লেখকঃ
অলিক মানুষ
………
এলাকার অলিগলি পথেঘাটে অনেক চায়ের দোকান-টং ই দেখা যায় রোজ। তবে একটা লোক ছিল_যে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এলাকাজুড়ে হেঁটে বেড়াত আর চা-কফি বিক্রি করতো_মাঝে মাঝে বড়মাঠের বটগাছটার নিচে বসে বিশ্রাম নিতেন। মাথায় একটি সাদা টুপি পড়ত লোকটা।
লোকটার বয়স আনুমানিক ৫৫-৬০ বছর হবে।লোকটাকে আমি প্রথম প্রথম যতদিন দেখতাম,এক নজরে তাকালে প্রথম তার যে ব্যাপারটি আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাত,তা ছিল তার_গুঁজো হয়ে ধীর গতিতে হাটা। কারণটা নিয়ে বেশকিছু দিন ভেবেছি,ভাবনার কুলকিনারায় পৌঁছাতে পারিনি।
একদিন বড়মাঠের বেঞ্চটায় বসে বসে ভাবছি,চাকরির প্রমোশন নিয়ে।
এমন সময় পেছন থেকে এসে লোকটা বললো,
[-মনটা খারাপ মামা?
মামা,এক কাপ চা খাবেন ?
-রঙ চা দিন এককাপ।
-মামা আদা দিমু চায়ে ?
-হুম,দিলে ভালো হয় ।
(গভীর মনোযোগে তিনি ফ্লাক্স থেকে ফুটন্ত গরম পানি ঢালছেন)
-আচ্ছা মামা,আপনি কী শুধু চা-ই বিক্রি করেন?
-মামা দিনেরবেলায় একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে দারোয়ানি করি।এক ধান্ধায় সংসার কী চলে মামা?আপনারা তো শিক্ষিত মানুষ,বুঝেন সবই।
-আপনার কয়জন ছেলে-মেয়ে ?
-চারজন।
-তারা কতটুকু,কাজকর্ম করে ?
-জ্বী মামা,দুই পোলা বিদেশ পাঠাইছি গেরামের ভিটি বিক্রি কইরা।সেজো পোলা কেলাস সিক্সে(6) পড়ে,ছোট একটা মাইয়া আছে, থিরিতে(3) পড়ে ।
আর বউ অসুস্থ, বিছানায় পড়া । ]
আরো কিছুক্ষণ তার সাথে কথাবার্তা হলো
ভালোই লাগলো, একজন চা ফেরিওয়ালা এমন সুক্ষ্ম চিন্তার মানুষ ,ভেবে ভালো লাগছে।
আরো কয়েকদিন নিয়মিত কথে বলে জানতে পারলাম,লোকটা পোলিও রোগে আক্রান্ত, তাই সে সোজা হয়ে স্বাভাবিক গতিতে হাটতে পারেন না,
‘ছেলেরা নিজেদের সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে,তাই পিতাকে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারছে না’_এমনটাই ধারণা ফেরিওয়ালা এই সাদেক মিয়ার।
সাদেক মিয়াকে বেশ কয়েকবার অফার করেছিলাম,’আপনি আমাদের বাগানটা একটু দেখাশোনা করুন,আপনার সংসারের সব খরচাপাতি আমার,তবুও দয়াকরে আর চা ফেরি করবেন না,দেখলে মনে আচোট লাগে’।
কিন্তু কোনো ফায়দা হয়নি,তিনি উল্টো আমাকে প্রতিবারই ‘ছোট বড় কোনো কাজই হেয় করা উচিৎ না’ এই যুক্তিতে পরাজিত করেছেন।
হঠাৎ একদিন খবর এলো আমার চাকরির ৩ বছরের ফরেইন ট্রান্সফার অস্ট্রেলিয়ায়
পরিবার পরিজন সব মায়া ত্যাগ করে চলে গেলাম অস্ট্রেলিয়া।কিছুই ভালো লাগছিল না ওদিকে। রাত হলেই সিডনির ফুটপাতে হাটতে হাটতে মনে পড়ে যেতো সাদেক মিয়াকে।মাঝে মাঝে মোবাইলে কথা হতো,তিনি বলতেন_তিনি নাকি এখন খুব সুখে আছেন,সংসার ভালোই চলছে।হঠাৎ দেশে ফেরার বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়,ফোন সুইচড অফ।
দীর্ঘ ৩ বছর পর দেশে ফেরার আগেরদিন অনেক কেনাকাটা করেছিলাম সবার জন্য। সাদেক মিয়ার জন্য একটা সাদা পাঞ্জাবি,তার মেয়েটার জন্য একটা রিমোট কন্ট্রোলার হেলিকপ্টার কিনলাম,ছেলেটার জন্য একটা মোবাইল।
পরদিন Sydney Kingsford Smith International Airport থেকে Etihad এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বেলা ২.৪৫ মিনিটে হজরত শাহজালাল অান্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভুমিতে পদার্পণ করি।
ভেবেছিলাম আগেই একটা uber নিয়ে সাদেক মিয়ার বাড়ি যাব।আমি নিশ্চিত তাকে কেউ বলেনি যে আজ আমি আসবো,আমাকে দেখেই হয়তো চমকে যাবেন সাদেক মিয়া।
কিন্তু তার বাড়িতে গিয়ে তা হলো না,বরং আমিই চমকে গেলাম তার স্ত্রীর মুখের কথা শুনে_
‘ভাইজান,ওর বাপের ক্যান্সার হইসিলো,শেষমেশ ৫ মাস হইব চইলা গেসে ওইপারে’।
কথাটা শুনে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল দাঁড়িয়ে থাকতে,সেদিন আমি দেখেছিলাম একজন সাদেক মিয়াকে,একজন সত্যিকারের শক্ত মানুষকে,যিনি হাজারো কষ্ট অভাবের মধ্যে থেকেও অন্যের কাছে হাত পাতেন নি।
সাদেক মিয়ার সেজো ছেলেকে সাথে নিয়ে কবরটা দেখতে চলে গেলাম,
তার কবরের পাশে একটা বিশাল আকৃতির বটগাছ,অজানা কোনো কাজের দায়িত্বভার নিয়ে অবিচল দাঁড়িয়ে আছে,
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম,তখন বারবার কানে এসে উপস্থিতি দিচ্ছে সেই অনেক বছর পুরোনো কথাটা_
‘মামা,এক কাপ চা খাবেন?’
এপারে হয়নি তো কী হয়েছে,আল্লাহ্ -র রহমতে ওপারে নিশ্চিত ভালো থাকবেন সব সাদেক মিয়াঁরা সেই কামনাই করি ।
আসাধারণ গল্পটি????????
kichu manus ache zotoi koste thakuk kintu hat pAtbe na.
Simplicity is best.
ভালো লাগছে।