লেখকঃ
Fahmida Fahmii
(এপ্রিল – ২০১৮)
……………
শ্রাবণ যখন তার মায়ের কোলজুড়ে এসেছিল, মা ছাড়া পরিবারের প্রায় সবার মুখ কালো হয়ে গেছিলো।
দাদা-দাদী চেয়েছিল তাদের বংশে একজন নাতী আসুক। তাদের চিন্তাধারা অনুযায়ী অভাবের সংসারে বংশের প্রদীপ পুত্রসন্তানের জায়গায় শ্রাবণের জন্ম বাড়তি বোঝা ছাড়া আর কিছুই না। নিজের বাবাও আশাভঙ্গ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ফুটফুটে শিশুটির থেকে। আর এসব দেখে অসহায় মা-ও ভাবতে বাধ্য হলো, “তুই বোধহয় ছেলে হয়ে জন্মালেই
ভালো করতিস… !”
মেয়ে হয়ে জন্মানোর দোষে দোষী শ্রাবণকে পদে পদে পস্তাতে হয়। একে তো পরিবারের অভাব, সাথে রয়েছে সকলের অবহেলা….একমাত্র মা-ই যেন শ্রাবণকে ভালোবাসে। ৬ বছর বয়সে তাই সবার বিরুদ্ধে গিয়ে একপ্রকার জোর করেই মেয়েকে স্কুলে পাঠায় ওর মা।
ছোট্ট শ্রাবণ সমাজের বৈষম্যতার রূপ দেখতে দেখতে বেড়ে উঠছিল। লেখাপড়ার প্রতি সে একধরণের আকর্ষণ খুঁজে পায়। মনের ভেতর লালন করেছিল ওকালতি পড়ার স্বপ্ন। কিন্তু তাতেও তার নিষেধ ছিল যে!
পনের বছর বয়সে একমাত্র কাছের যে মা, সে-ই তাকে একলা করে রেখে চলে যায় না ফেরার দেশে। মায়ের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই বাবা ও দাদা-দাদী কোন রকম বিপত্তি ছাড়াই তাদের গলার কাঁটাকে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব এক লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
ফলে মাধ্যমিকের গণ্ডি না পেরোতেই তার স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটে পরিবার নামক কসাই-এর হাতে। নতুন পরিবারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে শ্রাবণ ভুলেই গেছিলো স্বপ্নের কথা!
বেচারি পায়নি দাদা-দাদির ভালোবাসা, বুঝতে পারেনি বাবার আদর কি জিনিস। বিয়ের পর মেয়ে হওয়ার কষ্ট ও যেন নতুনভাবে উপলব্ধি করতে লাগলো। সংসারের সবকিছু তাকে একা হাতেই সামলাতে হয়। মাঝে মাঝেই পরিবারের দারিদ্র্যতার কারণে কথা শুনতে হয়। বিয়ের মাস কয়েক পরেই স্বামীর আরেক রূপ ফুটে উঠতে থাকে শ্রাবণের চোখে। নেশা করে বাড়ি ফেরা, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা এখন যেন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতোকিছুর পরেও সব সহ্য করা ছাড়া তার
কোন উপায় ছিলোনা। চলতে থাকে এভাবেই……..!!
বছর দেড়েক পরে একদিন শ্রাবণ বুঝতে পারে তার ভেতর ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে আরেকটি সত্ত্বা। কিশোরী মেয়েটি
নিজের খেয়ালই নিতে পারেনা, আরেকটি প্রাণের দায়িত্ব কি করে নেবে ? অতঃপর জন্ম নিলো পুষ্টিহীনতার শিকার
অসুস্থ এক শিশু। আরেকটি কন্যাসন্তানের আগমন, যেন মায়েরই মতো বৈষম্যের বলি হতে! কিছুদিন পর শিশুটির
ফুসফুসের সমস্যা ধরা পড়ে। তার চিকিৎসার জন্য প্রায়ই ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হয়।
এমনই একদিন স্বামী সহ ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরছিল সে। সেদিন তার জীবনে আসে নতুন মোড়….উল্টোদিক
থেকে নিয়ন্ত্রণ হারানো এক বাস প্রচণ্ড জোরে তাদের রিক্সাকে ধাক্কা দেয়। আর তাতে রিক্সাচালক ঘটনাস্থলেই
মারা যায়। শ্রাবণের কোল থেকে ছিটকে পড়ে ছোট্ট শিশুটি। এতোটা আঘাত সইতে পারেনি তার অসুস্থ শরীর। ধুঁকপুক
করতে করতে হৃদস্পন্দন থেমে যায় চিরজীবনের জন্য।
তার স্বামীর দু’পা মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
আর শ্রাবণ? তার মাথায় কিছুটা জখম হলেও অন্যদের তুলনায় তা ততোটা গুরুতর নয়।
কুড়ি বছরের জীবনে সাধারণের চেয়েও অনেক বেশি অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে শ্রাবণের। নিজ পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, সংসার, সব জায়গায়, প্রতিটি পদক্ষেপে অবহেলার শিকার, মায়ের চলে যাওয়া, স্বপ্নের মৃত্যু….অল্পবয়সে বিয়ে, সন্তান হারানো…অতঃপর পঙ্গু স্বামীর হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে বেঁচে থেকেও যে আজ সে মৃত।
মন-টা মরে গেছে, আত্মার মৃত্যু ঘটেনি……
যেন অপেক্ষায়….. আরো জর্জরিত হওয়ার…… !
০ Comments