অবন্তীর জন্য
প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০১৮
লেখকঃ আওয়ার ক্যানভাস

আওয়ার ক্যানভাস বই প্রেমীদের মিলন মেলা। লেখকদের লেখা পাঠকের কাছে বই আকারে পৌঁছে দেওয়া, আওয়ার ক্যানভাসের সাথে জড়িতদের সম্মানজনক জীবিকার ব্যবস্থা করার স্বপ্ন নিয়েই আমাদের পথ চলা।

 1,928 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ আওয়ার ক্যানভাস

বুনোহাঁসের গল্প: অবন্তীর জন্য।

ভোরে কুয়াশাচ্ছন্ন চারপাশ দেখতে খুবই সুন্দর। সবাইকে বিমুগ্ধ করে। হেমন্ত আর বসন্তকালের মাঝে শীতকাল। শীত বড় আরামদায়ক মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের কাছে। কিন্তু নিম্নবিত্তদের? শীত শব্দটি তাদের কাছে খুবই বেদনার। বলছি অবন্তীর কথা। রেল লাইনের পাশের বস্তিতে থাকে তারা। মা-বাবা, অবন্তী আর তার এক ছোটভাই সহ চারজনের পরিবার। কিন্তু এই চারজনের সংসার চালোনোও অবন্তীর বাবার কাছে চারটেখানি কথা নয়। তিনি ঠেলাগাড়ি চালান। সারাদিন যা রোজগার করতে পারেন তা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তেল, তরকারী, চাল আর অবন্তীর মায়ের জন্য ওষুধ নিয়ে আসেন। আগে অবন্তীর মাও মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতো। কিন্তু সেবার যখন বস্তিতে আগুন লাগে তখন অবন্তীর মায়ের শরীরের বেশ কিছু স্থান পুড়ে যায়। সে থেকে তিনি শয্যাশায়ী। অবন্তীর ভাইটি এখনো ছোট। বয়স মাত্র দুবছর। আর অবন্তীর বয়স সতেরো/আঠারো হবে। সে এক প্রফেসরের ঘরে কাজ করে। অবন্তী যেখানে কাজ করে সেখানেই থাকে। দশ, পনেরো দিন পরপর বস্তিতে এসে তার মা-বাবা আর ভাইকে দেখে যায়। সে মাইনে যা পায় তা বাবাকে দিয়ে আসে, তবে তা খুব সামান্য। এত ছোট একটি মেয়ে আর কতই বা আয় করতে পারে? প্রফেসরের স্ত্রী গত হয়েছেন বছর তিনেক হবে। প্রফেসর সারাদিন কলেজে থাকে। আর তার একমাত্র ছেলে সাদিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সাদিফদের ঘরের সব কাজই অবন্তী করতো। সেই সকালে ঘুম থেকে উঠে থালাবাসন ধোঁয়া, সাদিফ আর তার বাবার জন্য নাস্তা বানানো, দুপুরের খাবার তৈরি করা ইত্যাদি, ইত্যাদি। সবকাজ অবন্তী তার কোমল হাতে নিপুণভাবে শেষ করতো। অবন্তী যদিও বা সাদিফদের বাসায় কাজ করতো সাদিফ তাকে নিজের ছোট বোনের মতো আদর করতো। সাদিফেরও যে ছোট বোন নেই, কিন্তু তার প্রফেসর বাবা?  লম্পট একটা, বনের পশুও তার মতো এত হিংস্র নয়।
সাদিফের ব্রেইন ক্যান্সার, তা শুধুমাত্র তার শিক্ষিত বাবা জানেন, আর কেউ না। মাঝে মাঝে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। কিছুদিন আগে যখন বাথরুমে পড়ে গিয়েছিল, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার বলেছিলেন সাদিফ এখন লাস্ট স্টেজে আছে। বেশিদিন বাঁঁচবে না। তাই তার বাবা তাকে বাসায় নিয়ে গেলেন। অবন্তী তার সাধ্যমতো সেবা করে আপন ভাইয়ের মতন সাদিফ কে। ভালো মতোই চলছিল সবকিছু, কিন্তু,….
গতরাতে সাদিফ তার বন্ধু রাহাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। যার কারণে বাড়ি ফিরতে পারেনি। অবশ্য এটি একটি সাধারণ ঘটনা। প্রায়শই বিভিন্ন কারণে বাড়ির বাইরে থাকে সে। কিন্তু ঘটনাটি সেখানেই শেষ নয়। নিয়মিত কাজের মতো অবন্তী হাতের কাজ সেরে শুতে যাবে ঠিক তখনই সাদিফের শিক্ষিত প্রফেসর বাবা অবন্তীকে ডাকলো। সেও নির্দ্বিধায় ডাকে সায় দিয়ে উনার রুমের দিকে গেল, কিন্তু কে জানে এই যাওয়াই অবন্তীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে? সে সময় তিনি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। যেই অবন্তী তার কাছে গেল সুযোগ পেয়ে হিংস্র জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো অবন্তীর উপর। অবন্তী শক্তিতে পেরে উঠলো না প্রফেসরের সাথে। নিরুপায় অবন্তী। যতক্ষণে পেরে উঠলো ততক্ষণে সব শেষ। সর্বস্ব হারাতে হলো দশ মিনিটের ঝড়ে। থেমে থাকেনি অবন্তী, টি টেবিলে থাকা ছুরি দিয়ে শেষ করে দিলো জানোয়ারটিকে। শান্ত হলো তার মন। কিন্তু মিনিটখানেক আগে তার সাথে যা হলো, তার কী হবে? এসব ভাবতে ভাবতে অজ্ঞান হয়ে পড়লো অবন্তী। যতক্ষণে হুঁশ আসলো অবন্তী নিজেকে আবিষ্কার করলো হাসপাতালের Emergency Room এ। বাইরে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাদিফ, ভাবতে গেলেই চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে।
অবন্তী হাসপাতালে কিভাবে আসলো? হ্যাঁ, সাদিফ যখন তার বন্ধুর বাড়ি থেকে নিজের বাসায় এসেছিল বেশ কিছুক্ষণ কলিং বেল দেবার পর ভিতর থেকে যখন কোনো সাড়া আসছিল না সে  দারোয়ান ডেকে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেললো। তারপর যা দেখলো তার জন্য প্রস্তুত ছিল না সাদিফ। শুধু বুঝতে পারলো বোন অবন্তীকে হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন। নিজের বাবার দিকে ফিরেও তাকায়নি সে। তার বাবার ব্যাপারটি জানা ছিল। যে দৃশ্যটা দেখেছে তারপর শুধু বাবার জন্য ঘৃণাই হচ্ছে তার, আর কিছু নয়। হাসপাতালে তিনদিন থাকার পর স্বাভাবিক হলো অবন্তী। সে ছটপট করতে লাগলো, নিজের বেঁচে থাকাতেই এখন চরম লজ্জা হচ্ছে তার। ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি। কিছুক্ষণ পরে আবার জ্ঞান হারালো অবন্তী।
কেবিনের বাইরে থাকা সাদিফ চিন্তা করছে তার পশুতুল্য বাবার কুকর্মের জন্য এখন কী করা দরকার তার? অবশেষে সাদিফ স্থির করলো তার  শিক্ষিত হিংস্র বাবার অর্জিত সব সম্পত্তি অবন্তীর জন্য উইল করে রেখে যাবে! যেই ভাবা সেই কাজ, সকল সম্পত্তি উইল করে গেল সাদিফ। অতঃপর অজানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো সে। বিদায় নেয়া হয়নি বোনের কাছ থেকে। কোন মুখে অবন্তীর সামনে দাঁড়াবে সে? সাদিফ চলে যাবার পূর্বে কর্তব্যরত ডাক্তারের কাছে অবন্তীর জন্য চিঠি রেখে যায়।
দুই ঘণ্টা পর অবন্তীর জ্ঞান আসলে ডাক্তার তাকে সম্পূর্ণ চেক আপ করে দেখলো, অবন্তী এখন পুরোপুরিভাবে সুস্থ। কিন্তু সাদিফের বাবার নরপশুতার জন্যে অবন্তীর দেহে আরেকটি জীবন ফুটে উঠলো। অবন্তী যখন শুনলো তার দেহের ভিতর আরেকটি দেহ বেড়ে উঠছে সে ঠিক করলো তাকে পৃথিবীর আলো দেখাবে না সে এবং নিজেকেও আর রাখবে না নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে। কেননা, যেখানে তার নিজেরই বেঁচে থাকাই দায়, সেখানে কীভাবে নিবে আরেকটি জীবনের দায়িত্ব?
পরমুহূর্তে মত পাল্টালো, না, পাল্টাতে বাধ্য হলো অবন্তী। সাদিফের রেখে যাওয়া চিঠি পড়ার পর পুরোদমে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল সে। চিঠিতে লেখা ছিল…

   প্রিয় বোন,
অবন্তী, তোমাকে সবসময় ছোট বোনের মতো স্নেহ করতাম। কিন্তু তোমার সাথে এই ধরণের ঘটনা ঘটে যাবে তা কখনো কল্পনা করিনি। আমি সত্যিই লজ্জিত। আমি বুঝতে পারছি যখন তোমার জ্ঞান আসবে তুমি থাকতে চাইবে না এ পৃথিবীতে। কিন্তু তুমি কেন হার মানবে? যদি তুমি এখন হার মেনে নাও, যদি আর কোনো নারীর সাথে এমন ঘটনা ঘটে তাদেরও জীবন নিভৃতে যাবে। মুখ বুজে সয়ে যাবে সবাই কিংবা কেউ ছেড়ে যাবে এ নিষ্ঠুর পৃথিবী। আমি চাই এর প্রতিরোধ হোক। আমি বলছি, তুমি হার মানবে না। ওই নরপশুর সকল সম্পত্তি আমি তোমার নামে উইল করে গেলাম। তুমি সুস্থ হয়ে সকল কিছু বুঝে নিবে। প্রতিরোধ করবে সব অন্যায়ের। দেখিয়ে দিবে সবাইকে আমরা নারী, আমরাও পারি।
ইতি
তোমার ভাই।

    হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে নতুন পরিচয়ে এগিয়ে পথচলা শুরু করলো অবন্তী। দেশের সকল সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য একটি সাহায্য সংস্থা খুললো সে। যেখানে সকল দুর্দশাগ্রস্ত নারীরা এসে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারবে।
এসব কিছু সম্ভব হয়েছে একমাত্র ভাই সাদিফের সুষ্ঠু মূল্যবোধের কারণে। আজ অবন্তী কোনো অবহেলিত নারীর নাম নয়। এ এক নতুন সাহসী, উদ্যমী এক নিষ্ঠাবান নারীর নাম। অবন্তী আজ অন্য নারীদের কাছে এক রোলমডের। এসব কিছুর মধ্য দিয়েই অবন্তী তৈরি হচ্ছে আগামীর জন্য, প্রস্তুত হচ্ছে তার অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য।

সকল অবন্তীদের জন্য একটি কবিতা,
অবলা নারী।

আজ পথের ধারে কাঁদছে দাঁড়িয়ে অবলা এক নারী,
তার সর্বস্ব লুটে নিয়েছে এক লোক বিরাট নামধারী।
অসহায় নারী দাঁড়িয়ে ভাবছে লোকে কত কথা বলবে পাছে,
ভাবতে গিয়ে ঝাপসা হয়ে গেল তার চোখ
দশ মিনিটের ঝড়ে তার জীবনে নামলো শোক।
সময়,পরিবেশ সব তার প্রতিকূলে
শুধুমাত্র দুঃখ-দুর্দশা তার অনুকূলে।
সকল দুঃখ-কষ্ট তাড়িয়ে
সে নারী উঠলো দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকবার আশে,
স্বপ্ন দেখেইতো মানুষ বাঁচে।
সে আজ ফিরেছে মৃত্যুর দুয়ার থেকে
চলার মাঝে যখন পথ গিয়েছিল বেঁকে।
এক অদম্য প্রয়াস নিয়ে
সে নারীর সর্বস্ব দিয়ে
মর্জি করে বিধাতার থেকে
সে নারী ফিরেছে।

উৎসর্গঃসকল অবহেলিত অবন্তীদের।
—–০——

লেখক: বুনোহাঁস।
বাকিহাটি, বক্সগঞ্জ, নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৮ Comments

  1. AKRAMUL islam

    Nice hoyca

    Reply
  2. Tasnim Rime

    পরিবর্তনের সুন্দর একটা গল্প। অবহেলা অার নির্যাতনের স্বীকার এসব অবন্তীরা সমাজ থেকে হারিয়ে যায় যদি না তাদের পাশে কেউ দাঁড়ায় নির্ভরশীলতার হাত বাড়িয়ে। অল্পসল্প ভুল অাছে দেখে নিবেন,
    তরকারী- তরকারি
    ধোঁয়া – ধোয়া
    ছটপট- ছটফট
    সে থেকে- সেই থেকে/ তখন থেকে

    Reply
    • বুনোহাঁস

      ধন্যবাদ প্রিয়।

      Reply
  3. Naeemul Islam Gulzar

    খুবই সুন্দর একটি গল্প পড়লাম।সত্যিই লেখক সমাজের চরম বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।ধন্যবাদ লেখককে।শুভকামনা♥

    Reply
    • বুনোহাঁস

      ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মন্তব্য করার জন্য।

      Reply
  4. Rifat

    খুবই সুন্দর একটা গল্প। বর্তমানে অবন্তীর মতো অনেক নারীই নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু অনেকেই তাদের নিজের জীবন শেষ করে দেয়। কিন্তু অবন্তীর মতো মেয়েরা সবসময় লড়ে যায়।
    বানানে তেমন একটা ভুল ছিল না।

    Reply
    • বুনোহাঁস

      ধন্যবাদ প্রিয়।

      Reply
  5. shahrulislamsayem@gmail.com

    এককথায় অসাধারন একটি গল্প, লেখার ধরণ এবং শব্দচয়ন খুব সুন্দর তবে একটি বানান ভুল লক্ষ্য করেছি…………..’ছটপট’ -‘ছটফট’

    Reply

Leave a Reply to Rifat Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *