর থেকে আল্লাহ যদি মমতা তুলে নিয়ে থাকেন, তার জন্য তো আমি দায়ী নই।’
নবীজী আরো বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি শিশু-কিশোরদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করে না, সে আমার উম্মত নয়।’
শিশুর জন্য হ্যাঁ বলুন, শিশুরা সবার আগে ত্রাণ পাবে, শিশু অধিকার রক্ষার প্রশ্নে দুনিয়াব্যাপী আজ এই স্লোগানটি উচ্চারিত হচ্ছে। রাসূল (সা.) আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে শিশুদের প্রতি সেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে গেছেন। একদিন আমাদের মহানবী (সা.) একদল শিশুর সঙ্গে আনন্দ করছেন। শিশুরাও নবীজীকে ঘিরে খুশিতে মেতে ওঠে। এমন সময় সেখানে এক বেদুঈন এসে উপস্থিত হয়। সে মহানবী (সা.)কে উপলক্ষ করে বললো, ‘শিশুদের নিয়ে এমন আমোদ আহ্লাদ করা আমার পছন্দ নয়।’ এ কথা শুনে রাসূল (সা.) এর হাসি-খুশি মুখখানি মলিন হয়ে গেল। তিনি বললেন,
‘যে ব্যক্তির হৃদয়ে মায়া নেই, আল্লাহ যেন তাকে দয়া করেন।’ (মুসলিম)।
রাসূল (সা.) কখনো শিশুদের ওপর রাগ করতেন না। চোখ রাঙাতেন না। কর্কশ ভাষায় তাদের সাথে কথা বলতেন না। তিনি ছোটদের আদর করে কাছে বসাতেন। তাদের সাথে মজার মজার কথা বলতেন। ছোটদেরকে দেখলে আনন্দে নবীজীর বুক ভরে যেত। তিনি তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। একদিন একটি সুন্দর শিশুকে দেখে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘এই শিশুরাইতো আল্লাহর বাগানের ফুল।’ তিনি কখনো কোন শিশুকে বিকৃত নামে ডাকতেন না। তিনি তাদের অর্থবোধক নাম রাখতেন এবং মিষ্টি সুরে সুন্দর নাম ধরে ডাকতেন। প্রিয় নবী শিশুদের যেমন আদর করতেন, তেমনি আবার তাদের সাথে রসিকতাও করতেন। একবার হযরত আনাস (রা.) এর ছোট এক ভাইয়ের একটি পাখি মারা যায়। এতে তার মন খারাপ হয়। নবীজী তখন তাকে আদর করে কাছে ডেকে নিলেন। বললেন-
‘ইয়া আবা উমায়েরু
মা কা-আলান নুগায়রু?’
অর্থাৎ হে আবু উমায়ের, তোমার পাখির ছানাটির কি হলো? তখন নবীজীর মুখে ছন্দ ও সুর শুনে হেসে ফেললো। (বুখারী ও মুসলিম)।
অপর এক ঘটনা। একদিন এক মহিলা তার ছেলের হাতে কিছু আঙ্গুর ফল দিয়ে বললেন, নবীজীকে দিয়ে আস। ছেলেটি আঙ্গুর ফলগুলো নবীজীর কাছে না এনে নিজেই সব খেয় ফেললো। নবীজী বিষয়টা জানতে পারলেন। তিনি শিশুটিকে আদর করে কোলে তুলে নিলেন। তারপর বললেন,
‘কি হে দেখি বলো
মায়ের দেয়া আঙ্গুরগুলো
কোথায় হারিয়ে গেলো।’
রাসূল (সা.) শিশুর মনের অভিব্যক্তি বুঝতে পারতেন। তাদের চাওয়া-পাওয়া মান অভিমান সবই আপন করে নিতে পারতেন। তাই শিশুরাও একাকার হয়ে যেতো নবীজীর ভালোবাসায়। রাসূর (সা.) বলেছেন, ‘শিশুরা আল্লাহর দেয়া খশবু। ওরা ফুলের মতো।’ (মেশকাত)।
বর্তমানে জাতিসংঘ শিশুদের রক্ষায় বিশ্বজনমত সৃষ্টির চেষ্টা করছে। অথচ তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। অহরহ শিশুরা প্রাণ হারাচ্ছে দেশে দেশে। মিয়ানমার, আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন, কাশ্মীরসহ সারা বিশ্বে কতো শিশু প্রাণ হারাচ্ছে। এদের জন্য দরদী জাতিসংঘের একবারও প্রাণ কাঁদে না। কারণ শিশুদের পক্ষে প্রতিবাদ করার সাহস জাতিসংঘেরও নেই।
আল্লাহর রাসূর (সা.) প্রায় পনেরশ’ বছর আগেই শিশুদের যুদ্ধে ব্যবহার ও হত্যা না করার নির্দেশ দিয়েছেন। বদর যুদ্ধের সময় কিছু বালক যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। রাসূল (সা.) বালকদের জিহাদী প্রেরণা দেখে খুশি হলেন। কিন্তু তিনি এই কচি শিশুদের ঘরে ফিরে যেতে বললেন। অবশ্য উমাইয়ার নামক একটি শিশুর দৃঢ় সংকল্পের জন্য শেষে তাকে যুদ্ধে যেতে অনুমতি দেন।
অন্য এক যুদ্ধে কয়েকজন শিশু মারা যায়। তারা ছিলো শত্রুপক্ষের। এ খবর এসে পৌঁছলে রাসূল (সা.)-এর প্রাণ কেঁদে উঠে। তিনি খুবই আফসোস ও দুঃখ করতে থাকেন। এ অবস্থা দেখে একজন সৈনিক বললেন,
‘হে আল্লাহর নবী। আপনি যাদের জন্য এতো মর্মদেনা ভোগ করছেন তারা বিধর্মীদের সন্তান। রাসূল (সা.) তার কথায় অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি বললেন :
‘এখন থেকে সাবধান হও। কখনো শিশুদের হত্যা করবে না। প্রতিটি শিশুই নিষ্পাপ ফুলের মতো।’
দ্বিতীয় হিজরীতে অনুষ্ঠিত বদর যুদ্ধের স্মৃতিকথা বলতে গিয়ে সাহাবীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় সাহাবী হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ (রা.) বর্ণনা করেন। বদর যুদ্ধের সময় যখন তুমুল যুদ্ধ চলছিল, হঠাৎ করে আমি দেখতে পেলাম আমার দু’পাশে দু’টি বালক। একটি বালক আমার নিকটে এসে অপর বালকটিকে আড়াল করে বললো, ‘চাচা আবু জাহল কে? আমি বললাম, আবু জাহলকে তোমার কি প্রয়োজন? সে বললো, আমি শুনেছি আবু জাহল আমাদের নবীজীকে কষ্ট দিয়েছে, তাই তাকে হত্যা করতে এসেছি। আমি তাকে বললাম, ঠিক আছে আমি রণাঙ্গনে আবু জাহলকে দেখিয়ে দেবো। এক সময় আবু জাহল আমার দৃষ্টিতে পড়লো। আমি বালকদ্বয়কে ইশারা করে দেখালাম। বালকদ্বয় বাজপাখির ন্যায় দ্রুত গিয়ে তাকে আঘাত করলো। যেহেতু তারা ছিল ছোট, আবু জাহলের গায়ে সরাসরি আঘাত করার সুযোগ ছিল না, বিধায় প্রথমেই তারা আবু জাহলের ঘোড়ার পায়ে আঘাত করলো। ততক্ষণে আবু জাহল ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলো। তারা আবু জাহলকে ছুরি দ্বারা আঘাত করে রক্তাক্ত করে ফেললো।
আঘাতের পর আঘাত করে মৃত মনে করে স্থান ত্যাগ করে নিজ স্থানে ফিরে এলো। এই শিশু দু’টি হলো আপন দুই ভাই। একজনের নাম মুয়ায এবং অপরজন হলো মুয়াবেবর। তাদের পিতার নাম আফরা। যুদ্ধ শেষে মহাবনী (সা.) এর স্নেহধন্য অপর কিশোর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এসে দেখলেন, আবু জাহল তখনো বেঁচে আছে। ইবনে মাসউদ তার বুকে বসলেন। আবু জাহল চোখ খুলে প্রশ্ন করলো:
‘তুমি কে?
তখন কিশোরটি জবাব দিলেন। আমি আব্দুল্লাহ আল মাসউদ।
তোমার খবর কি? আবু জাহল বললো, ‘দুঃখ আমার, মদীনার কৃষকের দু’টি ছেলে আমার এ অবস্থা করেছে। কোন বীরপুরুষ আমাকে ধরাশায়ী করেনি।’ তারপর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ আবু জাহলের গর্দান থেকে মাথাটা আলাদা করে নিলো। এরা আমাদের নবীজীকে কত ভালোবাসতেন। আবু জাহলকে মেরে তার নজির স্থাপন করলেন। হযরত আবু যায়েদ (রা.) হযরত আবু হুরায়রা (রা.)সহ বহু কিশোর নবীজীর ভালোবাসা পেয়ে কখনো তাকে ছেড়ে যেতেন না।
নবীজী যখন কোথায়ও সফরে বের হতেন, রাস্তায় কোন শিশুকে দেখলেই তাকে উটের পিঠে তুলে নিতেন এবং নিজ গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতেন। তিনি এতিম শিশুদের ভালোবাসতেন। তাদের মাথায় হাত বুলাতেন। নতুন জামাকাপড় কিনে দিতেন। আদর যত্ন করতেন। ফলে শিশুরাও তাদের বন্ধু নবীজীকে ভালোবাসতেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রোজ্বল আলোয় আলোকিত হয়েছিল শিশুরা। আলোকিত হয়েছে বিশ্ব ভুবন। শিশুরা পেয়েছিলো তাদের প্রাপ্য অধিকার।
যদি পাশে থাকো
তাসফিয়া শারমিন ** আজকের সকালটা অন্য রকম। সাত সকালে আম্মু বকা দিলো। মানুষের ঘুম একটু দেরিতে ভাঙতেই পারে। তাই বলে এত রাগার কী আছে ?একেবারে যে দোষ আমারও তাও নয়। মানুষ ঘুম থেকে উঠে ফোনে বা দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখে। কিন্তু আমি উঠি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের আলো দেখে।কে জানে...
প্রোজ্বল- প্রোজ্জ্বল
অাধার- অাঁধার
প্রস্ত্ততি – প্রস্তুতি
খুব তথ্যমূলক একটা লেখা পড়লাম, ভালো লাগলো। নবীর অাদর্শ মেনে চলা এক সুন্দর জীবন বিধান।
আলহামদুলিল্লাহ।
খুব সুন্দর লেখা। অনেক নতুন কিছু জেনেছি। এরকম নতুন তথ্যবহুল প্রবন্দ লেখার জন্য ধন্যবাদ
শিশুদের প্রতি ভালোবাসতে হবে। শুধু তাই নয়, ভালোবাসার মাঝে শিশুদের জ্ঞানার্জন করাতে হবে। একজন শিশু ভবিষ্যৎ নিশে কি স্বপ্ন দেখবে সেটা পিতামাতার অন্তরায়। পিতামাতার অবস্থানের অন্তরায়। পিতামাতা যদি ভালো পরিবারের হয় তাহলে সন্তান ও ভালো হয়ে উঠবে। কিন্তু শুধু পারিবারিক অবস্থান নয়, নিজ দারিদ্রের অবস্থান থেকেও একজন শিশুকে মানুষের মত মানুষ করা সম্ভব।