মিরার স্বাধীনতা
প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০১৮
লেখকঃ vickycherry05

 3,026 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ vickycherry05

গল্প লেখকঃ
Rubaya Akter Luna
(মার্চ – ২০১৮)
……………

সহ্য হচ্ছে না আর। বৃষ্টির পানিতে আর ঝাঁকুনিতে ক্ষত যেন দুমড়ে মুচড়ে জীবন বের করে নিচ্ছে। আহ কি ব্যাথা!
কাতরাচ্ছে সফিক।
কাঁধে গুলি লাগা জায়গাটায় জহিরের শার্ট বাধা থাকলেও বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। সফিক তার গুলি লাগা হাত ছেড়ে দিয়ে হাঁটছে। হাতটা ঝুলে আছে। অন্য হাতটা সামছুর কাঁধে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে খুব দুর্বল হয়ে গেছে সফিক। নিঃশব্দে সে আর্তনাদ করছে। মনে হচ্ছে জ্ঞান হারালে ভালো হতো।
-সামছু, আর কতো দূর? পারছি না আর।
-আর একটু কষ্ট করেন ভাই। এইতো আইয়া পরছি।
এমন আশ্বাস সামছু গত আধ ঘণ্টা যাবত দিয়ে আসছে।
জঙ্গলের মাঝের রাস্তা দিয়ে চলছিলো তারা। এখন গাছপালা বেশ কমে এসেছে। তারা যাচ্ছে মতিন ডাক্তারের বাড়ি। মতিন ডাক্তার বুদ্ধিমান ও সাহসী লোক। তার বাড়ির পেছনের জঙ্গলে পুরনো একটি কুয়োর পাশে পরিত্যেক্ত একটি কালীমন্দির আছে। সেখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেন। খাবার আর তথ্য সরবরাহও করা হয় সেখানে। সামছু সফিক কে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে।
তারা পৌঁছে গেছে প্রায়। মন্দিরের পাশের তাল গাছটার মাথা দেখা যাচ্ছে। ভেতরে ঢুকে সামছু মুখ দিয়ে এক ধরনের শব্দ করলো। এটা তাদের সংকেত। মুক্তিবাহিনীরা এখানে এলে এই শব্দ করে নিশ্চিত করে তারা মুক্তিবাহিনী।
সামছুর উত্তরে কামাল বলল “জয় বাংলা”।
মন্দিরের ছাদ ভেঙে নিচে পড়েছে এমন ভাবে, যে তা দেখলে ভাঙা খাড়া দেয়াল মনে হয়। কামাল সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। সে মতিন ডাক্তারের চাচাতো ভাই। সে এখানেই থাকে। মুক্তিবাহিনীর কেউ এলে মতিনকে খবর দেয়।
ভেঙে পড়া ছাদের পিছে খড় পাতানো আছে স্তূপ আকারে। সামছু সফিককে সেখানে শুইয়ে দিয়ে পাশে ছোট তেলের প্রদীপটা জ্বালালো। সফিকের হাতে বাধা শার্ট এর পানির সাথে রক্ত মিশে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। সফিক মুখ হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
– সামছু আমি মনে হয় আর বাঁচবো না।
-কি কন ভাই এগুলা। আল্লারে ডাকেন।
-আমি মারা গেলে তুমি একটা কাজ করবে। (ঢোক গিলে আবার বলল) ক্যম্পে আমার ট্রাংকে দেখবে একটা ডায়রি আছে। (একটু থেমে) সেটা তোমার ভাবিকে দেবে। দেশ যদি স্বাধীন হয়, যদি কেন বলছি। স্বাধীনতো হবেই। সব জায়গাই তো আমাদের দখলে। হাতে গোনা কয়েকটা জায়গা বাকি। তুমি তোমার……
কথা শেষ হওয়ার আগেই মতিন ডাক্তার উপস্থিত। সে দ্রুত সফিকের পাশে বসে। কামাল একটা হারিকেন ধরিয়েছে। যতটা সম্ভব আলো ঢাকার চেষ্টা করছে। যেন বাইরে থেকে কেউ দেখে না ফেলে।
মতিনের ভ্রু কুচকে আছে। সফিকের অবস্থা তার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। সফিকের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে। হাতে বাধা শার্ট সম্পূর্ণ ভেজা। প্রচুর রক্ত গেছে।
-কামাল, বাড়ি গিয়ে গরম পানি, গরম ভাতের মাড় আর সাথে একখানা কম্বল নিয়ে আয়। জলদি।
কামাল ছুটে বেরিয়ে গেল।
মতিন সফিকের গুলি বের করছে। ব্যাথায় সফিক গোঙানির মত শব্দ করছে। সে চোখে ঝাপসা দেখছে। তার দিকে সামছু তাকিয়ে আছে। তার চোখ ভেজা। এই ছেলেটা তাকে ভীষণ পছন্দ করে। সেও তাকে স্নেহ করে। ভদ্র ছেলে। দেশের প্রতি অনেক টান।
সফিকের মনে হল ওটা সামছু নয়, তার বাবা। সফিকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু চোখ ভেজা।
সফিক ভবছে তার বাবা এখানে কিভাবে আসবে। সে নিশ্চয়ই ভুল দেখছে। তাহলে কি আমি মারা যাচ্ছি?
সফিক শুনতে পায় তার বাবা তাকে ডাকছে,
-সফিক তাকাও। আমার দিকে তাকাও।
সফিক চোখে ঝাপসা দেখছে। তার মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারাবে।
– সফিক। সফিক তাকাও। জ্ঞান হারিয়োনা। ভালো করে চোখ খুলে তাকাও। সফিক।
মতিন সংকিত ভাবে সফিককে ডাকছে। জ্ঞান হারালে অবস্থা জটিল হবে আরো।
সামছুর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।
-ও সফিক ভাই তাকান। চুখ খুলেন সফিক ভাই। ও সফিক ভাই।

সফিকের হাতের গুলি বের করে ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ব্যান্ডেজ লাগানো। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে। তবুও যে পরিমান রক্তক্ষরণ হয়েছে তা এখন চিন্তার বিষয়।
কামাল চলে এসেছে। তার সাথে মতিন ডাক্তারের মেয়ে মিরাও এসেছে। সে কৌতূহলী চোখে সফিককে দেখছে।
মতিন ডাক্তার সফিকের মুখে পানি ঢালছে। কামাল পাতলা কম্বলতা সফিকের গায়ে দিয়ে দিয়েছে।
সফিকের আচ্ছন্নের মত ভাবটা একটু কেটেছে। সে কিছুটা ভালো বোধ করছে। তাকে মাড় খাওয়ানো হচ্ছে। মিরা পাশে দাড়িয়ে তা দেখছে। সফিক মিরাকে দেখছে। কি মায়াবী চেহারা।

প্রায় ঘণ্টা তিনেক হয়েছে। সফিক আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝে আছে। সফিকের অবস্থা কিছু ভালো দেখে মতিন বাড়ি গেছে। সামছু সফিকের মাথার কাছে বসে আছে। তাকে একটু আগে মুড়ি খেতে দেওয়া হয়েছিল।
মিরা মাঝে মাঝেই তার চাচার সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। তার এতো প্রশ্নে কামাল বিরক্ত। মিরার প্রতিটা প্রশ্নে সে মনে মনে একবার করে বলছে -“আল্লা রেহায় দাও”।
-চাচা লোকটা কি মারা যাচ্ছে?
কামাল উত্তর না দিয়ে সামনের দিকে চেয়ে আছে ভ্রু কুঁচকে।
-চাচা উনি কি মুক্তিযুদ্ধ?
মিরা মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযুদ্ধ বলে। দুটি শব্দের যে দুটি অর্থ তা তাকে ব্যাখ্যা করে বোঝানোর পরও সে মুক্তিযুদ্ধই বলে।
-যে, উনি মুক্তিযোদ্ধা। তোমারে না বলছি শব্দডা মুক্তিযুদ্ধ না যোদ্ধা হইব।
-চাচা মুক্তিযুদ্ধ কি মারা যাচ্ছে?
এই মেয়ে কে বলে লাভ নেই। তাই কামাল তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,
-তোমার এইখানে কি? যাও বাড়িত যাও। দুপুরের খানা তৈয়ার হইলে আইসা খবর দিবা, যাও অহন। খালি বিরক্তং করে।
কামালের “বিরক্ত” শব্দতার শেষে “ং” লাগিয়ে বলতে ভালো লাগে তার কাছে মনে হয় এতে শব্দতার তাৎপর্য বেড়ে যায়।
মিরা উঠে গেল ঠিকই কিন্তু বাড়ি গেল না। সে দেয়াল ধরে দাড়িয়ে সফিকের দিকে তাকিয়ে রইল।
কামাল একবার বিরক্ত মুখে মিরার দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিলো। এই মেয়েটাকে সে অত্যেন্ত স্নেহ করে। কিন্তু তা সে নিজেও যানে না।
সফিক হাত নেরে মিরাকে ডাকল। মিরা দৌড়ে চলে গিয়েও গেল না। দরজা থেকে কি মনে করে ফিরে এসে সফিকের পাশে বসল। সফিক কিছু বলার আগেই সে বলল,
-আমি জানি তুমি মুক্তিযুদ্ধ। কাউকে বলব না আমি, সত্যি।
মৃদু হাসল সফিক। মিরা চলে যাচ্ছে। তাকে ডাকার মত শক্তি বা ইচ্ছা তার হচ্ছে না। সে বুঝতে পারলো এতক্ষণ ব্যাথাটা অনুভব করতে পারেনি এখন পারছে।

দুদিন পর মতিন ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে মন্দিরে ঢুকল। সে বেশ খুশি।
-পাকিস্তানিরা সারেন্ডার করতে চেয়েছে। রেডিওতে বলল মাত্র। সফিক শুনেছ? দেশ স্বাধীন হচ্ছে। আর মাত্র কয়টা দিন বাকি।
মতিনের হাসির রেখা কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সফিক ঘোর লাগা চোখে চেয়ে আছে। যেন সে কিছু বুঝতে পারছে না।
মতিন যেমন ছুটে এসেছিল, তেমনি ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেল।
সফিকের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। আজ ১৩ তারিখ, ১৬ তারিখ নাকি পাকিস্তানিরা সারেন্ডার করবে। এ যেন কোনো স্বপ্ন।

সেদিন গভীর রাতে হঠাৎ কামালের ঘুম ভেঙে গেল। মিরা তাকে ধাক্কা দিচ্ছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– এতো রাইতে তুমি এইখানে কি কর? কার লগে আইছো। তোমার আব্বার লগে?… মতিন ভাই? ও মতিন ভাই?
কোন সারা শব্দ নেই। কামেলর ডাকে সফিক আর সামছুও জেগে গেছে।
মিরা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রদীপের আগুনে। এবার ভয় লাগে কামালের। সে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করে,
-মিরা, কি হইছে আম্মা? তুমি এতো রাইতে একা এইখানে কেন?
মিরা দৃষ্টি সরায় না। ছোট্ট মুখটাতে বলে ওঠে,
-চাচা, ওই লোকগুলো বাবাকে নিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে গেছে। আমি একবার দুটো সিঁড়ি থেকে পরে গিয়েছিলাম, কত ব্যাথা লেগেছিল। আর ওরা বাবাকে পুরটা সিঁড়ি টেনে নিয়ে গেছে। বাবার কত ব্যাথা লেগেছে বলো।
কামাল কিছু বলতে পারলো না। সে যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে যেন বুঝতে পারছেনা মিরা কি বলছে।
-যানো চাচা, ওরা না বাবার শার্টের কলার ধরে নিয়ে গেছে। এই দেখো বোতামটা ছিঁড়ে গেছে।
মিরা তার হাতের মুঠো খুললো। ছোট্ট হাতটাতে সাদা বোতাম রয়েছে একটা।
-বাবা বলেছে ওরা নাকি বাবাকে আবার দিয়ে যাবে। বাবা আসলে বোতামটা সেলাই করে দেবো।
কামালের দৃষ্টি যেন এবার প্রদীপে আটকে গেছে।
-তোমার মা কই মিরা? আর রেনুর মা? সে কই?
-রেনুর মা বাবকে মারতে দেখে পালিয়ে গেছে। আর মা …
ধক করে উঠলো কামালের বুক।
-তোমার মা কই মিরা?
কামালের কণ্ঠে উদ্বিগ্ন।
-মাকে ওরা ফেলে দিয়েছে। মা কেমন যেন করছিল চাচা।
মিরার ছোট গাল বেয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। প্রদীপের আলোয় তা চিকচিক করছে। ছোট মেয়ে টা যেন এক রাতের ঘটনায় পাথর হয়ে গেছে।
-চাচা বাবাকে ওরা ফিরিয়ে দেবেনা তাই না? ওরা মিথ্যা বলেছে।
সফিক আর সামছু দৌড়ে গেল মতিন ডাক্তাররে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
কামাল মিরাকে জরিয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। কিন্তু মিরার দৃষ্টি সেই প্রদীপের আগুনেই গেথে আছে। যেন সেই আগুনে রাতের বিভীষিকা ময় চিত্র গুলো বার বার ভেসে উঠছে।

সেই ১৪ই ডিসেম্বরের রাত শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হয়ে গেলো। কত পরিবার প্রিয় মানুষকে হারালো। স্বাধীনতার জন্য অসংখ্য মিরা সেই রাতে নিঃস্ব হয়ে গেলো। আজও মিরা আপেক্ষায় থাকে কবে দেশের সব মানুষের মাঝে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পৌছাবে এ আশায়।

সম্পর্কিত পোস্ট

ঈদের ঈদ

ঈদের ঈদ

লেখক: রাসেল আহমদ রস (জুন - ২০১৮) ............ মেয়ে: আব্বু এই নতুন জামা আমার জন্য? বাবা: হ্যাঁ মা, এইটা তোমার জন্য! সুন্দর না? মেয়ে: তোমারটা আর আম্মুরটা কই? বাবা:...

আপনাকে কি “বাবা” ডাকতে পারি?

আপনাকে কি “বাবা” ডাকতে পারি?

লেখকঃ Shopno Balika (এপ্রিল - ২০১৮) ............... অনেকদিন হলো রিকশা চালাই। নানা রকম প্যাসেঞ্জার ওঠে। মাঝে মাঝে খুব অদ্ভুত প্যাসেঞ্জার পাই। এই যেমন গত বছরের ঘটনা। সীটে বসেই কেমন অস্থির হয়ে গেলো মানুষটা। মনে হচ্ছিলো কিছু একটা নিয়ে খুব পেরেশানিতে আছে বেচারা। প্রায়...

স্বপ্নার স্বপ্ন

স্বপ্নার স্বপ্ন

গল্প লেখকঃ Md Si Rana (এপ্রিল - ২০১৮) ............... বিলাশপুর গ্রামের এক দরিদ্র ভ্যানচালকের মেয়ে স্বপ্না। প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তার অধিকারী স্বপ্না। ছোটবেলা থেকেই ওর স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া। এত গরিব ঘরের মেয়ে হয়েও এই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখার জন্যই মূলত ওর ডাকনাম স্বপ্না।...

০ Comments

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *