গল্প লেখকঃ
মাহদী হাসান ফরাজী
(মার্চ – ২০১৮)
……………
শরীফ দরিদ্র পরিবারের বড় ছেলে। পিতা-মাতার বাধ্যগত ও ভদ্র ছেলে। বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে। ধর্মের প্রতি অগাধ ভালবাসা রয়েছে শরীফের। নামাজে খুব যত্নবান। লেখা-পড়াতেও বেশ মনোযোগী। ক্লাসের ফার্স্টবয়। স্বপ্নও ছিল তৃপ্তি ও সুখকর। লেখা-পড়া শেষ করে ভালো একটি চাকরি করবে। ফলে দরিদ্রাঁধার চিঁড়ে স্বচ্ছলতার সূর্যোদয় হবে। ঘুচে যাবে সব দুঃখ কষ্ট। মা-বাবা, ভাই -বোনদের নিয়ে বাস করবে সুখরাজ্যে। জড়িয়ে থাকবে মায়া, মমতা ও ভালবাসার চির বন্ধনে। কিন্তু অদৃষ্টের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ শরীফের স্বপ্নপ্রাসাদ। ঘন আঁধারে ঢাকা পড়ে যায় শরীফের চলতি পথ। আকস্মিক মৃত্যু ঘটে শরীফের বাবার। টাকার অভাবে মাঝ পথেই বন্ধ হয়ে যায় শরীফের লেখা-পড়া। বাধ্য হয়েই হাল ধরতে হয় পরিবারের। এখান থেকেই কালকের ফার্স্টবয় আজকের মৌসুমী ফেরিওয়ালা। ঘুরে ঘুরে মৌসুমের জিনিস বিক্রি করে শরীফ। ফেরারেই চলে শরীফের সংসার।
সেদিন প্রচন্ড গরম পড়েছিল। তাই সকাল সকাল আইসক্রিমের বাক্স নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে শরীফ। হয়তো দু’টাকা বেশি বিক্রি হবে। আর তা দিয়ে মায়ের ঔষধও কেনা যাবে। বেলা গড়িয়ে দুপুর। অগ্নিপিণ্ড সূর্যটাও ঠিক মাথার উপর। আগুন যেন ঠিকরে পড়ছে। রোদ্রের প্রকান্ড তাপে ভ্যাপসা গরম সব কিছু অস্থির করে তুলছে। ঘামে কাপড় ভিজে চুবোচুবো।আইসক্রিমের বাক্স কাঁধে নিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে হেঁটে চলছে শরীফ আপন উদ্দেশ্যে। এরই মাঝে শরীফের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হল আজানের সুমধুর ধ্বনি। এলাকার মাতব্বর গনি সাহেবের বাড়ির পাশের মসজিদ প্রাঙ্গণে এসে থামল শরীফ। পুকুর থেকে দ্রুত অজু সেরে যহুরের নামাজ পড়ে নিল। নামাজ শেষে ছোট্ট মুনাজাত করে মসজিদ থেকে বের হল শরীফ। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আইসক্রিমের জন্য ভিড় করল। শরীফও খুশি মনে বেচা আরম্ভ করল। কয়েকজন এতিম বাচ্চাকে ফ্রিতেই আইসক্রিম দিচ্ছিল। কারণ, ব্যথিত ও অসহায়ের অসহায়ত্ব অসহায় ব্যক্তিই অনুভব করতে পারে। প্রসিদ্ধ সুদখোর মাতব্বরের ছোট মেয়েও পাঁচ টাকা নিয়ে আইসক্রিম কেনার জন্য ছুটে আসে। ভিড়ের মাঝে তিন টাকা দামের আইসক্রিম নিয়ে দু’টাকা না নিয়ে বাড়ির দিকে দৌঁড়। শরীফ টাকা দেয়ার জন্য পিছন ফিরে ডাক দিল। কিন্তু ততক্ষণে মেয়ে উধাও। মাতব্বর সাহেব মেয়ের হাতে শুধু তিন টাকা দামের আইসক্রিম দেখে রাগে ফোঁসে উঠল। গালি দিতে দিতে শরীফের কাছে এসে বলতে লাগল, ‘ঐ ছোট লোকের বাচ্চা! দুই টাকার লোভ সামলাতে পারিস না? ‘শরীফ প্রকৃত বিষয়টি বুঝাতে চাচ্ছিল। কিন্তু শরীফের কথায় কর্ণপাত না করে শরীফকে মারা শুরু করল। শরীফের দাড়ি ধরে হেঁচকা টান মেরে মাতব্বর বলল, ‘দাড়ি রেখে বাটপারি করিস! আজকেই দাড়ি কেটে ফেলবি। ‘শরীফ মাতব্বরের দাড়ি অবমাননার কথা সহ্য করতে না পেরে বলে উঠল, ‘প্রকৃত বিষয়টি না বুঝেই আমাকে মারছেন, মারুন। কিন্তু দাড়ি নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। দাড়ি রাখা আমাদের নবীর সুন্নত (ওয়াজিব)। ‘
অতঃপর দু’টাকার জন্য নৈতিকতার বিসর্জন দিয়ে দু’টাকা নিয়ে শরীফকে ছোট লোক বলে গালি দিতে দিতে চলে গেল সুদখোর মাতব্বর।
শরীফ আপন ভাগ্যের লিখন ভেবে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে নিরবে সয়ে গেল মাতব্বরের অমানবিক নির্যাতন। প্রভাবশালী জালিমের বিরুদ্ধে নিঃস্ব, অসহায়, নিপীড়িত দরিদ্রের আর্তনাদের কোনোই মূল্যায়ন নেই এই দুনিয়ায়। তাই, ঊর্ধ্ব জগতের দরবারে শ্রেষ্ঠ বিচারকের কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়, বেদনাবিধুর মন ও বিষাদময় নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির পথে পা বাড়ায় শরীফ।
০ Comments