গল্প লেখিকা:
আফরোজা আক্তার ইতি
(Lîly Ãfröz)
মার্চ-২০১৮
………………
আজও দু’ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে এইমাত্র গ্রাফিক্স ডিজাইনার পদে একটা ইন্টারভিউ দিয়ে বের হলাম। ম্যানেজার বলেছে, ফলাফল জানাবে দু’দিন পর। দু’দিন পরের মানে কি সে কথা আমার জানা হয়ে গেছে। বিএ পাস করার পর দু’বছর ধরে ইন্টারভিউ দিয়েই যাচ্ছি আর “পরে জানানো হবে”, “আপনি পরে যোগাযোগ করুন”, “দু’দিন পরে ফলাফল জানানো হবে” এসব শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি এখন। ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হতে না হতেই বাবার কল এলো। বাবা আমাকে আবার প্রচন্ড আদর করেন। কন্যাদায়গ্রস্ত হলেও কখনো আমাকে তা বুঝতে দেন নি। বাইরে কোথাও গেলে আর ফিরতে দেরি হলে বাবা টেনশন করতে থাকেন। তাই তাড়াতাড়ি বাবার কল রিসিভ করলাম। “কলি, তুই বের হয়েছিস? তাড়াতাড়ি বাসায় আয় মা। রহমান খুব ভালো একটা প্রস্তাব এনেছে। এবার আর পাত্র হাতছাড়া করব না, দেরি না করে আজই আসতে বলেছি।” আমি নিচু স্বরে বললাম, “বাবা, এখন এসব শুনতে ভালো লাগছে না। আমি আসছি।” বলে ফোন টা কেটে দিলাম। দাঁড়িয়ে রইলাম রিকশার জন্য। একটু আগে জ্যাম ছুটেছে। একটাও রিকশা পাচ্ছি না। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ঘড়িতে দেখলাম ১২.১০ বাজে। এদিকে রোদের তাপে দরদর করে ঘেমে যাচ্ছি। আশেপাশে কিছু লোক আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ১৮/২০ বছরের একটা ছোঁড়া যেতে যেতে বলল, “একে তো কালা, তারুপর পরছে হলুদ শাড়ি। আজিব।” শুনে মনে আঘাত লাগলো না। জন্মের পর থেকেই আমার গায়ের রঙের তিরস্কার শুনতে শুনতে আমি অভ্যস্ত। বলতে গেলে এখন না শুনলেই যেন অস্বাভাবিক লাগে।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে একটা রিকশা পেলাম। রিকশায় উঠতেই ঘন ঘন বাবার কল আস্তে লাগলো। ফোন সাইলেন্ট করে রাখলাম। বাসায় আসতে আসতে প্রায় ১.৩০ বেজে গেছে। মা বললেন, “এসেছিস? যা গোসল সেরে নে। আমি ভাত বেড়ে রাখছি, তুই আর তোর বাবা খেয়ে নে। পলি আর শিলা পরে আমার সাথে খাবে।” “রানা এখনো স্কুল থেকে ফেরে নি মা?” “না, আজকে ওদের স্কুলে প্রোগ্রাম আছে।” কিছুক্ষণ থেমে মা আবার বললেন, “তোর ইন্টারভিউ এর খবর কি?” আমি ক্লান্ত স্বরে বললাম, “বলেছে, দু’দিন পরে জানাবে। এর মানে, আর হবে না।” শুনে মা হায় হায় করে উঠলেন যেন। “ভেঙে পড়িস না, ভাগ্যে ভালো কিছু অবশ্যই আছে।” আমি বিদ্রুপাত্মক হাসি হেসে নিঃশ্বব্দে ঘর থকে বের হয়ে বাথরুমে ফ্রেশ হতে গেলাম। বাবা আর আমি যখন খাবার টেবিলে খেতে বসলাম, বাবা খেতে খেতে আবার সেই প্রসঙ্গ শুরু করলেন।
“সন্ধ্যায় তৈরি থাকিস। রহমান একটা ভালো প্রস্তাব এনেছে। ছেলে সরকারি চাকরি করে।” আমি আস্তে করে বললাম, “আচ্ছা বাবা।” আর খেতে ইচ্ছা করলো না। হাত ধুয়ে টেবিল থেকে চলে এলাম। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছিল। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তি যেন আরো গায়ে ভর করলো। ছোটবেলায় যখন বাবা স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন, প্রথমদিন তো কেউ ই আমার সাথে কথা বলেনি। অনেকেই বন্ধু হয়নি। কালো বলে কখনো কোন ছেলের দৃষ্টিও আমার ওপর পরেনি। এমনকি কিছু মানুষ তো মুখের উপরই বলত, কাক ও নাকি আমার কাছে হার মানবে। প্রথম প্রথম এসব শুনতে ভীষণ কষ্ট লাগতো। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বালিশে মুখ লুকিয়ে কত যে কেঁদেছি আর নিজেকে শাপ শাপান্তর করেছি তার হিসেব নেই। একসময় মনে দৃঢ় ধারণা জন্মালো, মানুষ আমাকে দেখলে এগুলো বলবেই। ধীরে ধীরে বড় হওয়ার পর বুঝতে পারলাম, এগুলো আমার কষ্টের কারণ না হলেও অন্যের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঠিকই। আমার বিয়ে হচ্ছে না, চাকরি পাচ্ছি না, বাবা মা’কেও কথা শুনতে হয়। আমি আমার ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়। এরপর আরোও দু’টো ছোট বোন আর এক ছোটভাই আছে। পলি, শিলা, আর রানা। বাবার সামান্য কেরানির চাকরি ছিল। সংসার ঠিকমতো চলতো না। কষ্ট করে হলেও বাবা আমাদের এতদূর লেখাপড়া করিয়েছেন যেন অন্তত নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারি। ক্লাসে সবার কাছে অবহেলিত হলেও পড়াশোনাতে ভালো ছিলাম সবসময়ই। কলেজে পড়ার সময় বাবার যক্ষ্মা ধরা পড়ল। চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করে দেওয়া হল বাবাকে। কত কষ্ট করে যে তখন সংসার চলেছে, তার উপর চার ভাই বোনের পড়ালেখা। ভাবতেই চোখে পানি চলে আসে।
একটা শাড়ি পরলাম মিষ্টি রঙের। হাল্কা একটু সাজগোজ করলাম, গায়ের রঙের জন্য ভারী সাজে আমাকে আরও কুশ্রী আর বেমানান লাগে। এ নিয়ে প্রায় ২৫বার একেকটা পাত্রপক্ষের সামনে একেকভাবে সং সেজে যেতে হয়েছে। এবারো গেলাম। তার প্রায় ৩০ মিনিট ধরে আমার ভাইবা নিলেন, আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন।কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে এবার বাবাকে বললেন, “তা ভাই, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে, ছেলের বিয়ের পর তো তার ঘর সাজানোর জন্য কিছু ফার্নিচার লাগেই। ছেলের আবার মোটর সাইকেলের খুব শখ।” এসব শুনে আমরা হতাশ হলাম না। বাবাও না। বললেন,” রহমান ভাই, মেয়ে আমার কালো হলে কি হবে, সে আমাদের চোখের মণি। ভাববেন না যে, তাকে আপনাদের ঘরে তুলে আমাকে উদ্ধার করবেন। মেয়েকে আমরা রাস্তা থেকে তুলে আনি নি, জন্ম দিয়েছি।” আমি স্তব্ধ হয়ে বাবার চোখে তাকালাম, সেই চোখে যেই আত্মবিশ্বাস আর স্নেহ ছিল, তা যেন আমার সকল কষ্ট মুছে দিয়েছিল।
দেখতে দেখতে দুটো বছর কত দ্রুতই না কেটে গেল। শিলা আর রানা কে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বের হলাম। পাশের ফার্মেসী থেকে বাবার কাশির জন্য একপাতা মেডিসিন কিনে নিলাম। নিয়মিত চিকিৎসায় বাবা এখন অনেকটাই সেরে উঠেছেন। ঘড়ি দেখলাম, অফিসের সময় হয়ে গেছে প্রায়। না আর দেরি করলে চলবে না। হাত বাড়িয়ে একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসলাম। হ্যাঁ, সেদিনের গ্রাফিক্স ডিজাইনার পদে ইন্টারভিউ এর ফলাফলে আমার নাম এসেছিল। আমি এখন নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পেরেছি। এই প্রথম কোথাও আমার গায়ের রংকে নয়, বরং আমার যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, আমি কৃষ্ণকলি।
onk sundor hoise 🙂 touched my heart <3
onk valo laglo