লেখকঃ Adian Rahman
………………
অত্যন্ত মনোযোগের সাথে আবিদুর রহমান চৌধুরী সাহেব কিছুক্ষন আগে তার একাউন্টস অফিসারের দেয়া এবছরের ব্যালেন্স শিটটি ল্যাপটপে দেখছিলেন।
‘বিদু, আমার কথা কি তুই শুনতে পাচ্ছিস? এই বিদু… এই…!’
আবিদ সাহেব প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠলেন, এতটাই চমকে উঠলেন যে, তিনি চেয়ার থেকে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। সামনে কাউকে দেখতে পেলেন না, চারিদিকে ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন, কেউ নেই। কিন্তু মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার সামনে থেকেই কথা বলছিল!
তিনি কি আসলেই কিছু শুনেছেন? মনে মনে ভাবলেন, ইনশাদের ব্যাপারে সারাক্ষন ভাবেন বলেই হয়ত তিনি অবচেতন মনে তার কথা শুনতে পেয়েছেন। খুবই অস্বস্তি নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে এক গ্লাস পানি নিয়ে পান করে তিনি আবার এসে চেয়ারে বসলেন।
‘হা…হা…হা…, তার মানে তুই আমার কথা ঠিকই শুনেছিস, তবে আমার কথা ভাবার জন্য অবচেতন মনে নয়, সত্যিই তুই আমার কথা শুনেছিস। তাই বলে এভাবে চমকে উঠতে হয়?’
এবার আবিদ সাহেব সত্যিই ভয় পেয়ে গেলেন। ইনশাদ কোমায় আছে হাসপাতালের আইসিইউতে, আর তিনি কাজ করছেন সেখান থেকে অন্তত দশ কিলোমিটার দূরে তার অফিসে বসে। তার কথা আবিদ সাহেবের শোনার কোনোই কারণ নেই!
‘ঠিকই ভাবছিস তুই। আমি কোমাতে থাকলেও এখনো মারা যাইনি মনে হয়, তাই তোর সাথে ‘কমিউনিকেট’ করতে পারছি’।
আবিদ সাহেব কী করবেন ভেবে পেলেন না! নিজেকে পাগলের মত মনে হলেও তিনি বলে উঠলেন, ‘সত্যিই তুই ইনশাদ বলছিস? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? তুই আছিস…!’
‘ সব ঠিক আছে, আমি হাসপাতালেই আছি, কীভাবে এটা হচ্ছে আমি জানি না, কিন্তু সম্ভব যে হয়েছে তা তো দেখতেই পাচ্ছিস। যাকগে, ইতিমধ্যেই বুঝেছিস তো, যে, আমি তোর মনের কথাও বুঝতে পারছি? তার মানে, তুই কথা না বলে মনে মনে কিছু ভাবলেও আমি তা শুনতে পাবো। তাই খামোখা তোর কথা বলার দরকার নাই। তোর অফিসের ষ্টাফরা আবার ভাববে, বস পাগল হয়ে গেছে, হা…হা…হা…।‘
আবিদ সাহেব ভাবলেন ঠিকই তো! যাই হোক, এটার কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে না পারলেও বা অবচেতন মনের কথা হলেও, তিনি তার প্রিয় বন্ধুর সাথে কথা বলতে পেরে মনে মনে অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করতে লাগলেন। মনে মনেই তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী অবস্থা দোস্ত তোর এখন?’
‘ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে মজার ব্যাপার হলো, খুবই ভালো আছি। কোন কষ্ট, চিন্তা, দুঃখ কিছু নেই! তোর মত কোনো কাজটাজও নেই!‘
‘আমার সাথে কমিউনিকেট করলি কীভাবে?’
‘আসলে দোস্ত, গত কয়েকদিনে তোকে ছাড়াও আরো অনেকের সাথেই চেষ্টা করছিলাম, হচ্ছিল না। আজ তোর সাথে চেষ্টা করতেই হয়ে গেলো। কিন্তু মাই ফ্রেন্ড, সেই যে প্রথমদিকে কয়েকদিন একনাগাড়ে কতবার করে এসেছিস হাসপাতালে, তারপর গত একসপ্তাহে তো তোকে একবারও দেখলাম না। কী ব্যপার, বন্ধুকে কি ভুলে গেলি?’
আবিদ সাহেবের দু’চোখ পানিতে ভরে গেলো। বেশ কয়েকবার তিনি যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু, তার ডাক্তার বন্ধু নিউরোলজিষ্ট ডাক্তার ইসলাম, যিনি ইনশাদের নিউওরোলজিক্যাল বিষয়গুলো দেখছেন, তার সাথে কথা বলার সময় তাকে বলেছেন, ‘ভাই, প্লিজ যাবেন না। আপনার কষ্ট হবে তার বর্তমান অবস্থা দেখলে’। একদিন হাসপাতালে গিয়েও আইসিইউতে ঢোকেননি। এমনকি গতরাতে তিনি স্বপ্নেও দেখেছেন ইনশাদকে……।
‘তুই স্বপ্নে আমাকে যেটা দেখেছিস, আমিও সেটা দেখেছি, বিশ্বাস না হয় বলি তোকে, কী দেখেছিস?’
আবিদুর রহমান সাহেব নিশ্চিত জানেন, ‘ইনশাদ’ অবিকল স্বপ্নের কথাগুলি বলে দেবে, কারণ আসলে তো তার অবচেতন মনই তাকে ইনশাদের সাথে ‘অদৃশ্য’ কথপোকথন করাচ্ছে!
‘আহ হা… তোর এই বচেতন মনের ব্যপারটা বাদ দে তো? আমি তো তোকে বলেছি, আমি তোর সাথে কমিউনিকেট করতে পারছি। কীভাবে তা জানি না, টেলিপ্যাথি, নাকি অদৃশ্য কোন শক্তির মাধ্যমে, আমি বলতে পারব না। কিন্তু প্লিজ দোস্ত, আমার সাথে কিছুক্ষণ ভালো মত মন খুলে কথা বল! আমার খুব ভালো লাগছে তোর সাথে ‘কথা’ বলতে পেরে। কতদিন হয়ে গেল কারো সাথে কথা নেই, দেখা নেই!’
এবার আবিদুর রহমান সাহেবের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল পড়তে লাগল। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেদিন গলফ খেলার সময় ম্যাসিভ হার্ট এটাকের প্রায় বিশ মিনিট পর হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে পৌঁছায়। এরপর ডি-ফিব্রিলেটরের মাধ্যমে কাউন্টার শক দিয়ে তিনবারের প্রচেষ্টায় তার হার্ট চালু করে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। ব্রেইনের অবস্থা কী তা নিউরোলজিষ্টের পক্ষে এখনো বলা সম্ভব না। কয়েকবার লাইফ সাপোর্ট খোলার চেষ্টা করা হলেও কোন রেসপন্স পাওয়া যায়নি বলে এখনো লাইফ সাপোর্টেই আছে। মৃত্যুর সাথে লড়ছে তার প্রিয় বন্ধু…।
‘এই শালা, তুই কাঁদছিস কেন? আমি মারা যাই নাই বলেই তো তোর সাথে কথা বলতে পারছি। তার মানে এখনো চান্স আছে, হয়ত…, আই উইল বি ব্যাক! তোর তো খুশি হওয়ার কথা!’
আবিদ সাহেব মনে মনে বললেন, ‘তাহলে দোস্ত, তুই ভালোই আছিস?’
‘এক্কেবারে ফাইন, নো উয়ারিজ, নো টেনশান, হা…হা…হা…’
‘সেদিন রাতে কী হয়েছিলো বল তো?’
‘আসলে হয়েছিল কী…’ ইনশাদ তার গল্প বলে চলে, আবিদ সাহেব ঝাপসা চোখ নিয়ে মর্মান্তিক সেই গল্প শুনে যান…
০ Comments