আবুলের মনের সরলতা বড়লোকদের মনের গড়লতা বুঝতে পারে না, খুঁজতে পারে না! হায় রে জীবন! আহা জীবন!
৪.
বাবা! শপিং কমপ্লেক্স না যেন আস্ত একটা শহর! কী নেই এখানে! আবুলের মাথা ঘুরে যায়। তার গর্ব করে বলতে ইচ্ছা করে,”দেখেন, দেখেন, এ বিশাল বিল্ডিং, আমি বানাইছি ইট-পাথর দিয়া। আমি বানাইছি! আমি!” ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় সে। সে আর মনের কথা বলতে পারে না, অবাক বিস্ময়ে চলতে পারে না। শপিং কমপ্লেক্সের জৌলুশের মধ্যে তাকে বেমানান লাগছিল। কোনো এক ভদ্রমহিলার ভদ্র আহ্বানে সিকিউরিটি তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। -ঐ ভিখারীর বাচ্চা, এখানে কি?
– চাচা, মানে, ঐ আমার বইনের বিয়া। কাপড় লাগত। গয়নাও।
– বইনের বিয়া? কাপড়? গয়না? দেখা, টাকা কই দেখা! টাকা আনসোস?
– চাচা, আমার বাসভাড়া আনসি, শাড়ি-গয়নার তো ম্যালা দাম। এতো টাকা পামু কই?
– তাইলে গয়না কিনবি তোর বইনের নাম বেইচা?
– না, আমি এই শপিং কমপ্লেক্স বানাইন্নার কাজে ছিলাম। আমারে কইসিলো ফ্রিতে দিব। আমি ভালো কাজ করসিলাম তো, তাই!
মুহূর্তে দারোয়ান অট্টহাসিতে ফেটে পডল, পালোয়ান হয়ে আবুলের ঘাড় ধরল। বলল-“ভিখারী! এইটা ভিক্ষার জায়গা না। বাইর হ।” আবুল যেতে চাইল না, দারোয়ানের হাত-পা আর যা যা পারল, ধরল। কিন্তু না, কাজের কাজ হলো না। শুধু ভীড় জমল চারপাশে। এতো হুড়োহুড়িতে না শপিং কমপ্লেক্সের ইমেজ নষ্ট হয়! তাই ভীড় ঠেলে মালিক গোছের কেউ একজন বেরিয়ে এলেন। সব শুনে তার দয়া হলো, আর এতোই দয়া হলো যে পাঁচ টাকা দিয়ে বলল এক কাপ চা খেয়ে নিতে। আবুল ঠাট্টা গায়ে মাখল না। এক দৌড়ে সে দোকান থেকে দোকানে ভিক্ষা চাইতে লাগল। ভিক্ষাই,তার প্রাপ্যটুকুর ভিক্ষা। রেগে- মেগে দারোয়ান-গাড়োয়ান-পালোয়ান সবাই তার পিছে ছুটল। নাগাল পাওয়া মাত্র প্রহার দেওয়া আরম্ভ হলো। আবুলের কোমল অঙ্গে কঠোর প্রহার পড়ল, হায়েনারা আরো একটা শিকার আহার করল। ধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দেওয়ার আগে বলা হলো-“ভিখারীর বাচ্চা, এটা ভিক্ষার জায়গা না, দানের জায়গা না!” এই কয়েক ঘন্টায় আবুল বড় হয়ে গেল, পৃথিবীর আসল রূপ আর তার অজানা নয়। দুঃখে, দুর্ভোগে, দুর্ভাগ্যে পীড়িত আবুল শুধু বলল – “আবুল দান চায় নায়, প্রতিদান চাইছে শুধু, প্রতিদান!” আর এভাবেই রোজকার দিনে স্বপ্নগুলো সস্তা দামে বিকোয়!
৫.
সর্বাঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ব্যথা নিয়ে আবুল ফিরতে লাগল। রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে, বুক ভরা দুঃখ আর মুখ ভরা দাগ নিয়ে আবুল হাঁটতে লাগল। “কী হবে আম্মার? কি হবে বুবুর? আল্লাহ,তোমার প্রতি কী দোষ করছিলাম?কও! আমারে তুমি এই কষ্ট দিয়া মুক্তি দাও আল্লাহ! মুক্তি দাও!” “মুক্তি দাও! মুক্তি দাও!” -বলে গোঙাতে গোঙাতে পথ চলতে গিয়ে আবুল খেয়াল করে নি, ওর মুক্তির ব্যবস্থা ও নিজেই করে ফেলেছে। রাস্তার মাঝ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে ও এসে পড়ে একটা ট্রাকের সামনে। এই ট্রাক স্বপ্ন চেনে না, শাড়ি-গয়না চেনে না, আবুলের মতো অসহায় ময়নাও চেনে না; শুধু চেনে দেহকে। ট্রাকটা জানে একটা দেহকে কীভাবে উড়িয়ে দিতে হয়, কয়েকটা স্বপ্নকে কীভাবে গুড়িয়ে দিতে হয়! নির্দ্বিধায়! নির্বিঘ্নে! আবুলের দেহটা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকে, আর সাথে পড়ে থাকে, হয়তো তার স্বপ্নগুলোও!
৬.
এদিকে আবুলের মা আবুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। “আমার আবুল! বাজান আমার কখন জানি আইবো?” দেরি দেখে নিজের মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি- “এতো দেরি ক্যান করতেসে আবুইল্লা?” পরে নিজেই জবাব দেন- “ও,দেরি তো হইতেই পারে। সাহেবরা নাকি ওরে অনেক আদর করে! এতোদিন পর দেখসে, হয়তো ছাড়তে চায় না। আর অত কিছু আনতেও তো সময় লাগব! কত কী! শাড়ি! গয়নাগাটি!” আহারে আবুলের মা! এতোটুকুও তিনি জানেন না যে এই দুনিয়ায় আবুলদের জন্য সাহেবদের আদর মানে মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দেওয়া না, ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে নিঃশ্বাস কেড়ে নেওয়া! এতোটুকুও তিনি জানেন না যে এই দুনিয়ায় আবুলদের মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য সোনার গয়না না, মরণের ইচ্ছা পূরণের জন্য লোহার ট্রাক থাকে! এতোটুকুও তিনি জানেন না যে, এই দুনিয়ায় আবুল, আবুলের মা, আবুলের বোনের জন্য টুকটুকে লাল শাড়ি না, ধবধবে সাদা কাফনের কাপড় থাকে! হ্যাঁ,কাফনের কাপড় থাকে!
০ Comments