অনর্থক হাহাকার
প্রকাশিত: জুন ১১, ২০১৮
লেখকঃ vickycherry05

 1,679 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ vickycherry05

লেখা: রেবা মণি
(জুন – ২০১৮)

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে , নেহা এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। উদাস দৃষ্টি মেলে বৃষ্টি দেখছে সে। কদম গাছটাতে অনেক ফুল এসেছে। বৃষ্টির ফোটা কদমের ফুলগুলো ভিজিয়ে নিচে পড়ছে। সুন্দর দৃশ্য! নেহার মুগ্ধ হবার কথা কিন্তু সে মুগ্ধ হতে পারছে না। তার মনটা প্রচণ্ড খারাপ। এই মন খারাপটা সাময়িক নয়, এটা এখন পার্মানেন্ট হয়ে গেছে। দিন-রাত সবসময়ই তার মন খারাপ থাকে। অথচ আগে নেহা খুব চঞ্চল ও হাসি-খুশি স্বভাবের ছিল। এখন নিজের উপর প্রচণ্ড বিরক্তি ও রাগ তার। গতরাতেও মাসুদ তাকে নানা ধরনের কটু কথা বলেছে। পরপর দুইটা কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে বিরাট বড় অপরাধ করে ফেলেছে নেহা! এজন্য মাঝেমাঝেই তাকে বকাঝকা শুনতে হয়। শেষ কবে হেসেছিল সে, তা ঠিক মনে পড়ে না। প্রথম কন্যার জন্মের পর থেকেই নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকে সে। প্রথমে শ্বাশুড়ি নানা কথা বলতো। এখন নিজের স্বামীই বকাঝকা করে। আর ভালো লাগছে না। একটা পুত্র সন্তানের আশায় আবারও সন্তান নিল সে। অসুস্থ শরীরে যেখানে নেহার অতিরিক্ত যত্ন আর মানসিক সুস্থতার দরকার সেখানে সে নিজের প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের অযত্ন করে।

বৃষ্টি কমে এসেছে। বড় মেয়েটা ভিজে ভিজে স্কুল থেকে ফিরেছে। ৯বছর বয়স বড়টার, ছোটটা ৪ বছরের। অথচ ওরা যথেষ্ট বুদ্ধিমতি। মায়ের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখে। এই মেয়ে দু’টির দিকে তাকিয়েই নেহা বেঁচে থাকে। ওদের মুখের দিকে একবার তাকালেই শত কষ্ট ভুলে যাওয়া সম্ভব। নেহার মনে পড়ে যেদিন বড় মেয়েটার জন্ম হলো, মাসুদ রাগ করে ঘরেই ফেরেনি। ছোটটার জন্মের পর একটানা সাতদিন ঘরে কোন খাবারই খায়নি। নেহা বুঝতে পারে না , ছেলে মেয়ের পার্থক্যটা কোথায়? কই মেয়েদের জন্মের সময় তো তার কষ্ট কম হয়নি! তাহলে কেন মাসুদ এমন করে? অফিসে বাজারে কেউ তার সন্তানের কথা উল্লেখ করলে নাকি লজ্জা পায় মাসুদ! দুই দুইটা মেয়ে! লোকে শুনলেও খারাপ ভাববে।
যত দিন যাচ্ছে নেহার টেনশনও বেড়ে যাচ্ছে। এইবারও যদি মেয়ে হয়? বাবার পছন্দে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়েছিল তাদের। কিন্তু মাসুদের মন মানসিকতা একদমই নোংরা। মেয়েদের প্রতি একধরনের অবজ্ঞা পোষণ করে সে। সামাজিকভাবে ছোট হয়ে যাওয়ার ভয়ে নেহা চুপ থাকে। নইলে কবেই ডিভোর্স হয়ে যেত! মাসুদের সাথে কথা বলাই যায় না। অযথাই তর্ক বিতর্ক করে মারা শুরু করে দেয় সে। চুপ থাকতে থাকতে নেহা এমন বোবা হয়ে গেছে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মাসুদের সাথে একটা কথাও বলে না সে। মাসুদের এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। জৈবিক প্রয়োজন মিটাতে পারলেই হলো।
মেয়েদের দিকেও তেমন মনযোগ নেই। অফিস শেষে বাসায় এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে। মাঝখানে এটা সেটা নিয়ে অযথাই রাগারাগি করে। মাসুদকে না দেখলে নেহা বিশ্বাসই করতো না, শিক্ষিত মানুষের মনমানসিকতা এতোটা নিচু হতে পারে।

মাসুদ যেমন ব্যবহারই করুক মেয়েরা বাবাকে খুব ভালোবাসে। দিনরাত জুরে মাসুদের ভাবনা একটাই , একটা ছেলে না হলে তার সহায় সম্পত্তির একজন উত্তম উত্তরাধিকারী থাকবে না। বড় মেয়েটা এবার ফাইভে উঠবে। যথেষ্ট বুদ্ধিমতি হলেও উত্তরাধিকারী হিসাবে মেয়েকে মানায় না। ‘এইবার নেহার মেয়ে হলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকটা বিয়ে করবো’। এমন ভাবনাও আসে মাসুদের মনে। নেহার আজকেই হয়ত ডেলিভারী হবে। ওর বাবা ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। মাসুদ অপেক্ষায় আছে, মেয়ে হবার খবর পেলেই দুই মাসের জন্য সিলেট থেকে ঘুরে আসবে, ভালো পাত্রী পেলে বিয়েটাও সেরে নেবে। নেহার এত্তোগুলা মেয়ের দায়িত্ব নেয়া তার আর সম্ভব নয়। এইসব ভাবছে আর রাস্তা দিয়ে হাঁটছে মাসুদ। এমন সময় উল্টোদিক হতে প্রবলবেগে ধেয়ে আসা একটি মাইক্রোবাস ধাক্কা দিয়ে মাসুদের গায়ের উপর দিয়ে চলে গেলো। কিছু বোঝার আগেই অচেতন হয়ে গেল সে।

প্রায় ২৩ঘণ্টা পর অল্প অল্প জ্ঞান ফিরে এলো মাসুদের। নিজেকে দেখে প্রচণ্ড কান্না এলো তার। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। মুখে অক্সিজেনের নল, চেষ্টা করেও ঠোঁট নাড়াতে পারছে না। রুমের বাইরে থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। কণ্ঠগুলো খুবই পরিচিত। দুই মেয়ে আর নেহার মায়ের কণ্ঠ! মাসুদের চোখ দুটি ভিজে এলো কিন্তু কণ্ঠনালী রুদ্ধ হয়ে আছে। চারদিকে কেমন আবছা অন্ধকার কুয়াশা কুয়াশা ভাব। অনেক কিছুই মনে আসছে আবার চলে যাচ্ছে কেমন একটা ঘোর ঘোর অবস্থা। কোনরকমে হাতটা সামান্য নাড়াতে পারলো সে। তখনই একজন নার্স ছুটে এলো। এসেই ডাক্তারকে ডাকতে লাগলো। ডাক্তার এসে দেখলো জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু অবস্থা গুরুতর।
মেয়েদের নিয়ে ভিতরে ঢুকলো একজন নার্স। সেই কখন থেকে বাবাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে মেয়ে দু’টো! ভিতরে ঢুকেই মেয়েদু’টি ঝাঁপিয়ে পড়লো মাসুদের উপর। ওদের কান্নায় মাসুদের ভিতরটা দুলে উঠল। হায় রে! এতোদিন কিনা এদেরই সে অবহেলা করে এসেছে? ছিঃ ! নিজেকেই ধিক্কার দিল সে। মেয়েদের প্রতি অন্যরকম একটা ভালোবাসা অনুভব করল সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আর কোনদিন মেয়ে বলে ওদের অবহেলা করবে না সে। কিন্তু চারদিক এমন অন্ধকার লাগছে কেন? শত চেষ্টা করেও ঠোঁট নাড়িয়ে মনের কথাটা বলতে পারলো না সে। বুকের ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছে করছে মেয়েদের কাছে, নেহার কাছে শেষবারের মত ক্ষমা চেয়ে নিতে। যদি নেহার ছেলেই হয় তাহলে সেকি জানবে একটা ছেলের জন্য এই বুকে এতো হাহাকার ছিল? সেকি জানবে ছেলে ছেলে করে নেহাকে কতটা কষ্ট দিয়েছি? সব প্রাপ্তিই জীবনে পূর্ণতা এনে দেয় না। তাই যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকুই আগলে রাখতে হয়। ধীরে ধীরে চারদিকে অন্ধকার নেমে এলো। ওদিকে হাসপাতালের লেবার রুমে সদ্য প্রসূত ছেলেটি কাঁদছে এদিকে
মেয়েদের কান্নার তীব্রতা হঠাৎ করেই আবার বেড়ে গেছে…।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

০ Comments

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *