নিরুপমা
প্রকাশিত: অগাস্ট ১০, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 2,858 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

—-লেখা :জুয়েল ইসলাম——-
.
.
কোনো এক চৈত্র মাসের ভরদুপুরে কাশেম মিয়ার ঘর আলো করে জন্ম নেয় নিরু।মেয়ে সন্তান দেখে কাশেম মিয়ার মুখটা বিষণ্ণতার চাদরে ঢেকে যায়।মেয়ে সন্তান জন্ম নেওয়াতে তার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই।কিন্তু মেয়ের গায়ের রং ছিলো কালো।আর তাতেই কাশেম মিয়ার মনে আক্ষেপ জমে উঠে বিধাতার প্রতি।তিনি চেয়েছিলেন ফুটফুটে সুন্দর এক রাজকুমারীর মতো মেয়ে।যেন বিয়ের সময় তার রুপ দেখে ছেলেপক্ষরা বিয়েতে রাজী হয়ে যায়।কারণ যৌতুক দিয়ে মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার মতো সামর্থ্য কাশেম মিয়ার নেই।কিন্তু বিধাতার এই অবিচার মেনে নেওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিলোনা।
.
নিরুর পুরো নামটি হলো নিরুপমা।নিরুর মার খুব ইচ্ছে ছিলো মেয়ে হলে তার নাম নিরুপমা রাখার।নাম তো ঠিকই রেখেছিলো কিন্তু মেয়ের মুখটা দেখার সুযোগটুকুও পায়নি তিনি।তিনদিনের প্রচণ্ড ব্যথার পর নিরুকে জন্ম দিয়ে ওর মা সবাইকে ছেড়ে রাতের আকাশে তারাদের সঙ্গী হয়ে যান।কাশেম মিয়া নিরুপমাকে নিরু বলেই ডাকে।
.
নিরু যখন ভালোভাবে কথা বলতে শিখে গেলো কাশেম মিয়া লক্ষ্য করলো নিরুর কথা বলার ধরণ একটু অন্যরকম। আর নিরুর আচারণও স্বাভাবিক না।কাশেম মিয়া নিজের কপাল চাপড়াতে থাকে আর বলেন,
–আল্লাহ,কি দোষ আছিলো আমাগো? যার কারণে মেয়েটা গায়ের রং কালো দিয়ে দুনিয়াতে পাঠাইলা।তাও মাওডারে কাইরা নিলা।এখন আবার মাও মরা মেয়েডারে এমন কইরা পাঠাইলা।
.
নিজেকে ভাগ্যকে দিনরাত দোষারোপ করতে থাকে কাশেম মিয়া।নিরু এসবের কিছুই বুঝতো না।শুধু মাঝেমাঝে বাবাকে মাঝরাতে কাঁদতে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে।বাবার পিঠে ধাক্কা দিতে থাকে।মেয়ের দিকে ফিরে তাকায় কাশেম মিয়া।
—কি অইছে আব্বা? তোমার কি মন খারাপ?
—না আম্মা।
—তাইলে কান্দো ক্যান?
—এমনি!
—এমনি কান্দা বালা না আব্বা। মাইনষে খারাপ কইবো।
মেয়ের কথা শুনে কাশেম মিয়ার মুখের এককোণে হাঁসি ফুটে।মেয়েটা যে তার এমন সুন্দর করে কথা বলতে পারে তার জানা ছিলোনা।চোখের পানি মুছে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে কাশেম মিয়া।
.
সারাদিন কাজ শেষে কাশেম মিয়া মেয়েটার সাথে বসে রাতে চাঁদের বুড়ি,রাজকন্যা গল্পসহ অনেক ভূতের গল্প শুনান মেয়েকে।নিরুও কখনো ভয় পেয়ে বাবার বুকে মাথা গুজে,আবার হাসতে হাসতে বাবার কোলে গড়াগড়ি খায়।যখন বাবা না থাকে নদীর ধারে গিয়ে খেলাধূলা করে সময় পার করে নিরু।এভাবেই তাদের দিনগুলি কেটে যেতে থাকে।
.
দেখতে দেখতে কয়েকটা বছর কেটে গেলো।নিরু এখন অনেকটা বড় হয়েছে।বাড়ির অনেক টুকটাক কাজ নিজ হাতেও করতে পারে।কাজ করতে পারলে নিরু অনেক খুশী হয়ে যায়।
.
ঘরকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখাতেও নিরু খুবই পারদর্শী। একদিন সকালে কাজ না থাকায় কাশেম মিয়া বাড়িতেই ছিলো।হঠাৎ দেখে নিরু ক্ষেত থেকে মাটি এনে রান্নাঘরের চারপাশে দিচ্ছে।কাশেম মিয়ার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে।যে মেয়ে কিনা এখনো মাটি দিয়ে ঘর বানিয়ে খেলে,সময় পেলেই কাঁঠাল পাতা দিয়ে খেলতে বসে যায় সে করছে ভারী কাজ? নিরু ভারী কাজ করতে পারছে দেখে কাশেম মিয়ার মনে যতোটা আনন্দ হচ্ছে,ঠিক ততোটাই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মেয়েটার তার সত্যিই অনেক মায়াবতী। কিন্তু ওর এই শিশুর মতো আচারণ আজো কাশেম মিয়ার বুকে কষ্টের ছুরি দিয়ে হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
.
মেয়েটা তার দিনদিন বড় হচ্ছে।আর কদিনই বা এভাবে রাখা যায়।যেকোনো ভাবেই হোক নিরুকে তো তার সংসার গড়ে দিতে হবে।কিন্তু এরকম মেয়েকে কি কেউ তার ঘরের বউ করবে? নিরুর আচারণ দেখলেই হয়তো তারা বলে উঠবে,মেয়েটা তো পাগলী। তখন সেই কথাগুলে কি কাশেম মিয়া সহ্য করতে পারবে? তার জানা নেই।কিন্তু মেয়েকে সুখী করতে যা প্রয়োজন সব করতেই রাজী কাশেম মিয়া।
.
একদিন সকালের কথা।কাশেম মিয়া উঠোনে বসে কাজ করছিলো। নিরু বারান্দায় বসে বাবার কাজ দেখছিলো।হঠাৎ করেই বলে উঠলো,
—আব্বা,আমি কি বড় হমুনা?
—ক্যান আম্মা? তুমিতো অনেক বড় অইছো।আমার চেয়ে কত্ত লম্বা তুমি।
—তাইলে তুমি যে কও আমার ছোট্ট লক্ষ্মী আম্মা?
—ওইডাতো আদর কইরা কই আম্মা।
—তাহলে আমি বড় অইছি।আব্বা মেয়ে বড় অইলে না বিয়্যা দেন লাগে? আমার বিয়্যা কবে দিবা আব্বা?
.
বিয়ের কথা শুনেই কাশেম মিয়ার মুখ কালো হয়ে যায়।যে কথা ভেবে সে রাতদিন এক কারে ফেলছে আজ মেয়েই সেটা তাকে জিজ্ঞেস বসলো।কি জবাব দিবে মেয়েকে? যদি কিছু না বলে তাহলে মেয়ে তার মন খারাপ করে থাকবে।তাই কোনোভাবে নিরুকে বুঝানোর চেষ্টা করলো কাশেম মিয়া।
—আম্মা,আর কয়ডা দিন যাক তারপর তোমার বিয়া দিমু।
বিয়ে দেওয়ার কথা শুনেই নিরু খুশিতে লাফাতে থাকে।
—আব্বা আমি তাইলে জিহাদ,আরিফ,লামি
য়া ওগোরে যাইয়া আমার বিয়ে কথাটা বলি।
জিহাদ,আরিফ, লামিয়া হলো নিরু খেলার সঙ্গী। বয়স বেড়ে গেলেও ছোটদের সাথেই তার উঠাবসা।
কাশেম মিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিরু বাড়ি থেকে চলে যায়।কাশেম মিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়।
.
আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে বলে,মওলা তুমি আমার মাইডারে ঠিক কইরা দাও।ও সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন দেখে।ওর স্বপ্নটা যেন সত্যি হয়।কিন্তু কেউ কি এমন আছে যে নিরুকে এভাবে বউ করে নিতে রাজী আছে? সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ এরকম অস্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষকে ঘরে তুলে নিবে কি?কিন্তু মেয়েকে যে তার বিয়ে দিতেই হবে।
.
এভাবেই পার হয়ে যায় আরো কয়েকটা মাস। হঠাৎ একদিন ঘটক ফয়েজ মিয়া নিরুদের বাড়ি আসে।তিনি জানান দুই গ্রামে পরে পলাশী নামে এক গ্রাম আছে।সেখানে সে গিয়েছিলো পাত্রের খুঁজে।নিরুর সাথে একদম মানাবে।কিন্তু ছোট্ট একটা সমস্যাও আছে। এক এক্সিডেন্টে পাত্রের এক পায়ের রগ কাটা পড়ে।অনেক চেষ্টা করেও তার বাবা আহসান মন্ডল ছেলেকে জীবনে আনতে পারেনি।এমনিতে কোনো সমস্যা নেই,শুধু হাঁটতে গেলে একটু বেগ পেতে হয় তার ছেলেকে।
.
বাবা আহসান মন্ডল ছেলের প্রতি খুবই যত্নবান। তাই বলে এই নয় যে মানুষ হিসেবে সে খুবই ভালো।স্বার্থ ছাড়া এক পা সামনে এগিয়ে যান না তিনি।সুদর্শন ছেলে নিয়ে তিনি খুবই গর্ব করতেন।ভাবতেন ভালো একটা ঘর পেলে ছেলের বিয়ে ঠিক করবেন। যৌতুক হিসেবে মেয়ের বাবার কাছ থেকে অঢেল টাকা-পয়সা নিবেন।কিন্তু একটা দূর্ঘটনা তার সব আশা-ভরসা এক নিমিষেই শেষ করে দেয়।তবুও তিনি হাল ছাড়ার লোক নন।ছেলের যে ঘরেই বিয়ে হোক না কেন কেন শশুরবাড়ী থেকে যৌতুক হিসেবে কিছু না কিছু সে আদায় করবেই।
.
ঘটক ছেলের একটা ছবি দিয়ে পরবর্তী কথার জন্য কাশেম মিয়াকে বলে চলে গেলো।কাশেম মিয়ার চোখ ছলছল করতে লাগলো।অবশেষে তাহলে তার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার মতো ছেলে খুঁজে পেলো।মেয়ের বিয়ে হবে,সংসার হবে।সন্তান হবে,সন্তানেরা কাশেম মিয়াকে নানা বলে ডাকবে।এসব কথা ভাবতেই কাশেম মিয়ার মনে খুশির বাণ বয়ে যায়।পরক্ষণেই আবার চুপ হয়ে বারান্দার খুঁটিটা ধরে ধপাস করে বসে পড়েন।মেয়ের বিয়েতে নিশ্চয় বড় অঙ্কের টাকা গুণতে হবে তাকে।এরকম একটা মেয়েকে তো আর এমনি এমনি কেউ ঘরে তুলে নিবে না।
.
ঘটককে নিয়ে আহসান মন্ডল একদিন কাশেম মিয়ার বাড়ী ঘুরে যায়।কথাবার্তা তার ভালো কিছুরই ইঙ্গিত দিলো।ঘটককে সব বলে দিবে বলে সেদিনের মতো আহসান মন্ডল ফিরে যায়।বাড়ীর পিছন থেকে নিরু তাদের সব কর্মকাণ্ড দেখছিলো।আহসান মন্ডল একটু থেমে নিরুকে একনজর দেখেই চলে যান।নিরু দৌড়ে তার বাবার কাছে যায়।
—আব্বা, ওই মানুষগুলা কারা?
—তোমার বিয়ের কথা বলতে আইছিলো আম্মা।
কথাশুনেই নিরুর চোখেমুখে খুশির ঝলকানি দেখা যায়
—তাইই! আব্বা আমার বিয়ে কবে অইবো তাইলে?
—জানিনা আম্মা। ঘটক পরে বলতে চাইছে।
—আইচ্ছা আব্বা।
কথা শেষ করেই নিরু দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ী থেকে বের হয়ে যায়।কাশেম মিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো চিন্তায় মগ্ন হয়ে যান।কাজে মন বসাতে পারছেন না কাশেম মিয়া।শুধু ঘটকের অপেক্ষায় তার দিন কেটে যেতে থাকে।এদিকে নিরুও তাকে কখন বিয়ে দিবে এই প্রশ্নে তাকে বিরক্ত করে তুলছিলো।
.
দিন পাঁচেক পর দুপুরের দিকে ঘটক ফয়েজ মিয়া একবার নিরুদের বাড়ীতে আসে।কথার ফাঁকে বলছিলো যে ছেলে পক্ষ বিয়েতে রাজী।তবে তাদের একটা দাবী ছিলো।যৌতুক হিসেবে তারা একটা বাচ্চাসহ গাভী চায় কিংবা গাভী কিনার সমপরিমাণ টাকা।তাদের শর্ত মেনে নিলেই কেবল বিয়ে হবে, নয়তো এই বিয়ে সম্ভব না।
.
কাঁধে রাখা গামছাটা দিয়ে মুখ মুছলেন কাশেম মিয়ার।তাকে আজ বড়ই ক্লান্ত লাগছে।উপায় না দেখে নিজ ভিটেমাটিটুকু বিক্রির চিন্তা করে ঘটককে কথা দেন।পরেরদিন ছেলেপক্ষ থেকে লোক এসে নিরুকে আংটি পরিয়ে যায়।যাওয়ার সময় ছেলের চাচা কাশেম মিয়াকে একান্ত কাছে নিয়ে বলেন,
—ভাইসাব,কতা মনে আছে তো? বিয়ের দিনই কিন্তু চাই।নইলে কিন্তু কবুল হবে না।
.
কাশেম মিয়া কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন।ছেলে পক্ষরা পনের দিন পর বিয়ের তারিখ ঠিক করে চলে যায়।কাশেম মিয়া টাকার চিন্তা বিচলিত। টাকা দিয়ে তিনি মেয়ের সুখ কিনবেন। অন্যদিকে আহসান মন্ডল খুবই খুশি।কারণ তার ইচ্ছে খুবই পূরণ হতে চলেছে।ঘটক ফয়েজ মিয়াও অনেক খুশি।এই ঘটকালীর সুবাদে দুপক্ষ থেকেই ভালো টাকা পাচ্ছে সে।সবাই নিজ স্বার্থ হাসিল হওয়াতে খুশি তবে শুধু ব্যতিক্রম হলো নিরু।
কারণ সে বিয়ে নিয়ে খুশী হলেও তার বাবাকে ছেড়ে যেতে হবে কথাটা ভাবলেই অনেক কান্না।হয়তো মানসিকভাবে সে একটু অন্যরকম কিন্তু কাশেম মিয়ার দুঃখগুলোকে ও বুঝতে পারে।
.
কাশেম মিয়া চুপিচুপি গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছে নিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দেয়।খুব কাকুতি-মিনতি করে একটু সময় চেয়ে নেয় যেন মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত তাকে বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়।
চেয়ারম্যান কাশেম মিয়ার কথা মেনে নিয়ে তাকে থাকার সুযোগ দেন।
.
কিছুদিন পর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ঘনিয়ে আসে।নিরুর বিয়ের দিন চলে আসলো।শর্ত অনুযায়ী কাশেম মিয়া গাভী কিনে আনে।শেষ সম্বলটুকু দিয়ে হলেও যে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছে এতেই তার পরম শান্তি।
.
চারদিকে বিয়ের রমরমা অবস্থা। কাশেম মিয়া মেহমানদের খাবারের খোজ-খবর নিচ্ছেন।নিরু বউ সেজে চুপচাপ হয়ে ঘরে বসে আছে।সবসময় হাসিখুশি থাকা মুখটা আজ খুবই বিষণ্ণ লাগছে।চোখের কোণে বিন্দুবিন্দু জল এসে জমা হয়েছে।নিরুর মনের অজান্তেই কয়েকফোঁটা টপ করে গাল বেয়ে ঝরে পড়ে।মনে পড়ে যাচ্ছে কাশেম মিয়ার সেই কথাগুলো।সেদিন রাতে বাবার কোলে মাথা রেখে রাতের তারায় ভরা বিশাল আকাশটা দেখছিলো।কাশেম মিয়া আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো।
.
—আম্মা, কয়দিন পর তোমার বিয়্যা।আমারে ছাইড়া যাইতে অইবো।তুমি আমার কাছে আমার ছোট আদরের মাইয়্যা ছিলা, কিন্তু অইহানে তুমি তাগোরে ঘরের বউ।তাই তোমারে বালামত থাকতে অইবো।এরকম দুষ্টুমি করা যাইবো না।আর একদম খেলতে যাবা না।তাইলে মাইনষে খারাপ কইবো। শশুরবাড়ী যাওয়ার পর মনে করবা আমি মইরা গেছি….।
.
মরার কথা শুনেই নিরু চোখগুলে বড় বড় করে কাশেম মিয়ার দিকে তাকায়।কাশেম মিয়া ব্যাপারটা সহজেই বুঝতে পারেন।
.
—হুনো আম্মা। মানুষ তো আর সবসময় বাঁইচা থাকেনা। মওত আসলে তার যাওন লাগতই।তোমারে এজন্য কতাডা কইছে যেন তুমি এইরকম মনে কইরা শশুরবাড়ী থাকতে পারো।তাইলে আস্তে আস্তে শশুরবাড়ী মনে ধইরা যাইবো।
হঠাৎ করেই নিরু কাশেম মিয়ার পাকা দাড়িগুলা টানতে টানতে বলে,
—ও আব্বা! তুমিও আমার লগে থাকবা।তাইলে আর তোমার মরতে অইবো না।
.
কথাটা বলেই নিরু খিলখিল করে হাসতে লাগলো।কাশেম মিয়াও শুকনো মরমরা মুখে একটু ব্যর্থ হাসির চেষ্টা করলো।পুকুরপাড়ে ঝিঁঝিপোকাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কাশেম মিয়া।কি যেন ভেবে আবারো নিরুর দিকে ফিরে তাকায়।
—আম্মা যদি আমি কোনোদিন হারায় যা তাইলে তুমি কিন্তু চিন্তা করবা না।আমারে দেখতে ইচ্ছা করলেই রাইতে চান্দের দিক তাকাতেই দেখতে পাইবা।চান্দের খুব কাছে যে তারাটা জ্বলবো ওইটাই আমি।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দম ফেলে বললো,
—জানো আম্মা আমি তোমার গরুর নাম কী রাখছি?
—কি নাম আব্বা?
—নিরু!
—তাই আব্বা। আমার নামে নাম।তাইলে আইজ থাইকা আমরা বন্ধু তাইনা আব্বা?
—হুম।
কথাগুলো বলেই সেদিনের মতো ঘুমাতে চলে যায় দুজনে।কিন্তু আজ নিরুর সেই কথাগুলোই বারবার মনে পড়ছে।হঠাৎ বাইরে চিৎকারের শব্দ শুনে নিরু চেতনা থেকে ফিরে আসে।বরের খুব দামী জুতাটা নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আহসান মন্ডলের কথা,নিশ্চয় কেউ চুরি করেছে জুতাজোড়া।কাশেম মিয়া নিরুপায় হয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
.
হঠাৎ আহসান মন্ডল হুংকার দিয়ে বলেন,
—ছিঃ ছিঃ এমন চুর আমার জীবনে দেহিনাই।আর এই গেরামের মানুষগুলাই এমন ক্যান? বিয়ার দিন বরের জুতা চুরি করে।ছিঃ
এগোরে নিয়া আত্মীয়তার সম্পর্ক করা অসম্ভব।ছিঃ
.
কথা শেষ করেই আহসান মিয়া ছেলেকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলো।নিমিষেই পুরো বাড়ীটা মানবশূন্য হয়ে গেলো।কাশেম মিয়া রান্নাঘরের খুঁটিটা ধরে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে।তার মুখে কোনো কথা নেই,নেই চোখে কোনো পানি।নিরুর ঘর থেকে বাবার কাধে হাত রেখে কাঁদোকাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—আব্বা এ আব্বা, সবাই চইলা গেলো ক্যান? আমার বিয়া কি হবো না?
.
কাশেম মিয়া কোনো কথা না বললে চুপিচুপি রাতের আঁধারে বাড়ী থেকে বেরিয়ে যায়। পিছন থেকে নিরুর চিৎকার সেদিন কাশেম মিয়ার কান পর্যন্ত পৌঁছালেও আর ফিরে তাকায়নি।আর কোনোদিন ফিরে আসেনি কাশেম মিয়া।একা অসহায় নিরু বাবার আশায় প্রতিনিয়ত চোখের জল ফেলে।বন্ধু নিরুকে নিয়ে মাঠে গিয়ে চুপচাপ নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকে।নদীর কলকলানিতে নিরু বাবা ফিরে আসার ডাক শুনতে পায়।
.
প্রতিরাতেই নিয়ম করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।চাঁদের পাশে হাজারো তারা দেখে নিরু নিরাশ হয়ে যায়।বাবা বলেছিলো চাঁদের পাশে তারা হয়ে তিনি থাকবেন,কিন্তু এখানে তো অনেক তারা।তাহলে কি কাশেম মিয়া বেঁচে আছে?যদি মারা যায় তাহলে নিরু কেন তারাদের মাঝে তাকে খুঁজে পায়না?
বিড়বিড় করে নিরু কথাগুলো বলতে থাকে।হঠাৎ করে বন্ধু নিরু এসে তার চিবুকের গন্ধ নেয়।দুজনেই অপেক্ষায় থেকে যায়। কিন্তু অসহায় নিরু বাবাকে ছাড়া খুবই একা।তাই বাবাকে যে তার খুবই প্রয়োজন।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

১০ Comments

  1. Mohasina begum

    সুন্দর গল্প

    Reply
  2. Rabbi Hasan

    খুব ভালো লিখেছেন। তবে খুশির বাণ> খুশির বন্যা হতো মনে হয়।
    এছাড়াও গল্পের শেষের দিকটা অদ্ভুত, আমি মনে করি কোনো বাবা তার মেয়েকে একা রেখে দুরে চলে যেতে পারে না। গল্প এমনভাবে লিখুন যেটা বাস্তব মনে হবে। ধন্যবাদ।

    Reply
    • জুয়েল ইসলাম

      কাশেম মিয়া মেয়ের জীবনের এরকম পরিস্থিতি দেখে নিজেকেই এর জন্য দায়ী মনে করেছেন।তাই ব্যর্থ জীবন নিয়ে জীবন থেকে পালাবার চেষ্টা।এমনটাই বুঝানোর চেষ্টা করেছি।আশা করি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন।

      Reply
  3. আফরোজা আক্তার ইতি

    খুব ভালো লিখেছেন। পড়ে মনে হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “নিরুপমা” পড়ছি। এভাবে যে যৌতুকের জন্য কত মেয়ে বলি হচ্ছে, তার হিসেব নেই। শুধু তারাই নয়, শেষ হয়ে যায় একটি সুন্দর পরিবারও। আপনি গল্পে সবকিছুই সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কিছু ভুল আছে।
    মাও মরা মেয়ে- মা মরা মেয়ে।
    হাঁসি- হাসি।
    খুশী- খুশি।
    অনেক চেষ্টা করেও তার বাবা আহসান মন্ডল ছেলেকে জীবনে আনতে পারেনি। কথাটা পুরোপুরি বোঝা গেল না।
    অনেক কান্না- এখানে বাক্যটি অসম্পূর্ণ। অনেক কান্না আসে হবে।
    আমি কোনদিন হারায় যা- যাই হবে।

    Reply
    • জুয়েল ইসলাম

      মাও মরা শব্দটি একটু গ্রামের ভাষার মতো ব্যবহার করেছি।গল্পটা লেখার পরেও অনেক চেক করেছি তবুও বানান ভুল থেকেই গেলো।যাইহোক ধন্যবাদ আপনাকে ভুলগুলো দেখিয়ে দেবার জন্য।

      Reply
  4. Anamika Rimjhim

    নিরুর মার -নিরুর মায়ের/মা’র
    শশুর -শ্বশুর
    হাঁসি-হাসি
    খুশী-খুশি
    কাশেম মিয়ার উক্তি গুলোতে ” ” ছিল না।দিতে হবে।
    গল্পটা পড়তে ভাল লাগছিল কিন্তু শেষটা একটু কেমন জানি হয়েছে। অন্যভাবেও শেষ করা যেত।
    শুভ কামনা 🙂

    Reply
  5. Halima Tus Sadia

    ভালো লিখেছেন।
    চমৎকার লেখনি।

    গল্পের মধ্যে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
    নিরুর মতো কতো মেয়ের জীবন যৌতুকেে জন্য নষ্ট হচ্ছে।প্রতিটি মেয়েরেই স্বপ্ন থাকে বউ সাজার।কালো বলে কি নিরুর স্বপ্ন পূর্ণ হবে না?
    অবশ্যই পূর্ণ হয় না।তাদের স্বপ্ন,স্বপ্নই থেকে যায়।

    তবে খারাপ লাগে টাকার জন্য বিয়ে দিতে কষ্ট হয়।
    বাস্তবেও এরকম অনেক হচ্ছে।
    বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে বিয়ে দিতে হয়।

    নিরুর বাবা চলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি।সংসারে থেকেই লড়াইকরে বাঁচতে হয়।মেয়েটাকে একা করে রেখে গেলো।

    বানান ভুল আছে।

    বালা–ভালা

    খেলাধূলা–খেলাধুলা

    খোজ–খোঁজ

    এককারে–একবারে

    আজো–আজও

    আচারন–আচরণ

    শ্বশুরবাড়ী–শ্বশুড় বাড়ি

    চোখগুলে–চোখগুলো

    বালামত–ভালামতো

    হাঁসি–হাসি

    খুশী–খুশি

    কাধে–কাঁধে

    বাড়ী–বাড়ি

    বানানের প্রতি যত্নশীল হবেন।

    জিজ্ঞেস বসলো–জিজ্ঞেস করে বসল।

    শুভ কামনা রইলো।

    Reply
  6. জুয়েল ইসলাম

    বালামতো আর বালা,শব্দদুটি গ্রাম্যভাষায় ব্যবহার করেছি।বাকীগুলো শুধরে নিবো ইনশাল্লাহ। ধন্যবাদ।

    Reply
  7. s m sahadat hossen

    গল্পে কিছু ভুল আছে। তবে গল্পটা অসাধারণ ছিল। শুভ কামনা আপনার জন্য…

    Reply
  8. Mahbub Alom

    দারুণ হয়েছে।মন জুড়ানো এক গল্প।

    তবে নিরুপমাকে ছেড়ে কাশেম মিয়া চলে গেলেন কেনো?
    এত্ত ভালোবাসা দিয়ে যেই মেয়েকে বড় করেছেন তার এই দুঃসময়ে বাবা চলে গেলেন।
    আর সামান্য জুতা চুড়ির জন্য বিয়ে ভেঙে দিলো।
    গল্পটা পড়ে হৃদয়ে কিছুটা শূন্যতা রয়ে গেলো।

    বানানে কিছু ভুল আছে।শুভকামনা রইলো।

    Reply

Leave a Reply to আফরোজা আক্তার ইতি Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *