লেখকঃ
Shopno Balika
(এপ্রিল – ২০১৮)
……………
অনেকদিন হলো রিকশা চালাই। নানা রকম প্যাসেঞ্জার ওঠে। মাঝে মাঝে খুব অদ্ভুত প্যাসেঞ্জার পাই। এই যেমন গত বছরের ঘটনা। সীটে বসেই কেমন অস্থির হয়ে গেলো মানুষটা। মনে হচ্ছিলো কিছু একটা নিয়ে খুব পেরেশানিতে আছে বেচারা।
প্রায় ঘন্টা ধরে আমার রিকশাতেই এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে লাগলো উদভ্রান্ত পাগলের মতো।
মানুষটাকে খুব জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছিলো, কি হইছে? ভয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারছিলাম না। আমি গরীব, অশিক্ষিত মানুষ আর মানুষটারও মেজাজ আছে চড়ে।
শেষমেষ যখন মোবাইলে মানুষটা কথা বলা শুরু করলো তখন বুঝলাম যে তার এক ব্যাগ রক্তের দরকার। স্ত্রী ইমার্জেন্সী রুমে খুব খারাপ অবস্থায় আছে, খুব তাড়াতাড়ি এক ব্যাগ রক্ত না হলে জীবন বাঁচানো মুশকিল। রক্তের গ্রুপ এ নেগেটিভ।
কিছুক্ষন পর খুব সাহস করে, শঙ্কোচ নিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, “বাবা, আমার রক্ত যদি নিতে বলি,আপনি কি রাগ করবেন? গত বছর এক অসুখে পড়ে রক্ত পরীক্ষা করিয়েছিলাম। আমি জানি আমার রক্তের গ্রুপ এ নেগেটিভ। আপনার বৌ এর তো এই গ্রুপেরই রক্ত লাগবে, তাইনা? আমি খুবই সৎ মানুষ, কোন খারাপ অভ্যাস নাই। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আমার সমস্যা একটাই, আমি মানুষটা গরীব। আপনার স্ত্রীকে কি আমাকে রক্ত দিতে দেবেন?”
একটু আগে যে মানুষটার সাথে আমার কথা বলতে ভয় করছিলো, সেই মানুষটা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফোঁপানো শুরু করলো। মানুষটা ভেতরে ভেতরে কি ভেঙেই না পড়েছিলো, বুঝতে পারছিলাম।
এরপর ইমার্জেন্সী রুমে গিয়ে রক্ত দিয়ে দিলাম এক ব্যাগ। সময় লাগলো মাত্র ঘন্টা দুয়েক। কিন্তু ঐ দুইটা ঘন্টা নিজেকে খুব আলাদা একটা মানুষ মনে হচ্ছিলো। যেন সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক বিস্ময় নিয়ে। সারা জীবনে আমার এই অনুভূতি আর কখনোই হয়নি।
আমার নাম্বার রেখে দিল। আমাকেও তাদের নাম্বার দিয়ে দিল। দরকারে-বিপদে অবশ্যই পাশে থাকবে বলল।
কেউ আমাকে টাকার কথা একটা বারের জন্যেও বলেনি। কারণ আমি তো মানুষটার কাছে আমার রক্ত বিক্রি করতে আসি নি। কিন্তু তার বদলে মানুষটা বললো, “আপনাকে কি আমি ‘বাবা’ ডাকতে পারি?”
নিজেকে এতটা দামী মানুষ, গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আমার আর কখনোই মনে হয়নি। সারাটা জীবন নিজেকে যে গরীব, নীচু মানুষ হিসেবে দেখে এসেছিলাম, এই একটা ঘটনায় আমার দেখার চোখটা একেবারে বদলে গিয়েছিলো। এখন আমি জানি, এই গরীবের শরীরের রক্ত দিয়ে একটা বড়লোকের জীবন বাঁচানো যায়।
০ Comments