নৈতিকতা
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 1,833 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

লেখা: আখলাকুর রহমান

ধানের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে ঘোর বর্ষায় থরথর করে কাঁপছে শফিক মিয়া।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে প্রায়।
কালো মেঘে ঢাকা আকাশটা থেকে অবিরত বর্ষা ঝরে পড়ছে।
গতবারের মতো এবারও জমিতে পানি উঠে সব ফসল নষ্ট হয়ে যাবে নাতো?
চিন্তার রেশ দেখা দেয় শফিক মিয়ার কপালে।
এই দুই বিঘা জমি তার পরিবারের আশা-ভরসা।
সকাল থেকে জমির আগাছা নিংড়াচ্ছে সে। আর বেশিক্ষণ জমিতে থাকতে পারবে না।
তার উপর প্রায় দু’ঘন্টা যাবৎ বৃষ্টি হচ্ছে।
জ্বর আসলে বিপদে পড়ে যাবে। দ্রুত উঠে বাড়ির পথে রওনা দেয় সে।
জমি থেকে উঠেই কাতর দৃষ্টিতে পেছন ফিরে তাকালো। এখনো গিরা দশেক বাকি আছে পানি উঠতে। আশে-পাশের দু’-দশটা জমির চেয়ে শফিক মিয়ার জমি একটু উঁচু।
অন্য জমিগুলোতে পানি উঠতে শুরু করেছে।
দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরে আছে সে।
হাঁক ছাড়ে…
– কই গো সেলিমের মা! গামছাডা দিয়া যাওতো।
শফিকের কন্ঠ শুনে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে জামিলা বিবি। গামছাটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে,
– এত্ত দেরি করলা যে? বর্ষায় জ্বর বাঁধাইবা নাকি?
– জমির আগাছাগুলো বড্ড বেড়েছিল। সেগুলো নিংড়ানি দিতেই দেরি হইছে।
– দ্রুত বারান্দায় উঠো। দুই মুঠো ভাত খাইয়া নাও।
– হ, ভাত বাড়ো।
গামছা দিয়ে শরীর মুছে বারান্দায় মাদুর নিয়ে বসে পড়ে শফিক মিয়া।
বর্ষাটা একটু কমেছে।
প্লেটে ভাত দিতে লাগল জামিলা বিবি।
– শহর থেকে রজব ব্যাপারী আইছিলো।
– কী বলেছে ব্যাপারী সাহেব?
– সেলিম ফোন দিছিলো তার কাছে। আমাগো সাথে কথা কইবার চায়।
– যামুনে কাল সকালে।
– খোকারে এইবার একটু বাড়ি থেকে ঘুরে যেতে বইলা আসবা।
এক লোকমা ভাত মুখের মধ্যে দিয়ে শফিক বলে,
– হ, কমুনে।
ভাত খেয়ে উঠে পড়ে সে। পশ্চিম পাড়ার মসজিদ থেকে মাগরিবের আযানের সুর ভেসে আসছে।
বৃষ্টি থেমে গেছে পুরোপুরি।
উঠানে কাদা জমেছে। শফিক মিয়াকে নামাজের তাগাদা দেয় জামিলা বিবি।
– কই গো, নামাজে যাও।
– এই কাদার মধ্যে মসজিদে যাইতে ভাল্লাগছে না। তুমি ওযুর পানি নিয়া আসো।
– আইচ্ছা।
উঠানের কোণে বসে আবছা আঁধারে ওযু সেরে নিয়ে ঘরের মধ্যে নামাজে দাঁড়িয়ে যায় শফিক মিয়া।
নামাজের পর কিছুক্ষণ তাসবিহ জপতে লাগল। লণ্ঠনের আলোতে ঘরের চারদিক চোখ বুলিয়ে নিলো সে।
জমিলা বিবিকে দেখতে না পেয়ে ডাক দিলো,
– কোথায় গেলে? নামাজ শেষ তোমার?
– হ, আইতাছি।
স্বামীর ডাক শুনে বারান্দায় নামাজের বিছানায় বসে থাকা জামিলা বিবি ঘরে যায়, আস্তে করে বসে শফিক মিয়ার পাশে।
প্রতিদিনের মতো আজকেও দুইজন মোনাজাতের উদ্দেশ্যে দু’হাত উঁচু করে ধরলো।
শফিক নিচু কন্ঠে বলতে লাগলো,
– আল্লাহ্, আমাগো কবুল করে নাও। জমিডা পানিতে যেন না ডোবে সেই ব্যবস্থা করে দাও। আমাগো সংসারে সুখ বজায় রাখো মাবুদ। মাবুদ, আমাগো শফিকরে ভালো করে লেখা-পড়া করার সুযোগ দাও। সে যেন অনেক বড় হতে পারে।
এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকা জামিলা বিবি এইবার একটু জোরে “আমিন” বলে উঠলো।
মোনাজাত শেষ করে একটু নড়েচড়ে বসলো শফিক।
– সেলিমের মা, টাকা-পয়সা যা আছে নিয়া আসোতো।
– কী করবা?
– গত মাসে ফোন দিয়ে শফিক বলছিলো নয় হাজার টাকা লাগবো। কী জানি পরীক্ষার জন্য লাগবে! কালকে টাকাগুলো মানি অর্ডার করে পাঠাই দিমু।
– বসো, আমি আনতাছি।
সিন্দুক খুলে একটা পুটলী বের করলো জামিলা বিবি। ধান বিক্রির তেইশ হাজার টাকা খুব যত্ন করে এর মধ্যে রেখে দিয়েছে সে।
পুটলীটা শফিকের কাছে দিলে সেখান থেকে চৌদ্দ হাজার টাকা আলাদা করে রাখে সে।
জমিলা বিস্ময়ের চোখে জিজ্ঞেস করলো,
– পাঁচ হাজার টাকা বেশি নিলা যে!
– হ, একটা কাজে লাগবো। তোমারে পরে কমু।
– আইচ্ছা।
– এশার নামাজের সময় হলো বলে। আমি নামাজ পইড়া আসি।
– কাদার রাস্তা। বাড়িতে পড়লে পারতা?
– না শফিকের মা। সেদিন হুজুর কইতেছিলো, “ফজর আর এশার নামাজের অনেক ফযিলত। যদি কেউ মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামাজ পড়ে সে অনেক সওয়াব পাবে।” এই কথা আমাগো নবী সাহেব বলে গেছেন।
– তাইলে যাও।
ব্যাটারীর টর্চ লাইট নিয়ে মসজিদে যায় শফিক মিয়া। নামাজ শেষ করে বাড়িতে এসে ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ে।
সারাদিনের ক্লান্তি সব ঘুম হয়ে এসে জড়ো হয়েছে। জমিলা বিবিও লণ্ঠন নিভিয়ে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়ে।
ফজরের আযান শুনে বিছানায় উঠে বসে শফিক মিয়া। স্ত্রীকে ডেকে তোলে।
ওযু করে মসজিদে চলে যায় নামাজ আদায় করতে।
নামাজের পর হুজুর সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়ছে। তার সাথে কন্ঠ মিলিয়ে সবাই পড়ছে।
পড়া শেষ হলে মসজিদের ঈমাম সাহেব সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
– এই আয়াতগুলো কেন পড়লাম জানেন?
শফিক আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
– কেন হুজুর?
– সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়লে প্রত্যেকের জন্য সত্তর হাজার ফেরেস্তা আমাদের জন্য মাগরিব পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে। এটা পড়া অনেক ভালো।
হুজুরের কাছ থেকে এ বিষয়ে জানতে পেরে বেশ খুশি হলো শফিক মিয়া।
ফুরফুরে মেজাজে বাড়িতে আসে সে।
উঠানে এসে দাঁড়াতেই জমিলা বিবির কন্ঠে সুমধুর কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পেলো।
বারান্দায় বসে প্রতিদিনের মতো আজও কুরআন তেলাওয়াত করছে জমিলা বিবি।
পাশে বসে তৃপ্তি সহকারে শুনতে লাগলো শফিক মিয়া।
সে কুরআন পড়তে পারে না। ছোটকালে শেখেনি। কিন্তু তার স্ত্রী পারে। এতেই খুশি সে।
সূর্য যখন কড়া রোদ ছড়াতে শুরু করেছে তখন শহরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে শফিক মিয়া। গায়ে একটা ফতুয়া, পকেটে চৌদ্দ হাজার টাকা।
শফিক মিয়াদের গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে শহর।
শফিক গ্রামের মধ্যে ভ্যানগাড়ি পেয়ে যায়। তার উপর চড়েই শহরে এসে পৌঁছায়।
রজব ব্যাপারীর সারের দোকানে বসে আছে সে।
সারের দোকানের পাশাপাশি মানি অর্ডারের কাজটাও করে সে।
– ব্যাপারী সাহেব, সেলিমের কাছে একটু ফোন দেন। কথা বলমু।
রজব ব্যাপারী ফোন দেয় শফিকের কাছে।
– এই লও শফিক, কথা কও পোলার লগে।
– বাবা সেলিম। ক্যামন আছিস?
– আসসালামু আলাইকুম আব্বা। আলহামদুলিল্লাহ্, আমি ভালো আছি। আপনারা ভালো আছেন?
– ওয়ালাইকুমুস সালাম। হ বাজান, আমরা ভালো আছি। কী করতাছিস?
– কলেজে বসটে আছি আব্বা। মা ভালো আছে?
– হ ভালো। তুই বাড়িত আইবি কবে?
– কাল ছুটি হবে কলেজ। আমি কাল বিকালে বাড়ি আসবো।
– তাইলে তো ভালোই। তোর টাকা পাঠাইতেছি।
– টাকা এখন লাগবে না। আমি ভালো করে পড়া-শোনা করি। এই জন্য প্রিন্সিপ্যাল স্যার আমার সব খরচ ফ্রী করে দিয়েছেন।
– আলহামদুলিল্লাহ্। আইচ্ছা বাবা। তাইলে তুই কালকে বিকালে আসিস। আমি শহরে বসে থাকবো।
– আচ্ছা বাবা। তাহলে রাখি।
টুট টুট শব্দে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।
খুশিতে ফোনটা রজবের দিকে এগিয়ে দেয় সে।
– ব্যাপারী সাহেব, খোকা কাল বাড়িতে আইবো।
– এইডা তো ভালো খবর।
– হ, আপনার ফোনের বিল কত দেবো?
শফিক মিয়ার কাঁধে হাত রাখে রজব ব্যাপারী।
– তোমার পোলাডা ঢাকায় থিকা পড়তাছে। আমাগো গর্বের বিষয়। সবদিন ট্যাকা নেওন লাগেনা।
ঠোঁটের কোণে কৃতজ্ঞতার হাসি ভেসে উঠল শফিক মিয়ার।
রজব আলীর সারের দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে। সামনের দেবব্রত জুয়েলার্সে ঢুকে পড়ে।
– দাদাবাবু, কানের দুলজোড়া বানানো হয়ে গেছে?
– হ্যাঁ। টাকা এনেছো শফিক মিয়া?
– আনছি।
ফতুয়ার পকেট থেকে পাঁচ’শ টাকার দশটা এগিয়ে দিলো স্বর্ণকারের দিকে।
– গুনে নিন। পুরো পাঁচ হাজার টাকা আছে।
টাকাগুলো গুনে একটা খামে করে একজোড়া কানের দুল শফিকের হাতে তুলে দেয় স্বর্ণকার।
দুল নিয়ে বাড়ি চলে আসে।
তাকে দেখেই জামিলা বিবি এগিয়ে আসে।
– শফিকের লগে কথা হইলো? টাকা পাঠাইছো?
– কথা হইছে। কাল বিকালে বাড়ি আসবে। আর টাকা লাগবো না কইলো। ওদের বড় মাষ্টার সব ফ্রী করে দিছে।
– যাক, আল্লাহ্ মুখ তুলে তাকিয়েছে। তোমার হাতে ওইডা কী?
– তোমার জন্য কানের দুল বানাইতে দিছিলাম। আজ নিয়ে আইলাম। খুলে দেখো।
স্বামীর হাত থেকে খাম নিয়ে খুললো। চকচক করছে একজোড়া সোনার দুল।
জামিলা মাথা নিচু করে কইলো,
– এসবের কী দরকার ছিলো? টাকাগুলো রাইখা দিলে হতো।
– মহব্বত কইরা দিছি, রাখো। কাল সেলিম আসতাছে। অনেক ভালো কইরা রান্না করবা।
– আইচ্ছা ঠিক আছে।
পরের দিন শহরে রজব ব্যাপারীর দোকানে বসে আছে শফিক। একটু পরেই ছেলে আসবে।
চা খাইতে খাইতে ছেলের গুণগান করছে।
– আব্বা….
ছেলের কন্ঠ শুনে পেছনে ফিরে তাকালো।
– সেলিম, বাবা আসছোস?
– হ্যাঁ বাবা।
সেলিমের মুখে কালো লম্বা দাঁড়ি। গায়ে লম্বা জামা- পাজামা। মাথায় টুপি পরা।
ঢাকার বুকে বসবাস করলেও সুন্নত লেবাস সর্বদা পরিধান করে থাকে।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার চেষ্টা করে।
রজব ব্যাপারীকে সালাম দেয় সে। কুশল বিনিময় করে।
তারপর বাপ ছেলে দু’জনে বাড়িতে আসে।
সেলিমকে পেয়ে খুশিতে বুকে টেনে নেয় জামিলা বিবি।
নিজে হাতে রান্না করে ছেলেকে খাওয়ায়।
প্রায় দুই বছর পরে গ্রামে এসেছে সে। পরদিন বাবার সাথে মাঠে যায় সে। নিজেদের ধানের জমিতে আগাছা পরিষ্কার করতে থাকে।
গ্রামের পরিবেশ সেলিমের অনেক ভালো লাগে। বাবার সাথে মাঠে কিছুক্ষণ কাজ করার পর বাড়িতে রওনা দেয় তারা।
রোদ উঠেছে টানা দু’দিন। জমির পাশের পানিও নেমে যেতে শুরু করেছে।
সেই চিন্তার রেশটা এখন আর শফিক মিয়ার কপালে দেখা যাচ্ছে না।
মাঝপথে এসে সেলিম দেখলো কয়েকটি ছোট বাচ্চা রাস্তার কিনারে বসে খেলছে।
বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো,
– আব্বা, এরা স্কুলে যায় না?
– ইশকুল পাইবো কই বাজান? চরের মাথার প্রাইমারী স্কুলডাও তো নদীতে ভাইসা গেছে।
– মেম্বার সাহেব নতুন স্কুল বানাচ্ছে না কেন?
– মেম্বার সাবের মতি গতি বুঝি না। তুই বাড়িতে চল, এসব নিয়া ভাবা লাগবে না।
বাবার সাথে হেটে বাড়ি ফেরে শফিক। বিকালে কয়েকটা বাল্য বন্ধুদের সাথে নিয়ে মেম্বারের বাড়িতে যায়।
কয়েকটা লোক নিয়ে বসে আছেন তিনি।
সালাম দিয়ে তার ঘরের মধ্যে গেলেন সেলিম। গ্রামের মধ্যে একটা স্কুল করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। চেয়ারম্যান সাহেব মৃদু হাসলেন। বললেন,
– তুমি শফিকের ব্যাটা না?
– জ্বি।
– শহরে পড়তাছো ভালো কথা। তা স্কুল দিয়া করবা কী? এই বয়সে আবার স্কুলে পড়ার শখ হইলো নাকি?
চেয়ারম্যানের পাশে থাকা লোকগুলো হো হো করে হেসে উঠলো।
কোনো সাহায্য না পেয়ে সেলিম সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো।
রাতে বাবা আর শফিক ভাত খাচ্ছে। পাশে বিছানায় বসে আছে জামিলা বিবি।
– আব্বা, গ্রামে বাচ্চাদের জন্য একটা স্কুল বানাইলে হয় না?
মুখ তুলে ছেলের দিকে তাকালেন শফিক মিয়া। কিছুক্ষণ পর বললেন,
– ভালোই তো হয়। কিন্তু ইশকুল বানাইতে টাকা লাগবো। আর মাস্টারি করবো কেডা?
– খুঁজতে হবে। আমি পরেরবার বাড়িতে এসে দেখবো কী করা যায়।
– আইচ্ছা বাবা।
ছেলের এমন চিন্তাধারা দেখে নিশ্চুপ থাকে জামিলা বিবি।
পর দিন সকালে।
সেলিম কলেজে ফিরে যাচ্ছে।
মা আঁচল দিয়ে বারবার চোখ মুছছে।
– আহা মা কেঁদো না তো।
অনুরোধের সুরে বললো সেলিম।
মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলতে লাগলো সে।
বাবা শহর অব্দি সাথে যাবে।
শহরের গাড়িতে তুলে দিয়ে শফিক মিয়া বাড়িতে চলে আসলো।
স্বামী-স্ত্রী দু’জন বসে আছে।
– বুঝলা জামিলা, তোমার পোলা অনেক বড় হইবো।
– আল্লাহ্ যেন তাই করে দোয়া করি।
– হুম।
– হুজুর নতুন কিছু কয় নাই? নবী সাহেব যা কইয়া গেছেন?
– শুনবা?
– হ কও।
– নবী সাহেব কইছে, “বিপদে ধৈর্য হারাতে নেই। যে ধৈর্য রাখলো না, যে পরাজিত হলো।”
হাদীসটা শুনে চুপ করে ভাবতে থাকে জামিলা। হয়তো ধৈর্য রাখার শপথ করে নেয় মনে মনে।
দেখতে দেখতে প্রায় চার বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে।
শফিক মিয়ার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। হায়াৎ হয়তো বেশিদিন নেই।
মানুষ কি আর চিরদিন বাঁচে?
দুনিয়া ছেড়ে তো কবরে যেতে হবে।
যদি কিছু ভালো কাজ করা যায় তাহলেই মুক্তি পাওয়া যাবে।
এসব চিন্তা করতে থাকে শফিক মিয়া।
তবে ছেলেটাকে মানুষ করতে পেরেছে এতেই খুশি সে।
সেলিম পড়া শেষ করে ঢাকায় চাকরী করে। মাসে অনেক টাকা পাঠায় বাড়িতে।
এখন থেকে আর চাকরী করবে না সে।
না করার কারণ বুঝতে পারছে না।
বিকালে বাড়ি আসে সেলিম।
দাঁড়িগুলো আগের চেয়ে লম্বা হয়েছে।
রাতে খাওয়ার সময় শফিক মিয়া প্রশ্ন করে তাকে,
– বাজান আর চাকরী করবি না কেন?
– ওখানে সবাই ঘুষ খায়। আমাকেও খেতে বলে। এটা আমার দ্বারা হবে না।
– তাহলে কী করবি?
– আমি ব্যবসা শুরু করবো গ্রামেই। আল্লাহ্ সুদকে হারাম আর ব্যবসাকে হালাল করেছেন।
– যা ভালো বুঝিস তাই করিস।
– আব্বা তোমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে তো?
– যাচ্ছে, তবে বুকের বাম পাশে চিনচিন ব্যথা করছে।
পাশ থেকে কথা বলে ওঠে জামিলা বেগম।
– তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও তো।
সেলিম খেয়ে শুয়ে পড়লো। সারাদিন গাড়িতে ছিলো, তাই খুব দ্রুত ঘুমিয়ে গেলো।
– এই সেলিম ওঠ। দ্রুত ওঠ।
– কী হইছে মা? ফজরের আযান হয়েছে নাকি?
– না, তোর আব্বা কেমন করতেছে।
হকচকিয়ে উঠে বসে বসলো সে।
ছুটে গেলো বাবার কাছে।
– আব্বা কী হইছে?
শফিক মিয়া কোনো কথা বলে না। অস্পষ্ট ভাষায় কালেমা পড়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।
পৃথিবী ত্যাগ করে চিরতরে ঘুমিয়ে যায় শফিক মিয়া।
পরদিন দাফন করা হয় তাকে। জামিলা বিবি প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়েছে। মানসিক দুর্বলতা গ্রাস করেছে তাকে।
সেলিম বাবার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর দোয়া করে। ফজরের পর কবর জিয়ারত করে।
ধীরে ধীরে শোক কাটিয়ে উঠেছে সেলিমেরা।
শফিক মিয়ার মৃত্যুর আরও দুই বছর পেরিয়ে গেছে।
সেলিম গ্রামের মধ্যেই গাভী পালন করে। বেশ স্বাবলম্বী হয়েছে সে। অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে সে।
নিজেদের ধানের জমিতে একটা প্রাথমিক বিদ্যাপীঠ গড়ে তুলেছে। যেখানে ছোট বাচ্চারা অ আ ক খ শেখে, কুরআন পড়া শেখে।
প্রতিদিনের মতো আজকেও ফজরের পর বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করছে সে।
মোনাজাতে আজ নতুন বাক্য যুক্ত হয়েছে।
“আব্বা, তুমি তো বলতে গ্রামে স্কুল বানাইলে খুব ভালো হতো। আজ গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাবা। তোমার কথা আল্লাহ্ শুনেছে।”
কথাটা বলার সময় অশ্রুধারা দু’গাল বেয়ে নেমে গেলো।
_______সমাপ্ত

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৩ Comments

  1. আফরোজা আক্তার ইতি

    খুবই সুন্দর একটি গল্প। যার শুরুটাও সুখের ছিল, শেষটাও সুখের হয়েছে।আল্লাহর উপর ভরসা রাখলে কোন কঠিন কাজই আর কঠিন থাকে না সহজ হয়ে যায়। সেলিমের নেক নিয়ত আর প্রচেষ্টার জন্যইই আজ সে তার কাজে সফল। তার বাবা শফিক মিয়া তার পুরো পরিবারকেই ইসলামের ছায়াতলে রাখতে পেরেছেন,সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে পেরেছেন। এই গল্প থেকে অনেক কিছুই শিখার আছে।
    অনেক যত্ন নিয়ে লেখা। তেমন কোন ভুল পেলাম না। শুভ কামনা রইল

    Reply
  2. রেজাউল করিম

    অসাধারন প্রকাশ। খুব ভালো লেগেছে। অনেক শুভ কামনা রইল।

    Reply
  3. মাহফুজা সালওয়া

    খুব সুন্দর উপস্থাপন। গল্পের মেসেজ টা ও দারুণ!
    আল্লাহ আপনার লেখাকে সাদকাহে জারিয়াহ হিসেবে কবুল করুন – আমিন।
    সত্যিই অনেক ভালো লেগেছে।
    কনভার্সেশনের দিকে খেয়াল রাখবেন যাতে শুদ্ধ ভাষা + অাঞ্চলিকতা মিশে না যায়।
    শুভকামনা আপনার জন্য।

    Reply

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *