প্রায়শ্চিত্ত
প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 2,019 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

মা শুনছো! দু’বছর ধরে পরা কালো প্যান্টটা ছিড়ে গিয়েছে গতকাল৷”
-তাতে কি হয়েছে রে বাপ? তোর তো আরো দু’একটা প্যান্ট আছে৷ ওগুলো না হয় পরে যাবি স্কুলে৷
-মা তুমি বুঝো না কেন? ঐসব জিন্সের প্যান্ট কি স্কুলে এ্যালাউ করবে? করবে না তো৷
-তাইলে কী তুই স্কুলে যাবি না বাপ?
-যেতে তো হবেই মা৷ আমি তো ক্লাসের ফাস্ট বয়৷ কিন্তু জানো মা? আমাদের প্রথম ঘন্টার স্যারটা বড্ড রাগী৷ কালো প্যান্ট পরে না গেলেই পিটিয়ে পিট লাল করে ফেলবে৷ সে ক্লাসের ফাষ্ট হই আর লাষ্ট হই৷ মাইরের ব্যাপারে ছাড় দেন না৷”

-সামনের ঘরটাতে খাটে শুয়ে মা-ছেলের কথা শুনছেন রহমান সাহেব৷
রহমান সাহেব একসময়ের স্কুল কাঁপানো মাষ্টার ছিলেন৷ বিগত কয়েক বছর ধরে তিনি অসুস্থ৷ প্যারালাইজের রোগী৷ কাজ করতে অক্ষম৷ সারাক্ষন শুয়ে অথবা কারো সাহায্যে বসে দিন কাটে৷
রহমান সাহেব আর জাহানারা বেগমের ঘরে একটা মাত্র সন্তান৷ ছেলেটা এবার ১০ম শ্রেণীতে উঠলো৷
লেখাপড়ায় বড্ড ভালো৷ বাবার নাম রেখেছে৷ চেহারাটাও বড্ড অমায়িক৷ সব মিলিয়ে বাধ্য ছেলে৷
ঘরে অভাব থাকা সত্তেও মন খারাপ করে চলে না কখনো৷ আল্লাহর উপর ভরসা করে সবসময়৷
রহমান সাহেবের স্ত্রী জাহানারা বেগম৷ খুউব পরিশ্রমী আর ধৈর্য্যশীল একজন মহিলা৷ এত কষ্ট আর অভাবের পরও কখনো কষ্ট দিয়ে কথা বলেনি রহমান সাহেবকে৷
জাহানারা বেগম অল্পস্বল্প লেখাপড়া জানেন৷ ছোট বাচ্চাদের পড়াতে পারেন৷
মানুষের বাড়িতে ছোট বাচ্চাদের পড়ানোর সাথে সাথে রান্নার কাজগুলোও করে থাকেন৷
যা আয় হয় এতেই সংসার চলে দুঃখে কষ্টে৷

~~

মায়ের কাছে কথার জবাব না পেয়ে মুখ মলিন করে ঘর থেকে বেড়িয়ে পরে রহমান সাহেবের ছেলে৷
ছেলেটার জন্যও কষ্ট হয় রহমান সাহেবের৷ তেমন কিছুই চায় না মায়ের কাছে৷

জাহানারা বেগম মন খারাপ করে রহমান সাহেবের শিয়রে এসে বসেন৷ রহমান সাহেব টুপ করে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলেন৷ নয়তো চোখের জলগুলো লুকোতে পারবেন না যে৷ ধরা পরে যেতে হবে৷ তার চোখের জলে হয়তো জাহানারা বেগমও ভেঙে পরবেন৷
কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে উঠে পরে জাহানারা বেগম৷

~~

মাথার উপরে সাই সাই করে ঘোরা সিলিংটার দিকে তাকিয়ে অতীতে ফিরে যান রহমান সাহেব৷

রহমান সাহেব তখন সদ্য স্কুলে চাকরি নিয়েছেন৷ ফুরফুরে মেজাজের রাগী একজন মানুষ৷ তরুণ বয়সের তেজ ছিল গায়ে৷
ছাত্রদের দোষ পেলেই পিটিয়ে ছাতু বানাতেন৷
ছাত্রদের স্কুল ড্রেসের প্রতি ছিলেন ভীষন সিরিয়াস৷
প্রথম কয়েকমাসের মধ্যেই স্কুলের ভয়ংকর শিক্ষকদের মাঝে একজন হয়ে উঠলেন রহমান সাহেব৷

নতুন বছরে রহমান সাহেবকে ৯ম শ্রেণীর শ্রেণী শিক্ষক বানানো হলো৷
ছাত্ররা ভয়ে জবুতবু হয়ে থাকতেন রহমান সাহেব ক্লাসে গেলেই৷ কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় সব ছেলেকেই পিটিয়েছেন রহমান সাহেব৷
কাউকে পড়ার জন্য পিটিয়েছন৷ আবার কাউকে পিটিয়েছেন ড্রেস এর জন্য৷
কিন্তু ক্লাসের ফাষ্ট বয়কে পিটানোর সুযোগ পাননি রহমান সাহেব৷
ছেলেটা সবকিছুতেই দুর্দান্ত ছিল৷ পড়ালেখায় ভালো, আচার-আচরণ সবকিছুতেই দারুন৷
তারপরও রহমান সাহেবের কেন যেন সহ্য হতো না ছেলেটাকে৷
পুরনো সাদা শার্ট আর রং জ্বলসানো কালো প্যান্ট পরে স্কুলে আসতো ছেলেটা৷ চুলগুলো ছোট করে কাটা৷
রহমান সাহেব একদিন জিজ্ঞেস করেছিল,
-তুই এভাবে চুল কাটিস কেন?
ছেলেটা হাসিমুখে জবাব দেয়,
-স্যার এভাবে কাটলে বাকি কয়েকমাস চুলে হাত দিতে হবে না আর৷ দিব্যি চলে যাবে৷
রহমান সাহেব জবাবে কিছু বলেন না৷ আস্তে করে বসতে বলেন৷
অবাক হন, এত অভাবের মাঝেও ছেলেটা কি অমায়িকভাবে হেসে সাধারন ভাবে কথাটা বলে ফেলল৷

একদিন সকালে রহমান সাহেব খেয়াল করলেন ছেলেটা প্রথম বেন্ঞ্চে নেই৷ একটু এদিক ওদিক তাকালেন৷
মাঝখানের একটা বেন্ঞ্চে চোখ গেল রহমান সাহেবের৷
নিয়মিত প্রথম বেন্ঞ্চে বসা ছেলেটাকে মাঝখানে দেখে রহমান সাহেবের একটু খটকা লাগলো৷
কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলেন ছেলেটা আজ অন্য রঙের প্যান্ট পরে এসেছে৷
রহমান সাহেব উৎফুল্ল বোধ করেন একটু৷
তারপর সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
-ভিন্ন রঙের প্যান্ট পরা সবাই বেরিয়ে আসো৷
কিছুক্ষণ পর গুটিগুটি পায়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে ছেলেটা৷
চেহারাটা মলিন হয়ে আছে৷ মুখে ভয়ের চাপ৷
ততদিনে অন্য সবাই কালো রঙের প্যান্ট কিনে নিয়েছে৷ আজ শুধু ছেলেটাই ব্যাতিক্রম৷
রহমান সাহেব ছেলেটাকে সামনে এনে দাঁড় করালেন৷ মোটা বেত দেখেই ছেলেটা একটু চমকে উঠলো৷
রহমান সাহেব চেয়ার থেকে উঠতেই ছেলেটা বলল,
-স্যার! কালকে প্যান্টটা ছিড়ে গিয়েছে৷ আব্বাকে বলেছি৷ মাসের মাঝখানে তাই কিনে দিতে পারেনি৷ মাসের শেষে কিনে দিবে বলেছে৷
ছেলেটার কথা শুনেও শুনলেন না রহমান সাহেব৷
দু’পাটি দাঁত বের করে হেসে বললেন,
-সবার জন্য সমান শাস্তি৷ রুলস ইজ রুলস৷ তুই ফাষ্ট বয় হয়ে রুল ভঙ্গ করবি বল?’
রহমান সাহেবের কথার জবাবে টু শব্দ করেনি ছেলেটা৷
চুপচাপ হজম করেছিল ছেলেটা৷
এরপরের কয়েকদিনেও ছেলেটা মার হজম করেছে৷ শুধু টুপটুপ করে চোখের জল ফেলেছিলো৷
আরেকদিন সকালে জীর্ণসীর্ণ চেহারা নিয়ে আবারও বেতের সামনে দাঁড়ায় ছেলেটা৷ মুখের হাসিটা উবে গিয়েছে ততদিনে৷
হাস্যোজ্জল মুখটা বড্ড মলিন৷
রহমান সাহেব হাতের বেতটা আর চালানোর শক্তি পেলেন না৷ হাত দু’টো কাঁপছিলো৷ বেতটা হাত থেকে পরে গেল৷
ছেলেটা বেতটা মাটি থেকে তুলে রহমান সাহেবের হাতে দিয়ে মুখে মলিন হাসি ঝুলিয়ে বলল,
-স্যার মারবেন না আমাকে? রুলস ভঙ্গ করছেন কেন স্যার? আপনি শিক্ষক হয়ে রুলস ভঙ্গ করবেন না!
ভারি কন্ঠে বলল ছেলেটা৷
তারপর আস্তে করে প্যান্টটা পায়ের দিক থেকে তুলে দিলো ছেলেটা৷
সেই দৃশ্যটা ভুলতে পারে না রহমান সাহেব৷
বেতের বারিতে তেতলে গিয়েছিল ছেলেটার পা দু’টো!
রহমান সাহেব হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷
চুপচাপ হেঁটে যখন রহমান সাহেব বেরিয়ে যাচ্ছিলেন৷
ছেলেটা পেছন থেকে ডাক দেয় রহমান সাহেবকে৷
রহমান সাহেব পেছন ফিরে তাকান৷
ছেলেটা স্মিত হেসে বলেছিল “জানেনতো স্যার! মনুষত্ব্যের কাছে নিয়ম তুচ্ছ”
তার দিন কয়েক পরেই মারা গিয়েছিল ছেলেটা৷

মাথার নিচের বালিশটার নিচ থেকে খাতা আর কলমটা হাতে নেন রহমান সাহেব৷
খুব যত্ন করে লিখলেন “জানেনতো স্যার!মনুষত্ব্যের কাছে নিয়ম তুচ্ছ”৷
ছেলে ঘরে ফিরলেই কাগজটা হাতে করে স্কুলের স্যারের কাছে পাঠিয়ে দিবেন৷
.
.
গল্প:প্রায়শ্চিত্ত
লিখা:ইমতিয়াজ আহম্মেদ

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৫ Comments

  1. Md Rahim Miah

    ছিড়ে-ছিঁড়ে
    কী-কি
    সারাক্ষন-সারাক্ষণ
    খুউব-খুবই
    দারুন-দারুণ
    শুনেও-শোনেও
    জানেনতো-জানেন তো
    সত্যিই অসাধারণ ছিল গল্পটা আর শিক্ষণীয় বটে। যেমন কর্ম তেমন ফল। পড়ে অনেক অনেক ভালো লেগেছে। শুভ কামনা রইল। ছোট গল্প হলেও শিক্ষার অনেক কিছু আছে এটাতে

    Reply
  2. Halima tus sadia

    মনুষত্ব্যের কাছে নিয়ম তুচ্ছ।
    এ কথাটার ভাবার্থ অনেক গভীর।

    অনেক ভালো লেগেছে।চমৎকার লেখনি।
    প্রতিযোগিতার গল্প,আরেকটু বড় করতে পারতেন।
    তবুও শিক্ষণীয় বটে।
    যে যেমন করে,তার ফল তেমনই হবে।
    শুভ কামনা রইলো।

    Reply
  3. সুস্মিতা শশী

    শিক্ষনীয় গল্প ছিল। ভালো লেগেছে

    Reply
  4. অচেনা আমি

    আসসালামু আলাইকুম। গল্প প্রসঙ্গে কিছু কথা :
    গল্পটা মোটামুটি ভালো লেগেছে। তবে লেখনী আরও সুন্দর হওয়া উচিত ছিল যেহেতু প্রতিযোগিতার গল্প। বেশ কিছু ভুল রয়েছে। নিচে তা লক্ষণীয় :
    কি /কী এর ব্যবহারে ভুল রয়েছে।
    না হয় – নাহয়
    সারাক্ষন – সারাক্ষণ
    খুউব – খুবই
    এত – এতো
    ভেঙে পরবেন – ভেঙে পড়বেন
    উঠে পরে – উঠে পড়ে
    কয়েকমাসের – কয়েক মাসের
    জবুতবু – জুবুথুবু
    জ্বলসানো – ঝলসানো
    সাধারন – সাধারণ
    ভয়ের চাপ – ভয়ের ছাপ
    ততদিনে – ততোদিনে
    জানেনতো – জানেন তো
    কন্ঠে – কণ্ঠে
    হাস্যোজ্জল – হাস্যোজ্জ্বল
    বেতটা হাত থেকে পরে গেল- বেতটা হাত থেকে পড়ে গেল
    বেন্ঞ্চে -বেঞ্চে
    মাথার উপরে সাই সাই করে ঘোরা সিলিংটার দিকে তাকিয়ে – সিলিং ফ্যান হবে।
    ছাত্ররা ভয়ে জবুতবু হয়ে থাকতেন রহমান সাহেব ক্লাসে গেলেই – ছাত্ররা ভয়ে জুবুথুবু হয়ে থাকতো রহমান সাহেব ক্লাসে গেলেই।(সম্বোধনে ভুল)

    আর বেতের মার খেয়ে মারাই গেল ব্যাপারটা কেমন যেন বেমানান লাগলো। যাইহোক চেষ্টা করেছেন সেটাই অনেক। আগামীতে নিশ্চয়ই আরও ভালো হবে। আপনার জন্য শুভ কামনা।

    Reply
  5. Nafis Intehab Nazmul

    চমৎকার একটা গল্প লিখেছেন। আরেকটু বড় করার দরকার ছিলো।
    অভাব বড্ড খারাপ একটা জিনিস। সর্ব্দায় মাথা নিচু করাতে বাধ্য করে। নিজের অবস্থান গুলো আমরা ভূলে যাই। কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া বোঝা, এক সময় নিজের উপরেই এসে পড়ে।

    Reply

Leave a Reply to সুস্মিতা শশী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *