লেখকঃ
Sumaia Sarah
(মে – ২০১৮)
……………
গত দেড় ঘণ্টা থেকে রানা বসে আছে জ্যামের মধ্যে। ভ্যাপসা গরম, আর বাসের পেট্রোলের গন্ধে রানার খুব অস্বস্তি লাগছে। বমিবমি লাগছে… জ্বরটাও বোধহয় বেড়েছে…
আজ ইন্টার্ভিউটা না থাকলে আজ বের হতো না বাসা থেকে। যদিও বের হওয়ার সময় মা বলছিলো “থাক বাবা যেতে হবেনা ইন্টার্ভিউ দিতে! এমনিতেও চাকুরী তো হয় না। অসুস্থ শরীর নিয়ে যাস না!”
মুখে শুকনা হাসি এনে রানা বলেছিলো “আজিজুল সাহেব বলেছে যেতে, চাকুরীটা এবার হয়ে যাবে বোধহয় মা।”
আজিজুল সাহেব রানার ছাত্রর বাবা। উনার অনেক চেনাজানা রয়েছে। তাই গত মাসে রানা ইতস্তত করে তাকে বলেছিলো যেন একটা চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেয়। তিনিই গতদিন বলেছে এই কোম্পানি তে ইন্টার্ভিউ দিতে যেতে….
চাকুরীটা হয়ে গেলে রানার আর কোনো চিন্তা থাকবেনা! মা’কে আর সেলাই মেশিনে বসে কোমরের ব্যথা বাড়াতে হবে না! এই মেশিনের শব্দ শুনলে রানার ইচ্ছে করে তুলে বাইরে ফেলে দিয়ে আসতে! কিন্তু সেটা সম্ভব না। কারণ এই মেশিনে কাজ করেই মা তাকে এবং তার দুই বোন কে বড় করেছে।
চাকুরীটা পেলে মা’কে আর মেশিনে বসতে দিবেনা! রুনা আপার বিয়ের জন্য পাত্র দেখতে হবে! বয়স বাড়ছে আপার, সেই অনুপাতে বিয়ে আসাও কমে যাচ্ছে! রিমার সব আবদার তখন পূরণ করতে পারবে! মেয়েটা চঞ্চল যেমন তেমনি অভিমানী! কিছু চেয়ে না পেলে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয়!
সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে যদি এই চাকুরীটা পেয়ে যায় রানা।
জ্যামে বসে এসব ভাবতে ভাবতেই রানার চোখ গেলো এক প্রাইভেট কারের দিকে, কারের কাচ নামানো। ভেতরে বসে থাকা মধ্যবয়সী লোকটার দিকে তাকিয়ে সেদিকেই চোখ আটকে গেছে রানার। লোকটা শুভ্র সাদা রঙের একটা ফুলহাতা শার্ট পরেছে….
এরকম একটা শুভ্র সাদা শার্টের খুব শখ রানার। শখ থাকলেও কখনো সামর্থ্য হয়নি, তাই কেনাও হয়নি আর পরাও হয়নি।..
ছোট থাকতে বাবাকে অনেকবার বলেছিলো একটা সাদা শার্ট কিনে দিতে। বাবা কিনে দিতেন না। বলতেন সাদা শার্ট একবার পরলে না ধুয়ে আরেকবার পরা যায় না, একটু কিছুর দাগ লাগলেও আর পরা যায়না! সাদা শার্ট পরার অসুবিধা অনেক!
মোট কথা হলো, অন্য রঙের কাপড় অনেকদিন পরা যায়, কিন্তু সাদা শার্ট পরা যায় না। আর গরিবি হালে সবকিছুই কিনতে হয় হিসেব করে!
তাই সাদা শার্ট পরা হয়নি কখনোই!
আজ কারের মধ্যে বসে থাকা লোকটাকে দেখে শাদা শার্ট পরার ইচ্ছেটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো! কিন্তু মধ্যবিত্তের সব ইচ্ছে কি আর পূরণ হয়? হয় নাহ, বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রানা।
ইন্টার্ভিউ এর ডাক এসেছে।
ভেতরে প্রবেশ করতেই রানা বেশ অবাক হলো। বসের চেয়ারে আজিজুল সাহেব কে দেখে। মানে কি এই অফিস আজিজুল সাহেবের?
আজিজুল সাহেব হয়তো রানার অবাক হওয়াটা ধরতে পেরেছেন।
তিনি স্বাভাবিক হয়েই বললেন “তুমি যা ভাবছ সেটাই সঠিক, এই অফিস আমার। বসো, তোমার সাথে আমার বেশ জরুরি কিছু কথা আছে! কথাগুলা মন দিয়ে শোনার পর তোমার সিদ্ধান্ত নিবে।”
একটু থেমে আজিজুল সাহেব বললেন “রানা, আমি তোমার পরিবার সম্পর্কে সবরকম খোঁজখবর নিয়েছি। এবং তারপরেই তোমাকে ডেকেছি। তুমি তো জানোই অর্পণ আমার একমাত্র ছেলে। আমাদের জীবনের একমাত্র অবলম্বন! কিন্তু যা জানো না তা হলো, অর্পণের একটা কিডনি ড্যামেজ! আমার সব আছে, অথচ দেখো ছেলেটাকে সুস্থ করার মতো উপায় নেই! দেশ বিদেশ কোথাও ওর সাথে ম্যাচ করে এরকম কিডনি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন একমাত্র তুমিই পারো ওকে বাঁচাতে, কারণ তোমার কিডনির সাথে ওর কিডনি ম্যাচ করে। ইন্টার্ভিউ এর জন্য যে মেডিকেল টেস্ট করানো হয়েছিলো, তা আসলে এইজন্যই… জানি, খুব অন্যায় আবদার করছি! কিন্তু এছাড়া আর উপায় নেই! তুমি আমার ছেলেটাকে বাচাও রানা! বিনিময়ে তোমার এবং তোমার পরিবারের সকল দায়িত্ব আমার!”
রানা পুরোটা সময় চুপ থাকলো। সবকিছু শুনলো। নিজের অবস্থা, পরিবারের অবস্থা সবকিছু ভাবলো।
এরকম সুযোগ সে আর কোথাও পাবেনা!
ওর একটা কিডনির জন্য একটা ছেলে বেচে যাবে! মায়ের কষ্ট দূর হবে, বোনের বিয়ে হবে! সবকিছু হয়ে যাবে!সবকিছু ভেবে রানা রাজি হয়ে গেলো। এগ্রিমেন্টে সাইন করে বাসায় ফেরার জন্য উঠবে এমন সময় আজিজুল সাহেব বললেন “রানা, তোমার কি কোনো ইচ্ছা বা স্বপ্ন আছে, যা পূরণ করতে চাও? তোমার জন্য কিছু করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে!”
ইচ্ছে, শখ, স্বপ্ন অনেক কিছুই আছে। তারপরেও কেন জানি রানার মনে হলো বলি “স্যার, আমাকে একটা সাদা শার্ট কিনে দিবেন? আমি কখনো সাদা শার্ট পরিনাই!” কিন্তু কেন জানি বলা হয় না।
সে বলে “আপনি আমার পরিবারের পাশে থাকবেন, এটাই আমার জন্য অনেক কিছু স্যার। আলাদা কিছু লাগবেনা…।”
রানা অনেক আগে ভেবে রেখেছিলো চাকরী হলে সিনেমার মতো বাসায় ফিরে মা কে সালাম করে বলবে “মা আমার চাকরি টা হয়ে গেছে। এইবার আর কোনো সমস্যা থাকবেনা!”
কিন্তু আজ এভাবে কিছুই বলা হয় না। সে বাসায় ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
ভাবতে থাকে কিডনিটা দেয়ার পর কি হবে! একটা কিডনি নিয়ে বেচে থাকা কি খুব কষ্টের হবে? কোনো সমস্যা হবেনা তো? সে অনেকদিন বাচবে তো? দুনিয়াটা ঘুরে দেখার এতো ইচ্ছে ওর, সব ইচ্ছে পূরণ হবে তো? আচ্ছা, মা যদি জেনে ফেলে, কি হবে তখন! না, কিছুতেই মা কে জানতে দেয়া যাবেনা….!
এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম!
ঘুম ভাঙে কপালে কারো হাতের স্পর্শে। চোখ খুলে দেখে মা বসে আছে মাথার কাছে।
হাসিমুখে বলে “চাকরির জন্যে মন খারাপ বাবা? মন খারাপ করিস না! এইবার হয়নি তো কি হয়েছে, পরেরবার হবে!” সে মায়ের হাতটা ধরে বলে “চাকরি টা হয়ে গেছে মা! খুব ক্লান্ত ছিলাম তো, তাই এসে বলা হয় নাই।”
“বলিস কি বাবা! এত খুশির খবরটা আগে বললি না কেন। ইশ এতো ভালো লাগছে আমার! খুব ভালো থাক, খুব সুখী হ আমার সোনা মানিক!” মায়ের মুখে এসব শুনে বেশ লজ্জা লাগছিলো রানার। সে মায়ের কোলে মাথা রেখে মনেমনে বললো মাফ করে দিও মা, তোমাকে সত্যি টা বলতে পারলাম না।
রাত্রে ব্যাগ গুছাচ্ছিলো রানা। বাসায় বলেছে একমাসের জন্য শহরের বাইরে যেতে হবে। এমন সময় ওর মা এলো, হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে… এগিয়ে এসে রানার হাতে ব্যাগ টা দিয়ে বললো “দ্যাখ তো পছন্দ হয় কি না!”
ব্যাগ টা খুলে দেখা গেলো তাতে একটা শুভ্র সাদা শার্ট। ঠিক যেমন শার্টের শখ ছিল রানার, তেমন-ই শার্ট টা! “তোর অনেক ইচ্ছে একটা সাদা শার্টের জানি। কিন্তু কখনো দিতে পারিনাই। যাই হোক, কিনে এনেছিলাম জন্মদিনে দিবো ভেবে। এখন ভাবছি চাকরির প্রথম দিনে এইটা পরবি, এটাই বেশি খুশির হবে!”
রানা ঠিক করলো পরদিন এই শার্ট পরেই সে যাবে চাকরিতে। মানে অপারেশনের জন্যে….
পরদিন সকালের কথা, রানাদের বাসায় ঈদ ঈদ আমেজ! ক্ষীর রান্না হচ্ছে, সাথে হচ্ছে লুচি! রানার পছন্দের এসব। অথচ রানার মনে উচ্ছ্বাস নেই! কেমন যেন উদাসিতা কাজ করছে!
আজকের পর রানার পরিবারে আর কোনো সমস্যা থাকবেনা। কিন্তু, ওর একটা কিডনিও তো থাকবেনা!এ কেমন পরিস্থিতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রানা!এসব ভাবতে ভাবতেই বের হলো বাসা থেকে।
রিকশা নিয়ে রওনা দিলো আজিজুল সাহেবের অফিসের উদ্দেশ্যে, সেখান থেকে যাবে যেখানে নিয়ে যাবে আজিজুল সাহেব।
মনের মধ্যে অস্থিরতা, পরিবারের কথা ভেনে খুশি, নিজের শরীরের ক্ষতির কথা ভেবে কষ্ট এরকম মিশ্র অনুভূতি ভাবাচ্ছিলো রানাকে।
এরকম সময়েই কি যেন হলো, কেমন যেন গভীর ব্যথা অনুভূত হলো, আকাশপাতাল সব উল্টেপাল্টে গেলো, চারিদিকের সবাই ছুটে রানার দিকে আসতে লাগলো, চিল্লাচিল্লি করতে শুরু করলো “এক্সিডেন্ট! এক্সিডেন্ট! কেউ এম্বুলেন্স ডাকো! আহারে মাথায় লেগেছে, কেউ ধর, রক্ত বেড়িয়ে যাচ্ছে…..!”
রানার জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছিলো, চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো, সেই বন্ধ হওয়া চোখ টেনে খুলে দেখলো ওর শরীরের সাদা শার্টটা আর সাদা নাই! লাল হয়ে গেছে…. টকটকে লাল! সারাজীবন সাদা শার্টের শখ করা রানার কাছে লাল টকটকে শার্টটা ভীষণ বিশ্রী লাগছে।
অথচ শক্তি পাচ্ছেনা খুলে ফেলার! খুব ক্লান্তি লাগছে, চোখজুড়ে নামছে রাজ্যের জমানো ঘুম।
০ Comments