লেখা:K.H.TUSHAR
(১)
আমি এখন একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো খাবারেরই অর্ডার দেওয়া হয়নি। অবশ্য পেটে ক্ষুধা বা খাওয়ার আশায় এখানে আমার আসা নয়। আসলে আমি বিশেষ একজনের জন্য অপেক্ষা করছি। অনেক হিসেব যে বাকি আছে। সব হিসেব মেলানোর জন্য এটুকু অপেক্ষা তো করতেই হবে।
ওয়েটার ইতিমধ্যে ৬বার এসেছে খাবারের অর্ডার নেওয়ার জন্য। কিন্তু বারবারই তাকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। ওয়েটারের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার। মন চাইছে চোখ মুখ শক্ত করে অনেক কিছু বলতে। সাথে দুই একটা ধমক দিলেও মন্দ হয় না। আর একবার আসুক বাছা, মজা টের পাবে।
ঘড়িতে এখন পাঁচটা বেজে দশ মিনিট। প্রায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেল এখানে আসা। কিন্তু মনে হয় না কোনো লাভ হবে। ওয়েটার আবারো এসে বলছে, “স্যার কী খাবেন? অনেক্ষণ ধরে বসে আছেন। একটা কফি দিই স্যার? একেবারে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা কফি। খেলেই দেখবেন মন একদম ভালো হয়ে যাবে।”
যদিও ভেবেছিলাম বকাবকি করবো, কিন্তু কেন যেন তা আর ইচ্ছে করছে না। আসলে ভেবে দেখলাম ও তো ওর কাজই করছে। এখানে দোষের তো কিছু নেই।
আমি মৃদু হেসে ছেলেটার হাতে একশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বললাম, “আজ উঠি কেমন? অন্য একদিন এসে না হয় খাওয়া যাবে।”
আমি যখন চলে আসছিলাম, তখন ছেলেটার চোখে মুখে একধরনের প্রশ্ন খেলা করতে দেখেছি। ছেলেটা হয়তো মনে মনে আমাকে ‘পাগল’ বলে গালিও দিচ্ছিল।
আসলে মানুষকে অবাক করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। কাউকে যদি অবাক করতে চান, তবে যে কাজটা কেউ কখনো করে না আপনি সেটাই করবেন। দেখবেন সবাই অবাক হতে বাধ্য।
(২)
আমি এখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বাড়ির পথে হাঁটছি। যদিও ওইটাকে আমার কাছে আর বাড়ি বলে মনে হয় না। আর বাড়ি হলেও তাতে আমার কিছু যায় আসে না। মিথ্যা মায়ার সংসারে পিছুটান বলে একটা শব্দ আছে জন্যই হয়তো ফেরা। নাহলে আমি এখন কোথায় থাকতাম কে জানে।
বাড়ি গিয়ে সোজা নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। যদিও আগে এমনটা কখনোই করতাম না। বাড়ি ফিরে সবার সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা না দিলে শান্তিই লাগতো না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই পাল্টে যাচ্ছে। সেই সাথে পাল্টে যাচ্ছে সম্পর্কগুলোও। এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হতে হবে কল্পনাতেও ভাবিনি।
আচ্ছা রক্তের সম্পর্কের বাইরে যদি কোনো সম্পর্ক না থাকে, তাহলে মা যেদিন মারা গেল সেদিন আমি ওতো কেঁদেছিলাম কেন? কথাটা খুব অদ্ভুত শোনা যাচ্ছে তাই না?
আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম যেদিন বড় ভাইয়া বলেছিল, “আমি নাকি ওদের রক্তের সম্পর্কের কেউ হই না।” সেদিন যেন আকাশ থেকে পড়ার মতোই অবস্থা হয়েছিল আমার। আমার কথাগুলো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল ভাইয়া আমার সাথে মজা করছে। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম কথাগুলো সত্যি ছিল। কিন্তু এই রকম একটা সত্যির তো কোনো দরকার ছিল না। আমি তো এইভাবেই বেশ ভালো ছিলাম। নাকি ভালো ছিলাম জন্যই কারো সহ্য হচ্ছিল না।
(৩)
দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। কিন্তু আমার সাড়া নিতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তবু দরজা খুলে দিলাম। বড় ভাইয়া দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বলল, “ভেতরে আসবো?”
আমি বিদ্রুপের হাসি হেসে বললাম, “পুরো বাড়িটাই তো আপনার। এখানে অনুমতি নেওয়ার কি আছে?”
বড় ভাইয়া আমাকে কাছে নিয়ে বসিয়ে বলল, “ভাইয়ার প্রতি খুব অভিমান হয়েছে তাই না? বাহ আমাদের তপু তো তাহলে অনেক বড় হয়ে গেছে বলতে হয়। মান অভিমান করাও শিখে গেছে দেখছি।”
আমার খুব করে ইচ্ছে করছে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে বলতে, “তোমাদের তপু কখনোই বড় হতে চায়নি ভাইয়া। তোমরাই তাকে বড় হতে বাধ্য করছ। সে তো আজীবন তোমাদের ছোট্ট তপুই থাকতে চেয়েছিল। তাহলে আজ কেন তোমরা তাকে এত পর করে দিচ্ছ?”
কিন্তু নাহ, কোনো কিছুই বলবো না। আমাকে দুর্বল হলে তো চলবে না। কোনো কিছুর মায়াতেও আর পড়া যাবে না। মায়া যে বড্ড খারাপ জিনিস।
“কী করবো বল? সত্যিটা তো একদিন না একদিন তোকে জানাতেই হতো। আর তোর বাবাও এখন চায় তোকে এদেশ থেকে নিয়ে যেতে। তাই কোনো উপায় না দেখে তোকে যে বলতেই হলো। আমাকে প্লিজ ভুল বুঝিস না তুই।”
‘বাবা’ বলতে আমার কাছে এতদিন ছিল শুধুমাত্র একটা কবর। এর আগে যতবারই বাবা নামক কথাটা মনে আসতো, সেই সাথে ভেসে উঠত একটা কবরের ছবি। কিন্তু কত সহজেই সেই সত্যিটা বদলে গেল। অজান্তেই কেন যেন ভীষণ হাসি পাচ্ছে। অন্যের বাবা-মাকে নিজের বাবা-মা ভেবে কত কান্নাকাটিই না করেছি। এসবের কোনো মানে হয়।
আর কিছুদিনের মধ্যেই আমি আমেরিকা চলে যাব। আর যাইহোক আমাকে এত সহজে কষ্ট পেলে তো চলবে না। আমেরিকা যাওয়া তো সবার স্বপ্ন থাকে। অথচ কত সহজেই সেই স্বপ্ন আমার জীবনে পূরণ হতে চলেছে ভাবা যায়।
(৪)
আমি দ্বিতীয়বারের মতো বসে আছি সেই রেস্টুরেন্টে। অপেক্ষা সেই বাবা নামক মানুষটির জন্যই। জানি না এর আগেরবারের মতোই এবারও আমাকে হতাশ করবে কিনা।
আজ ওয়েটার ছেলেটা কেন যেন একবারও কাছে আসেনি। কী লাগবে না লাগবে জানতেও চায়নি। হয়তো ভেবেছে আগের দিনের মতোই সময় কাটিয়ে চলে যাব। আসলে মানুষ খুব সহজেই একে অপরের প্রতি ধারণা করে নেওয়াটা পছন্দ করে।
আজ আমিই ওয়েটারকে ডেকে দু’টো কফির অর্ডার দিলাম। ছেলেটা হয়তো কিছুটা অবাক হয়েছে। হোক না অবাক, তাতে আমার কী।
এই প্রথম বাবা নামক ব্যক্তিটির মুখোমুখি আমি। জীবনে প্রথমবার নিজের বাবাকে দেখেও কেন যেন কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না। আগেরবারের মতো এক্সাইটেড ফিলও হচ্ছে না।
অবশ্য যে মানুষটা সকল দায়িত্ব থেকে নিজেকে এতকাল দূরে দূরে রেখেছে, তার প্রতি আর যাইহোক ভালো কোনো অনুভূতি কাজ করতে পারে না।
যে সময়টাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, সেই সময়ই যখন পাশে পাইনি তাহলে আজ কেন হঠাৎ করেই বাবার অধিকার ফলাতে এসেছে তা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি।
জন্মের সময়ই নাকি আমার মা মারা যায়। বাবা তখন আমাকে তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের কাছে দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায়। উনি চাইলেই তো পারত আমাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে। তাহলে অন্তত এতটা বছর একটা মিথ্যা সম্পর্ক আমাকে বয়ে বেড়াতে হতো না।
(৫)
দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই যেন আমার মধ্যে একটা অজানা বিষাদ ভর করছে। কোনো কিছুর বিনিময়েই নিজেকে মানিয়ে উঠতে পারছি না। দুপুরে টেলিফোন করে পাসপোর্ট কনফার্মের খবর দিয়েছে বাবা নামক তথাকথিত মানুষটি। নিজের মধ্যে ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে তা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। খুব করে ইচ্ছে করছে বাকি জীবনটা এখানেই থেকে যেতে। কিন্তু কোন সম্পর্কের জোরেই বা থাকবো? আর আমাকে কেনই বা ওরা থাকতে দেবে। এতদিন না হয় মিথ্যা মিথ্যা একটা সম্পর্ক ছিল। এখন তো সেটাও নেই। এখন তো সত্যিটা আমি জেনে গেছি। আর যাইহোক অন্যের আশ্রয়ে থাকাটা ঠিক না। তাছাড়া আপদ যত তাড়াতাড়ি বিদায় হয় ততই তো ভালো।
(৬)
ভাইয়া খুব করে চাইছিল আমাদের সাথে এয়ারপোর্টে আসতে। আমিই আসতে বারণ করেছি। কারণ আমি আর এক বিন্দুও কারো মায়ায় জড়াতে চাই না। মিথ্যা মায়ায় জড়িয়েই বা আর কী হবে। সত্যিটা তো পাল্টে যাবে না। আর ভাইয়া তো আমাকে একটুও ভালোবাসে না। যদি ভালোই বাসতো তবে কি আমাকে এতটা পর করে দিতে পারতো নাকি।
আসার সময় ভাইয়াকে চিরকুটে লিখে এসেছি, “তোর জিনিসে আর কেউ ভাগ বসাবে না। সবকিছু তোকেই দিয়ে গেলাম। তোর বাবা-মাকে যে এতদিন আমার সাথে শেয়ার করেছিস সেজন্য আমি তোর কাছে কৃতজ্ঞ। কোনো ভুল করলে ক্ষমা করে দিস। আমার এই মুখটা তোকে আর সহ্য করতে হবে না। আশা করি খুব ভালো থাকবি। আমিও চাই তোরা ভালোই থাক। সেজন্যই তো তোদের সবাইকে ছেড়ে একেবারে চলে যাচ্ছি।”
আমি জানি ভাইয়া যতবারই চিরকুটটা পড়বে ততবারই খুব কাঁদবে। কাঁদুক না, তাতে আমার কী। সবাই মিলে আমায় এত কাঁদিয়েছে, এটুকু কষ্ট তো ওদেরও প্রাপ্য।
(৭)
এতদিন শুধু মাথার উপর দিয়ে প্লেন যেতে দেখেছি। আজ হয়তো আমিই কারো মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছি সবকিছু ছেড়ে। নিজেকে ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটা বাড়ি সেই সাথে কিছু মানুষজনের মুখ। কত স্মৃতিই না চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বাইশটা বছর কম তো সময় নয়। আচ্ছা আমার মতো কি ওদেরও কষ্ট হচ্ছে?
যদি কষ্টই হবে, তবে আসতে কেন দিলো? যদি একবার বলতো, “তপু তুই যাস না” তবেই তো আমি সবকিছু ভুলে থেকে যেতাম। তাহলে কি এতদিনের সবকিছুই লোক দেখানো ভালোবাসা ছিল? এতদিনে আমার উপর একটু অধিকারও কি জন্মায়নি ওদের, যে অধিকারের জোরে সারাজীবন ওদের সাথে থাকা যায়।নাহ, আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না। চোখটা ভীষণ ঝাপসা হয়ে আসছে।
জানি সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই একসময় ফিকে হয়ে যাবে। তখন এগুলো বলতে বোঝাবে কয়েকটা স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই না। স্মৃতি হয়তো মানুষকে কষ্ট দেয়, কিন্তু স্মৃতি আকড়ে কেউ সারাজীবন বেঁচেও থাকে না। আমিও হয়তো অনেক পরিবর্তন হয়ে যাবো। সেই সাথে বদলে যাবে সব চেনা সম্পর্ক। ‘সম্পর্ক’ নামক শব্দেটার সাথে ‘অতীত’ নামক আরেকটা শব্দ যুক্ত হবে। সবই শুধু সময়ের অপেক্ষা।
নয়-নই(যেহেতু নিজের কথা বলা হয়েছে)
ওঠা-উঠা
যায়-যাই
নাহলে-না হলে(না আলাদা বসে যেহেতু শব্দ)
কি-কী
করছ-করেছো
ছোট্ট-ছোট
বাহ্ বেশ ভালো লিখেছেন। একটা ছোট ঘটনাকে কত বড় না করেছেন। পড়ে মনে হচ্ছে শেষ হয়েও হয়নি, গল্পটা আরেকটু লিখলে ভালো হতো। বানানে ভুলের মান কমই, অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।
অসাধারণ লিখেছেন।
অন্যরকম একটা থিম ছিলো।
ভালো লাগলো।
মনোমুগ্ধকর লেখা।প্রতিটা লাইন হ্নদয় ছুঁয়ে গেল।
স্মৃতি হয়তো মানুষকে কষ্ট দেয়।
স্মৃতিকে আকড়ে ধরে কেউ বাঁচে না।
লাইনগুলো ভালো ছিলো।
বানানেও কোনো ভুল নেই।
দুর্বল–দূর্বল
আবারো–আবারও
শুভ কামনা রইলো।
লেখার হাত ভালো,লিখে যান।
আমিও ঠিক এমনটাই ভাবি যেসব সন্তান বাবা-মায়ের কাছে আশ্রিত থাকে, তাদের স্নেহের পরশে থাকে, কিন্তু যখন জানে এতোদিন যাদের মা বাবা বলে ডেকেছে তারা আসলে তার কেউই না, তখন কেমন লাগে তার। একষ্টের কি কোন সীমা আছে? নিজের বাবা মা থাকা স্বত্তেও তারা আসল বাবা মা না, প্রকৃত বাবা মাকে সে দেখেও নি এই কষ্ট যে কতটা কষ্ট। যখন তারা একথা শুনে তখন পপুরো দুনিয়াই তাদের কাছে নিষ্ঠুর মনে হয়, পালিতা পিতামাতাকে তুচ্ছ মনে হয়!
গল্পটা অন্যরকম ছিল। ভালো লাগলো বেশ। বানানেও তেমন কোন ভুল ছিল না।
অনেক অনেক শুভ কামনা আপনাকে।