গল্প লেখিকাঃ আফরোজা আক্তার ইতি
(মে – ২০১৮)
………………
সৌরভ, সজল, প্রচ্ছদ, প্রণয় আর আমি আমাদের ফুটবল টিমের মেম্বার। শুধু মেম্বার বললে ভুল হবে। আমরা পাঁচজন কলিজার বন্ধুও। বন্ধুত্বটা হয়েছে মূলত ফুটবল ক্লাবে আসার পরই। নয়ত আমরা কেউ ই কাউকে চিনতাম না, আমরা থাকি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। ক্লাবে খেলতে আসার পরই পরিচিত হই একে অপরের সাথে। সেই থেকেই আমাদের পাঁচজনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
আমাদের ফুটবল খেলার মাঠটা মোটামুটি সবার বাসা থেকেই দূরে। তবে সজলদের বাসা ছিল মাঠের কিছুটা কাছেই। তাই কখনো ম্যাচ শেষে আমাদের বাড়ি ফিরতে রাত হলে সে রাতটা আমরা সজলদের বাসাতেই কাটিয়ে দিতাম।
সেবার আমাদের ফুটবল ম্যাচ শেষ হতে প্রায় রাত হয়ে গেল। এত রাতে বাড়ি ফেরা যাবে না বলে সবাই সজলের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখলাম ওদের বাসায় আমাদের আগেই ওদের আরো কিছু অতিথি এসেছে। উলটো আমরা হঠাৎ এসে ঝামেলা বাড়িয়ে দিলাম বলে লজ্জা লাগছিল। আমাদের এ সংকোচ দেখে সজলের মা মুচকি হেসে বললেন, “বাবা, আজকে তোমাদের একটু কষ্ট করতে হবে যে। হঠাৎ করেই সন্ধ্যায় সজলের নানাবাড়ি থেকে মেহমান এসে পড়েছে। তোমরা না হয় আজকে রুম শেয়ার করে ঘুমাও।” বিষম খেয়ে আমরা শুধু মাথা ঝাঁকালাম।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে হাত ধুতে যাব এমন সময় সৌরভ আমার হাত হ্যাঁচকা টান মেরে বলল, “নিবিড় শোন। আমি কিন্তু তোর সাথেই ঘুমাবো। কেন যেন এ বাড়িটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে।” আমি মুখ টিপে হাসলাম, কিন্তু মুখে ঠিকই ওকে অভয় দিয়ে বললাম,”আরেহ ধুর বোকা! এর আগেও তো আমরা এখানে এসেছি। এখানে তো ভয় পাওয়ার মতো কিছুই নেই। আসলে না, তুই একটু বেশিই ভীতু।” সজলের মা এসে বললেন, “বাবা শোন, ওরুমে তো তোমাদের বন্ধু-বান্ধব আর সজলের কাজিনরা ঘুমাবে। তোমরা চাইলে তোমাদের শোওয়ার ব্যাবস্থা ঐ খালি রুমটাতে করি?” ডানদিকের তালাবদ্ধ রুমটার দিকে ইংগিত করে বললেন তিনি। আমি একটু ভেবে বললাম, “ঠিকা আছে আন্টি। কিন্তু রুমটাতো আগে পরিষ্কার করতে হবে?” আন্টি তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “তোমরা ভেবো না, আমি এখনই সব গুছিয়ে দিচ্ছি।” এই বলে তিনি চলে গেলেন। প্রায় এক ঘন্টা পর আমাদের ডাক দিলেন ঘুমাতে যাওয়ার জন্য।
রুমের দরজা খুলতেই আমি আর সৌরভ অবাক হয়ে গেলাম। এই বন্ধ রুমটাতে বেশ সুন্দর করেই ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছেন আন্টি। মাটিতে ফ্লোরিং করে আমাদের শোয়ার বিছানা তৈরি করে দিয়েছেন। এমন ঝকঝকে আর তকতকে করে রুমটা পরিষ্কার করে গোছানো হয়েছে যে কেউ দেখলে বলবেই না এটা অনেকদিন ধরে তালাবদ্ধ ছিল। কেন যেন এ ঘরটা সবসময় তালাবদ্ধ থাকতো। ওরা যখন এ ঘরটা ভাড়া দিয়েছিল, তখন ভাড়াটিয়েরা প্রায় দু’মাস থেকে ভাড়া থেকে চলে গিয়েছিল। কোন ভাড়াটিয়েই বেশি সময় এ বাড়িতে থাকতে পারে নি। এর মূল কারণ সম্ভবত এ ঘরটাতে শুধু একটি মাত্র জানালা, তাও আবার সেটিও পশ্চিমের জঙ্গলের দিকে। এজন্য কোন ভাড়াটিয়ে এ ঘরে বেশিসময় ভাড়া না থাকায় এ ঘরটাকে স্টোররুম বানায় সজলরা। কিন্তু এরপরও ঘরটা কোন কাজে না লাগায় সেটি তালাবদ্ধ করে রাখা হল।
যাইহোক, আমরা বিছানায় গিয়ে কাঁথা টান দিয়ে শুয়ে পড়লাম, সারাদিনের ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল। এমন সময় সৌরভ বলতে লাগল, “নিবিড়, শোন, তুই কি জানিস, ঐ পশ্চিমের জঙ্গলে নাকি শকুন এসেছে।” আমি ঘুমের ঘোরে বললাম, “তাতে আমাদের কি?” সৌরভ বলল,”না মানে, এখন যদি এসে আমার চোখ তুলে নেয়?” আমি ঠাট্টা করে বললাম, “তোর চোখ তুলে নেবে কিভাবে? তুই তো চশমা পড়ে থাকিস।” সৌরভ ঘুমাবে বলে চশমাটা খুলে তার পাশেই রেখেছিল। আমার কথা শুনে ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি চোখে চশমা দিয়ে বলল, “যা, তুই ফাজলামো করিস না।” ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর আবার আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। তখন সম্ভবত রাত তিনটা হবে। সৌরভ আমাকে ডাক দিয়ে বলল, “নিবিড় শোন, আমার পেট খুব ব্যাথা করছে, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। তুই কিন্তু জেগে থাকিস।” আমি ঘুমের ঘোরে হু বলে জবাব দিলাম। ও চলে গেল।
আমার আর ঘুম আসলো না। ঘরটার মধ্যে প্রচন্ড গরম। আমি উঠে গিয়ে পশ্চিমের জানালাটা খুলে দিলাম। প্রচুর বিরক্ত লাগছে। সৌরভ এখনও আসছে না। আবার গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এমন সময় প্রচন্ড মড়মড় শব্দ করে উঠল মাটির নিচে। আমি বিরক্ত হয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে লাগলাম। নাহ এ শব্দ তো আর থামার নাম নিচ্ছে না। হঠাৎ আমার কানে একটা বাচ্চার কান্না ভেসে এল। কিন্তু এখানে তো ধারে কাছে কোন বাচ্চাই নেই। এমনকি সজলদের বাড়ির নিচের ফ্ল্যাটগুলোতে যে ভাড়াটিয়েগুলো আছে, তাদেরও কোন বাচ্চা নেই। বাচ্চার কান্নাটা ধীরে ধীরে আরও বাড়তে লাগলো। বুঝতে পারলাম, আসলে কান্নার শব্দটা আসছে, পশ্চিমের জঙ্গলটার দিক থেকে, আমি জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম, ঘোর অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজড়ে পড়ল না। একটা বাচ্চা এত রাতে ঐ ঘন জঙ্গলে কিভাবে গেল কিছুই মাথায় আসলো না। বাচ্চার কান্নাটাকে ঠিক কান্না বলা যাবে না, ভালোমত শুনলে মনে হয় যে, একটা বাচ্চাকে কেউ গলা টিপে ধরেছে, আর সে প্রাণপণে চিৎকার করে আর্তনাদ করছে। ব্যাপারটা দেখার জন্য আমি ঘর থেকে বের হয়ে জঙ্গলের দিকে পা বাড়ালাম। হঠাৎ মনে হল, যেন কেউ আমার পাশ কাটিয়ে শুকনো পাতা মাড়িয়ে মড়মড় শব্দ করে চলে যাচ্ছে। আমি পিছন ঘুরে তাকালাম, কিন্তু অন্ধকারে কাউকেই দেখতে পেলাম না। কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল। হালকা চাঁদের আলোয় সবকিছু কেমন যেন ভূতুড়ে লাগছে। বাচ্চার কান্নার শব্দটা আস্তে আস্তে দূরে মিশিয়ে যাচ্ছে, অস্পষ্ট হয়ে আসছে। আমি শব্দটাকে অনুসরণ করে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই দেখতে পেলাম সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো কি যেন একটা দুলছে। এবার বুঝতে পারলাম সংকেত ভালো না। আমি দৌড়াতে শুরু করলাম। দৌড়তে দৌড়তে জঙ্গলের পরিত্যাক্ত বিলটার সামনে এসে পা পিছলে পড়ে গেলাম। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালাম ঠিক এমন সময় নজড়ে পড়ল, খুব ছোট একটা আগুনের কুন্ডলী বিল থেকে বেরিয়ে নিমিষেই মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। প্রাণপণে দৌড় দিয়ে ঘরে এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ,আমার ঘাড়ে এক ঠান্ডা নিঃশ্বাস ফেলার অনুভূতি পেলাম। আমার পুরো গা ঘামে ভিজে গেছে। অজানা এক ভয়ে আমার স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে লাগলো। চারদিক ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে এল।
যখন চোখ মেলে তাকালাম, তখন দেখলাম আমাকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সজল আমার দিকে ঝুঁকে বলল, “কিরে এখন কেমন লাগছে?” আমি অস্ফুট স্বরে বললাম, “একটু ভালো।” “আচ্ছা, তুই জঙ্গলে কি করছিলি নিবিড়? আর জ্ঞান হারিয়েছিলে কেন?” ওদেরকে আমি আস্তে আস্তে সব ঘটনা খুলে বললাম। আমার কথা শুনে সবার মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলেও সজল তো হেসেই একাট্টা। আমি অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে ও বলল, “শোন নিবিড়, তুই নিশ্চয়ই জানিস আমাদের পাশের জঙ্গলে শকুন এসেছে? এটাও নিশ্চয়ই জানিস যে শকুনের বাচ্চার ডাক অবিকল মানুষের বাচ্চার কান্নার মত?” আমি প্রচন্ড লজ্জা পেলাম। ঠিকই তো! আমি কি বোকা! বললাম, “তা না হয় হলো। কি আগুনের কুন্ডলীর আর সাদা কাপড়ের ঘটনা কি হবে?” ও বলল, “তুই আমার সাথে আয়, চল তো তোরা আনার সাথে জঙ্গলে।” বলে ও আমাদের জঙ্গলে নিয়ে গেল। একটা জায়গায় থেমে আমি সজলকে সাদা কাপড়টা দেখালাম। কিন্তু একি! সেখানে কোন সাদা কাপড় নেই। বরং সেখানে মাঝারি আকারের একটা কলাগাছ। সজল বলল,”খেয়াল করেছিলি কালকে চাঁদটা ঐদিকে ছিল? ঐদিক থেকে চাঁদের আলো সরাসরি কলাগাছের উপর পড়ছিল, তাই গাছটা চাঁদের আলোয় সম্পূর্ণ সাদা দেখাচ্ছিল। বাতাসে দুলছিল বলে তুই সেটাকে সাদা কাপড় পরিহিতা কেউ ভেবেছিলি। এবার চল, বিলের কাছে যাই।” আমরা সবাই বিলের ওখানে গেলাম। আশ্চর্য তখনো বিলের ওপর আগুনের কুণ্ডলী উঠছে। সজল বলল,”এই বিল অনেক বছর ব্যবহার না করায় পরিত্যাক্ত হয়ে গেছে। ফলে এর গভীরে মিথেন গ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই মিথেন গ্যাস উপরে উঠে আসার সময় বাতাসের সংস্পর্শে এসে আগুন জ্বলে উঠে আবার মিলিয়ে যায়।” আমি বললাম, “সবই তো বুঝলাম কিন্তু ঠান্ডা নিঃশ্বাস, পা দিয়ে পাতা মাড়ানোর শব্দ আর মাটির নিচের বিশ্রি শব্দটার কাহিনি কি?” সজল বলল, “বুঝেছি শব্দটা নিচতলার নতুন ভাড়াটিয়েদের ফ্যানের থেকে হচ্ছিল।” সৌরভ বলল, “তুই আমাকে ঘরে সিগারেট খেতে দিবি না বলে জঙলের সামনে এসে সিগারেট খেয়ে আবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমার পায়ের পাতা মাড়ানোর শব্দেই তুই চমকেছিলি। আর সম্ভবত আমি ঘুমের ঘোরে তোর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম।” এবার আমি সব শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক, এই রহস্যময় রাতটার রহস্য থেকে মুক্তি পেয়ে ভালো লাগছে। বন্ধুদের বললাম, “চল, সকালের নাস্তা খেয়ে ম্যাচের প্র্যাক্টিস করতে যাই।”
০ Comments