মন খারাপ এর বৃষ্টি
প্রকাশিত: মে ১৮, ২০১৮
লেখকঃ vickycherry05

 2,983 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ vickycherry05

লেখিকা: অনামিকা রিমঝিম
(মে – ২০১৮)

আজ সকাল থেকে জানালার ধারে বসে আছি। বৃষ্টি দেখছি। আজ আমি কোন কাজ করতে পারব না! কারন আজ ১১ই জুলাই। আজ সারাদিন আমার আকাশের বৃষ্টির সাথে আমার চোখেও বৃষ্টি থাকবে। আজ আমার কোন দিকে খেয়াল থাকবে না আমি জানি। স্বামীর অফিস আছে, মেয়ের স্কুল আছে সারা বাড়িতে এত কাজ পরে আছে কিন্তু আমার কোনদিকেই মন নেই। আজ আমি বৃষ্টি দেখব! জানি না এটাকে কি বলে, কিন্তু বৃষ্টি সবসময় শুধু আমাকে কষ্টই দিয়েছে। আমার জীবনের সব থেকে মূল্যবান জিনিস গুলো যখন আমি হারিয়েছি তখন একমাত্র বৃষ্টিই ছিল তার সাক্ষী।

আজ মনে পরে যাচ্ছে অনেক কথা। আজ থেকে ১০ বছর আগে আমি এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলাম। তবে কোন বিয়ের গাড়িতে বরের ঘাড়ে মাথা দিয়ে আসিনি। এসেছিলাম এক কাপড়ে। অরুন আমাকে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে এ বাড়িতে এনেছিল। তবে তাতে আমারো সম্মতি ছিল।
অবশ্য সেই দিনই আমার শ্বশুর আর শ্বাশুরি আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে চেয়েছিল। সেটাই স্বাভাবিক। কে চায় তার একমাত্র ছেলের বউ একজন পতিতা হোক! তার উপর আবার মুখের কিছুটা অংশে এসিড পোড়া। আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু অরুন তখন বলেছিল যদি আমাকে বের করে দেওয়া হয় তাহলে সে ও বের হয়ে যাবে বাড়ি থেকে। একমাত্র ছেলেকে বাবা মা একটু বেশিই ভালবাসত। তাই হয়ত বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে মেনে নিয়েছিল।

কিন্তু আমার শ্বাশুরির শর্ত দিয়েছিল। তার শর্ত ছিল আমরা কখনো কোন সন্তান নিতে পারব না। কারন তিনি চান না একজন পতিতার রক্ত এ সংসারের উত্তরাধিকার এর গায়ে থাকুক। অরুন আবারো প্রতিবাদ করে এবং বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে চায়।এবার আমি মুখ খুলি। আমি বাধা দিই অরুন কে। অনেক কষ্ট করে রাজী করিয়েছিলাম তাকে। বলেছিলাম এক মা কে সন্তান হারা করে আমি নিজে মা হতে চাই না। অরুন রাজী হলো। ব্যস,শুরু হলো আমার পথচলা এই বাড়িতে। আমার শ্বশুর বা শ্বাশুরি কেউ ই প্রথম দিকে আমার সাথে কথা বলতেন না। সারাদিন পিছে পিছে ঘুরতাম মা এর। তিনি এতে আরো রেগে যেতেন। বকাবকি করতেন। একদিন তো মুখের উপর বলেই দিলেন..”এই মেয়ে শোন,আমার ছেলেকে বস করে এ বাড়িতে তোর ঠাঁই হলেও আমার মন পাবার চেষ্টা করিস না। তাতে কোন লাভ হবে না”।

আমার সেদিন ভাল লেগেছিল। কারন যে কথায় বলুক না কেন, মা অন্তত আমার সাথে কথা বলেছিল। আমি চেয়েছিলাম সে আমার কথা বলুক। আমার শ্বাশুরির পা টা ঠিক আমার মা এর মত ছিল। আমি চেয়েছিলাম এই মা এর মাঝে আমার মা কে খুঁজতে।

কিন্তু কোন লাভ হচ্ছিল না। দিন দিন তিনি আমার সাথে আরো খারাপ ব্যবহার করতে লাগলেন। আমাকে ডাইনিং টেবিলে বসে েখেতে দিতেন না। কোথাও বের হতে দিতেন না। অবশ্য আমার কখনো ইচ্ছা ও হয়নি বের হবার। আমার কপাল এর এক পাশে এসিড এর দাগ। এটা দেখে মানুষ নানান কথা বলে। শুধু বাইরে কেন, বাসাতেও যখন কেউ আসে এক এক জন এক এক কথা বলে। অপমান জনক কথা। আমার জন্য আমার শ্বশুর শ্বাশুরিকেও কথা শুনতে হতো। লোকে বলত তারা কেন আমার মত একটা মেয়েকে ঘরে থাকতে দিয়েছেন। শ্বাশুরি অবশ্য সেটার উত্তর হিসেবে প্রত্যেক বারই তার কপাল কে দোষ দিয়ে গেছেন।তবে হ্যা, অরুন এর সামনে তিনি আমার তেমন কিছু বলতেন না।

একদিন অরুন আমায় বলল, “তনিমা, এভাবে আর কতদিন। আজ পাঁচ মাস হয়ে গেল তুমি এ বাড়িতে এসেছ। কিন্তু মা ত এখনো তোমায় মেনে নিতে পারেনি। উল্টো তোমার সাথে আরো খারাপ ব্যবহার করছেন। আমার এসব ভাললাগে না। আমি তোমাকে জীবনে একটু শান্তি দেব বলে বিয়ে করেছিলাম। এত কষ্ট পাবার জন্য না। চলো আমরা এ বাড়ি থেকে চলে যাই।”
উত্তরে আমি তাকে বলেছিলাম “জানো, মা এর পা টা না..ঠিক আমার মা এর মত। তিনি আমার সাথে যতই খারাপ ব্যবহার করুন না কেন, আমার খারাপ লাগে না অরুন। তুমি তো সব ই জানো, আমাকে আরো একবার মা হারা করে দিও না প্লিজ।আমি এখানে থাকতে চাই।”
সেদিন অরুনের বুকে মাথা দিয়ে সারা রাত কেঁদেছিলাম।

বিয়ের ছয় মাসের মাথায় আমার শ্বশুর মশায় মারা যান। অবশ্য এর কারন হিসেবে শ্বাশুরি মা আমাকেই মনে করেন। আমিই নাকি অপয়া। তাকে যখন সেসময় আমি সামলাতে গেলাম বাড়ি ভর্তি মানুষ এর সামনে আমার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বললেন, “চলে যা এখান থেকে ডাইনি, তুই একটা অপয়া। তোর জন্যই আমি বিধবা হয়েছি।”

এরপরেও আমি কুকুরের মত সেই বাড়িতে থেকে গেছি। কারন আমি মা কে ছাড়া থাকতে পারতাম না। সে আমাকে যতই অপমান করুক না কেন।
সবসময় মায়ের কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করতাম। এভাবে কেটে গেল আরো ৬টি মাস। এখন তো বাড়িতে শুধু আমি অরুন আর মা। যদিও মা প্রায়ই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চান, কিন্তু অরুন আটকে রাখে। মা ও অরুন কে খুব ভালবাসে তাই আর যেতে পারে না। ইদানিং মা আমার সাথে কথা বলায় বন্ধ করে দিয়েছে। আগের মত আর বকাবকিও করেনা। আমাকে কিছু বলতেই নাকি তার ঘৃনা লাগে। আমার মন খুব খারাপ থাকে। মা আর কথা বলে না। কিন্তু এত কিছুর পর কি যেন একটা টান আমাকে তার কাছে টেনে রাখত। জানিনা কি সেই টান। হয়ত কোন মায়া! তার তো কোন দোষ নেই। তার একমাত্র আদরের ছেলে ১০ দিনের ট্রেনিং এ শহরের বাইরে গিয়ে ফেরার সময় একজন পতিতা কে বিয়ে করে ঘরে এনেছে। এতে তার রাগ হবার ই কথা। অবশ্য তার ছেলে এ কাজ কেন করেছে সেটা জানার আগ্রহ তার এত দিনেও হয়নি। আবার সেই অপয়া বউ ঘরের আসার ৬ মাসের মধ্যে তিনি বিধবা হয়েছেন। এত কিছুর পরে তিনি আমায় মানবেন কি করে! তার জায়গা থেকে হয়ত তিনি ঠিক।

এ বাড়ির নিয়ম অনু্যায়ী, এ বাড়িতে কোন নতুন বউ বিয়ে হয়ে আসার পরের দিন তার সিঁথিতে তার শ্বাশুরি সিঁদুর পরিয়ে দেয়।কিন্তু আমি এটা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তিনি আমায় আজ পর্যন্ত মেনেই নিতে পারলেন না সেখানে এসব নিয়ম কানুন তো দূরের কথা।

যাক সে কথা। মা এর একটা জিনিস আমার ভাল লাগতো, তিনি আমাকে যখন বকা দিতেন, বা ভুল ভবিষ্যৎ কোন কাজে ডাকতেন তখন আমায় সম্বোধন করতেন তিনি “এই মেয়ে” বলে। আমাকে কখনো ডাকতে হলেও তিনি “এই মেয়ে ” বলেই ডাকতেন, তনিমা বলে নয়।

এদিকে অরুন এর মনে অন্য কষ্ট। সে বাবা হতে চায়। সে চায় আমাদের একটা ফুটফুটে সন্তান হোক। কিন্তু আমি যে মাকে কথা দিয়েছি। তাই এটা সম্ভব না। এ বিষয়ে প্রায় রাতেই অরুন আর আমার মধ্যে আলোচনা হতো। ওকে বোঝাতাম, আর সকালে যখন ও অফিসে চলে যেত এসব কথা ভেবে আমি মন মরা হয়ে থাকতাম প্রায়ই। মা তো খুব কম কথা বলতেন।

এমনই এক সকালে আমি মন খারাপ করে ঘরে একা বসে আছি, তখন মা এর চিৎকার শুনতে পেলাম রান্নাঘর থেকে।
“এই মেয়ে…..”
আমি দৌড়ে গেলাম রান্নাঘরে। দেখি মা শ্বাস নিতে পারছেন না। হঠাৎ করে শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে। আর ইনহেলার টাও এখানে আনেন নি তিনি। মাটিতে পড়ে আছেন মা।
আমি দৌড়ে মা এর ঘর থেকে ইনহেলারটা নিয়ে এসেছিলাম তাড়াতাড়ি তার মুখে দিয়ে দিলাম। মা একটু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে তাকে ধরে ধরে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম। আর বললাম রেস্ট নিতে, আমি তার জন্য দুধ গরম করতে গেলাম।

দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখলাম মা পাশ ঘুরে কাঁদছেন। আমার দেখে খুব খারাপ লাগলো। আমি কি আবার কোন ভুল করলাম!
মাকে বললাম…
– মা,আমি কি আবার কিছু করেছি? তাহলে আমাকে বকা দিন মা। প্লিজ এভাবে কাঁদবেন না।
কথা টা বলে দুধের গ্লাস টা মায়ের ঘরে রেখে বের হয়ে যেতেই মা পিছু ডাকলেন….

– এই মেয়ে শোন…
-হ্যাঁ মা..
-আমি তোকে এত বকি এত অপমান করি, গায়ে হাত পর্যন্ত তুলি তাও তুই আমায় আজ কেন বাঁচালি?
-ছিঃ ছিঃ মা, এসব কি বলছেন। আপনাকে আমি মা বলে ডাকি। আপনি তো আমার মা ই…আমি থাকতে আপনার কিছু হতে দিই কি করে?

মা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে কাছে ডাকলেন। এই প্রথম আমাকে তার পাশে বসতে বললেন। আমি বসলাম। মা বললেন….

– আজ তোকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে। করব?
-অবশ্যই মা।
-তোর মত মেয়ে ওই পাপ কাজ কেন করতে?
-হাহা। ভাগ্যের ফেরে! আমার কপাল দোষে আর নয়ত সে সর্বনাশা বৃষ্টির জন্য।
– বৃষ্টি?
-না। আসলে আমার জীবনের সব কয়টি খারাপ সময়ে আকাশ কাদত। মন খারাপের কান্না! একেই সর্বনাশা বৃষ্টি বলি আমি।

-যদি জানতে চাই তোর জীবনের গল্প, বলবি আমাকে? সবটা বলবি?
-আপনি শুনতে চান মা?
-হ্যাঁ চাই। তুই বল।

-আচ্ছা শুনুন তবে, আমার যখন ৫ বছর বয়স, তখন আমার বাবা মারা যায়। মা আমাকে নিয়ে একা থাকত। বাড়িতে অবশ্য ঠাকুর মা আর কাকা-কাকিমাও ঠাকত। ওরা আমার মাকে সহ্য করতে পারত না। খুব অপমান করত সব সময়। তাও মা আমাকে মানুষ করার জন্য মুখ বুজে সব সহ্য করত। আমাদের আর যাওয়ার জায়গা ছিল না…
আস্তে আস্তে ওরা কারণে অকারণে মায়ের গায়ে হাত তুলত। আমার খুব খারাপ লাগত। আমার এস এস সি পরীক্ষার পর কাকা আমার পড়াশুনাও বন্ধ করে দিলেন। মা খুব কাঁদত। সারাদিন কাঁদত। মাকে জরিয়ে আমিও খুব কাঁদতাম…খুব…

-তারপর?
-তারপর একদিন মায়ের খুব অসুখ হলো। আমি কাকার পা ধরে কয়েকটা টাকা চেয়েছিলাম ঔষুধ কেনার জন্য। কাকা একটা চড় মেরে ঘর থেকে বের করে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে গেলাম দেখি মা যন্ত্রনায় ছটফট করছে।
কাছে গেলাম মায়ের…জরিয়ে ধরলাম…বললাম, তুমি চিন্তা করো না মা…সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি এক্ষুনি ঔষধ নিয়ে আসছি। সেদিন ছিল বৃষ্টির রাত। দৌড়ে মোরের ঔষধ এর দোকান গেলাম। টাকা ছাড়া ঔষধ দিবে না বলল দোকানদার। ঔষধের দাম ২৫০ টাকা। দোকানে কেউ ছিল না। দোকানদার আমাকে ঔষধ দিলেন তবে জোড় করে ……। সেই ১৭ বছর বয়সে আমার ইজ্জত এর দাম হলো ২৫০টাকা! দৌড়ে দৌড়ে মায়ের কাছে ঔষধ নিয়ে এলাম কিন্তু ……..
-কিন্তু?
-মা ততক্ষনে আমায় ছেড়ে চলে গেছে। সেই থেকে আমি একা হয়ে গেলাম। আর কেউ নেই আমার।
শ্বাশুরি মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখে জল। আমিও কাঁদছি…এই প্রথম তিনি আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন…”আমি আছি মা…তোর আরেক টা মা”।

জানো মা….সেদিন সারারাত কেঁদেছিলাম মা কে জরিয়ে ধরে। খুব কেঁদেছিলাম। আর আমার সাথে সাথে আকাশ ও কাঁদছিল।মন খারাপের বৃষ্টি হচ্ছিল। মা চলে গেল আমার থেকে …. অনেক দূরে।

-চুপ কর পাগলি। কাঁদিস না। তারপর কি হয়েছিল বল।

-মা চলে যাওয়ার পর ও বাড়ির সবাই আমার সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করত। বাড়ির সব কাজ আমিই করতাম। বিনিময়ে ওরা আমায় থাকতে আর খেতে দিত। কাকিমা ভেবেছিল আমাকে সারাজীবনের জন্য ঝি বানিয়ে বাড়িতে রেখে দিবে ।
বাড়ির বাজার করার জন্য ও আমিই যেতাম বাজারে। পথে একটা খারাপ ছেলে আমায় ফলো করত প্রতিদিন। আমাকে বিরক্ত করত। উল্টা পাল্টা কথা বলত। আমি বাড়ি এসে কাকা কে বলে দিলাম। কিন্তু কেউ আমার কোন কথায় কান দিল না।
একদিন ছেলেটা আমার সাথে অসভ্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে..আমি ওর গালে একটা চড় মাড়ি।
এরপর ছেলে টা রাগে পরের দিন এসিড নিয়ে এসে আমার মুখে ছুড়ে দেয় কিন্তু আমি মুখ সরিয়ে নিয়েছিলাম অনেকটা তাই শুধু কপাল এ লেগেছে। তারপর বাজারের লোকজন সবাই ওই ছেলেটাকে মারে আর আমাকে ওই অবস্থায় বাড়ি নিয়ে আসে।
ওরা কাকা কে খুব অপমান করে খুব! আমার জন্য। আমার উপর অত্যাচার এর জন্য। বাজারের লোকজন চলে গেলে….

– এবার নিশ্চই তোর কাকা কাকিমার সুমতি হয়েছিল।
– তুমি যে কি বলোনা মা। আমার জন্য ওদের অপমানিত হতে হয়েছে। এই রাগে কাকিমা আমার এসিড পোড়া অংশের উপর লবন ছিটিয়ে দিল। আরো মারলো। আর কাকাকে বলল যত তাড়াতাড়ি পার এই আপদ টাকে বিদেয় কর বাড়ি থেকে।
– এত টা নিষ্ঠুর মানুষ হয়?
– হ্যাঁ মা,হয়।
-তারপর কি হয়েছিল??
-তারপর আমি ওবাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। কাকিমা কড়া নজর রেখেছিল।
এর কয়েকদিন পর একদিন রাতে আমি জানালার ধারে বসে বসে বৃষ্টি দেখছি। খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। কাকা আমার ঘরে এলো, বলল তার সাথে যেতে। এই নরক থেকে মুক্তি পাব ভেবেছিলাম। তাই কোন প্রশ্ন না করে কাকার সাথে বেড়িয়ে এসেছিলাম।
কিন্তু কাকা আমাকে কেমন যেন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। একটা মহিলার হাতে তুলে দিলো আর মোটা অঙ্কের টাকা নিলো। বুঝতে পারলাম আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে।
কাকা চলে যাচ্ছিল… আমি চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে ডেকেছিলাম। বলেছিলাম আমায় নিয়ে যাও।
শুনলো না…তারপর থেকেই সেই ভয়ংকর জীবন শুরু হলো।

– তোর জীবনে এত কষ্ট ছিল! আমি বুঝতে পারিনি রে পাগলি,মাফ করে দিস আমায়।
-মা জানো,তোমার পা টা না…ঠিক আমার মায়ের মত।
-তাই! আমি তো তোর মা ই।
-হ্যাঁ তুমিই আমার মা।
-এবার বল অরুন তোকে কোথায় পেল!
-আমি বার বার পতিতালয় থেকে পালানোর চেষ্টা করতাম, কিন্তু পারতাম না। একদিন রাতে যখন আবার পালানোর চেষ্টা করেছিলাম তখন পথে তোমার ছেলের সাথে দেখা হয়েছিল। জানিনা কেন জানি ও আমায় সাহায্য করল পালাতে। আমার জীবনের সব গল্প শুনলো… তারপর আমাকে বিয়ে করে নিলো। তারপর তো এখানে এলাম।
– এই মেয়ে শোন।
– হ্যাঁ মা বলো।
-পারবি না আমায় মাফ করে দিতে? আমি তো তোর মা।
– কি যে বল মা।
-একটা কাজ কর।
– কি মা?
– ওই ড্রয়ারে একটা সিঁদুর কৌটো আছে। নিয়ে আয়।

মায়ের এই কথা শুনে আনন্দে আমার চোখ ছলছল করে উঠলো। আমি নিয়ে এলাম সিঁদুর কৌটা।
মা বলল “এ বাড়ির নিয়ম..নতুন বউ বাড়ি এলে তার সিঁথিতে এই সিঁদুর কৌটা থেকে সিঁদুর নিয়ে শ্বাশুরিরা পরিয়ে দেয়। আমার শ্বাশুরিও আমায় দিয়েছিল। আজ আমি তোকে দিলাম।
এই বলে মা আমায় সিঁদুর পরিয়ে দিলো আর সিঁদুর কৌটাটা আমার হাতে দিলো।
আমি বললাম…
– মা দেখ, আজো আকাশে কেমন বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আজ আর মন খারাপের বৃষ্টি না মা। এ পর্যন্ত আমার জীবনের সব মূল্যবান জিনিস গুলো হারানোর সময় বৃষ্টি ছিল! কিন্তু আজ, নতুন করে তোমাকে পাওয়াতে মন ভালোর বৃষ্টি হচ্ছে।
– হ্যাঁ। ঠিক বলেছিস। তুই আর কাঁদবি না হ্যাঁ?
-ঠিক আছে।

কিন্ত এর কিছুক্ষন পর থেকে মা এর শরীরটা আরো খারাপ হয়ে যায়। শ্বাসকষ্ট শুরু হয় আবার। আমি অবস্থা এরকম দেখে তাড়াতাড়ি অরুনকে ফোন দেই। ও বাসায় আসে। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। এদিকে মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে আসছে। অরুন একজন ডাক্তার কে নিয়ে বাসায় আসে। ডাক্তার মা কে দেখে বলল, অবস্থা খুব খারাপ এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে ..অরুন এম্বুলেন্স এ ফোন করল। আর আমি মায়ের পা ধরে কাঁদছিলাম। তারপর মা বলল…
-এই মেয়ে …শোন।
-হ্যাঁ মা..
– এদিকে আয়…অরুন তুই ও আয়। আমরা ২ জন মায়ের কাছে গেলাম। মা আমাদের হাত টা ধরলেন। বললেন…আমাকে মাফ করে দিস তোরা, খুব ভাল থাকিস, সুখে থাকিস। আমি বুঝতে পারছি আমার সময় শেষ। তোদের আশীর্বাদ করে গেলাম।
আর একটা কথা …
এই মেয়ে…
-হ্যাঁ মা..
– তোর মেয়ে হতে খুব ইচ্ছে করছে রে! আমাকে তোদের মেয়ে হওয়ার সুযোগ দিস।
বলতে বলতে মা চলে গেল।
আবারো আমি আরেক মা কে হারালাম…আর আজও আকাশে বৃষ্টি। মায়ের হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিলাম। অরুন কাঁদছে। কিন্তু আমি কাঁদছি না। বাইরে চলে গেলাম। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালাম। খেয়াল করলাম….বৃষ্টিতে সব কিছু ধূয়ে গেলেও…মায়ের পড়িয়ে দেওয়া সিঁদুর টা ধুয়ে যায়নি।

সেদিন ছিল ১১ জুলাই। আর আজও। আজ ও প্রতিবছরের মত এই দিন টাতে আমার কোন কাজে মন নেই! চুপ করে বৃষ্টি দেখছি। মন খারাপের বৃষ্টি।

এমন সময় একটা আওয়াজ আমার ঘোর কাটিয়ে দিলো! আমার মেয়ের ডাক ….
-“এই মা,কি ভাবছো “??….

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

০ Comments

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *