আফরোজা আক্তার ইতি
এইবছর মার্চ মাসে আমরা পাঁচজন ফ্রেন্ড মিলে হঠাৎ করেই প্ল্যান করি যে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাব। যেহেতু খুব দূরে কোথাও যেতে পারবো না এবং হাতে খুবই অল্প সময় ছিল তাই আমরা কাছে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলাম। ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম “বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর”-এ যাব। এটি ঢাকা জেলায় ‘রাজারবাগ পুলিশ লাইন’-এর পাশেই রাজারবাগে অবস্থিত। আমাদের সেখানে যেতে পনেরো মিনিটের মতো লাগবে, উপরন্তু আকাশের অবস্থাও ভালো ছিলো না তাই আমরা খুব দ্রুত পায়ে হেঁটেই রওনা দিলাম। প্রায় দশ-পনেরো মিনিট পরে আমরা সেখানে পৌঁছালাম। ততক্ষণে টিপটিপ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেল। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য আমরা মেইন গেট দিয়ে টিকেট কাউন্টারে ঢুকে টিকেট নিলাম। আমাদের কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যাদি যেমন, আমাদের নাম, মোবাইল নম্বর একটি ফর্মে লিখে তাতে স্বাক্ষর দিতে হল। আমাদের ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিষ নিরাপত্তার জন্য তাদের কাছে জমা রেখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মূল ভবনে ঢুকলাম। সেখানে প্রবেশ করতেই হারিয়ে গেলাম অন্য এক পরিবেশে। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম চারদিক। ঝকঝকে আলোয় সজ্জিত চমৎকার জাদুঘরটি স্থাপিত হয়েছে বেসমেন্টে। আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই সর্বপ্রথম নজর কাড়ল বিশালাকার চারটি পুলিশ কর্মকর্তা ও সেনাবাহিনীর পুতুল। তাদের সামনে সুসজ্জিত রয়েছে মেশিনগান, গান, রাইফেল। কিছুক্ষণ সেটি দেখার পর আমরা জাদুঘর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। সেখানে একটি বৃহদাকার, লম্বা ও কালো রঙের ঘন্টা দেখে আমরা আশ্চর্য হয়েছিলাম। সেটির নিচে বিবরণীতে লেখা ছিলো এর নাম ‘পাগলা ঘন্টা’। কোনো এলাকায় অতর্কিতভাবে পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশ করলে পুরো পুলিশ ভবনে সেই ঘন্টা বাজিয়ে সতর্ক করা হতো। সেটির আওয়াজ খুবই জোরালো ছিল বলে সবাই এর শব্দ শুনে ভবনের নিচে একত্রিত হতেন এবং যুদ্ধের জন্য তৈরি হতেন। এজন্যই এর নাম ‘পাগলা ঘন্টা’। এরপর দেখলাম, দেয়ালে একটি কাঁচের বাক্সে সাজানো রয়েছে যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র, তলোয়ার, রাম দা, বিশালাকার চাপাতি, বিভিন্ন আকারের ছুরি। পুরোনো ও ব্যবহৃত বলে প্রতিটিই ছিলো মরচে পড়া। এরপাশেই একটি কাঁচের টেবিলে ছিল যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পুলিশের ব্যবহৃত বেশকিছু রাইফেল ও পিস্তল এবং তার নিচে ফুলের মতো সুন্দর করে সাজানো ছিলো বিভিন্ন আকৃতির বুলেট ও বুলেটের খোসা। আরেকপাশে ছিলো শহীদ পুলিশ কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সযত্নে ভাঁজ করে রাখা রক্তাক্ত শার্ট, ইউনিফর্ম, তাঁদের টুপি, হেলমেট, মাইক ও অন্যান্য বস্ত্র। দেয়ালে কাঁচের ফ্রেমে টাঙানো ছিল মুক্তিযুদ্ধের এবং জাতির পিতার বেশকিছু ছবি ও তার নিচে বর্ণনা। বিশাল বড় একটি কাঁভের টেবিলে ছিলো ছোট ছোট গাছ, ঘরের সমন্বয়ে তৎকালীন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জীবন্ত দৃশ্য। সেখানে ছিলো যুদ্ধে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তাদের বহু পুরোনো একটি রেজিস্টার খাতা, রেডিও। জাদুঘরের একপাশে ছিলো সেসময়ে ব্যবহৃত বিশাল, সুসজ্জিত, চমৎকার একটি রিকশা যা দেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো হা করে তাকিয়ে ছিলাম। সামনেই ছিলো অডিটরি রুম। আমরা সেখানে প্রবেশ করতেই একজন পুলিশ কর্মকর্তা এগিয়ে এলেন। তিনি আমাদের জানালেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের ধারণা উজ্জীবিত করার জন্য এখানে দশ মিনিটের কিছু চলচ্চিত্র দেখানো হয়। আমরা হলরুমে বসে সেই চলচ্চিত্রটি দেখলাম। সেখানে তুলে ধরা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের অবদান। যা দেখে আমার গা শিউরে উঠেছিল আর অজান্তেই চোখের কোণে পানি চলে এসেছিল। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা দোতলায় উঠে এলাম। এখানে একপাশে ছিলো লাইব্রেরি যেখানে আছে অনেক বই, বিভিন্ন পদক, সম্মাননা এবং অন্যপাশে ছিলো একটি ক্যান্টিন, যেখানে বসে কেউ বই পড়ছে, কেউ গল্প করছে, কেউবা চা খাচ্ছে। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা দোতলা থেকে বেরিয়ে জাদুঘরের প্রাঙ্গণে গেলাম। শহীদ পুলিশদের স্মরণে ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি সৌধ। আমরা নিচে নেমে ছাতা মাথায় বৃষ্টিতে ঘুরে দেখলাম পুরো সৌধ এবং জাদুঘরটি। ততক্ষণে বৃষ্টি কমে এসেছে। এবার যাবার পালা। এই সুন্দর, চমৎকার স্থানটিকে রেখে মনভার করে আমরা কাকভেজা হয়ে ফিরে এলাম যার যার নীড়ে।
খুব ছোট্ট একটি ভ্রমণ হলেও আমরা শিক্ষা নিয়েছি অনেক। আমাদের এই দেশমাতৃকা কত রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে, এর পেছনে রয়েছে কত শহীদের অবদান তা এখানে না আসলে হয়তো আমাদের জ্ঞানে অসম্পূর্ণতা রয়ে যেতো। স্যালুট তাঁদেরকে যারা নিজের জীবনের বিনিময়ে আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন একটি স্বাধীন দেশের পতাকা। দেশমাতৃকার প্রতি রইল অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
খুব ভালোভাবে খুঁটিনাটি বর্ণনা করা হয়েছে, যেটা ভালো লেগেছে, তবে ১ টা বানান ভুল লক্ষ করেছি…………
জিনিষ – জিনিস