লেখকঃ
সোমা দাশ
( মে – ২০১৮)
ওই, ভাত দে কইতাছি, এত কওন লাগে ক্যান?
রাগে ফুঁসতে থাকে রজত।
কেমনে ভাত দিমু? ভাত ত দূর, কোন খাওনই নাই ঘরে। শরম করে না, রিক্সা চালাইয়া যা পাও, তাও রাইতে ওই বাজারের মাইয়াডারে দিয়া আহো, ঘরে দুইডা ছোড পোলা আইজ তিন দিন মুড়ি খাইয়া রইছে। ভাত চাইলেও দিবার পারি না, আর বাপ হইয়া ভাত চাও নিজের জন্যি, বেশরম।
শুভার কথায় ক্ষেদ।
কি কইলি? ফের মুখে মুখে কতা? রজত শুভার চুলের মুঠি ধরে দরজার চৌকাঠে ঠুকে দিয়ে, জোরে জোরে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। তারপর গজ গজ করতে করতে বেরিয়ে গেল।
শুভা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। নিঃশব্দে কাঁদে। কান্নার শব্দে মানিক আর রতন উঠে গেলে সমস্যা হবে। উঠেই খেতে চাইবে। গত তিনদিন মুড়ি দিয়ে চালিয়ে গেছে, এখন কি দেবে, কিছুই নেই যে দাঁতে কাটবে।
তার স্বামী রজত আজ এক মাস ধরে ঘরে টাকা পয়সা কিছুই দেয় না। মারধর করে শুভাকে, বাচ্চা গুলোকেও ছাড়ে না।
পাঁচ বছরের মানিক আর আড়াই বছরের রতন। ছেলেদের মুখ দেখে আরো কান্না পায় শুভার।
কি ভেবে দরজা ভেজিয়ে ছুটে যায় পাশের কলোনীর জমিলার কাছে। এই জমিলার সাথেই জল আনতে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে কত ঝগড়া করেছিল আগে। এখন সেই জমিলার কাছেই ছুটে যেতে হচ্ছে তাকে।
একেই বলে নিয়তি।
জমিলা বু, ও জমিলা বু, আছ নাকি বাড়িত?
কেডা, শুভা দি নি? শুভার হাঁকডাকে বেরিয়ে আসে জমিলা।
হাত কচলাতে কচলাতে শুভা বলে, বু’জান, কিছু খাওন অইবো? আমার ঘরে কিচ্ছু নাই, আইজ তিনদিন পোলাগুলান মুড়ি খাইয়া থুইছে, আইজ তাও নাই।
জমিলা অবাক হয় না। সে জানে রজতের কীর্তি।
তর কপালে লাগলো কেমনে?
মরদে আইজকাও কিলাইছে নি?
শুভা চুপ করে থাকে।
জমিলা বলে চলে, হুন শুভাদি, মরদে যেন চাইনা, তর পোলাপান গো ভার, সংসারের ভার, তরেই লইতে অইবো। আর কতদিন এমতে মাইনষের বাড়ি বাড়ি ঘুইরা খাওন জোটাবি। আমি তরে একবেলা খাওন দিবার পারি,তারপর?
তুই আমার লগে চল, আইজ এনজিওর বড় দিদিমণি আইবো। হের লগে কথা কইয়া কাম যোগাড় কইরা দিমু। ভাতে মরবি নারে।
হঠাৎ শুভা জমিলার পা ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে, আমারে বাঁচাও বু’জান, আমার পোলাগুলানরে বাঁচাও। আমি মা অইয়া কেমনে পোলাগো খিদার কান্দন সইজ্জ্য করুম।
আরে ছাড় ছাড়, জমিলা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে, কান্দস ক্যান, কাইন্দা লাভ নাই, তুই খাড়া আমি খাওন লইয়া আইতাছি, পোলাগো খাওয়াইয়া, তারপর চল কামের খোঁজে।
জমিলা থালায় কিছু ভাত, চুনোপুঁটির তরকারি, আর ডাল নিয়ে শুভার হাতে দিল।
শুভা তড়িঘড়ি ঘরে ফিরে দেখে ছেলেরা উঠে বসে আছে।
মানিক বলে, মা কই গেছিলা, খাওন দাও।
এই ত দিতাছি বাপ। হাত মুখ ধুইয়া আহো। থালায় ভাত দেখে মানিক রতন খুব খুশি হয়। মানিক মাকে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে, কি মজা, আইজ ভাত খামুরে, কি মজা।
রতন দাঁত বের করে হাসে আর তালি দেয়।
শুভার চোখ ফেটে জল আসে।
গরীবের সংসারে দু’মুঠো ভাত যে অমৃতসুধা। ভাতের চেয়ে বড় আর কিছুই হয় না তাদের সংসারে।
ছেলেদের তাড়া দিয়ে বলে, তাড়াতাড়ি খাইয়া লও, তোগোরে লইয়া জমিলা বু’র লগে বাইর হমু।
মানিক রতনের মুখে পরম তৃপ্তিভরে ভাত তুলে দেয় শুভা। কী যে শান্তি পায় মনে!! অনেক দিন পর ছেলেদের ভরা পেটে ভরা মুখে হাসতে দেখে স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগ করে শুভা। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, ছেলেদের আর উপোসী রাখবেনা সে। কাজ একটা জুটিয়ে নিতেই হবে।
ছেলেদের খাইয়ে বাকি ভাতটুকু রেখে দেয় শুভা, যদি মানুষটা দুপুরে আসে, নয়ত দুপুরেও ছেলেরা এই ভাত খেতে পারবে। শুভা ভুলে যায় নিজের ক্ষুধা। জল খেয়ে পেট ভরিয়ে ছেলেদের নিয়ে রওনা হয়।
************************
বাড়ি ফেরার পথে এক কেজি চাল, ছয়টা ডিম, মসলা পাতি, মসুর ডাল কিনে নেয় শুভা। মনের আনন্দে আজ ছেলেদের রান্না করে খাওয়াবে। এনজিওর বড় দিদিমণি তার হাতের কাজে খুব খুশি হয়ে একটা বাচ্চাদের জন্য নকশীকাঁথা সেলাই করতে দেন।আগাম ৫০০ টাকা হাতেও দেন। মানিক রতনকে এন জিওর স্কুলে ভর্তি করে নিলেন। ছেলেদের সাথে নিয়েই শুভা কাজ করতে পারবে। এতেই নিশ্চিন্ত হল সে। শুভা যদি একসপ্তাহের মধ্যে এই কাঁথা সেলাই করতে পারে, তবে তাকে শাড়ির কাজ করতে দিবেন।
হাতের কাজের শাড়ির বেশ কদর।
বাড়ি এসে সবে রান্না শেষ করেছে, এমন সময় প্রতিবেশী সোলাইমান এসে খবর দেয়, রজতের এক্সিডেন্ট হয়েছে। সে সদরের হাসপাতালে এখন। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে শুভার। সোলাইমান আরো বলে, মাথায় তিন সেলাই হয়েছে রজতের, সবাই মিলে ওষুধপত্রের খরচা যোগাড় করেছে, শুভা যেন খাবারের ব্যবস্থা করে।
শুভা আর দেরী করে না, গামলা ভর্তি করে ভাত, মসুর ডাল, আর ডিমের তরকারি পোটলায় বেঁধে বের হয়ে যায়।
হাসপাতালে গিয়ে দোতলায় রজতের বেডে যায় তারা।
রজত শুভা আর ছেলেদের দেখে চোখের জল ফেলে।
সোলাইমান ওষুধ আনলে নার্স শুভাকে বুঝিয়ে দেয় খাবারের পর কি ওষুধ খাবে।
রজত শুভার হাত ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে, আমারে মাফ কইরা দে শুভা, তরে আর পোলাগোরে যা কষ্ট দিছি, এইসব তারই ফল।
শুভা রজতের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,পোলাপাইনের সামনে কি ছেলেমানুষি করতাছ, আহো খাইয়া লও, ওষুধ খাওন লাগবো। আমি এনজিও গেছিলাম, বড় দিদিমণি আমারে কাম দিছে, তুমি চিন্তা কইরো না, তোমারে আর পোলাগোরে ভাত দিবার পারুম।
শুভা ছেলেদের পাশে বসিয়ে রজতের মুখে ভাতের গ্রাস তুলে ধরে, অত ভাইবো না, খাও,আমি ত আছি। রজত একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে শুভার দিকে, সকালে কেটে যাওয়া কপালের দিকে।
আর শুভা পরম তৃপ্তিতে স্বামীর মুখে ভাত তুলে দেয়।
০ Comments