ইয়াসরিব খান
আজ গোধূলি বেলায় নির্ঝরিনী’র কোল ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছি ৷ পদধূলি মাড়িয়ে যাচ্ছে বিবস্ত্র মনোহর কোন এক সবুজ গালিচা ৷
যার মসৃণ কমল ছোঁয়ায়
দেহমম শিওরে উঠছে ৷
সেই সবুজ গালিচা আর কিছু নয় নদীর পাড়ের ছোট ছোট ঘাস ৷
কিছুকাল পূর্বেই জোয়ারের একটা
বিবস্ত্র দল এসে ,
যেন সবুজ ঘাসকে ছুঁয়ে দিয়েছে ৷ শিশির ভেজা ঘাসের মতো যেন তাদের গায়েও জোয়ারের নগ্ন দেহের ঘর্ম-বর্ণ বিদ্যমান ৷ তাদের ললাটের জলকণা যেন
রেশমি রুমালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তার দানার সাদৃশ্য ৷
নদীর ওপারে দেখা যাচ্ছে মরা এক শ্মশান ৷
সামনে আছে “গঙ্গা” (নদী) এবং দু’একটি মন্দির ৷ পাশে একটি বটবৃক্ষ শোভা পাচ্ছে ৷ বটবৃক্ষ তার পাতাকে যেন শবদেহের মত জ্বালিয়ে দিয়েছে ৷
গাছের পাতার দিকে পলক পড়তেই লক্ষ করলাম !
মুহুর্তের মধ্যে কোন এক নিকষ কালো ধোঁয়া বটবৃক্ষটিকে আবৃত করে দিলো ৷ তাহলে কেউ কি বটবৃক্ষে অগ্নিসংযোগ দিচ্ছে ?
না ! আসলে তা নয় , কিছু লোক বটবৃক্ষের ছায়ার নিচে একটি শবদেহকে পোড়াচ্ছে ৷
যা কিনা ছিল এক সনাতন ধর্মাবলম্বীর ৷ প্রথমে চিতার নিচে একটি চুুলার মতো গর্ত খুঁড়লো ৷
তারপর উপরে বেশ কিছু কাঠ দিয়ে চিতা তৈরি করল এবং মৃত ব্যক্তির রুক্ষ পদদ্বয় কে হাঁটু থেকে পিছন দিকে ভাঁজ করে কোমর বরাবর নিয়ে এলো
এবং চিতার উপর শুইয়ে উপরে বেশ কিছু কাঠ দিয়ে দিল ৷
আমার অনুমান যদি ভুল না হয় ,
দূর থেকে দেখলাম শবদেহটির সন্তান তার নিজের মাথাকে মুণ্ডিত করে ,
কাঁধে এক কলস পানি নিয়ে ,
তার পিতার চিতার পাশ দিয়ে তাওয়াফ করছে এবং মন্ত্র পড়ছে ৷
তারপর চিতায় আগুন দেয়া হলো ৷
দাও দাও করে সে আগুন জ্বলছে ৷
প্রথমেই পুড়লো শবদেহের চুল তারপর কাপড় অতঃপর চামড়া , এক সময় লাঠি দিয়ে তার শরীরকে খন্ড-বিখন্ড করল ৷
আহ: সে কি মর্মান্তিক দৃশ্য ৷
অবশেষে বাকি থাকলো একমুষ্টি ছাই ৷
তারপর সেই ছাইগুলোকে ছোট্ট একটি মাটির হাঁড়ির ভিতর ভরে শেষ অস্তিত্বকে গঙ্গার জলে বিলীন করে দিল ৷
নিমেষেই একটি জীবন ভষ্ম হয়ে গেল ৷ নির্ঝরিনীর কলকল গান
কেমন যেন থেমে গেল ৷
মাঝিরাও তাদের নাও ভিড়িয়ে
তীরে নিয়ে এলো ৷
আজ নদীর পাশ দিয়ে খুব ভালো ভাবেই গোধূলি বেলা উপভোগ করছি ৷
চিতার আগুন দেখার পরে কেমন যেন ইমোশনাল হয়ে গেলাম ৷
বাড়ি ফেরার পথে কানে ভেসে এলো আশহাদু আল্লা ইলাহা (কালেমায়ে শাহাদাত) এর আওয়াজ ৷
সে দিক-পানে ফিরতেই বিস্মিত হয়ে দেখলাম ৷
শুভ্রবর্ণ পোষাকে একগুচ্ছ মানব দল তাদের কাঁধে শেষ বিদায়ের পালকি নিয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় গোরস্থানের দিকে যাচ্ছে ৷
কৌতূহল মেটানোর জন্য আমিও তাদের পিছু নিলাম ৷
তাদের পাশে যেতেই স্বর্গীয় সুঘ্রাণে মনটা ভরে গেল ৷
এক লোক বলল
“বাইজান আপনে কেডা” ?
আমি বললাম
“আপনাদের মুসলমানের মরা পোড়ানো দেখতে এসেছি”
সে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
“এইসব কি কন বাইজান ?
আপনেরে দেইখ্খা মনে অইতাছে আপনি একজন শিক্ষিত লোক ৷
আমরাতো মূর্খ , কিছু বুজিনা ,
তবুও যেটুকু বুজি ,
আমগো মুসলমানরা জীবিত তাকতে য্যামনি সম্মান পায় মরার পরেও ঠিক হ্যামনি সম্মান পায় ৷
আপনে আমগো লগে আইয়েন ৷
তারপর দেখবেন ”
লোকটার মুখে এমন কথা শুনে আমি ইতিমধ্যে হতবাক হয়ে গেলাম ৷
গোরস্থানের দিকে যেয়ে দেখি চারকোনা একটি মাটির গর্ত এবং পাশে শেষ বিদায়ের পালকি রাখা ৷
পরে তিনজন মিলে খুব আস্তে ধীরে শবদেহটাকে মাটির গর্ভে অর্পণ করলো ৷
ঠিক যেমনিভাবে মা তার সন্তানকে কোলে তুলে নেয় ৷
অতঃপর বাঁশের খণ্ডকে মাটির উপর দিয়ে বিছিয়ে দিল ৷ যেন শবদেহের গায় মাটির টুকরা না পড়ে এবং বাঁশের উপর দিয়ে একটি চাটাই বিছিয়ে দিল এবং তার উপর দিয়ে ধীরে ধীরে মাটি দিতে লাগল ৷
তারপর , সবাই হাত তুলে স্রষ্ঠার কাছে তার স্বর্গের প্রার্থনা করতে লাগল এই হলো মানুষের শেষ ঠিকানা ৷
কেউ আগুনে পুড়ে ভষ্ম হবে ৷
কেউ আবার যত্নসহকারে মাটির নিচে রবে ৷ কাউকে আবার মমিতে করে মাটির নিচে দাফন করে দিবে ৷
কাউকে আবার ভেলায় করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিবে ৷
তবে হ্যাঁ ,
যে যাই করুক না কেন ,
একদিন না একদিন তাকে
বিলিন হতেই হবে ৷
গোধূলি বেলায় এই দুটি ঘটনা দেখে মনটা কেমন যেন আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল ৷
তখন ঠিক সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব ৷
রবিও যেন তার দেহের তেজকে শবদেহের মত বিলীন করে দিয়েছে ৷
দেখে যেন মনে হচ্ছে , নীলাম্বরের মাঝে এক টুকরো রক্তমাখা চাঁদ ৷
মুহূর্তের মধ্যেই নিশাচর পাখিদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল ৷
তটিনীর হাস্যোজ্জল মুখও যেন রাতের মায়াবী আবরণে মলিন হয়ে গেল ৷
“জীবনের সূর্য যে দিন এভাবে ডুবে যাবে সেদিনও থেমে যাবে সব কিছু ,
পাখিরা আর আগের মতো গাইবে না , আকাশের নীলিমাও যেন মলিন হয়ে যাবে , পুষ্পেরাও হারাবে তাদের ঘ্রাণ ,
হারিয়ে যাবে মায়ের ভালোবাসা ,
বাবার আদর , হারিয়ে যাবে আজকের এই গোধূলি বেলা ”
আপন হবে শুধু মাটি , আগুন , পানি এবং কয়েক টুকরো কাপড় ৷
“হারিয়ে যাব আমিও একদিন , হারিয়ে যাবে আমার এ গোধূলি বেলা” ৷
—————————————————————
স্থান : আরবী বিশ্ববিদ্যালয় ,
হাট হাজারী , চট্টগ্রাম
ক্ষণিকের এ পৃথিবী, একদিন সবাইকেই এ মায়া ত্যাগ করতে হবে। সুন্দর লেখনি।
কমল- কোমল
দেহমম- দেহমন
মত- মতো
শুভ কামনা
এটা তো প্রবন্ধ হলো না! গল্প হয়ে গেছে।
আপনাকে এই লেখাটি গল্প বিভাগে জমা দিতে হতো।
তবুও শুভ কামনা।
লেখার ধরণ এবং ধারা দুটোই বেশ সুন্দর এবং ভালো লেগেছে, তবে আসল প্রবন্ধের স্বাদতা যেন কোথাও কোথাও পাচ্ছিলাম না