ইশু মণি
বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে তাসবিহ্ ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে ঘরের এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে।টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ায় অনবরত শব্দ হচ্ছে, বাসার সাথে লাগানো পেয়ারা গাছটার বিশাল বড় ডালপালা গুলো চালের উপর চলে এসেছে বারবার সেগুলো বারি খাচ্ছে যার কারণে শব্দ আরও দ্বিগুণ হয়েছে।
-‘তাসবিহ্, তাসবিহ্? কোথায় তুই মা?’ (আশরাফ সাহেব)
তাসবিহ্’র বাবা আশরাফ সাহেব তখন থেকে তাসবিহ্ কে ডাকছে।কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না, পাবে কই থেকে তাসবিহ্ একদম ড্রেসিং টেবিলের কোণায় লুকিয়ে আছে তাও দু’কান চেপে ধরে এদিকে ঝড়ের শব্দ ক্রমশ বাড়ছে।আশরাফ সাহেব একটু বাহিরে গিয়েছিল মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখে দ্রুত বাসায় চলে আসে বৃষ্টির মধ্যেই।বৃষ্টিতে
আছমা এবং আশরাফ সাহেবের একমাত্র মেয়ে তাসবিহ্।ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে, দেখতে যেমন মাশাআল্লাহ, পড়াশোনা ও তেমন।এই বয়সী ছেলেমেয়েরা বৃষ্টির শব্দ কান পেতে শুনে, বৃষ্টির শব্দ শুনলেই তাদের মনের ভেতরটা আকুপাকু করে কখন গিয়ে এক লাফে বৃষ্টির পানিতে পা ভিজাবে, দৌড়াদৌড়ি করে আম কুড়াবে, পেয়ারা কুড়াবে।কিন্তু তাসবিহ্ তার পুরো উল্টো। ও যে জন্ম থেকে এমন তা না, ওর জীবনেও একসময় এমন ছিলো যখন বৃষ্টির শব্দ শুনলে ও কোন বাঁধা মানতো না।ডানা কাটা পরীর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে যেতো বৃষ্টিতে ভিজতে।
-‘মা?, মা? ঘরে এসো তাড়াতাড়ি ‘
তাসবিহ্’র গলা শুনে আশরাফ সাহেব বুঝলো ও তাদের ঘরে।আশরাফ সাহেব তার স্ত্রীর ঘরে ঢুকে দেখলো ছোট্ট পরীটা দু’কান চেপে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে।আর ওর মা মানে আমার স্ত্রী আসমাকে ডাকছে। আশরাফ সাহেব জলদি গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো ভেজা কাপড়েই।বাবার স্পর্শ পেয়ে তাসবিহ্ বাবাকে ধরে কাঁদতে লাগলো। তাসবিহ্ কাঁদছে এবং সাথে ওর পুরো শরীর কাঁপছে আর বলছে,
-‘ বাবা, শুনতে পাচ্ছো? পেয়েরা গাছটা আবার টিনের চালে শব্দ করছে। বাহিরে তুমুল তাণ্ডব চলছে।মা কই বাবা? বাবা মা কে ঘরে নিয়ে এসো আমি আর বাহিরে যাবো না বাবা। মা কে ঘরে ডেকে আনো।’
আশরাফ সাহেব মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কাঁদতে লাগল।বুকের ভেতরে আরেক তাণ্ডব চলছে যা বাহিরের ঝড়ের চেয়েও ভয়াবহ।তিনি কোথা থেকে ডেকে আনবেন তার স্ত্রী আসমাকে সে তো মৃত।
আজ থেকে ঠিক একবছর আগে এমন এক ঝড়ের দিনে তাসবিহ্ আসমার সব বাঁধা উপেক্ষা করে বাহিরে বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়েছিলো। চারদিকে ছিলো ঘন কালো মেঘ সাথে ঝড় আসমা মেয়েকে খুঁজতে যায় ঠিক সেই সময় বাড়ির সামনের পেয়ারা গাছ টা ভেঙে আসমার ওপর পড়ে।হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে।
তারপর পেয়েরা গাছটা কেটে ফেলা হয়েছে।এবং ওখানেই আসমাকে কবর দেওয়া হয়েছে
কিন্ত তাসবিহ্ অনেক বড় একটা শক্ পায়, মানসিকভাবে এত ভেঙে পড়ে যে ওর ধারণা ওর উপর রাগ করেই ওর মা ওকে ছেড়ে চলে গেছে।তারপর থেকেই আকাশে মেঘ করলে তাসবিহ্ ভয়ে কাঁপতে থাকে, কখনও বাহিরে যায় না।ও ভাবে এই বুঝি আবার ঝড় শুরু হবে আর পেয়েরা গাছটা আবার ওর মা কে মেরে ফেলবে।যে মানুষ একবার মারা গেছে সে বারবার মরবে কীভাবে এই কথাটা তাসবিহ্’র বাচ্চাসুলভ অবচেতন মনে কখনোই বোঝানো সম্ভব হয় নি।
কিন্তু তাসবিহ্ এখনো ঝড়ের সময় সেই পেয়ারা গাছের ডালপালার টিনের চালের সাথে বারি খাওয়ার শব্দ পায়।হঠাৎ করেই আবার তাসবিহ্ চিৎকার করে উঠল,
-‘ বাবা, পেয়েরা গাছটা আবার ভেঙে পড়লো।আমি মা’কে বাঁচাতে পারলাম না বাবা।’
০ Comments