লেখিকাঃ
Umme Jannat
(মে – ২০১৮)
……………
চব্বিশ নম্বর বেডের রোগীটাকে সবেমাত্র দেখা শুরু করেছি। এমন সময় নার্সের ডাক।
-ম্যাডাম, ইমারজেন্সিতে একজন রোগী এসেছে। খুব সিরিয়াস অবস্থা।
-তুমি যাও। আমি আসছি।
তড়িঘড়ি করে পা চালিয়ে ইমারজেন্সিতে পৌছালাম। তখনো ঘুনাক্ষরে টের পাই নি, আমার জন্য কতবড় ধাক্কা অপেক্ষা করছে!এই রোগীটা আমার কাছে শুধুমাত্র রোগী নয়। আরো অনেক বেশী কিছু। একটা সময় যে ছিলো আমার সকল স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু।যার জন্য আমি বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেতাম। এমন সিরিয়াস পেসেন্ট দেখে যেকোনো ডাক্তারেরই ঝড়ের বেগে চিকিৎসা শুরু করার কথা। কিন্তু আমাকে মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকতে দেখে সবাই বোধয় বিরক্তই হচ্ছিলো।
-ম্যাডাম, রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। এই যে ম্যাডাম…. শুনতে পাচ্ছেন? অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে। আরে ম্যাডাম… কি ভাবছেন আপনি?
-ওহ সরি। ওনার বাড়ির লোকজন এসেছে?
-না ম্যাডাম। উনার সাথে এমন কিছু ছিলো না যাতে তার পরিচয় সনাক্ত করা যায়।
-ওহ আচ্ছা। আমি তোমাকে একটা নম্বর দিচ্ছি। এর পরিবারের লোকদের সাথে যোগাযোগ করো।
-আপনি চেনেন একে?
-না, মানে..ইয়ে..কই নাতো। এত প্রশ্ন করো না।
ওর পা দুটো একদম থেতলে গেছে। রাখা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। মুখ, হাত পায়ের বেশীরভাগ অংশের চামড়া উঠে গেছে।প্রফেসর মোশতাক পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে ওর পা দুটো যতদ্রুত সম্ভব কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু আমি বেঁকে বসলাম। এই ধরনের কেসগুলোতে আমি হাল ছাড়ি না। অবশ্য সব কেসেই যে সফলতা আসে, তা নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত রোগীর প্রাণ বাঁচাতে হাত-পা কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু কিছু কিছু কেসে ধৈর্য নিয়ে চিকিৎসা করলে মিরাক্কেল ঘটে। তখন মনে হয় এর থেকে বেশি আনন্দের মুহূর্ত একজন ডাক্তারের কাছে আর কিছু হতে পারে না। এবারও আমি একটা মিরাক্কেলের প্রতিক্ষা করতে চাই। প্রফেসর স্যার আমার ইচ্ছে শুনে তেমন কিছু বললেন না। কারণ আমার এমন আচরণে তিনি অভ্যস্ত। শুধু ছোট্ট করে উত্তর দিলেন
-“জোর দিয়ে বলতে পারি এবার তুমি যত চেষ্টাই করো ভাগ্য তোমার পক্ষে থাকবে না। ওর পা দুটো কাটা পড়বেই”।
ওর জ্ঞান ফিরেছে একটু আগে। বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বোধয় এখনো বুঝতে পারেন নি, ওর সাথে কি ঘটে গেছে।আমার দিকে দু-এক বার তাকিয়েছে। চিনতে পারে নি। অবশ্য চেনার মতো অবস্থায় নেই। গালের যেখান থেকে মাংস উঠে গেছে, সেখানে বারবার হাত বুলাচ্ছে। একটা ছোট্ট তিল ছিলো ওখানে। এই তিলটা নিয়ে ওর সাথে আমার বহু খুনসুটির মিষ্টি স্মৃতি আছে। অভি ছিলো বিত্তশালী পরিবারের বিলেত ফেরত ব্যারিস্টারি পাস একমাত্র সন্তান। আর আমি তখন মধ্যবিত্ত ঘরের মেডিকেল পড়ুয়া ছাত্রী মাত্র। শুরুর দিকে সম্পর্কের সবই ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো মাঝপথে। যখন ওর উপর আমি সম্পূর্ন নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। ও বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে আমি ওর যোগ্য নই। ওর মতো আমার পরিবারের যশ, খ্যাতি, অঢেল অর্থ কিছুই নেই। সুতরাং সম্পর্কটা আর এগিয়ে নিতে চায় না। আমি আমার তরফ থেকে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। যেহেতু আমি না জেনে বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়িয়েছি সেহেতু শাস্তি আমাকেই ভোগ করতে হবে। গত পনের বছর ধরে সেই শাস্তিই আমি ভোগ করছি। অভিকে ইনজেকশনটা পুশ করে পেছন ফিরতেই দেখি অভির বাবা দাড়িয়ে আছেন। চোখ দিয়ে অনবড়ত পানি ঝরছে। আমি কিছু বোঝার আগেই আমার হাত দুটো চেপে ধরে বললেন
-“মাগো আমার একটাই ছেলে। কোনোভাবে শুধু বাচিয়ে রাখেন।”
কোনো উত্তর দিলাম না। কারণ আমি জানি তিনি আমার দিকে এক নজর তাকাতেই তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়বেন। সর্বোচ্চ স্মরণ শক্তি দিয়ে কিছু মনে করার চেষ্টা করবেন। কারণ পনেরো বছর আগে এক বিকেলে এই মেয়েটাই বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ নিয়ে লাজুক লাজুক মুখে ওনার সামনে বসেছিলো। শত হোক হবু শ্বশুড়ের সাথে প্রথম দেখা বলে কথা। আর তিনিই সেদিন মিষ্টি ভাষায় আমায় অপমান করেছিলেন।
-“আমার ছেলের পিছনে না ঘুরে মন দিয়ে পড়াশোনা করো, কাজে লাগবে। বুঝলে? আচ্ছা তোমার বাবা যেন কি করে?………
যাইহোক থাক সেসব কথা। আধ মিনিট হলো তিনি চোখ গোল গোল করে দাড়িয়ে আছেন। দেখছেন আমায়। বোধয় কিছু মনে পড়েছে। ধপ করে হাতদুটো ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন,
-“তুমি মিম না?
-“জ্বি। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ছেলে বেঁচে থাকবে। শতহোক আপনার ঋণটা তো শোধ করতে হবে।”
-“কোন ঋণের কথা বলছো?”
-“কেনো আংকেল ভুলে গেলেন? সময় নষ্ট না করার যে উপদেশটা দিয়েছিলেন, তার ঋণ।
এমন সময় একজন সুন্দরী মধ্যবয়সী মহিলা প্রবেশ করলেন। উনাকে চিনতে আমার অসুবিধা হয় নি। অভির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যার ছবি দিয়ে ঠাসা। অভির স্ত্রী। স্লিভলেস ব্লাউজ, পাতলা শাড়ি, আর ভারি মেকাপে যেকারো চোখ আটকে থাকার মতো। নাকে আচল গুজে অভির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাকে জোর করে বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝে বসিয়ে দিয়েছে। চারপাশের দুর্গন্ধে তিনি প্রচন্ড বিরক্ত।
-ওহ মাই গড! ওহ মাই গড! ইউ সুড বি মোর কেয়ারফুল! ওয়াট দ্যা ফাকিং সিচ্যুয়েশন দিজ ইজ! বাই দ্যা ওয়ে এই চেকটা সাইন করো।
-আমি ভেবেছিলাম আমায় দেখতে এসেছো। এখন টাকার কি এতটাই দরকার?
-হাউ ফানি! আমি নিজে এসেছি। সো তোমার বোঝা উচিত বিষয়টা কতটা জরুরি।
অভি আর কথা না বাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে চেকটা সই করে দিলো। আমি স্পষ্ট দেখছিলাম ওর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠেছে।
-একটু বসবে সোহা?
-ওয়াট ইউ ওয়ান্ট? এখানে থেকে তোমার মতো আমিও অসুস্থ হই? কি অসুখ অসুখ গন্ধ চারদিকে।
-আচ্ছা যাও। আবার যদি আসো তবে জনি আর এনিকেও সাথে করে নিয়ে এসো।
-আর ইউ ম্যাড? তোমাকে দেখলে ওরা কতটা ভয় পাবে জানো? আমারই তো গা ঘিনঘিন করছে। আর ওরাতো জাস্ট কিড।ওকে বায়। টেক কেয়ার।
অভির চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। নিজের অজান্তেই আমার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেড়িয়ে গেলো।
প্রকৃতি বোধয় কখনো করো কাছে ঋণ রাখে না। যার যা পাওনা দেরীতে হলেও শোধ করে দেয়।
০ Comments