আমি হাঁ করে তাকিয়ে। আর-একটু ঝুঁকে এসে আমার নতুন অঙ্ক-স্যার বললেন, ‘টিউশনটা চলে গেলে খেতে পাব না, জানো? তাই ঝপ করে রাজি হয়ে গেছি। কিন্তু অঙ্ক আমি তেমন পারি-টারি না। ভয়ও পাই শক্ত অঙ্ক দেখলে। এখন তুমিই আমার ভরসা।’
আমি তুতলে-মুতলে একাকার, ‘আ-আমি ক-কী করে ভ-ভর…’
স্যার আমার একটা হাতের মুঠো ধরে ফেলে বললেন, ‘ তুমি একটু সাহায্য কোরো আমায়। আমি তো প্রায়ই সল্ভ করতে গিয়ে আটকে যাব, তুমি একটু মাথা খাটিয়ে উতরে দিও সে-সব জায়গাগুলো। তোমার কমবয়সী ব্রেন, ফ্রেশ বুদ্ধি… তুমি ঠিক পারবে। আর কাউকে যেন কিচ্ছুটি বলে ফেলো না, খুব বিপদ হয়ে যাবে আমার…’
বিস্ফারিত চোখে নতুন মাস্টারমশাইকে দেখছিলাম আমি। কীরকম কাঁচুমাচু মুখ, কাঁদো-কাঁদো স্বর! চোখ দুটো দেখে ভারী মায়া হল। হঠাৎ মনে কীরকম একটা অদ্ভুত জোর এল। আপনারা জানেন, সহানুভূতি কত তীব্র একটা আবেগ… বিপন্নকে সাহায্য করার জন্য ভিতু, দুর্বল মানুষও এক নিমেষে প্রাণ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কখনো কখনো! আমারও সেইরকম মনে হল। কোনও একটা ভালো কাজ করার ইচ্ছে জাগলে যেমনভাবে স্নায়ুরা চনমনিয়ে ওঠে, তেমনই উদ্দীপনা টের পেলাম বুকের মধ্যে। ঠিক করলাম, বাঁচাতেই হবে মানুষটাকে! তার জন্যে নিজে-নিজে অঙ্ক কষা চাই? কষব ঠিক। মাথা খাটাব, ভাবব অঙ্ক নিয়ে, প্রাণপণ চেষ্টায় আয়ত্ত করব সমাধানসূত্রগুলোকে। যদি পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাই, লোকে যদি বোঝে আমার উন্নতি হয়েছে— তবেই এঁর চাকরিটা থাকবে। আহা, মানুষটা বড় অসহায় যে!
আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, পরের দিন থেকেই অঙ্কের ভয়টা কর্পূরের মতো উবে গেল আমার মন থেকে! সব সাবজেক্ট ছেড়ে অঙ্কের বই নিয়ে পড়ে রইলাম দিনরাত। উদাহরণ দেখে-দেখে চ্যাপ্টারের পর চ্যাপ্টার বুঝতে শুরু করলাম। রোখ চেপে গিয়েছিল। যেখানটা জটিল লাগছে,সেখানটা নিয়ে রগড়াচ্ছি ঘন্টার পর ঘন্টা। দেখছি, শেষ অবধি ঠিক খুলে যাচ্ছে জট। নিজেই অতিক্রম করছি সব বাধা। একটাই লক্ষ্য, মাস্টারমশাইকে বাঁচানো। সপ্তাহ তিনেকের মধ্যের টের পেলাম, অঙ্ক কিলবিল করছে মাথায়। সমস্যা দেখামাত্র সমাধানের সূত্রগুলো স্টেপ বাই স্টেপ বুঝতে পেরে যাচ্ছি। আর একটা জিনিস এতদিন বুঝতে পারিনি— একটা শক্ত অঙ্ক কষে ফেলার মধ্যে যে এত আনন্দ লুকিয়ে আছে জানতামই না আগে!
মাস্টারমশাইও খুব চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তিনি প্রায়ই আটকে যেতেন। কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্র-শিক্ষকের ভূমিকা প্রায় পাল্টাপাল্টি হয়ে গেল। হয়তো একই অঙ্ক দুটো খাতায় দুজন কষে বার করব বলে লড়ছি। আমার উত্তর বেরিয়ে গেল, তিনি তখনও কাটছেন আর কাটছেন। ‘এঃ হে, তুমিই তো আগে করে ফেললে… কী প্রসেসে করলে একটু বুঝিয়ে দাও দেখি,’ বলে করুণ হাসলেন। আমিই যেন মাস্টারমশাই, এরকম ভঙ্গি করে আমি তাঁকে বোঝাতে শুরু করলাম। ‘ওহ, এই ব্যাপার,’ বলে, যেন নিজের লজ্জা ঢাকতেই, আরও শক্ত একটা অঙ্ক দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘এটা কিন্তু অত সহজে হবে না মনে হচ্ছে!’ আমার মাথায় জেদ চেপে যায়। চোয়াল শক্ত করে ভুরু কুঁচকে মগজ খাটাই, তারপর ঠিক রাস্তাটা বেরিয়ে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই। মাস্টারমশাইএর মুখ সরল হাসিতে মাখামাখি। বললেন, ‘তোমার তো দারুণ মাথা! পরীক্ষায় পারবে তো সব ঠিকঠাক? দেখো বাবা, আমার টিউশনটা থাকে যেন…!’ ততদিনে বিপুল আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়ে গেছে আমার। বলতাম, ‘দেখে নেবেন শুধু, হ্যাঁ!’
কখনও আবার মাস্টারমশাই কোত্থেকে সব খিটকেল অঙ্ক বেছেগুছে নিয়ে আসতেন। বলতেন, ‘এগুলো আমি একদম ধরতেই পারছি না। দ্যাখো তো, তোমার ব্রেনে যদি কিছু আসে… বড্ড শক্ত, তুমিও বোধহয় পারবে না…।’ রক্ত গরম হয়ে উঠত শুনে। পারব না! খাতা পেন্সিল নিয়ে বসে পড়তাম আমি, এদিক সেদিক দিয়ে মাথা খোঁড়াখুঁড়ি করতাম। পাশে বসে মাস্টারমশাইও একটা-দুটো ক্লূ হাতড়াতেন। তারপর একসময় ‘ইউরেকা’ বলে চেঁচিয়ে ঊঠতাম আমি, গড়গড় করে সমাধান করে ফেলতাম, কৃতজ্ঞ গলায় মাস্টারমশাই বলতেন , ‘উফ, ভাগ্যিস তুমি ছিলে…’ “ইশকুলের স্যাররাও বেশ অবাক হচ্ছিলেন। ক্লাসে যে অঙ্কই দেওয়া হোক,সবার আগে করে ফেলছিলাম আমি। অবিনাশ স্যার একদিন বলেই ফেললেন , ‘তোর নিরেট মাথাটা কোন ম্যাজিকে এরকম খুলে গেল রে! বিশ্বাসই হয় না!’
ফস করে বলে ফেললাম, ‘এবার অ্যানুয়াল পরীক্ষার নম্বর দিতে গিয়েও আপনার বিশ্বাস হবে না, স্যার!’
বাড়িতে কিন্তু মাস্টারমশাই ওই কথাটা শুনে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ওরকম আগে থাকতে বড়াই করে বলতে নেই। যদি পরীক্ষায় আগের মতো সব ভুলেটুলে যাও?’
আমি স্থির চোখে তাকিয়ে বলেছিলাম, ‘ভুলে যাব কী করে? আমার মগজে এখন অঙ্ক ঠাসা থাকে জানেন না ? আর কারও জন্যে না হোক, আপনার জন্যে পারতেই হবে আমাকে, তাই না ?’
সেই প্রথম তাঁর ভিতু-ভিতু চোখ দুটোকে আমি চিকচিক করে উঠতে দেখছিলাম। অশ্রুতে, না কি উত্তেজনায়— তখন বুঝে উঠতে পারিনি।
গ্লাস থেকে একটু জল খেলেন ডক্টর সান্যাল। গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, আর বেশি সময় আমি ব্যয় করব না । অনেক ধৈর্য নিয়ে শুনছেন আপনারা, কিন্তু গল্প এবার শেষ হয়ে এসেছে ।
রেজাল্ট যেদিন বেরোল, সেদিন স্কুলের স্যারেরা হতবাক! বললে একদম আষাঢ়ে গল্পের মতো শোনাবে আজও। যে-ছেলে জীবনে কখনও দু’অঙ্কের নম্বরও ছুঁতে পারেনি, সিক্স থেকে সেভেনে উঠছে সে এক্কেবারে তিন অঙ্ক নিয়ে। একশোয় পাক্কা একশো! মিরাকল বললেও কম বলা হয়। তিনবার দেখা হয়েছে অঙ্কের খাতা, একটা নম্বরও কমাতে পারেননি অবিনাশ স্যার!
রেজাল্ট নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেই বাবাকে বললাম, ‘ আমাকে এক্ষুনি মাস্টারমশাইএর কাছে নিয়ে চলো!’ তাঁকে না-দেখানো পর্যন্ত আমার ছটফটানি কমবে না, বেশ বুঝতে পারছিলাম।
বাবার মুখটা দেখলাম কেমন গম্ভীর। চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমি যে এত ভাল রেজাল্ট করেছি তাতে কোনও উচ্ছ্বাস নেই। খুব শান্ত,নিচু গলায় ধীরে ধীরে বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাব বলেই অপেক্ষা করছি।’
একটু থেমে যোগ করলেন, ‘তিনিও তোমাকে দেখতে চান।’
আমাদের গাড়িটা কিন্তু কোনও বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল না। ভীষণ অবাক হয়ে দেখলাম,সামনে একটা হাসপাতালের গেট!
আমি আসলে লেখক নই, গল্প লেখতে ভালো লাগে শুধু। এ গল্পের সামান্য গ্রহীতা আমি, ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।
nice
nice
awesome