জাকিয়া সিদ্দিকী।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ জ্বালা করে উঠল হরফের। চিবুকের কালশিটে দাগটার দিকে চোখ পড়তে অজান্তেই চোখ নিচে নেমে গেল ওর। দাগটা যেন ব্যঙ্গ করছে তাকে। এতদিনের পরিশ্রম, চেষ্টা আর স্বপ্ন কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দাগটা প্রশ্নবিদ্ধ করছে আজ হরফ কে।
কি লাভ হল বল তো? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল হরফ। এই যে এতগুলো দিন! অদৃশ্য রেসে নেমে পড়েছিল যেন ও। শুধু কি ও একা ছিল? না, ওর মতই আরো অনেকে ছিল। যারা সবাই সব সব সবকিছু ভুলে একটা স্বপ্নকে ছোঁবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। অনেকেই পেরেছে সেই স্বপ্নকে ছুঁতে। কেউ বা ব্যর্থ হয়েছে।
আজ সকাল অব্দি সেই স্বপ্ন ছোঁবার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে ছিল হরফ। অসস্মাৎ চুরচুর করে ভেঙ্গে গেল স্বপ্নটা। এ যেন বালির বাঁধ। এতদিনের পরিশ্রমও বুঝি বা ভোলা যায়। তবে কিছুতেই ভোলা যায়না বাবার হতাশা আর ঘৃণাভরা সেই তীব্র চাহনি। আর সেই আঘাত! কি ভয়ানক!
স্বপ্নটা দু’বছর আগেও ধরা দিয়েছিল হাতের মুঠোয়। এবার কিভাবে যেন মুঠো ফস্কে বেরিয়ে গেল। ঠিক যেন পারদ।আর ভাবতে পারে না হরফ। তাকাতে পারে না নিজের মুখের দিকে। দু হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফেলল সে।
হ্যা, স্বপ্নটার একটা নাম আছে। নাম তার জিপিএ-৫। এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছিল এবার হরফ। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল যাতে রেজাল্ট টা মাধ্যমিকের মতই হয়। ব্যর্থ হল হরফ। পারল না এবার। অল্পের জন্য, খুব অল্পের জন্য প্লাস মিস করে গেল। নিজেই যখন হতবাক, কি করবে কিছুই ঠাহর করতে পারছে না ঠিক তখনি তার ওপরে চড়াও হলেন বাবা। খামখেয়ালীপনা আর আলসেমির জন্য যে তার এই দশা তা বার বার জানিয়ে দিতে লাগলেন তিনি সবাইকে। ব্যথিত চোখে একবার স্বামির দিকে তাকালেন সুরমা। তার দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট অসম্মতি। তিনি ভাল করেই জানেন, ছেলের চেষ্টার কমতি ছিল না। তবে পেরে না ওঠার কারণে তিনিও কম আশাহত হন নি।
‘তুমিই বল কি করা উচিত তোমাকে নিয়ে? কি হবে এই রেজাল্টে? ভবিষ্যতের কথা ভাবতে বলেছিলাম তোমাকে। আর তুমি…..’
বৃথা আক্রোশে আস্ফালন করতে থাকেন আমিনুল খোন্দকার।
‘যে ছেলে নিজের ভবিষ্যত বোঝে না তাকে নিয়ে কি করা উচিত আমার?
ফের চিৎকার করে উঠলেন তিনি।
ব্যর্থতার গ্লানি চেপে বসেছে হরফের কাঁধে। বাবার ধমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে সে বার বার।
‘পড়া-লেখা জান না তা জানি, দেখেও কি রাখতে পার না? নাকি অফিস-আদালত বাদ দিয়ে এসে আমাকেই ঘরে বসে ওর পড়া-শোনার দায়িত্ব নিতে হবে?”
-স্ত্রীর দিকে ফিরে কর্কশ কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আমিনুল।
জড়সড় হয়ে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইলেন সুরমা। হরফের ব্যর্থতার দায়ভার এবার সুরমার কাঁধেই চাপাবেন আমিনুল। এ নতুন কিছু নয়। সেই ছেলেবেলা থেকে এমনটাই দেখে আসছে হরফ।
সময় যত গড়াতে লাগল আমিনুলের রাগ ততই বাড়তে থাকল। হরফের মুখে সজোরে আঘাত করেছেন তিনি। তাতেও তার রাগ কমেনি। বসার ঘরের সবচেয়ে দামী ফ্লাওয়ার ভাস টা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেললেন আমিনুল। তার বন্ধু-বান্ধব সব রেজাল্ট জানতে চাইলে তিনি কি করে মুখ দেখাবেন সেই চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। বার বার বলতে লাগলেন-
“কারো কাছে মুখ দেখাবার জো রইল না আর”!
বাবার রাগের সাথে পাল্লা দিয়ে হরফও যেন সঙ্কুচিত হতে থাকল। সত্যিই তো! কি করবে সে এই রেজাল্ট নিয়ে? কি করে টিকবে এই ভর্তিযুদ্ধে? কি হবে ভবিষ্যৎ?
গভীর রাত।
কাঁপা কাঁপা হাতে একটা ব্লেড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হরফ। কঠিন তো নয় খুব! সে ভয় পাচ্ছে কেন? আশিক এভাবেই মারা গেছিল। জে.এস.সি পরীক্ষায় যখন আশিক ফেইল করল সেদিন ওর বাবা বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল ওকে। লজ্জা আর ব্যর্থতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে আত্নহননের পথ বেছে নিয়েছিল আশিক। হাতের একটা শিরা ব্লেড দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। ব্যস! এতটুকুই তো! এ আর এমন কি!..
কাল থেকে আর বাবাকে তার জন্য ঝামেলা পোহাতে হবেনা, মা’কে তার জন্যে শুনতে হবে না কোন কটুকথা। এই বা কম কি! সে সাফল্য বয়ে আনতে না পারুক অন্তত বাড়তি টেনশান থেকে তো তাদের মুক্তি দিতে পারে। ভেবে আবার হাতে ধরা ব্লেড অন্য হাতের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল হরফ। রিংটোনের শব্দে হাতটা কেঁপে উঠে ব্লেডটা পড়ে গেল আচমকা।
ফোনটা বেজে উঠেছে হঠাৎ। অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা হাতে নিল হরফ। ভুল হয়েছে। ফোনটা অফ করে রাখতে পারত। স্ক্রীনে রবিনের নাম্বার। রিসিভ করল না হরফ। কেটে যেতেই আবার রিং করল রবিন। অনিচ্ছাসত্বেও বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করল হরফ। নিশ্চয়ই রেজাল্ট নিয়ে এতগুলো প্রশ্ন করবে। তা করবে না কেন? ক্লাসের ফার্স্ট বয় রবিন। সর্বোচ্চ স্থান থেকে কেউই সরাতে পারেনি ওকে আজ পর্যন্ত।
ফোন রিসিভ করতেই রবিনের কান্না ভেজা গলায় বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেল হরফ। ব্যাপার কি? কোন দূর্ঘটনা ঘটল না কি? ওর মত ছাত্রও কি…..
হরফ, তোর রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ না? ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করল রবিন।
হ্যাঁ। তাতে কি? হতভম্ব ভাব কাটছেই না হরফের।
একটু মেডিকেলে আসতে পারবি? মা’র রক্ত দরকার। জরুরী অপারেশন হবে। এখন রক্ত কোথায় পাই বল? ডাক্তার রা কেনা রক্ত নিতে চাইছে না। এক ব্যাগ রক্ত দিবি দোস্ত? মিনতি ঝরে পড়ল রবিনের কন্ঠে।
পুরো ঘটনা শুনল হরফ। মাথা যেন এখনও এলোমেলো লাগছে ওর। তবে মুখে বলল-
আচ্ছা আসছি।
প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি আয়। প্লিজ। ব্যাকুল হয়ে বলল রবিন। অপারেশান শুরু করবে ডাক্তার রা।
আচ্ছা। বলে ফোন কেটে দিল হরফ। ফ্লোরে পড়ে থাকা ব্লেডের দিকে চোখ গেল ওর। ফোনটা না এলে মেঝেতে এখন “বি পজেটিভ” রক্তের বন্যা বয়ে যেত। আর ওদিকে হয়ত একজন অসুস্থ রোগী হসপিটালে শুয়ে রক্তের অভাবে ছটফট করত।
মাথা ঝাঁড়া দিল হরফ। শরীরের তাজা রক্ত মেঝেতে রক্ত বিসর্জন না দিয়ে কোন একজন মায়ের শরীরে সেটা ট্রান্সফার করা যাক। উঠে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। বাবার কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা। মা ও হয়তো ঘুমিয়েছে। ঘুমাক। ধকল গেছে তার ওপর দিয়ে। ডাকার প্রয়োজন নেই। নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ল হরফ। এত রাতে রিক্সা পাওয়াই মুশকিল।
হাঁটতে মন্দ লাগছে না তো! রাহুল কাকার কথা মনে হল আচমকা ওর হাঁটতে হাঁটতে। গোল্ডেন স্টুডেন্ট ছিলেন। সব জায়গায় প্রথম। ভার্সিটি থেকে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে বেরিয়ে জুতোর তলা খয়ে ফেলেছেন একটা চাকরীর খোঁজে। দলীয় পজিশান আর অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত না থাকায় লাভ হল না কোন। চাকুরী না পেয়ে সব সার্টিফিকেটে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দোকান খুলে বসেছিলেন একটা। অবশ্য আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
আচ্ছা, যদি একাডেমিক রেজাল্টই সব সাফল্য হবে তবে কেন রবিন এত হাহাকার করছে? ও তো গোল্ডেন পেয়েছে। কিন্তু মায়ের অসুখের সামনে, মা কে হারানোর ভয়ে ওর কাছে সব কিছু ম্লান হয়ে পড়েছে।
ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। হয়ত মেঝেতে রক্তের মাঝে পড়ে থাকত হরফ এতক্ষণ। এই মিষ্টি বাতাস, স্নিগ্ধ চাঁদের আলো কিছুই দেখতে পেত না আর কোনদিন। আচ্ছা জীবন কি এতটাই ঠুনকো? সৃষ্টিকর্তা কেন পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে? এজন্য যে আশানুরুপ কিছু না পেলে মানুষ নিজেই নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে? না কি চরম হতাশার মুখেও সৃষ্টিকর্তার অপার দয়ার কাছে আত্নসমর্পণ করে নতুনভাবে উঠে দাঁড়াতে? হতাশাবাদী দের কি তিনি পছন্দ করেন নাকি যারা ভালো-মন্দ সব সময়েই তার ওপরে ভরসা করে তারই সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে যায় তাদের পছন্দ করেন? হাঁটছে আর ভাবছে হরফ। এই জীবন তো সৃষ্টিকর্তার উপহার বৈ নয়। এই তো একজনের বিপদে সে মাঝ রাতে ছুটে যাচ্ছে এটা কি জীবনের মানে নয়? দুটো পয়েন্টই জীবনের সব কিছু?
এই রেজাল্ট নিয়ে কি সে পারবে না একজন সুশিক্ষিত, উদারমনা মানুষ হতে? পারবে না একজন দায়িত্ববান আর যোগ্য নাগরিক হতে? পারবে না কি অসহায় কিছু মানুষদের পাশে দাঁড়াতে? পারবে না জীবন-মরণের মালিক সেই রবের শুকরিয়া আদায় করতে? সে হোক ভাল বা মন্দ যে কোন সময়। সবই তো জীবনের অংশ!
কোন বোঝা বা ভার নয় বরং জীবন আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। এর মাঝে হতাশা আসবে, আসবে খারাপ সময়। নিরাশ না হয়ে জীবনকে নব উদ্যমে কাজে লাগানোর প্রতিজ্ঞা করল হরফ। আল্লাহর দেয়া এই “উপহার” তার দেখানো “সরল পথেই” ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ব্যর্থতার ছোবলে আক্রান্ত এই তরুণ। এই ব্যর্থতাকে পুঁজি করে সাফল্যের শীর্ষে ওঠার স্বপ্নটা কি তার একেবারেই অমূলক? রাতের নীরবতার মাঝে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল হরফ। তবে রাতের আঁধার নয় জবাব টা তোলা রইল বহমান সময়ের জন্য।
অসাধারণ একটি গল্প। যতবারই পড়ছিলাম, বেশ ভালো লাগছিল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। এই গল্প একই সাথে চমৎকার এবং শিক্ষামূলক। বর্তমান হতাশাগ্রস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উপযোগী গল্প।
একটা এ প্লাস জীবনের সবকিছু নয়।
বানানে কিছু ভুল আছে।
ছোঁবার- ছোঁয়ার।
অসস্মাৎ- অকস্মাৎ।
স্বামির- স্বামীর।
ফস্কে- ফসকে।
আত্নহনন- আত্নহনন, একইভাবে আত্মসমর্পণ হবে।
শুভ কামনা রইল।
কি লাভ – কী লাভ
হরফ কে – হরফকে
স্বামি – স্বামী
ফস্কে – ফসকে
অনেক সুন্দর লিখেছেন। পড়ার সময় ভিন্ন অনুভূতি কাজ করছিল।
শুভ কামনা।
অনেক অনেক সুন্দর, শিক্ষনীয়
,চমকপ্রদ একটা গল্প।অসাধারণ লেখনী, স্বীকার করতে বাধ্য।
কতো অল্পতেই বুঝিয়ে দিলেন, আত্মহনন সমাধান হতে পারেনা।
সত্যিই তো,খোদার দেয়া এই অমূল্য উপহারের কতোটা মর্ম বুঝে সবে?
যদি সত্যি বুঝতো,তবে এভাবে অকালে কোনো প্রাণ কি আদৌ ঝরতো?
শুভকামনা রইল লেখিকার জন্য।