অদ্ভুত নিয়তি
প্রকাশিত: মে ১৭, ২০১৮
লেখকঃ vickycherry05

 3,128 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ vickycherry05

লেখা: আপসারা নূর তিথি
(মে – ২০১৮)
……………

“শোনো আফরা, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না”
আফরা ফাহিমের কলার ধরে বললো, “কেনো পারবে না? আমি ধর্ষিতা বলে?”
ফাহিম চোখমুখ শক্ত করে বললো, “হ্যাঁ তাই। একজন ধর্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করলে আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না”।

আফরা এতোক্ষণ নিরবে কাঁদছিলো। কাঁদতে কাঁদতে ওর হেচকি উঠে গেছে। ও পাগলের মতো ফাহিমের হাত ধরে বলছে, “বাবু এমন করো না প্লিজ। তুমি জানো না আমি তোমাকে কত ভালোবাসি? আমি তোমায় ছাড়া বাঁচতে পারবো না বিশ্বাস করো। তুমি তো তোমার আম্মুকেও আমার কথা বলেছো না? তিনি তো রাজী হয়েছে। এমন কেনো করছো? আমি কি ইচ্ছে করে ধর্ষিত হয়েছি? প্লিজ বাবু আমার সাথে এমন করো না”।
ফাহিম ধাক্কা দিয়ে আফরাকে দূরে সরিয়ে দেয়। তারপর চিল্লিয়ে বলে, “তোরে কোনো ছেলেই বিয়ে করবে না। আর আমার মা ই না করছে তোর সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখতে। সে আমার জন্য তোর থেকে অনেক সুন্দরী ও ভালো পরিবারের মেয়ে দেখেছে”।
আফরা কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেল। ফাহিমের কথা শুনে কাঁদতেও ভুলে গেছে। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। এই মানুষটাকে সে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ভালোবেসে এসেছে? এই মানুষটাই তাঁকে কত স্বপ্ন দেখিয়েছে। হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছে যেকোনো পরিস্থিতিতে পাশে থাকবে। কখনো হাত ছেড়ে দিবে না। কোথায় গেলো তার সে প্রতিশ্রুতি!
ফাহিম চলে যেতেই আফরা দাঁড়ানো থেকে বসে পড়ে পাগলের মতো চিল্লিয়ে কাঁদতে শুরু করে। ওর কাছে পুরো দুনিয়া অসহ্যকর লাগছে। মনে পড়ে যায় সেই বিভস্যকর রাতের কথা। প্রতিবেশির কটুক্তির কথা। বাবা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। মা আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদার দৃশ্যটা। ফাহিমকে নিয়ে দেখা সব স্বপ্নগুলো। না ও আর কিছু ভাবতে চায় না। ওর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। দৌড়ে চলে যায় রেললাইনের উপর। হাঁটতে থাকে আনমনে। চোখের সামনে কিছু চেহারা বারবার ভেসে উঠছে। মার, বাবার আর ফাহিমের। আফরা বিশ্বাস করতে চায় না একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা। এটা নিছক একটা দুঃস্বপ্ন আর কিছু না। হ্যাঁ আর কিছুই না!
ঝনঝন করে ট্রেন সামনে থেকে এগিয়ে আসছে। আফরার পা অসাড় হয়ে পড়েছে। ট্রেন একদম কাছাকাছি আসতেই ছিটকে পড়লো পাশের রাস্তায়। উঠে বসে আবারও ঢুকড়ে কেঁদে উঠলো। না ও এতো সাহসী কখনোই ছিলো না। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যে অনেক সাহসের প্রয়োজন হয়।

বাসায় পৌছাতেই ওর মা লক্ষ্য করলো আফরার হাত বেশ কিছু জায়গায় ছিলে গেছে। রক্ত পড়ছে। তিনি মেয়ের কাছে গিয়ে আকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হইছে তোর? রক্ত পড়ে ক্যান? কস না কি হইছে?”
আফরা শান্ত দৃষ্টিতে বলে, “মরতে গেছিলাম সাহসে কুলায় নাই”।
নাদিরা বেগমের হাত থেকে কাঁচের গ্লাস মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। ইকবাল হোসেনও পত্রিকা হাতে কেঁপে উঠে। তাদের একমাত্র মেয়ে। একটা দুর্ঘটনার জন্য এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আফরা ঘরে গিয়ে দরজা লাগাতেই দুইজনই অনবরত দরজায় টোকা দেয়। আফরা কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বলে, “ভেবো না মা। সুইসাইড করার সাহস আমার নেই”।
ইকবাল হোসেন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। হাউমাউ করে কাঁদে। আফরাও কাদে। নাদিরা বেগম বারবার আঁচলে চোখ মুছে।

সেদিনের পর থেকে আফরা পুরো চুপচাপ হয়ে যায়। কারোর সাথে কোনো কথা বলে না। শুধু এক দৃষ্টিতে আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে। ওর মা বাচ্চাদের মতো অনেক সময় লাগিয়ে ওকে খাইয়ে দেয়। আফরা অন্যমনস্ক হয়ে খায়। এক লোকমা মুখে নিয়ে বসে থাকে চিবোয় না। মেয়ের অবস্থা দেখে মা সকাল বিকাল শুধু কাঁদে। বাবা এক সাইক্রিয়াটিস্ট থেকে আরেক সাইক্রিয়াটিস্টের দ্বারে দৌড়ায়। কোনো লাভ হয় না। কারোর কোনো কথায় আফরা কোনো প্রকার রেসপন্স করে না।

আজ ফাহিমের বাসায় হৈ-হুল্লোড়ে চারদিক মুখোরিত। নতুন বৌ বাড়িতে আসবে। ফাহিমের যার সাথে বিয়ে হচ্ছে ঐ মেয়ের নাম সাদিয়া। মোটামুটি ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে। সমাজে ভালো নামডাক। মেয়ে দেখতেও যথেষ্ট সুন্দরী। পাড়ার অনেক ছেলেরই স্বপ্নের রানী। এরকম মেয়েকে বিয়ে করতে পেরে ফাহিম নিজেকে ভাগ্যবান ই মনে করছে। যদিও আফরার জন্য কিছুটা খারাপ লাগছে। কারণ ভালো তো ঠিকই বেসেছিলো। ফাহিম জোর করে আফরার কথা মাথা থেকে সরিয়ে দেয়। ঐ ধর্ষিতার কথা ভাবার কোনো মানেই হয় না।
সব অনুষ্ঠান শেষে নতুন বর বৌকে বাসর ঘরে রেখে সবাই যে যার মতো ঘুমোতে যায়। ফাহিম নতুন বৌ এর ঘোমটা তুলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে বেশকিছুক্ষণ।
মাঝরাত! ফাহিমের রাগে গা হিনহিন করছে। একহাতের দুই আঙুলের মাঝে সিগারেট ধরে আরেকহাত মুষ্টিবদ্ধ করে বিছানা জাপটে ধরেছে শরীরের সব শক্তি দিয়ে। বিছানার ঠিক মাঝে অর্ধনগ্ন অবস্থায় গুটিশুটি হয়ে বসে আছে নতুন বৌ সাদিয়া। সাদিয়ার দৃষ্টি নিচুপানে। ফাহিমের চোখ টকটকে লাল। যেনো চোখের ভিতর বিস্ফোরিত হচ্ছে আগুনের কুন্ডলি। ফাহিম কোনোমতে নিজেকে কন্ট্রোল করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “তুমি ধর্ষিতা এ কথা লুকিয়ে বিয়ের আসরে বসেছো কেনো?”
সাদিয়া কিছু বলে না। চুপচাপ নিচের দিকেই তাকিয়ে থাকে। ফাহিম আবারো জিজ্ঞাসা করে, “কি হলো কথা বলছো না কেনো?”
সাদিয়া তখনও চুপ। ফাহিমের মাথায় রক্ত উঠে যায়। ও সাদিয়ার দুই বাহুতে শক্ত করে ধরে ওকে ঝাঁকিয়ে বলে, “কি হলো জবাব দাও”।
সাদিয়া চমকে উঠে। ও তাড়াতাড়ি করে বলে, “আ আ আমি ধর্ষিত না”।
“মানে?”
“ইয়ে মানে ইয়ে”।
ফাহিম সাদিয়ার দিকে ঝুঁকে বলে “ইয়ে মানে ইয়ে না করে সত্যিটা বল”।
সাদিয়া চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলে, “আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আমার বেশ কিছুবার সম্পর্ক হয়েছিলো। কিন্তু গত দুইমাস আগে ও আমার সাথে ব্রেকআপ করেছে”।
ফাহিম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাদিয়ার দিকে। এতোক্ষণের চিল্লাচিল্লিতে ফাহিমের বাবা-মা উঠে আসে। বাইরে থেকে দরজা নক করলে সাদিয়া তাড়াতাড়ি করে শাড়ি ঠিক করে নেয়। ফাহিম গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ফাহিমের মা জিজ্ঞাসা করে, “কিরে কি হয়েছে? এতো চেঁচামেচি কিসের?”
ফাহিম মা এর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “দুর্ঘটনায় সতীত্ব হারানো মেয়েটাকে ঘরের বৌ করে আনতে তোমার ঘোর আপত্তি ছিলো। কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় ফুর্তি করে পরপুরুষের কাছে অবৈধভাবে সতীত্ব বিকিয়ে দিয়ে যে মেয়ে সমাজে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ায় তাঁকে তুমি বরণ করে ঘরের বৌ করে এনেছো”
ফাহিম আরকিছু না বলে শার্ট গায়ে জড়িয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। ফাহিমের মা সাদিয়ার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

১ Comment

  1. Siful Islam

    খুব সুন্দর হয়েছে

    Reply

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *