লেখকঃ
অপরাজিতা অনু
(এপ্রিল – ২০১৮)
……………
বাসটা হঠাৎ নষ্ট হলো ব্রিজের কাছে এসে। বাস সারতে দের ঘন্টার মতো লাগবে।
এখন তিনটা বাজে।
চৈত্র মাসের পিচ গলানো রোদ উঠেছে।
আকাশ পরিষ্কার। কোথাও মেঘের অস্তিত্ব নেই।
দুপুর বেলা কিছু খাওয়া হয়নি, তাই এখন পেটে ইদুরের দৌড়াদৌড়ি টের পাচ্ছি।
বাসটা নষ্ট হতে হলো এই ব্রীজটার কাছে এসেই? আশেপাশে দোকান পাট কিছুই নেই।
নদী দেখে সময় পার করা যেতো, কিন্তু নদীতে দেখার মতো কিছুই নেই। নদীর আসল সৌন্দর্য হলো পানি। শীতে পানি শুকিয়ে যায়, বর্ষায় বাড়ে। এখন চৈত্রমাস। তাই এখন শুকনো নদী।
আমি হ্যান্ড ব্যাগটা নিয়ে বাস থেকে নেমে পরলাম।
নদীর পার ধরে হাটতে লাগলাম।
চর জেগেছে, তাতে অসংখ্য ছোট ছোট অস্থায়ী বাড়ি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ছবি এগুলো।
হঠাৎ দেখি একটা বাড়ির রঙ একটু আলাদা। নীল গোলাপি রং।
কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম বাড়ির সামনে থেকে উঠান পর্যন্ত নীল আর গোলাপি রংয়ের পর্দা টানানো।
বুঝতে পারলাম অনুষ্ঠান চলছে কোনো।
বাড়ির গেটে দাঁড়াতেই তিন চার জনের ঠেলাঠেলি তে ভিতরে ঢুকে গেলাম। বাড়ির ভেতরের সবাই ব্যস্ত অনেক।
বাড়ির পিচ্চিগুলো আমাকে ঘিরে রেখেছে। চোখ বড় বড় করে দেখছে।
একজন মহিলা আমাকে দেখে কি যেনো ভেবে দৌড়ে ঘরে ঢুকলো, তারপর এক বয়স্ক মতো লোকে সাথে নিয়ে বের হয়ে আসলো।
লোকটি এগিয়ে এসে বললো,
আপা আপনার পরিচয়?
এতো বয়স্ক একজন মানুষ আমাকে আপা ডাকছে বিষয় টা কেমন জানি লাগছে।
আমি বললাম, আসলে আমাদের বাসটা নষ্ট হয়ে গেছে তো।
আমার কথা শেষ না হতেই তিনি হাক ডাক শুরু করলেন,
ও শাপলার মা, কই গেলা তাড়াতাড়ি আসো।
শাপলার মা নামক মহিলা টি ছুটে এলেন। তার হাতে তরকারির নাড়বার চামচ।
লোকটি আমাকে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ইনি বিপদে পইরা আইছে, তার অযত্ন না হয় যেনো।
আইজ আমার মাইয়ার বিয়া, আইজ সব অতিথি রে খাতির করবা।
শাপলার মা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন।
আমাকে ঘরে ঢোকানো হলো, এর মধ্যেই এক গ্লাস শরবত চলে এসেছে।
দেখলাম বিছানার উপর একটা মেয়ে বসে আছে বিয়ের শাড়ি পরে। বয়স ১৭-১৮হবে। মেয়েটি অসম্ভব রুপবতী। আচ্ছা এই মেয়েটি কি জানে সে রুপবতীদের একজন? খুব সাধারণ একটা বিয়ের শাড়িতেও তাকে পরীর মতো লাগছে।
অল্পবয়স্ক একটা পরী।
তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সে সালাম দিলো। ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেছে, সে ভেবেছে আমি বরপক্ষের মানুষ।
আমি তাকে বললাম, তোমার নাম শাপলা?
সে মাথা দুলিয়ে হ্যা বললো।
আমি বললাম, তুমি কি জানো তুমি দেখতে কতোটা সুন্দর?
মেয়েটি ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে আছে, তারপরেই লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিলো।
আমি বললাম, তুমি সাজোনি কেনো? আজকে না বিয়ে তোমার?
শাপলা জবাব দিলো, বিয়ের কেনাকাটির সময় পাইনাই, হঠাৎ বিবাহ ঠিক হয়েছে, আব্বা রাতে শাড়ি কিনে আনছে শুধু, সে পুরুষ মানুষ, সে তো আর জানেনা মেয়েছেলের সাজতে কতো কি লাগে।
আমি বললাম, আচ্ছা, আমি সাজিয়ে দিচ্ছি।
আমি শাপলাকে সাজিয়ে দিচ্ছি আমার হ্যান্ডব্যাগে থাকা জিনিসপত্র দিয়ে।
তিন চার জন হা করে আমার সাজানো দেখছে। এরমধ্যেই আরো ছয় সাত জন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে সাজবে বলে।
শাপলাকে সাজিয়ে দিয়ে ওদেরও সাজিয়ে দিলাম।
বাইরে শোরগোল শুনা যাচ্ছে। মনে হয় বর এসেছে।
আমি ভেবেছিলাম বর হবে মাঝবয়সী কোনো মানুষ। কিন্তু আমার ধারনা ভুল। ২৪-২৫বছরের একটি ছেলে মুখে রুমাল চেপে ধরে বসে আছে।
খাওয়া দাওয়া শেষে বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। বরের চাচা হঠৎ শাপলার বাবা কে বললেন, ভাই সাহেব, দেনাপাওনার বিষয়টা আগে মিটায় নিলে ভালা হইতো না?
তারপর তারা ফিসফাস করে কিছুক্ষণ কথা বললেন।
শাপলার বাবার চোখ মুখ শুকনো, অসহায় লাগছে। আর ছেলের চাচার মুখ রাগে জ্বলছে।
আমি গিয়ে শাপলার পাশে বসলাম। শাপলা আতংকিত চোখে বললো, কি হইছে বুবু?
আমি বললাম, ঝামেলা হচ্ছে শাপলা।
তোমাদের কি কিছু দেয়ার কথা ছিলো ছেলেকে?
শাপলা বললো, একটা সাইকেল, স্বর্নের চেইন, আর ২০হাজার টাকা দেওয়ার কথা আছিলো।
আমি বললাম, তাই নিয়েই ঝামেলা হচ্ছে, তোমার বাবা মনে হয় জোগাড় করতে পারেন নি সব।
শাপলা চুপ করে গেলো, তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে।
আমি বললাম, শাপলা তোমার বিয়েটা যদি ভেংগে যায় খুব কষ্ট পাবা?
শাপলা কাপা কাপা গলায় জবাব দিলো, তার সাথে দুই দিন কথা বলছি, মানুষটা বড় ভালো। বিয়ে শাদি আল্লাহ’র ইচ্ছা বুবু।
আমি বললাম, নাম কি তার?
শাপলা বললো, তার নাম মিজান।
আমি ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম মোটামুটি ঝামেলা লেগে গেছে।
শাপলার বাবা গলার চেইন ছাড়া কিছুই যোগাড় করতে পারেননি।
ইচ্ছে করছিলো বর পক্ষের লোক গুলোকে পিটিয়ে তক্তা বানাই।
আমি বরকে গিয়ে বললাম, শাপলা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চায়।
ছেলেটি কে নিয়ে শাপলার ঘরে গেলাম।
শাপলা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখ থেকে পানি পরছে।
আমি বললাম, মিজান সাহেব, শাপলা আপনাকে অনেক পছন্দ করে। কিন্তু আপনাদের চাওয়া জিনিসগুলো দিতে পারছে না শাপলার বাবা। তাই আপনাদের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে।
শাপলাকে কিছু বলতে চান?
ছেলেটি কিছুক্ষণ শাপলার দিকে তাকিয়ে থেকে আমাকে বললো, আপনি আমার লগে আসেন একটু।
আমি তার পেছন পেছন গেলাম।
ছেলেটি তার চাচার সামনে গিয়ে বললো, চাচা আমি এই মাইয়ারেই বিয়া করুম, আল্লাহ আমার হাত পা দিসে, ট্যাকা রোজগার করবার পারুম অনেক। কিন্তু শাপলা বড় ভালা মাইয়া। আমার কোনো দাবি দাওয়া নাই আমার শ্বশুর বাড়ির কাছে।
আপনেরা চুপচাপ বিবাহ দেখেন।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মিজানের দিকে।
তার কাছে গিয়ে বললাম, মিজান ভাই খুব ভালো একটা কাজ করলেন। আল্লাহ আপনাদের সুখী করবে।
মিজান বললো, আপা আপনে শাপলার কে হোন?
আমি বললাম, আমি শাপলার কেউ হই না।
ছেলেটি হাসলো, বললো, আপা একটা কাজ কইরা দিবেন?
শাপলারে বলবেন তারে বউ সাইজা খুব সুন্দর লাগতেসে।
আমি হেসে বললাম, সেটা তো আপনিই বলতে পারেন।
মিজান বললো, শরম করে আপা।
আমি শাপলার ঘরে গেলাম, তাকে বললাম, চোখ মুছো, কাজি সাহেব বিয়ে পরাতে আসছে।
এক নিশ্বাসে তিন বার কবুল বলবা ঠিক আছে?
তোমার জামাই খুব ভালো মানুষ, তোমরা অনেক সুখী হবা। আর মিজান বলেছে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।
শাপলা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।
ঘড়িতে দেখলাম প্রায় সাড়ে চারটা বেজে গেছে।
আমি মিজান আর শাপলার কাছে বিদায় নিয়ে বের হলাম, অবাক করা কান্ড আমার আসার সময় শাপলা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরলো। আমি যেনো তার কতোদিনের চেনা।
আমি বাসে এসে উঠলাম, বাস চলতে শুরু করলো। আমার চুল উড়ছে বাতাসে। মনের মধ্যে খুব শান্তি অনুভব করছি।
আমার জীবনের যতো সুন্দর এক্সপিরিয়েন্স আছে তার মধ্যে শাপলার বিয়েটা একটি।
অথচ দুই ঘন্টা আগেও আমি তাকে চিনতাম না।
সুখে থাক শাপলা-মিজান।
০ Comments