লেখক—মেহেদী হাসান হাসিব
সাইফুল আলম কয়েকদিন আগে বিয়ে করেছে। বয়স আটত্রিশ। আর তার বউয়ের বয়স সতেরো। কিন্তু তার বউয়ের সুস্বাস্থ্য আর শরীরে গঠন দেখলে বোঝার উপায় নেই তার বয়স সতেরো। মনে হবে– পঁচিশ বছর বয়সী দামরী।
সাইফুল আলমের বিয়েতে কোন মত ছিল না। তার ছোট ভাই সাদেক বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে ছিল। যতক্ষণ না তার বড় ভাইয়ের বিয়ে হচ্ছে ততক্ষণ সে বিয়ে করতে পারছিল না। সমাজ বলে একটা কথা আছে। আর ব্যাপারটা ভালও দেখাবে না। তাই সাদেক তার বড় ভাইয়ের বন্ধুদের দিয়ে অনেকবার বলিয়েছিল বিয়ে করে ফেলতে, তার বয়স আরো বাড়লে তখন আর কেউ মেয়ে দিবে না।
সাইফুল আলমের বন্ধুরা তাকে বুঝিয়েছিল,‘‘দেখ তোর বয়স হইয়া যাইতাছে আর ওইদিকে তোর ছোট ভাই সাদেকেরও তেত্রিশ বয়স চলতাছে ওই বেচারা তোর জন্য বিয়া করতে পারতাছে না। লোকজনরে দিয়া বলাইতাছে তোরে বিয়ার কথা কইতে।’’
সাইফুল আলম বলল, ‘‘আমি দেখতাছি। বিয়া যদি করতে অয় তাইলে ছোট ভাইয়ের লেইগ্যা করুম। আমার লেইগ্যা ছোট ভাই আটকাইয়া থাকব কেন। যা অরে কইস বিয়া করুম মাইয়া দেখতে।’’
সাইফুল আলমের বিয়ের ব্যাপারে এমন উদাসীনতার মূলে তার যৌবনকালের একটা প্রেমের কাহিনী জড়িত আছে। তার কাহিনীটা অনেক সিনেম্যাটিক।
তখন সে ট্রাকের ড্রাইভার ছিল। সন্ধ্যার পর থেকে তার হাতে আর কোন কাজ ছিল না। এলাকার গলিতে আড্ডা মারত আর সামান্য বখাটেপনা করত। আর বখাটে ছেলেদের বখাটেপনার মূল উৎস হচ্ছে সুন্দরী মেয়েরা। যৌবনের এই সাইফুল বখাটেও রিমি নামের এক মেয়েকে ইভটিজিং করতে গিয়ে তার প্রেমে পড়ে যায়।
মেয়েটাও তার গলির মেয়ে। সমস্যা একটাই মেয়েটা পড়াশোনা করে। প্রতিদিন রাত আটটার সময় কোচিং ছুটি হলে গলি দিয়ে হেঁটে যায়। সাইফুল এমন কোন দিন বাদ নেই যেদিন মেয়েটার পেছন পেছন যায়নি। সপ্তাহে শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন মেয়েটাকে না দেখলে তার ঘুম হত না। ঘুমতে গেলে বিছানায় একবার একাত আরেকবার ওকাত করতে করতে কখন যে সকাল হয়ে যেত। আর এভাবে মেয়েটাকে মনের কথা না বলে থাকতে না পারার যন্ত্রণায় সারাক্ষণ মন ছটফট করতে থাকত।
একদিন সাইফুল মেয়েটার রাস্তা আটকিয়ে গোলাপ ফুল দিয়ে প্রপোজ করে। কিন্তু মেয়েটা কোন কথা না বলে সোজা তার রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাসায় চলে যায়। তার পঁনেরো মিনিট পর সাইফুল তখন চায়ের দোকানের বাহিরে দাঁড়িয়ে চা পান করছিল। হঠাৎ ১৫-২০ জন তাগড়া ছেলেপেলে হাতে ক্রিকেট খেলার স্টেম্প নিয়ে আসতে দেখল।
ছেলেদের কয়েকজনকে দূর থেকে দেখে সাইফুল চিনতে পারল, ওরা এলাকার স্থানীয় লোক। এই গলির ছয়তলা বাড়ি নামে যে বাড়িটা পরিচিত ঐ বাড়ির মালিকের তিন ছেলে। আর পাশের বাড়ির মালিকের দুই ছেলে। তারা সবাই নাকি আবার আত্নীয়।
সাইফুল খেয়াল করল ছেলেগুল তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সাইফুল চায়ের কাপ মুখ পর্যন্ত উঠাতে গিয়ে বুক বরাবর এসে থামিয়ে ধরে রেখে তাদের দেখছে—তারা কাকে আজকে আবার হাত-পা ভাঙতে যাচ্ছে। একি! একজন এসেই তার চায়ের কাপ বরাবর স্ট্যাম্প দিয়ে জোরে আঘাত করল। তারপর সাইফুলকে যে যেভাবে পারল পেটাল।
তার মাথা ফেঁটে যায়। চোখের উপরে ভ্রুতে কেটে যায় আর সাথে এক হাতও ভেঙে যায়। মারার পরে তাকে ছয়তলা বাড়ির বড় ছেলে বলে যায়, ‘‘তোর সাহস অনেক হইছিল না? আমার ছোট বোনের দিকে নজর দিসস।’’ সাইফুল তখন বার বার চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘‘ভাই আর করুম না ভাই-ভাই আর করুম না ভাই-আমারে মাপ কইরা দেন ভাই।’’
সাইফুল ভেবেই পাচ্ছিল না,—এমন গুন্ডাদের ঘরে ওরকম সুন্দর আর ভাল একটা মেয়ে কিভাবে হল। সৃষ্টিকর্তা আসলেই খুব রহস্যময়।
তারপর থেকে তার আটত্রিশ বছর হওয়া পর্যন্ত কোন মেয়েকে মনে ধরেনি।
সাইফুল আলমের বিয়ের একমাস পর তার ছোট ভাই সাদেক বিয়ে করে ফেলে। সাদেকের বউয়ের রুপ গুন নিয়ে কোন কথা তোলার মত নেই। শুধু সাইফুলের বউ সমালোচনায়।
সাইফুল আলম তার গ্রামের বাড়ি রয়পুর থেকে এই মেয়েকে বিয়ে করে। এই মেয়েরও বিয়ে হচ্ছিল না—মোটা যেমন তেমন লম্বা, গায়ের রংও শ্যাম কালো। এই গ্রামের মেয়েদের শরীরের বয়ঃসন্ধিকালের একটু লক্ষণ দেখলেই তাদের বিয়ে দেয়া হয়। অথচ শারমিনেকে দেখতে এসে কেউ পছন্দ করেনি। দুইএকজন রাজি হয়েছিল মোটা অঙ্কের যৌতুকের দাবিতে। সবশেষে সাদেক তার ভাইকে নিয়ে মেয়েকে দেখতে এল। সবার মত গন্ডা গন্ডা প্রশ্ন না করে সোজা বিয়ের কথা পাকাপুক্ত করে আসে।
শারমিনের বাবা-মারও আফসস ছিল না। কারণ তার জন্য এর চেয়ে ভাল হয়ত আর প্রস্তাব আসবে না। সব কপালের দোষ।
গ্রামের বাড়িতেই বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছিল। তারপর সাইফুল ঢাকা এসে মেস থেকে বের হয়ে বাসা ভাড়া করে। সিঙ্গেল এক রুম পাওয়া গেল না। শেষে এক বন্ধু বলল, ‘‘আমরা তিন রুম ভাড়া নিছি। সাথে ছোট ডাইনিং আছে। কিন্তু আমাদের দুইরুমের বেশি প্রয়োজন নাই। এক রুম ভাড়া দিতে চাই। তুই যদি নেস তাহলে ভালই হইল তোরও আমারও।’’
বউ নিয়ে এসে উঠল সেই বাসায়। তার বউ আর সংসারে প্রথম কয়েকমাস ভালই মনোযোগ ছিল। কিন্তু যেমন বউ তেমন তার কর্ম। বাসার কোন কাজ কর্মে হাত দেয় না। ঠিক মত রান্না করে না।
একদিন তিনি তার বউয়ের এমন উদাসীন সংসার জীবন দেখে আর সহ্য করতে না পেয়ে বলে দিলেন,
–ঘরের কাম করতে পারলে তুই আমার লগে থাকবি নয়ত সোজা বাপের বাড়ি যাবিগা।
–আমি কি ঘরের কাম করিনা?
–কী করসটা কি তুই? হারাদিন হুইয়া থাকস আর আমি ঘরে আইলে তারপর কাম করস? আর রুম গোছান, ঝাড়ু দেয়াতো আমি করি, জামাকাপড়ডাও আমি ধুই—তোর সমস্যাডা কী?
একসময় সাইফুল আলম মারধর শুরু করে গ্রামে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
কয়দিন না যেতেই তার বাপ ফোন করে বোলে অনুরোধ করে আবার মেয়েকে পাঠায়–বাবা আমার মেয়ের কী দোষ! ঐইতো সংসারে কোন কাজ কর্ম করে নাই। আস্তে আস্তে অভ্যাস হইয়া যাইব।
তারপর কাজ-কর্মের অভ্যাস হয়ে গেলেও নতুন ঢাকায় সাবলেট বাসায় পাশের রুমের ভাবিদের সাথে তার আড্ডারও অভ্যাস পেয়ে বসে। এখন তার নতুন করে মার খেতে হয় ভাত চুলয় দিয়ে পাশের রুমের ভাবির সাথে কথা বলতে গিয়ে ভাত জাউ করে ফেলা নয়ত তরকারির ঝোল শুকিয়ে ফেলা, মাঝে মাঝে তরকারিসহ পুরিয়ে ফেলা।
নতুন অজুহাতে সাইফুল আলম তার বিরুদ্ধে আরো শক্ত সিদ্ধান্ত নেয়। তাকে প্রত্যেকটা কাজ-কর্মে মারধর না করলে ঠিক হবে না। তাই উঠতে বসতে থাপ্পর, লাথি শারমিনের পাওনা হতে লাগল। ইদানিং সাইফুল কাজ করে এসে দেখে শারমিন পাশের রুমে গিয়ে চিংপটাং হয়ে শুয়ে আছে, গায়ের কাপড় ঠিক নাই এমন ভাবে অন্য ভাবির বাসায় শুয়ে থাকতে দেখাটা তার খারাপ লাগে।
যখনি শারমিন টের পেল সাইফুল আলম বাসায় এসেছে তখনি তাড়াতাড়ি করে উঠে নিজের রুমে গেল। রুমে ঢুকতেই সাইফুল আলম হুংকার দিয়ে বললেন,
–এই তোর স্বভাব দেহি দিন দিন নষ্ট হইতাছে। তুই ঐ বেডিগো ঘরে গিয়া এম্নে হুইয়া আছিলি কেন? তোর কী ঘর নাই?
–ঘরের ভিত্রে একটা টিভিও কিনি দেওনা আবার বড় বড় কথা কও—
–কী কইলি! টিভি তোর বাপ কিন্না দিব। তোর জ্বালা বহুত সহ্য করছি। তুই বাইরা। এহনি তোর বাপের বাড়ি যা। অনে বইয়া বইয়া টিভি দেহিস। যা!
সত্যি সত্যি চলে গেল। সাইফুল সেদিন রাতে ভাত খেল না। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। যতকিছুই করেছে কিন্তু শেষে তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়াটা ঠিক হয়নি। এই নিয়ে কতবার বাপের বাড়িতে পাঠিয়েছে ঠিক নেই।
ইদানিং সাইফুল আলমের তার স্ত্রী জন্য শূন্যতা লাগে। লাগার কারণও আছে—সেই কবে বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছে। এইবারতো একবারও ফোন করে আসতেও চায়নি। সাইফুল আলমের খুব একা একা লাগে। তিনি আজকাল সন্ধ্যার পর কাজ থেকে এসে পাশের রুমে তার বন্ধু আর ভাবির সঙ্গে গল্প করে।
তার বন্ধুর একটি মেয়ে আছে ক্লাস সিক্স এ পড়ে। সাইফুল আর তার বন্ধু ও ভাবি গল্প করতে বসলেই মেয়েটি পাশের রুম থেকে এসে খাটের এক কোণে বসে ড্যাবড্যাব করে কথা শুনে কিছু বুঝুক আর না বুঝুক। সাইফুল আলমকে ছোট মেয়েটি জিজ্ঞেস করল,
–আঙ্কেল আন্টি কোথায়? কতদিন আন্টিরে দেখি না।
–আন্টি ঘুরতে গেছে।
–আপনি কি আন্টিরে অনেক মারেন?
–নাতো মা। তোমার আন্টিরে আমি অনেক ভালবাসি।
সাইফুল আলম নিজেই অবাক হয়ে যায় ‘‘তোমার আন্টিরে আমি অনেক ভালোবাসি’’–কথাটা কি সে বলতে চেয়েছিল? নাকি মুখ ফসকে মাঝে মাঝে সত্য কথা বেরিয়ে যায়।
সাইফুল আলম রাতের রান্নাবান্না শেষ করে খেয়ে তারপর খাটের উপর মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসল। ডায়েল করল তার শ্বশুরেরর নাম্বার—
–হ্যালো! আস্সালামু আলাইকুম আব্বা। কেমন আছেন?
মোবাইলের স্পিকারে শ্বশুরের গলায়,
–হুঁ ভাল। তুমি কেমন আছ?
–ভাল। শারমিন কেমন আছে?
–শারমিন! ওহ—বাবা–একটা সুসংবাদ আছে, আাজকেই তোমারে জানাইতাম। তুমি আব্বা হইবা।
–কন কি! কবে, আপ্মে আমারে জানাইলেন না কেন?
–জানাইতাম। আজকেই আমরা জানলাম।
–আচ্ছা, আব্বা আমি কাল্কাই আইতাছি শারমিনরে নিতে।
সাইফুল আলম কালকের কথা বলে আজকেই রওনা হয়।
একটি শান্ত স্নিগ্ধ অনুভূতি তার মনকে চঞ্চল করে দেয় শারমিনের কাছে ছুটে যাওয়ার জন্য। কোন অভিমান, রাগ আজকে তার আনন্দকে আটকে রাখতে পারবে না। শারমিনকে সাথে নিয়ে সে স্বপ্নের জাল বুনবে। নানা গল্প করবে রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আর হঠাৎ তার পেটে হাত রেখে বলবে–আমার সুজন আসবে কবে পৃথিবীতে। সুজনের সাথে কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে সে শিশুখেলা খেলবে সারাদিন, আর তাকে কোলে নিয়ে বাহিরে গিয়ে আকাশ দেখাবে, পাখি দেখাবে, রঙধনু দেখাবে আর তাদের পাশের বিল্ডিং এর কুকুরটাকে দেখিয়ে বলবে বাবা বলত এটা কী? তার সুজন তার মাকে ভয় পেয়ে যখন দৌড়ে ছুটে আসবে তার কাছে তখন তিনি তাকে এক নিমিষেই কোলে তুলে কপালে একটা চুমু খাবে। বাসটা এখনো পৌঁছাচ্ছে না কেন? রাস্তা আর কত বিশাল। কখন সে তার শারমিনের কাছে গিয়ে বলবে, চল, তোরে নিতে আইছি।
এত রাতে কে কড়া নাড়ে। শারমিন হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলেই খুব ভয় পেয়ে গেল। এই গ্রামে নাকি অনেক পরিচিতদের রুপ ধরে জ্বীন-ভূত আসে। আর বাচ্চা পেটে থাকলেতো এগুল বেশি ঘটে। তখন পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। এই জ্বীনটাও কি তার স্বামীর রুপ ধরে তার পেটের বাচ্চাকে নষ্ট করতে এসেছে। এমন থমথমে রাতে কোন অমঙ্গল হয় ভেবেই তার ভয় বেড়ে যেতে লাগল। অন্ধকারে সে এখনো নিশ্চিত হচ্ছে পারছে না।
হঠাৎ শারমিনের মা ঘুম ভেঙে মেয়েকে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উঠে দরজার সামনে এসে চোখ টিমটিম করে কতক্ষণ তাকিয়ে বলে উঠল–
–আরে বাবা তুমি! বললা যে কাল আসবা আর আজকে এমন রাইতেই আসলা।
–আইলাম।
তারপর লাইট জ্বালিয়ে শারমিনের মা তার দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘‘কিরে এতক্ষণ দরজা খুইলা দাঁড়াইয়া আছিলি–জামাইরে ভিত্রে আইতে কইলিনা।এমন রাইত কইরা আইল।’’
শারমিন কোন উত্তর না দিয়ে খাটে গিয়ে বসল। শারমিনের মনে একটা চাপা অভিমান সাইফুলকে দেখে জেগে উঠল। সাইফুল তার পাশে গিয়ে বসল। এতক্ষণে শাশুড়ি বাইরের থেকে অপর ভিটার বাড়ি থেকে তার স্বামীকে খবর দিতে গেল, তাদের জামাই এসেছে।
সাইফুল তার বউয়ের হাতের উপর হাতটি রেখে বলল, ‘‘কিরে যাবি–চল।’’
শারমিন হেসে অভিমানী স্বরে বলল, ‘‘তখন না ঘরতে বাহির কইরা দিছ?’’
সাইফুল বলল, ‘‘আর করমু না–চল।’’
তারপরেই দিনই সাইফুল আলম শারমিনকে নিয়ে চলে এল। এখন শারমিনের প্রতি তার যত্নের কমতি নেই। বরং সে রান্নাবান্নাও এখন করে দেয়। শারমিনকে সে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। সেদিন তাকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলছ,
–হ্যাঁরে! পোলা হইব না মাইয়া বোঝার উপায় আছে?
–আমি কেমনে কমু? তোমার কী লাগব?
–আমারতো পোলা লাগব।
–যদি মাইয়া হয়?
–পোলাই হইব। আমি নামাজ পইড়া আল্লার কাছে পোলা চাইতাছি। কত মানত করতাছি আল্লায় যেন আমারে পোলা দেয়। বাপের কষ্ট বুঝব পোলায়।
সাইফুল আলম প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে একটা ছেলে চায়। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে। পীর-ফকিরের কাছে মানত করে।
তার স্ত্রী সন্তান সম্ভাবনা এই খবরটা তার বন্ধু-বান্ধব জানতে পারলে তাকে বলে–কিরে সাইফুল তুই আব্বা হবি; কিরে তোর পোলা হইব না মাইয়া–আলট্রাস্নোগ্রাফি করাইছস; মিষ্টি কবে খামু ইত্যাদি ইত্যাদি।
কোথায় হতে সে খোঁজ পেল একজন কবিরাজ কোন গাছের বাকল বিক্রি করে সেটা নাকি পানিতে মিশিয়ে খেলে ছেলে সন্তান হবে। সেই বাকল আজকে এক সপ্তাহ ধরে শারমিনকে খাওয়াচ্ছে। রাতে ওযু করে শোয়ার আগে কোরআনের কয়েকটা আয়াত পড়ে–মসজিদের ইমাম বলছিল রাতে শোয়ার আগে প্রতিদিন এক হাজার বার পড়তে হবে। যেখান থেকে আর যার থেকেই যা কিছু শুনছে না কেন সেটা পরখ করে দেখতে বাকি নেই। বলা যায় না আল্লাহ কোন উছিলায় তার ছেলে পাওয়ার ইচ্ছা পূরণ করে দেয়।
আলট্রাস্নোগ্রাফি রিপোর্ট সাথে ডাক্তারে চেম্বারে নিয়ে গেল শারমিনকে। ‘‘হুঁ, সব ঠিক আছে, মেয়ে হবে।’’ সাইফুল মানতে রাজি না– ডক্তারের হয়ত ভুল হয়েছে, শুনেছে– অনেকের আলট্রাস্নোগ্রাফি রিপোর্টে যা আসে সেটা একশো পারসেন্ট সত্যিও না। তার এক বন্ধুর ছেলে হবে বলেছিল শেষে ডেলিভারির সময় মেয়ে হয়। সে এই আলট্রা-টালট্রা বিশ্বাস করে না। তার বিশ্বাস তার ছেলেই হবে কারণ সে যেভাবে আল্লাহর কাছে চেয়েছে, এমন কোন কিছু নেই যে সে করেনি।
শারমিনের বাবা এসে শারমনিকে নিয়ে গেছে তারা চায় তাদের কাছে থেকেই যেন তাদের মেয়ের ডেলিভারি হয়।
আবার সাইফুল আলমের মন ছটফট করে শারমিনের জন্য। সে পাশের রুমে তার বন্ধুর সাথে অবসর সময় কাটানোর যায়। সাইফুলকে দেখেই তার বন্ধুর মেয়েটি গল্প শোনার জন্য পড়া থেকে উঠে খাটের কোণায় এসে গুটি মেরে বসেছে।
–সাইফুল আঙ্কেল আপনার কি মেয়ে হইব?
–মেয়ে না ছেলে।
–আম্মু বলছে আপ্নের মেয়ে হইব আমি শুনছি।
–তোমার আম্মুয় ভুল কইছে।
–সাইফুল আঙ্কেল আপ্নের মেয়েটা অনেক কিউট হইব।
–আরে বাবা, মেয়ে নাতো ছেলে–ছেলে।
–না, আপনার মেয়েই হইব।
সাইফুলের মেজাজটা গরম হয়ে গেল এই ছোট অবুঝ মেয়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে। তিনি উঠে চলে গেলেন।
সন্ধ্যার সময় আবার সে মন খারাপ করে এসে তার পাশের রুমে গিয়ে বসে রইল। তার বন্ধু বলল,
–কিরে হইলোডা কী তোর?
–(কোন উত্তর নেই)
–কিরে কিছু হইছে—মন খারাপ কেন?
–ভাবিই ঠিক কইছিল মাইয়াই হইছে।
–আলহামদুলিল্লাহ! এইডাতো খুশির কথা। কহন হইছে ডেলিভারি?
–বিকালে।
–তুই খুশি হস নাই?
–আমিতো পোলা চাইছিলাম।
–আরে ধূর! মাইয়ারা হইল গিয়া লক্ষী–লক্ষী। মাইয়া হইলে কপাল খুইলা যায়। দেখ তোর কপালও খুইলা যাইব।
সাইফুল তার সন্তানকে দেখতে গ্রামের বাড়ি যায়। ফুটফুটে একটা মেয়ে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে ছোট চোখে তাকিয়ে আছে। সে কোলে নিল না। তার শ্বাশুড়ী বলছে, ‘‘বাবা একেবারে তোমার চেহারা পাইছে।’’ কিন্তু সে খুশী হতে পারল না।
ধীরেধীরে সে আরো হতাশ হতে লাগল, তার চোখের নিচে কাল দাগ বসতে থাকে। সে নিজেকে কোন কাজ কর্মে মনোযোগ বসাতে পারে না। সব কেমন পাল্টে গেল।
আগের মত সে কারো সাথে কথা বলে না। এখন আর নামাজও পড়ে না। তাকে দেখে যে কেউ বলে দিতে পারত যেন সে সাতদিন না ঘুমিয়ে আছে।
কেউ তাকে জিজ্ঞেস করলে, ‘‘সাইফুল ভাই আপনার কী হয়েছে? আপনি কি অসুস্থ?’’
তখন সে মুখে একটা অনিচ্ছার হাসি দিয়ে বলত, ‘‘আরে না ভাই। একটু টেনশানে আছি, আর কিছু না।’’
মাস কয়েক কেটে যাওয়ার পর শারমিনের বাবা ফোন করে সাইফুলকে বলে তার স্ত্রী এবং সন্তানকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সাইফুল আলম তার মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে এলেন।
এখন সে আর তার স্ত্রীর সাথে ভাল মত কথা বলে না। সে কাজ করল কী না করল এ ব্যাপারে ডাক দেয় না।
মেয়েটা আস্তে আস্তে ছয় মাস বছরের হয়ে উঠল। সাইফুল আলম এখন পর্যন্ত মেয়েকে কোলে নেয়নি। সাইফুল যতক্ষণ কাজে থাকে ততক্ষণ শারমিন তার বাচ্চাকে নিয়ে পাশের রুমের ভাবির সাথে তার দুঃখের কথা বলে বলে কান্না করে উঠে, ‘‘ভাবি আমার কী দোষ! আল্লায় আমগো মাইয়া দিছে। এই মাইয়াডা কি জন্মাইয়া ভুল করছে নাকি–এহন পর্যন্ত মাইয়ার গায়ে একটা টাচও করে নাই।’’ বলতে বলতে কান্নায় জুড়ে যায় শারমিন।
একদিন রাতে সাইফুল আলম খুব দেরি করে বাসায় ফিরল। রুমের দড়জা খুলে দিয়েই শারমিন ওয়াসরুমে গেছে।
সাইফুল রুমে এসে খাটের উপর বসে দুহাত পিছনে খাটের সাথে হেলান দিয়ে শার্টের বোতাম খুলে সিলিং ফ্যানের বাতাস নিচ্ছে, ঠিক এমন সময় তার পিছন থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসল ‘‘বাব্-বাব্-বাবা।’’ সাইফুল পিছনে তাকিয়ে দেখল তার ছয়মাসের মেয়েটি তাকিয়ে মাড়ি দেখিয়ে হেসে তার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলার চেষ্টা করছে, ‘‘বাব্-বাব্-বাবা।’’
সাইফুল আলম তাকে কোলে তুলে বলছে, ‘‘কও– মা।’’ আবারও বাচ্চাটি অফুস্ট স্বরে বলছে, ‘‘বাব্-বাব্-বাবা।’’ সাইফুল আবার বলছে, ‘‘না, এবার মা কও-মা।’’ বাচ্চাটি তার চোষা লোলে ভরা আঙ্গুলটি বাবার গালে লাগিয়ে হেহেহে করে হেসে পরপর বলছে, ‘‘বাব্-বাব্-বাবা।’’
সাইফুল আলমের এমন শিশুখেলা দেখে শারমিনও এগিয়ে এল। এখন তারা তিনজন তাদের বাচ্চা-মেয়ের সাথে শিশুখেলায় মেতে উঠেছে। এদিকে সাইফুল আলম ভুলেই গেছে তার কোলের সন্তানটি ছেলে নয়।
শব্দ চয়ন অসাধারণ ছিলো।
থিমটা চমকপ্রদ।
তৃপ্তি নিয়ে পড়েছি।
আরো ভালো কিছুর অপেক্ষায় রইলাম।
শুভ কামনা।
অনেক ভালো লেগেছে।
নতুন ধাঁচের গল্প।
আপনার জন্য শুভকামনা রইল
।।।
অসাধারণ লিখেছেন। চমকপ্রদ থিম আর সেই সাথে লেখনীও খুব সুন্দর। বর্ণনাভঙ্গি খুবই ভালো লেগেছে।
সাইফুল ছেলে চাইলেও তার ঘরে কন্যা সন্তান আসায় সে সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু সেই কন্যাই বাবার মন জয় করতে পেরেছে। শিশুরা তো এমনই হয়, নিষ্পাপ, স্নিগ্ধ।
বানানে কয়েকটা ভুল আছে।
পঁনেরো- পনেরো।
পাকাপুক্ত- পাকাপোক্ত।
আফসস- আফসোস।
আপ্নে- আপনে।
শুভ কামনা রইল।