অশ্রুজল
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 1,187 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

লেখা: সাজ্জাদ আলম বিন সাইফুল ইসলাম
.
.
চোখের কোণা দিয়ে আয়েশার অনবরত ঝরঝর করে পানি ঝরছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে বারবার মুছে ফেলার চেষ্টা করলেও কোনক্রমেই বাধা মানছে না। ছাদের এ কোণায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাউকে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলো সে। যদিও বা সে জানে মানুষ মারা গেলে পরজগতে চলে যায়, চাঁদ হয়ে আলো বিলিয়ে নিঃশেষ হবার উপক্রম হয় না।
কিন্তু আব্দুর রহীম তো চাঁদ হয়েই বাংলার ঘরে ঘরে আলো বিলাচ্ছে। সকলের মুখে মুখে তাদের আত্মত্যাগের বুলি শোভা পাচ্ছে। চারদিকে সবাই কত খুশি হয়েছে! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেদের মতো প্রাত্যহিক কাজকর্ম করে ব্যস্ত দিন পার করছে। কিন্তু তারা তো ভুলেই গেছে তাদের যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে মুখের বুলি স্বাধীনভাবে বলতে পারছে।
পাশ কেটে একটা বিড়াল ম্যাও ম্যাও করতে করতে চলে গেল। চারদিকে বেশ ঠান্ডা পড়েছে, আঁচলটা ঠিকঠাকভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকলো। হয়তো চার বছর আগে এই দিনটি অন্যরকম হতে পারতো। হৃদয়ের অতৃপ্তটা নিমিষেই তৃপ্ততায় রূপ নিয়ে স্তস্তির নিঃশ্বাসের সাথে সাথে নতুন স্বপ্নের জাল বুনতো। সাহায্য করতো আব্দুর রহীম, আয়েশার প্রিয়তম স্বামী। যার কাছে সঁপে দিয়েছিলো নিজের সবটা। জীবন দিয়ে ভালোবাসার অক্ষরে লিখেছিলো দু’জনের নাম।
ছেলেটা হয়তো শূণ্য হৃদয়ের বাবার ভালোবাসার কমতি নিয়েই প্রতিদিনের মতো ঘুমিয়ে গেছে। মা হয়েও সবটা দিয়ে খোকনকে ভালোবাসলেও বাবার কথা বিন্দুমাত্র ভুলতে চায় না সে। খোকন মাঝে মাঝে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বুলি আওড়াতে থাকে,
‘মা সবার বাবাই তো স্কুলে আসে, আদর করে কোলে তুলে নেয়, আমার বাবা কেন আসে না মা? আমাকে কেন আদর করে কোলে তুলে নেয় না?’
খোকনের কথায় চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা জমা হলেও হাসি মুখে ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলে, ‘খোকন, আজ কি তোমার পছন্দের কৈ মাছ রান্না করবো?’
খোকনের কৈ মাছ খুব পছন্দের। আলতো তেলের আঁচে সামান্য করে ভেজে রান্না করা। অদ্ভুতভাবে প্রিয়তমের সাথে মিলে যায় খোকনের আচরণ। আব্দুর রহীমেরও ভাজা কৈ মাছ খুব পছন্দের ছিলো। মাঝে মাঝে ডেকে বলতো,
‘বউ, আজ কি কৈ মাছ নিয়ে আসব? তুমি রান্না করবে আর আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার চাঁদমাখা মুখখানা দেখবো। নিজের অজান্তেই মনে মনে ভালোবাসার সাগরে ঢুব গিয়ে তোমাকে আপন করে নিবো।’
লজ্জাবতী আয়েশার চোখ-মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যেত। খানিক পরে মুখ ফুটে বলতো, ‘আপনার মুখে কি কিছুই অাটকায় না? এই ভরদুপুরে কী শুরু করেছেন!’
ঠোঁট বাঁকিয়ে আব্দুর রহীম বলতো, ‘আমার বউয়ের সাথে আমি প্রেম করবো, এতে কার কী আসে যায়?’
আয়েশা আর কোনো কথা বলতো না। কাজের ছলে দ্রুত পাশ কেটে চলে যেত, নতুবা ভীমরতির শেষাংশটুকুও বাদ থাকতো না।
ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে আবারো বৃষ্টির ফোঁটা জমে অঝরে ঝরে পড়ে। চাঁদটা এখন কালো মেঘের আড়ালে কিছুক্ষণের জন্য ডুবে গেছে। আচ্ছা যদি এমন হতো, প্রিয়তম ফিরে এসে জড়িয়ে ধরে বলতো, ‘সোনাই আমি ফিরে এসেছি। দাবি আদায়ের পথটা সহজলভ্য করেই এসেছি।’
সোনাই নামটা আব্দুর রহীমেরই দেয়া। আদর করে ডাকতো। অদ্ভুত নামের পুরুষ্কার হিসেবে আয়েশা তাকে একটা বকুল ফুলের মালা দিয়েছিলো। শেষদিন পর্যন্তও যেটা তার পকেটে শোভা পেয়েছিলো। শুকনো বকুল ফুলের মালাটা রক্তে রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিলো।
.
২১শে ফেব্রুয়ারি যতই কাছে আসছে ততই হৃদয় কম্পন আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে রহীমের। বিছানায় একাত-ওকাত করেই রাত্রিটা কাটছিলো। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় আয়েশার। রহীম তখনো বালিশের উপর ভর দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলো,
‘এ কী! আপনি ঘুমাননি?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহীম বলে উঠে, ‘ঘুম তো আসতে চায় না সোনাই।’
রহীমের মতো আয়েশাও ঠেশ দিয়ে প্রিয়তমের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন। আল্লাহ নিশ্চয়ই বাঙ্গালীদের নিরাশ করবে না। তিনি ন্যায্য অধিকারটুকু ফিরিয়ে দিবেন।’
সান্ত্বনা অনুভব করে রহীম ম্লান হেসে বলে, ‘তাই যেন হয় সোনাই, তাই যেন হয়।’
‘আপনি ঘুমিয়ে পড়েন। না হলে শরীর খারাপ করবে।’
‘আচ্ছা সোনাই, তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো না?’
কিছুটা আশ্চর্যবোধ অনুভব করে আয়েশা বলে, ‘এত রাতে হঠাৎ আপনার কী হলো! এমন করছেন কেন?’
‘২১ তারিখ মনে হয় খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে।’ প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে রহীম।
আয়েশা স্বামীর বুকে মাথা রেখে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে বলে, ‘এমন করে বলবেন না। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবে। তিনি ছাড়া তো উত্তম সাহায্যকারী নেই।’
অায়েশার কথাটা শুনে ওর মাথায় হাত বোলাতে থাকে। মেকি হেসে খোকনের দিকে তাকায় সে। ঘুমন্ত অবস্থায় নাকি মানুষকে খুব সুন্দর দেখায়, সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। সে তো একটা মাছুম বাচ্চা, তাই তার সৌন্দর্য থাকাটাই স্বাভাবিক।
আস্তে আস্তে উভয়ে ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যায়। চাঁদ তার আপন গতিতে আলো বিলাতেই থাকে। কোথাও কোথাও দু’একটা কুকুর না ঘুমিয়ে হাঁক পাড়তে থাকে।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নামায পড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় অায়েশা। ঘুম থেকে নামাযের জন্য রহীমকে ডেকে বলে, ‘জায়নামাজে বসে দেশের জন্য কাঁদো, আল্লাহর কাছে আমাদের ন্যায্য দাবী আদায়ের কথা বলে ফরিয়াদ করো। নিশ্চয়ই তিনি শুনবেন। ততক্ষণে আমি আপনার জন্য নাস্তা বানাই।’
ঘুম থেকে উঠে আয়েশাকে বলে, ‘তুমি ঠিকই বলেছ আয়েশা। কেবলমাত্র আল্লাহই পারেন আমাদের দাবীকৃত অধিকার ফিরিয়ে দিতে।’
আয়েশা হাস্যোজ্বল মুখে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। বিছানা থেকে উঠে বাথরুমের দিকে হাঁটা দেয় রহীম।
.
বিকেলে বাজার থেকে খরচ এনে আয়েশাকে ডাকতে থাকে। নিভৃতে নিরবে বারান্দার একপাশে বসে ছিলো আয়েশা। প্রিয়তমের ডাকে দ্রুত তার সামনে এসে বলে, ‘বাজার আনছেন?’
ভায়ার্ত কণ্ঠে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, বাজারের ব্যাগ নিয়ে ভেতরে যাও। আমাকে মিজান ভাই একটু ডেকেছেন, সেখানে যাচ্ছি। আর একটা চিঠি পোস্ট করতে যাচ্ছি।’
‘চিঠি! কার কাছে?’ অবাক হয়ে বলে আয়েশা।
‘মায়ের কাছে, অনেকদিন মায়ের কোনো খোঁজ খবর নেয়া হয়নি।’
‘আচ্ছা যাও, আমি রান্না বসাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’
বাজারের ব্যাগ নিয়ে ভিতরে যায় আয়েশা। গেট দিয়ে বাইরে বের হয়ে যায় রহীম।
দিনান্তে বাইরের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে আয়েশা। রহীম এখনো ফিরে আসে না। বুকের ভিতরটা দুরুদুরু করে কাঁপছে।
ঘরের ভিতর মন টিকছে না। হৃদয় কম্পন বাড়ছেই। কূল-কিনারা না পেয়ে দরজার সামনে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে সে। তাড়াহুড়ো করে ঘরে ফিরে আসে রহীম।
রহীমকে দেখে কিছুটা ভয় কেটে যায় আয়েশার। দ্রুত স্বামীর পিছনে পিছনে ঘরের মধ্যে যায় সে।
‘সারাদিন আপনি কোথায় ছিলেন? এতক্ষণ পরে আসলেন যে?’
রহীম কোনো কথা না বলে চুপ করে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছে। আবারো প্রশ্ন করে আয়েশা, ‘কথা বলেন না কেন? কী হয়েছে বলবেন তো!’
রহীম খানিকটা স্থির হয়ে আয়েশার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শান্তস্বরে বলার চেষ্টা করে, ‘সোনাই, সরকার থেকে আগামীকাল ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। তবুও বাংলার আপামর জনতা মিছিলে যোগ দিবে। মিজান ভাই এখনি আবার সেখানে ডাকলেন। অনেক কাজ বাকি।’
হৃদয়ের মধ্যে সাহস সঞ্চার করে রহীম আবারো বললো, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’
তাড়াহুড়ো করে কয়েকটা দরকারী জিনিষপত্র নিয়ে বললো, ‘সোনাই আমি এখন যাই।’ এক বছরের খোকনের কপালে চুমু খেয়ে যাবার উপক্রম হলো।
আয়েশা পিছন থেকে ডেকে বললো, ‘আপনার পছন্দের কৈ মাছ রান্না করেছি।’
মুখে হাসির রেখা টেনে রহীম ফের বলে, ‘আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে কালকে খাবো সোনাই। আপাতত আল্লাহর কাছে দোয়া করো।’
আর একটি মুহূর্তও দাঁড়ালো না রহীম। ফরফর করে চলে গেল। ফ্যালফ্যাল করে শুধু চেয়ে থাকলো আয়েশা।
.
‘ঢাকার রাজপথে আজ গুলি বর্ষণ হয়েছে। পাখির মতো নাকি মানুষ মারা গেছে।’
খবরটা খুব ভাবাচ্ছে আয়েশাকে। সকাল ১০টার পর থেকে ছটফট করছে সে। বাংলার আপামর জনতা নাকি সরকারের বেঁধে দেয়া ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে নেমেছে। তখনই ঘটেছে আসল ঘটনা। রেডিওতে কান পেতে খবরটা শুনে বুকটা দুরুদুরু করছে। সকালে রহীমের পছন্দের কৈ মাছ রান্না করলেও এক গ্রাস ভাত মুখে তুলতে পারেনি আয়েশা। কোনো এক অজানা ভয়ে চেপে আছে সে।
যোহরের আযান দিলো, আয়েশা ওজু করে নামাযে দাঁড়িয়ে সকলের মঙ্গলকামনার্থে আল্লাহর দরবারে দু’হাত উত্তোলন করলো। চোখের পানি বৃষ্টির মতন পড়তে লাগলো।
নামাযের পর প্লেটে ভাত মেখে খাওয়ার চেষ্টা করলেও গলা দিয়ে ভাত নামছে না। খোকনও কান্না করছে।
অযথা আর খাওয়ার চেষ্টা না করে ভাতগুলো ঢেকে রেখে বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। খোকন একটু পরপর কাঁদছে।
রহীম যাওয়ার সময়কার কথাটা বারবার ভেসে আসছে, ‘আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে কালকে খাবো সোনাই।’
খোকন কোলোয় ঘুমিয়ে গেছে। নিঃশব্দে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মুরগীগুলোকে খাবার দিতে লাগলো। সকাল থেকে এক ফোঁটা পানিও পেটে যায়নি।
পিছন থেকে ডাক আসলে, ‘আয়েশা।’
আয়েশা পিছনে ফিরে তাকায়, মিজান ভাইসহ আরো কয়েকজন পরিচিত মুখ। সকলের মুখ কিংবা অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রক্তিম রঙ্গে রঞ্জিত। পিছনে খাটিয়ায় কে যেন শুয়ে আছে।
ম্লান হেসে ঘোমটা টেনে উত্তর দেয়, ‘ভাইজান, আপনাদের শরীরের এ কী অবস্থা!’
মিজান ভাই কথা বলে না, চুপ করে ঝরঝর করে পানি ফেলতে থাকে। করিম ও মিলন খাটিয়াটা আয়েশার সামনে এনে রাখে। আয়েশা নিশ্চুপভাবে খাটিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। মুখের কাপড়টা সরিয়ে দেখে প্রিয়তমের লাশ।
এখনো মুখে হাসি লেগেই আছে রহীমের।
মিজান ভাই কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘রহীম সামনের দিকে ছিলো। জোরে জোরে স্লোগান দিচ্ছিলো, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ কিন্তু হায়েনাদের থাবায় কিছুক্ষণের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল লক্ষ কোটি স্বপ্ন। অনবরত বুলেট ছোঁড়ার কারণে বুলেটবিদ্ধ হয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যায় রহীমের বুকের হৃদপিণ্ড।’
মিজান ভাইসহ সবাই কাঁদছে। আয়েশা খাটিয়ার সামনে বসে নিশ্চুপ শব্দে শুধু অশ্রুকণা ফেলছে।
ঘর থেকে ভেসে আসে খোকনের কান্নার শব্দ। বাবার শহীদ হবার খবর হয়তো তারও কান অবধি পৌঁছেছে। তাই সেও চোখের পানি ফেলে নিজেকে হালকা করার চেষ্টায় মশগুল।
কাঁদুক, কাঁদলে নাকি মানুষের কষ্টের বোঝা হালকা হয়। কোটি বাঙ্গালীর স্বপ্ন পূরণ করতে না হয় একটি পরিবারের স্বপ্ন বিলীন হোক, তাতে মন্দ কী?
মিজান ভাই বললো, ‘আয়েশা, রাজপথে কতই না লাশ পড়ে আছে। অনেক খোঁজার পর রহীমের লাশটা পেয়েছি।’
আয়েশা এবারো কোনো উত্তর প্রদান করে না। চুপ করে ভাবছে গত রাতের শেষকথাটি, ‘সোনাই, আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে কালকে কৈ মাছ দিয়ে একসাথে ভাত খাবো।’
বারবার মনে হচ্ছে, কেন ধোঁকা দিলেন তিনি?
.
ছাদ থেকে সরাসরি ঘরের দিকে প্রত্যাবর্তন করে আয়েশা। এতক্ষণ নিজের স্মৃতিতে আঁটকে থাকা স্মৃতিটুকু স্মরণ করার চেষ্টা করছিলো। স্মৃতিটুকু ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ ভিজে গেছে টেরই পায়নি। ঘরে এসে দেখে খোকন ঘুমাচ্ছে, মাঝে মাঝে বাবার আদর পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। ঘরের ডিম লাইটটা অন করে জানালা লাগাচ্ছিলো, এমন সময় রিতা ঘরে আসে। রিতা পাশের রুমেই থাকে।
‘আপু আপনার চিঠি।’
চিঠির কথা শুনে আবারো বুক ধুঁক করে উঠে। নিজের ব্যাকুলতাকে আপাতত মনের ভিতর নিমজ্জিত করে বলে, ‘হ্যাঁ দাও।’
রিতা হাসিমুখে বললো, ‘আপনি বাড়িতে ছিলেন না, ডাকপিয়ন আমাকে চিঠিটা দিয়ে চলে গেছে। বিকেলে আবার আমিই টিউশনিতে গিয়েছিলাম যার কারণে দিতে দেরি হলো।’
রিতার সামনে ব্যর্থ হাসি হাসার চেষ্টা করে আয়েশা, ‘সমস্যা নেই রিতা।’
রিতাও ম্লান হেসে ঘর থেকে চলে যায়। রাত হয়েছে বলে আয়েশা আজ তাকে বসতে বলে না। চিঠির উপর প্রেরকের ঠিকানা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়েশা। আজকে ৩০টি চিঠি পূর্ণ হলো। একটারো উত্তর ঠিকমতো দেয়া হয়নি। দিলে দু’চার বাক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
চিঠিটা আসে রহীমের মায়ের কাছ থেকে। কখনো ছেলের কাছে টাকা চেয়ে বা কখনো ছেলেকে দেখতে চেয়ে চিঠি লিখেন। আয়েশা আজ পর্যন্ত মাকে বলেনি তার ছেলে একজন ভাষা শহীদ। দেশের তরে, দেশের মানুষের তরে, একমাত্র বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়ে অনন্তকালের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে।
আয়েশা এখন একটা স্কুলে চাকরি করে কোনোমতে সংসারটা চালাচ্ছে, তা থেকে মায়ের জন্যও মাঝে মাঝে কিছু পাঠায়। আয়েশা আস্তে আস্তে চিঠিটা খুলে,
‘বাজান, কতদিন পর হয়ে গেল, কতদিন তোরে দেখি না। মায়েরে কি তোর দেখতে মন চায় না? তোরে দ্যাখতে আমার খুব ইচ্ছা করতাছে। বাজানরে, আমি মনে হয় আর বাঁচমু না, শেষবারের মতন আমারে একবার দ্যাখা দে।’
চিঠিটা পড়ে কাঁদতে লাগলে আয়েশা। কী লিখবেন এর উত্তরে? এতদিন রহীমের হয়ে চিঠির মাধ্যমে মাকে সান্ত্বনা দিয়েছে সে। কিন্তু আজকের এ চিঠির জবাব দেয়ার মতো ভাষা তার কাছে জানা নেই।
ঘুমন্ত খোকনকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে। মায়ের কান্নার অর্থ বুঝতে না পারা সত্ত্বেও খোকনও তার সাথে যোগ দেয়।
এখন তার কী করা উচিত আয়েশা ভেবে পায় না। মাকে কি সবটা বলা দরকার যে, ‘মা আপনার ছেলে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। মাগো, আপনার ছেলে একজন ভাষা শহীদ। আপনি একজন গর্বিত মা।’
এক হাতে খোকনকে জড়িয়ে ধরেছে আরেক হাতে চিঠিটা। বুকের কোণায় শূণ্যের বালুচর তৈরি হয়েছে। কে পূরণ করবে তা? কে দেখাবে নতুন স্বপ্ন? তাদের পরিবারের স্বপ্ন। খোকনকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। কবে ফিরে আসবে সে? মিষ্টি সুরে বলবে, ‘সোনাই, আজ তুমি কৈ মাছ রান্না করবে, আর আমি চুপিচুপি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবো।’
চুপচাপ হয়তো পূর্বের মতো বলতো, ‘আপনার মুখে কী কিছুই আটকায় না? এই ভর দুপুরে কী শুরু করেছেন?’
(সমাপ্ত)

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

১ Comment

  1. আফরোজা আক্তার ইতি

    খুব সুন্দর ভাবে লিখেছেন। পড়তে পড়তেই চোখের কোনায় আনমনে পানি চলে এল। আসলেই, প্রতিটি আন্দোলনের পিছনেই রয়েছে ইতিহাস। এই আন্দোলনে শুধু তারা প্রাণ দেন নি,সর্বস্ব হারিয়েছে তাদের পরিবারও। আর আমরা কত নির্মমভাবেই না বাংলা ভাষার অপব্যবহার করছি,অমর্যাদা করছি। কথায় কথায় গালি দেয়া আমাদের স্মার্টনেস হয়ে দাঁড়িয়েছে অথচ এতে যে আমাদের বাংলা ভাষারই অপমান হচ্ছে এটা কি আমরা ভেবেছি?
    বানানে খুব বেশি ভুল নেই।
    স্তস্তির- স্বস্তির।
    ঢুব- ডুব।
    কোলোয়- কোলে।
    অনেক শুভ কামনা।

    Reply

Leave a Reply to আফরোজা আক্তার ইতি Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *