মানুষখেকো
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 1,636 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

লেখা: মোঃ রাব্বি হোসেন

সীমান্ত সেন, একজন বিরাট লোক। টাকা পয়সা, ধন সম্পত্তির অভাব নেই তার। শুধু যে টাকা পয়সা, প্রতিপত্তিই আছে, তা কিন্তু নয়! তিনি ঢাকা শহরের একজন প্রভাবশালী লোকও বটে। বড় মাপের একজন ব্যবসাদার তিনি। কখনো অভাব কি, সেটা তিনি কখনো উপলব্ধি করেছেন বলে তার মনে হয়না। সেই ছোটবেলা থেকেই তিনি রাজার হালে জীবন কাঁটান। তার বাবা ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন অফিসার। যখন তিনি ছোটবেলাতে স্কুলে যেতেন, তখন তার স্কুলের সবাই তাকিয়ে থাকতো তার দিকে। কারণ তিনি হেঁটে স্কুলে যেতেন না। বাবার গাড়িতে স্কুলে যেতেন আবার ফিরতেন। স্কুল জীবনের দশটা বছর তিনি কখনো মাটিতে পা রেখেছেন কিনা সেটাও সন্দিহান। বিলাস বহুল বাড়ি, দামি গাড়ি, আবার খাবারের বেলায় রকমারি খাবার দাবার, সবকিছুই ছিলো তার ভোগ বিলাসের জন্য।
সীমান্ত সেন যখন ইন্টার পাস করলেন, তখন তার বাবা তাকে ডেকে বললেন “বাবা তুই নৌবাহিনীতে জয়েন কর। সেখানে থাকার পাশাপাশি তুই পড়ালেখাও পুরা দমে চালাতে পারবি। যেমনটা এখন আছিস, তখনও তুই তেমনটাই থাকবি। বরং এখনকার চেয়ে আরো ভালো থাকবি তখন।
সীমান্ত সেনের তখন কোন কিছু বোঝার যথেষ্ট জ্ঞান হয়েছে। তিনি তার বাবার কথার প্রত্তুত্তরে বললেন, বাবা আমি কোন ফোর্সে চাকরি করবোনা। আর ফোর্সে কেন, আমি কোন চাকরিই করবো না। আমি হবো একজন বিসন্যাস ম্যান। যাকে এদেশের সবাই চিনবে। যার নাম শুনলেই দেশবাসী একটু দম নিয়ে কথা বলবে, যার ক্ষমতাতে কাঁপবে চারদিক। যাকে দেখলে দেশের সব প্রশাসন দাঁড়িয়ে উঠবে।
ছেলের মুখে এমন কথা শুনে বাবা হেমন্ত সেন চুপ হয়ে গেলেন। পরে তিনি আর কখনো তার ছেলেকে চাকরির বাকরির কথা বলেন নি।
.
একসময় হেমন্ত সেন বৃদ্ধ হন। শরীরের চামড়া গুছিয়ে যায় তার। তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। আর অন্যদিকে তার ছেলে সীমান্ত সেন হয়ে ওঠেন দেশের একজন বড় বিজন্যাস ম্যান। যেমনটা তিনি তার বাবাকে বলেছিলেন। চারদিকে সীমান্ত সেনের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে। সীমান্ত সেনের মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর পরই তার ব্যাবসার উন্নতি হতে থাকে। পূর্বে যতটা বড় ছিলো, এখন তার থেকে তিনগুন বড় হয়েছে তার ব্যবসা। নিজের টাকাতে তিনি কয়েকটা স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি হিন্দু হওয়া স্বত্ত্বেও অনেকগুলো মাদ্রাসা, মসজিদ তৈরি করেছেন। তিনি একদিকে যেমন উদার মনের মানুষ, অন্যদিকে তেমন রাগিও।
অনাবিল সুখে ভরপুর তার জীবন। কোন প্রকার অভাব ছাড়া বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটে যাচ্ছিলো তার জীবন। তিনি পরিকল্পনা করেন ব্যবসাটা আরেকটু বড় করেই একটা বিয়ে করবেন। ছয়মাস পর যখন তার ব্যবসাটা বড় আকার ধারণ করলো, তখন তিনি বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে থাকলেন।
ঠিক সেসময়ই হঠাৎ করে তার বাবা হেমন্ত সেন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার বাবা এই অসুখটা প্রায় এক বছর ধরে পুষে আসছিলেন। তিনি এরকম মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তবে এবারে তিনি পূর্বের থেকে দরুণভাবে অসুস্থ হন। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তারেরা জানান, তারা এই রোগের চিকিৎসার কোন উপায় জানেন না। তারা হেমন্ত সেনকে বাইরের কোন ডাক্তার দিয়ে দেখাতে বলেন। সীমান্ত সেন তার বাবাকে বাইরে নেওয়ার ব্যবস্থা করতেই তার বাবার মৃত্যু চলে আসে।
বাবার মৃত্যুতে সীমান্ত সেন মানসিকভাবে খানিকটা দূর্বল হয়ে পড়েন। তবে মাস খানেক যেতে না যেতেই তিনি নিজেকে শক্ত করে নেন। কারণ তিনি ভাবেন, তিনি ভেঙে পড়লে তার সবকিছু দেখাশোনা কে করবে?
.
সীমান্ত সেনের বাবা মারা যাওয়ার বছর খানেক পর তারও একটা জটিল রোগ দেখা দেয়। প্রথমে রোগটাকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও পরে তিনি রোগের বিষয়ে সিরিয়াস হয়ে ওঠেন। রোগটা এতোটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে, রোগের কারণে শরীরে একবার জ্বালাতন শুরু হলে তা আর ঘন্টা খানেকের মধ্যে থামেনা। এর মধ্যে তিনি বিয়েও করেছেন। তার বউ সবসময় তার দেখাশোনা করেন। প্রচুর সেবা যত্নও করেন। তবুও সীমান্ত সেনের সুস্থ হওয়ার কোন আভাসই দেখা যায়না।
সীমান্ত সেন লক্ষ করেন, তার শরীরের ওজন দিনদিন কমে যাচ্ছে। ভালো ভালো খাবার খাওয়া সত্ত্বেও শরীরের অবনতি হয়েই চলেছে। শরীর একদিকে যেমন দূর্বল হয়ে পড়ছে, তেমনি আরেকদিকে শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে তার শরীরে অবস্থিত রোগটা মাথা নাড়া দিয়ে উঠছে। রোগের লক্ষণটা যখন তিনি ধরতে পারলেন, তখন থেকেই তিনি এর প্রতিকারের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। প্রথমে তিনি একজন সাধারণ ডাক্তারকে দেখালে, ডাক্তারটি তাকে জানান, তিনি এই রোগের চিকিৎসা করতে পারবেন। ডাক্তারের কথায় সীমান্ত সেন মাস খানেক সেই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করান। মাস খানেকের মধ্যে ডাক্তার সাহেব সীমান্ত সেনের কাছ থেকে বেশ মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। পরে তিনি জানান, তার দ্বারা এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব না। তার যতটুকু সাধ্য ছিলো, তিনি ততটুকু চেষ্টা করেছেন!
সীমান্ত সেন ডাক্তারের কথায় বিচলিত হয়ে পড়েন। তবে বিচলিত হওয়ার কারণটা টাকার জন্য নয়, বরং তার জীবনের জন্য। এদিকে দিনদিন শরীরটার বেহাল দশা দেখা দিচ্ছে। অতি দ্রুত তিনি ঢাকা শহরের সকল বড় বড় ডাক্তারদের দেখান। তারা কিছুদিন করে তার চিকিৎসা করার পর জানান, তাদের দ্বারাও এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তারা এও বলেন যে, আপনি কোন বড় ডাক্তার দেখান। আপনি চিকিৎসার জন্য মাদ্রাজ যান। তাহলে হয়তো কিছু একটা করতে পারবেন সেখানকার ডাক্তারেরা।
.
সব জায়গায় দেখানো শেষ হলে, কোন জায়গা থেকে কোন প্রকার উপকার না পেয়ে যখন তিনি ক্লান্ত। ঠিক তখনই এক বৃদ্ধ সন্নাসী মতো লোক তার দ্বারে আসেন। সীমান্ত সেন তখন বাড়ির আঙিনায় বিশ্রাম নেওয়ার জায়গাতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। গেটের দারোয়ান এসে তাকে জানায়, এক বৃদ্ধ লোক কিছু সাহায্যের জন্য এসেছেন। প্রথমে তিনি কিছু না দিতে চাইলেও পরে দিলেন। বৃদ্ধকে তিনি কিছু টাকা দেওয়ার সময় বৃদ্ধ লোকটি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তুমি কি অসুস্থ?
সীমান্ত সেন নির্লিপ্ত নয়নে নিচু স্বরে জবাব দিলেন, হ্যাঁ আমি অসুস্থ। প্রায় মাস তিনেক ধরে অসুস্থতায় ভুগছি। শরীরটা দিনদিন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। এখন যদিও হেঁটে চলে খেতে পারি, তবে আমি সিওর যে আগামী ছয়মাস পর আমি আর এটাও পারবোনা।
বৃদ্ধ লোকটি চলে যাওয়ার সময় তাকে বলে গেলেন, বাবা এই ঠিকানাটা রাখো। পারলে এই ঠিকানায় গিয়ে যোগাযোগ করিও।
সীমান্ত সেন বৃদ্ধের হাত থেকে ঠিকানা লেখা কাগজটি নিয়ে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার ঠিকানা। উত্তরে বৃদ্ধ বললেন, আমাদের সখিপুর গ্রামের নিজাম কবিরাজের ঠিকানা এটা। ঐ কবিরাজকে আমি দেখেছি অনেক লোকের অনেক রোগের চিকিৎসা করতে। তুমিও একবার গিয়ে দেখতে পারো।
.
বৃদ্ধ লোকটি চলে যান। সীমান্ত সেন ছোট্ট কাগজ হাতে বৃদ্ধের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তিনি কোনকালেও এসব কবিরাজ টবিরাজে বিশ্বাসী নন। তবুও এবার কেন জানি তার মনে হলো, একবার কবিরাজের কাঁছে গিয়েই দেখিনা। কত তো ডাক্তার দেখালাম। তবুও তো এই রোগের কোন প্রতিকার পেলাম না। যদি এই কবিরাজের দ্বারা কোন প্রতিকার পাই, তবে তো বেঁচে যাবো।
তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সময় করে একদিন তিনি সখিপুর গ্রামের সেই নিজাম কবিরাজের কাছে যাবেন। সিদ্ধান্তে অটল হওয়ার পরেও তার কেমন যেন এসব কবিরাজে বিশ্বাস হচ্ছেনা।
মাস খানেক পার হয়ে গেছে এর মাঝে। সীমান্ত সেনের শরীরটা এখন আগের থেকে একটু ভালো। ভালো হলেও তার অসুস্থতার কোন গতিমতি বোঝা যায়না। কখনো তিনি একটু ভালো থাকেন, আবার কখনো অসুখের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েন। যখন রোগটা সীমান্ত সেনের শরীরে জেগে ওঠে তখন সীমান্ত সেন যেন নিজেকে আর নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারেন না। তার তখন মনে হয়, মৃত্যুটা যেন তার অতি নিকটে চলে এসেছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করেন তিনি তখন। অনেক জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করে যখন রোগের গতিবেগ কিছুটা কমে, তখন তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন। তিনি মনে মনে তখন বলেন, এ যাত্রায় বুঝি বেঁচে গেলাম। আগামী যাত্রায় বাঁচবো কিনা সন্দেহ।
বাড়ি থেকে তিনি তার বউয়ের সাথে একটু আলাপ করে বেরিয়ে পড়েন সখিপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে। নিজাম কবিরাজের দ্বারা ভালো হলে, কবিরাজের কবিরাজিত্ব করার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
অতি ভোরে রওয়ানা দিয়ে বিকেল চারটায় তিনি সখিপুর গ্রামে পৌঁছান। গ্রামের মধ্যে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কোন পথ না থাকায় একটি দোকানের পাশে গাড়ি দাঁড় করান তিনি। দোকানটি ছোট, তবে অনেক জমজমাট। সেটা দোকানের ভীড় দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
সীমান্ত সেন নিজেকে একটু জিড়িয়ে নিতে টঙ দোকানটাতে গিয়ে বসলেন। তিনি সেখানে যেতেই সেখানকার সবাই উনাকে যথেষ্ট সম্মান দিলেন। তিনি দু’কাপ চায়ের অর্ডার করে বসে আছেন। দু’কাপ চা অর্ডার করার কারণ হলো, তিনি তার সাথে তার বাড়ির বিশ্বস্ত কাজের লোক কাঁদেরকেও সাথে নিয়ে এসেছেন। ওদিকে দোকানদার চা তৈরিতে ব্যস্ত, আর এদিকে সীমান্ত সেন সেখানকার লোকজনদের কথা বার্তা শোনায় ব্যস্ত। গ্রামের লোকগুলোর কথা বলার ধরণ দেখে তিনি বুঝে যান, এরা খুবই সহজ সরল প্রজাতির মানুষ। কথা প্রসঙ্গে এক লোক তার পাশে থাকা আরেক লোককে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন “জানো হাসু মিয়া, আমার পোলাডা এখন কথা কইতে পারতাছে। এখন একটু একটু করে খাইতেও শুরু করছে। কবিরাজে কয়ছে, আর কিছুদিন গেইলেই আমার পোলায় আবার আগের মতন হইয়া যাইবো।”
লোকটি কথাটা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন। লোকটিকে কান্না করতে দেখে পাশে থেকে আরকেজন বলে উঠলেন, কাইন্দোনা গো গফুর মিয়া। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, সব ঠিক হইয়া যাইবো। আর পারলে গেরামের মানুষজনরে কিছু সিন্নি খাওয়াইয়ে দিও।
সীমান্ত সেন তাদের কথার সারমর্ম কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন। তিনি মনে মনে ভাবতে থাকলেন সত্যিই কি কবিরাজের চিকিৎসাতে অসুখ সেরে যায়?
“এই নেন স্যার আপনের চা” দোকানদার তার দিকে চা এগিয়ে দিলো।
সীমান্ত সেন ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে একটু চুমুক দিয়ে সেখানে থাকা লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, কবিরাজের চিকিৎসাতে রোগ ভালো হয়?
তার কথা শুনে গফুর মিয়া বলে উঠলেন, সাহেব ভালো হয় মানে? একশোতে একশো ভালো হয়। আমার পোলাডা অসুখের চোঁটে কিরহম যেন করতাছিলো। প্রত্তম দুই দিন আমি তেমন গুরুত্ব দেইনি। পরে পোলাডার অবস্থা খারপ হইতে দেইখা আমাগো গেরামের নিজাম কবিরাজের কাছে নিয়া যাই। নিয়া গেইলে কবিরাজ কন, নিয়মিত চিকিৎসা করাইলে কয়েকদিনেই নাকি আমার পোলা ভালো হইয়া যাইবো। কবিরাজের কথা মতো আমি চিকিৎসা করাইতে থাহি। সপ্তাহ যাইতে না যাইতেই আমার পোলাডা আবার সুস্থ হইয়া ওঠে।
.
গফুর মিয়া কবিরাজ এবং তার ছেলের সম্বন্ধে আরো অনেক কথা বললেন। সীমান্ত সেন তাকে “কবিরাজের বাড়িটা কোনদিকে” জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেন, ঐযে একটা বড় নারিকেল গাছে দেখা যায়। ওখানেই তার বাড়ি।
সীমান্ত সেন চায়ের বিল মিটিয়ে কাঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে কবিরাজ নিজামের বাড়ির দিকে রওয়ানা দেন।
কিছুদূর এগোতেই ঝিড়িঝিড়ি বৃষ্টি হতে শুরু করে। সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠটা পেরোলে তবেই কবিরাজের বাড়ি যাওয়া সম্ভব। কাছে তাদের কোন ছাতাও নেই। অবশ্য বৃষ্টিটাও তেমন গায়ে লাগছেনা। তবে মেঘের কারচুপিতে বোঝা যাচ্ছে অতি শিঘ্রই জোড়ে বৃষ্টি নামতে পারে।
হাঁটতে হাঁটতে যখন তারা মাঠটির একেবারে কাছে চলে এলেন, তখন সীমান্ত সেন খেয়াল করলেন মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে দুজন লোক কথা বলছেন। বৃষ্টিও আগের থেকে হালকা বেড়েছে।
মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুটির মধ্যে একজনের পরনে কালো জুব্বা টাইপ কিছু একটা পড়া, মাথায় টুপি আবার হাতে বিভিন্ন রকমের তজবি। সীমান্ত সেন ভাবেন, সামনে গিয়ে লোকটিকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি কবিরাজের বাড়ি আর কতদূর! বৃষ্টির জন্য চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। আকাশে মেঘেরা দল বেঁধে জড়ো হচ্ছে। মাঠের ওপারে কি আছে, সেটা বোঝার কোন উপায় দেখছেনা তারা।
দাঁড়িয়ে থাকা পথটি ছেড়ে মাঠের সরু পথে নেমে পড়লেন তারা। যখন তারা ঐ লোক দুটি থেকে হাত দশেক দূরে পৌছলেন। তখন সীমান্ত সেন লক্ষ করলেন, এই অনাবিরত বৃষ্টি হওয়া স্বত্তেও কালো জুব্বা পড়া লোকটির মধ্যে তেমন কোন রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছেনা। অথচ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বৃষ্টির পানির কারণে ঠান্ডাতে কাঁপতে শুরু করেছে। ঐ লোকটি জুব্বা পড়া লোকটিকে কি যেন বলছেন। দেখে বোঝা যাচ্ছে, হয়তো কোন বিষয় নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত। আর সে কারণেই হয়তো তিনি জুব্বা পড়া লোকটিকে অনুরোধের স্বরে কিছু বলছেন। কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে সীমান্ত সেন শুধু এটুকু বুঝতে পারেন যে, একজন লোক বিপদে পড়ে আরেকজনের কাছে সাহায্য চাচ্ছেন।
ধীরে ধীরে তারা লোক দুটির দিকে এগোতে থাকলেন। যখন তারা লোক দুটির অতি নিকটে চলে গেলেন, তখন ঐ জুব্বা পড়া লোকটি তাদেরকে সালাম দিলেন। সীমান্ত সেন সালামের উত্তর দিলেন। যদিও তিনি হিন্দু, তবুও তিনি কোন ধর্মকে ছোট মনে করেন না, নিজের ধর্ম নিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের সাথে বাড়াবাড়িও করেন না।
তিনি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, এই গ্রামে নিজাম নামে যে কবিরাজ থাকে তার বাড়ি এখান থেকে আর কতদূর?
কথাটা শুনে লোকটির কি হলো, সেটা তিনি আর উপরওয়ালা জানেন। কথাটা শোনা মাত্রই লোকটি উচ্চস্বর মিশ্রিত হাসিতে চারদিক মুখোরিত করে তুললেন। সীমান্ত সেন লোকটির সেই হাসির কারণটা বুঝতে পারলেন না। তিনি একবার লোকটির দিকে তাকান আরেকবার কাঁদেরের দিকে তাকান। কাঁদেরকে তিনি ইশারায় জিজ্ঞেস করেন, লোকটির হাসার কারণ সে জানে কিনা! কিন্তু লোকটির অমন হাসার কারণ কাঁদেরেরও জানা নেই।
কিছু সময় পর হাসি থামিয়ে লোকটি বললেন, চলুন আমার সাথে। সীমান্ত সেন এবং কাঁদের লোকটির পিছু পিছু যেতে থাকলেন। বৃষ্টির বেগ ততক্ষণে আরো একটু বেড়ে গেছে।
মাঠ পার হতে আর একটু পথ বাকি। ঠিক সেসময় হঠাৎ করেই সীমান্ত সেন অসুস্থ হয়ে পড়েন। শরীরে তার কোন শক্তিই নেই তখন। হাত পা একদম ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
কাঁদের আর লোকটি তাকে ধরে বাড়ির দিকে নিয়ে যান। যখন তারা বাড়িতে পৌছলেন, তখন কাঁদের অালী বুঝতে পারলেন এই লোকটিই সেই নিজাম কবিরাজ।
তিনি সীমান্ত সেনকে ঝারফুঁক করেন, পানি পড়ে মুখে ছিটিয়ে দেন। তবু সীমান্ত সেনের জ্ঞান ফেরেনা। এদিকে কাঁদের খুব চিন্তার মধ্যে আছেন। তিনি ভাবছে যদি তার মনিব মারা যায়!
ঘন্টা খানেক ধরে ঝাড়ফুঁক করেও যখন তার জ্ঞান ফিরলোনা, তখন নিজাম তার কবিরাজি প্রয়োগ ছেড়ে দিলেন।
তিনি বুঝলেন, এ রোগ তার দ্বারা উপশম করা সম্ভব নয়। যদি জ্বিন পরীর আচড় পড়তো সীমান্ত সেনের উপরে, তবে তিনি সেটার ভার নিতে পারতেন।
.
বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যে সন্ধ্যে ভাব, সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, সূর্যের লালচে আভা তখনও দেখা যাচ্ছে, ঠিক তখন সীমান্ত সেনের জ্ঞান ফিরলো। তিনি দুচোখ মেলে চারিদিকে একবার দৃষ্টি গোচর করলেন। তিনি অনুভব করলেন তার কপালে কিছু একটা দেওয়া। কপালে হাত দিতেই তিনি বুঝলেন, তার অসুস্থতার সময় জলপট্টি করে মাথায় দেওয়া হয়েছিলো। কাঁদের তার মনিবকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে যেন তার দেহে তিনি প্রাণ ফিরে পেলেন।
সীমান্ত সেন কাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তার অসুস্থতার সময় তাকে সেই নিজাম কবিরাজের বাড়ি নেওয়া হয়েছিলো কিনা! তখন কাঁদের একটু ইতস্তত বোধ করলেন। তিনি কিছু বলতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে কবিরাজ নিজামই বলে উঠলেন, সাহেব আপনের এই রোগের চিকিৎসা আমার দ্বারা সম্ভব না। আপনি মাদ্রাজ যান। সেখানকার ভালো একটা ডাক্তারকে দেখান। যদি আপনার উপর কোন জ্বীন, পরী, আত্মা এসব ভর করতো, তবে আমি সেটার একটা ব্যবস্থা নিতাম। কিন্তু আপনের যে রোগ হয়েছে, তা সারানো আমার কষ্টসাধ্য। আমি এই রোগের চিকিৎসা জানিনা।
.
সেদিন রাতেই সীমান্ত সেন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ঢাকাতে এসে তিনি মাদ্রাজে যাওয়ার জন্য সবকিছু ঠিকঠাক করেন। আগামী মাসে তার ফ্লাইট। তিনি ঢাকাতে আসার পর বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগটাকে কিছু সময় দমিয়ে রাখার জন্য তার পরিচিত ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার জানান, এই রোগ নাকি ছোঁয়াচে রোগ।
যখনই তার পরিবারের সবাই জানতে পারলেন, রোগটা ছোঁয়াচে। ঠিক তখন থেকেই সবাই তার কাছে থেকে দূরে চলে যেতে থাকলেন। তার সহধর্মীনি স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেলেন। এখন তিনি একেবারে একা। ভীষণ একা।
পরের মাসে ফ্লাইটের সময় হয়ে গেলে তিনি মাদ্রাজ চলে যান। সেখানকার নামকরা একটা হোটেলে ওঠেন তিনি। খুব কম সময়ে তিনি প্রচুর টাকা ইনকাম করেছেন। যা আগামী দশ বছর কোন কাজ না করে শুয়ে বসে, ফূর্তি করে কাটালেও শেষ হবেনা।
তিনি সেখানকার সবচেয়ে বড় হাসপাতলের বড় ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার জানান, তার এই রোগের ঔষুধ আছে, তবে তিনি এটা তাকে দিতে পারবেন না। সীমান্ত সেন “না দেওয়ার” কারণ জানতে চাইলে ডাক্তার তেমন কিছুই বলেন না। সীমান্ত সেন ডাক্তারকে “তার কি রোগ হয়েছে” এটা জিজ্ঞেস করলে ডাক্তার তাকে বলেন, আপনার সাথে কেউ আসলে তাকে পাঠিয়ে দিন। সীমান্ত সেন বুঝতে পারলেন, ডাক্তার কেন অন্য কাউকে ভিতরে আসার জন্য বলছেন! তিনি বললেন, যা বলার আমাকেই বলুন। আমি শক্ত আছি। আপনি কি এমন বলবেন? আমি আর কয়েকমাস পর মারা যাবো, এটা বলবেন তো?
ডাক্তার তার কথা শুনে অবাক থেকে অধিকতর অবাক হলেন। তিনি এমন রোগি কখনও দেখেননি। তিনি বললেন, আপনার কথাটাই ঠিক। আপনার সময় প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। আপনি কম করে হলেও আর সাত থেকে আট মাস বাঁচবেন।
সীমান্ত সেন ডাক্তারের এমন কথা শুনে কিছুক্ষণ হেঁসে বললেন, আপনি গ্যারান্টি দিচ্ছেন? ডাক্তার তাকে আরেকবার চেকআপ করে বললেন, হ্যাঁ গ্যারান্টি দিচ্ছি। সীমান্ত সেনের কাছে মনে হচ্ছে তিনি এখনো দুই তিন বছর বেঁচে থাকবেন। তিনি ডাক্তারের কথার বিরুদ্ধে বললেন, আপনি লিখিত কাগজ দিয়ে বলুন যে আমি আর মাত্র সাত থেকে আট মাস বাঁচবো। ডাক্তার দেখলেন, ইনি তো আট মাস দূরের কথা ছয়মাসেও মারা যেতে পারেন। তাই তিনি কাগজে লিখে দিলেন, আট মাস বাঁচার কথা।
সীমান্ত সেন কাগজটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন ডাক্তারের চেম্বার থেকে। তার মাথাটা বেশ গরম হয়ে আছে। তিনি ভাবছেন, তার কি এমন অসুখ হলো, যেই অসুখের ঔষুধ থাকা স্বত্তেও ডাক্তার সেই ঔষুদ দিতে নারাজ। আর তার মাথা গরম হওয়ার আরেকটা কারণ হলো, ডাক্তারের দেওয়া তার বেঁচে থাকার গ্যারন্টির কথা। তিনি কিসের ভিত্তিতে বলেন, তিনি আর মাত্র আট মাস বেঁচে থাকবেন। এটা তাে মাথায় কিছুতেই ঢোকেনা।
তিনি দেখলেন ডাক্তার তো আর এমনি এমনিতেই ডাক্তার হন নি। তাও আবার পুরো দেশের মধ্যে নামকরা হাসপাতালের একজন প্রধান ডাক্তার। তার এমন কথার পেছনেও যথেষ্ট কারণ আছে।
.
মৃত্যুকে সামনে রেখে তিনি তার উপার্জিত টাকার সদ্ব্যবহার করতে লাগলেন। আনন্দ ফূর্তিতে মেতে উঠলেন তিনি। আর কখনো আনন্দ ফূর্তি করার সময় পাবেন কিনা সেটা সন্দেহ।
তিনি সারাদিন যেখানেই ঘোরাঘুরি করেন না কেন, খাওয়ার সময় হলে তিনি তার ওঠা হোটেলে এসেই খাওয়া দাওয়া করেন। হোটেলের ডাইনিংয়ের জায়গাটাও বেশ পরিপাটি। নিচের পুরো ফ্লোরটা খাওয়া দাওয়া করার জন্য। আর দ্বিতীয় তলা থেকে থাকার জন্য রুম করা।
তিনি যখন খেতে আসতেন তখন তিনি তার খাবারের সাথে মাংস রাখতেন। তিনি যেই খাবারই খেতেন তার সাথে কম করে হলেও মাংসটা খেতেন। সেখানকার খাবার এতোটাই সুস্বাদু যে, যতবার তিনি খান ততবারই তার নেশা ধরে যায় খাবারের প্রতি।
অানন্দ ফুূর্তির মাঝে তার তিনটা মাস কেটে গেলো। তিনি আগের থেকে নিজেকে একটু সুস্থ বোধ করছেন। তিন মাস আগেও তিনি বারবার অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কিন্তু গত দুই মাসে তিনি একবারও অসুস্থ হন নি। বরং তার কাছে নিজেকে আরো সুস্থ মনে হতে থাকে।
তিন মাস, চার মাস, পাঁচ মাস, এভাবে সাতটি মাস কেঁটে যায়। সাত মাস পর তিনি নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে অবাক হয়ে যান। সাত মাস আগে তার শরীরের অবস্থা ছিলো কাহিল, আর এখন একেবারে তরতাজা। আর আরেকটা অবাক করা বিষয় হলো, তিনি এখন এতোটাই সুস্থ যে, তিনি মরার কথা চিন্তাও করেন না। তিনি নিজেই নিজেকে বলেন, আমাদের দেশের ডাক্তারদের মতো এখানকার ডাক্তাররাও কি সব ভুয়া সার্টিফিকেটের দ্বারা ডাক্তার হয়েছে নাকি? সবাই টাকা কামানোর ধান্দাতে থাকে। রোগীরা ঠিকমতো চিকিৎসা পাক বা না পাক। তারা ঠিকমতো বেতন পেলেই হলো।
.
আর মাত্র একদিন। তারপরেই ডাক্তারের দেওয়া সেই আটমাস পূর্ণ হবে। সীমান্ত সেনের খুশি যেন আর ধরেনা। এই প্রথম তিনি কোন ডাক্তারের মুখোমুখি হবেন, তার ডাক্তারিত্ব নিয়ে।
পরদিন সকাল হলেই তিনি হাসপাতালে চলে যান। ডাক্তার আসতে এখনো ঘন্টা খানেক দেরি। তিনি ওয়েটিং রুমে বসে আছেন। আর ভাবছেন, এদেশের আবহাওয়া কত সুন্দর। এদেশে না আসলে বোধ হয় তিনি জীবনটাকে ভালোভাবে উপভোগই করতে পারতেন না। তিনি মনে মনে তার মধ্যে হওয়া রোগটাকেও ধন্যবাদ জানান। এসবের পেছনে রোগটারও অবদান অনেক।
অপেক্ষার পালা শেষ করে ডাক্তার আসলেন। ডাক্তার তার রুমে ঢোকা মাত্রই সীমান্ত সেন সেই লিখিত কাগজখানা নিয়ে তার রুমে ঢুকে টেবিলের উপর একটা থাবা দিয়ে বললেন, এই নিন আপনার কাগজ। এসব ডাক্তারের নামে ভন্ডামি ছাড়ুন। আপনি কি যেন বলেছিলেন? আমি আর অাট মাস বাঁচবো? আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন আট মাস ঠিকই পার হয়ে গেছে। তার উপর আবার আমার শরীরটারও উন্নতি হয়েছে।
ডাক্তার টানা আট মাস পর সীমান্ত সেনকে এরকম সুস্থ সবল দেখে বেশ অবাক হলেন। কারণ তার তো এতোদিনে মারা যাওয়ার কথা।
তিনি সীমান্ত সেনকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি তিনবেলা খাবার খেতেন? সীমান্ত সেন বললেন, হ্যাঁ আমি তিন বেলাই খেতাম।
ডাক্তার আবার বললেন, আপনি কি প্রতি বেলাতেই খাবারের সাথে মাংস খেতেন?
সীমান্ত সেন আবারও বলেন, হ্যাঁ খেতাম।
ডাক্তার এবার খানিক উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আপনি কি সবসময় একই জায়গায় মানে একই হোটেল খেতেন?
সীমান্ত সেন আবার বললেন। হ্যাঁ খেতাম। তবে আপনি এসব কথা জানলেন কি করে?
ডাক্তার এবার সীমান্ত সেনের কথার কোন উত্তর না দিয়ে পাল্টা তাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি যেই হোটেলে খেতেন, সেই হোটেলের নাম বলুন। সীমান্ত সেন হোটেলটার নাম বলার সাথে সাথেই তিনি পুলিশকে ফোন করেন এবং বলেন আপনাদের শক্তিশালী একটা ফোর্স নিয়ে “hotel of king” হোটেলটা ঘিরে ফেলুন। আমি একটু পরেই সেখানে আসছি।
সীমান্ত সেন ডাক্তারকে বললেন, কি হয়েছে ডাক্তার সাহেব?
তিনি কোন উত্তর না দিয়ে বললেন, চলুন আমার সাথে।
তারা হোটেলের সামনে পৌছে দেখেন পুলিশ দিয়ে পুরো হোটেল ঘেরা হয়ে গেছে। ডাক্তার এবার পুলিশের অফিসারদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা আমার সাথে আসুন। ডাক্তার তাদেরকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বললেন, যেখান রান্নার কাজ করা হয়, সেখানকার পুরো তল্লাসি নিন। সেখানকার কোন পরিত্যাক্ত রুমও যেন বাদ না পড়ে। পুলিশ অফিসারেরা রান্না ঘরের দিকে গেলেন সেখান তারা সন্দেহজনক কোন কিছুই পেলেন না। যখন তারা সেখান থেকে চলে আসতে যাবেন, ঠিক তখনই পাশে থেকে ডাক্তার বলে ওঠেন। আপনারা ঐ তালা ঝুলানো রুমটা চেক করেছেন? অফিসারেরা উত্তর দেয়, না করিনি। তখন তিনি বললেন, আপনারা এখনই ঐ রুমটা চেক করুন।
এসব কি হচ্ছে, সীমান্ত সেন তার কিছুই বুঝছেন না। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, হঠাৎ এই ডাক্তারের আবার কি হলো! ডাক্তার পাগল হয়ে গেলেন না তো?
রুমের তালা খুলতে বলাতে হোটেল মালিক এবং সেখানকার কর্মচারীরা তালা খুলতে নারাজ। তারা ভয়ার্ত কন্ঠে বারবার বলেই চলেছেন, এর ভেতরে কিছুই নেই স্যার।
পুলিশ অফিসার বললেন, যদি আপনারা তালা না খোলেন, তবে আমাদেরকেই খুলতে হবে। আর যদি আমরা খুলি, তাহলে কিন্তু অনেক খারাপ হয়ে যাবে। পুলিশের এমন হুমকি শুনে হোটেল মালিকের নির্দেশে একজন বাবুর্চি রুমটার দরজা খুলে দিলেন।
রুমটা অন্ধকার। তবে রুমের ভেতরের এক কোণায় একটা মৃদু মৃদু আলো জ্বলছে। আলোটা এতই কম পরিমাণে জ্বলছে যে, রুমের মধ্যে কি অাছে সেটা বোঝার কোন উপায় নেই। বাবুর্চিকে আলো জ্বালাতে বললে বাবুর্চি আলো জ্বালায়। আলো জ্বালানোর সাথে সাথেই রুমের মধ্যে প্রায় শতাধিক শিশুকে দেখা যায়। সবার মুখ বাধা, হাত পা বাধা।
তালা ঝুলানো অন্ধকার রুমে এতো এতো বাচ্চা দেখতে পেয়ে সীমান্ত সেন অবাক হয়ে গেলেন। এদিকে হোটেল মালিক দৌড় দিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা খেলেন। সেখানকার যত কর্মচারী ছিলো সবাইকেই আটক করা হলো।
পুলিশ অফিসার এবার মৃদু মৃদু আলো জ্বলা রুমটার দিকে এগিয়ে গেলেন, সাথে সীমান্ত সেন এবং ডাক্তারও।
সেখানে গিয়ে তারা আরো একবার অবাক হলেন। কারণ সেটা কোন রুম নয়, করং কসাই খানা।
সবাইকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ ডাক্তারকে একটা ধন্যবাদ দিলেন। আর বললেন, আপনি আমাদের সবচেয়ে বড় কেসটা সলভ করতে সাহায্য করেছেন। ডাক্তার বললেন, ধন্যবাদ আমাকে নয়, এনাকে দিন (সীমান্ত সেনকে উদ্দেশ্য করে)।
কারণ এনার জন্যই এইসব কুচক্রি অপরাধীদের ধরতে পারলেন আপনারা।
.
সবকিছু শেষ হওয়ার পরেও সীমান্ত সেন কিছুই বুঝতে পারলেন না, কি হলো এসব! ডাক্তারকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এসব কি হলো?
ডাক্তার বললেন, আপনাকে আমি বলেছিলাম না যে “আপনার মধ্যে থাকা রোগের ঔষুধ আছে, তবে সেটা আমি আপনাকে দিতে পারবোনা?।
সীমান্ত সেন বলেন, হ্যাঁ বলেছিলেন। তো?
ডাক্তার এবার খানিক্ষণ চুপ থেকে বললেন, একমাত্র মানুষের মাংসই ছিলো আপনার ঐ রোগটির ঔষুধ। কিন্তু আমি একজন ডাক্তার হয়ে কি করে একজনকে মেরে আরেকজন বাঁচাই?
সীমান্ত সেন ডাক্তারের কথার কোন মানে বুঝলেন না। সবকিছু যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, মানে?
ডাক্তার বললেন, আপনি এখানে বসুন।
সীমান্ত সেন চেয়ার টেনে বসার পর ডাক্তার তাকে বললেন, আপনাকে আমি আট মাস মেয়াদ দিয়েছিলাম যে “আপনি আর মাত্র আটমাস বেঁচে থাকবেন। কিন্তু যখন দেখলাম আপনি আটমাস পরেও সুস্থ আছেন, ঠিক তখনই আমার মনে সন্দেহ জাগলো ‘আপনার তো সুস্থ হওয়ার কথা ছিলোনা।’ কারণ আপনাকে সুস্থ হতে হলে মানুষের মাংস খেতে হবে। আর সেজন্য আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কোন হোটেলে খাবার খেতেন। যখনই আপনি বললেন “hotel of king” এর কথা। তখনই আমি বুঝতে পারলাম, সেখানে মানুষকে কেটে তাদের মাংস দিয়ে খাবার পরিবেশন করা হয়। আর আমার মনে তখন আরেকটা বিষয় উঁকি দিলো। আর সেটা হলো, আমাদের দেশ থেকে প্রতি মাসেই প্রায় ৫০ জন করে শিশু হারিয়ে যায়। আমি ভেবে নিলাম সেই শিশুগুলোই হয়তো মানুষের খাদ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সীমান্ত সেন যেন স্তব্দ হয়ে গেছেন। তিনি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। তার “সব ডাক্তারগুলোই হলো সার্টিফিকেট ধারী ডাক্তার, কেউ সত্যিকারের ডাক্তার নয়” এই কথাটি ভুল প্রমাণিত হলো এবার।
তিনি বুঝলেন, কেউ এমনি এমনিতে ডাক্তার হয়না। সবাই পড়ালেখা করেই ডাক্তার হয়।
.
পরে জানা যায়, সেই হোটেল মালিক হলেন সে দেশেরই খাদ্যমন্ত্রী। সেই ঘটনার পর থেকে তাকে এবং তার হোটেলের নামকরণ করা হয় “মানুষখেকো।”

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৭ Comments

  1. আখলাকুর রহমান

    লেখনীর মধ্যে থাকা ভুলগুলো তুলে ধরলাম।

    অভাব কি – কী

    করবোনা – করবো না (“না” আলাদা শব্দ)

    বিসন্যাস – বিজনেস

    বলেন নি – বলেননি (“নি” শব্দের সাথে বসে)

    ব্যাবসার – ব্যবসার

    দরুণভাবে – দারুণভাবে

    লক্ষ – লক্ষ্য

    এটা কার ঠিকানা। – এটা কার ঠিকানা? (বাক্যের শেষে “?” হবে)

    কাঁছে – কাছে

    জিড়িয়ে – জিরিয়ে

    কাঁদেরকে – কাদেরকে

    বাড়িটা কোনদিকে – বাড়িটা কোনদিকে ? (“?” হবে শেষে)

    ঝিড়িঝিড়ি – ঝিরিঝিরি

     ওপারে কি  – কী

    পৌছলেন – পৌঁছালেন

    জুব্বা পড়া – পরা

    কি যেন – কী যেন

    ঝারফুঁক – ঝাড়ফুঁক

    আচড় পড়তো – আছর পড়তো (জ্বিনেদের আছর ব্যবহৃত হয় সাধারণত)

    দুচোখ – দু’চোখ

    হেঁসে – হেসে

    বেড়িয়ে এলেন – বেরিয়ে

    ঔষুদ – ঔষধ অথবা ওষুধ শব্দ ব্যবহার করবেন

    গ্যারন্টির – গ্যারান্টির

    কি হয়েছে – কী

    পৌছে – পৌঁছে

    পরিত্যাক্ত – পরিত্যক্ত

    স্তব্দ – স্তব্ধ

    অনেক ভালো ছিল। শেষাংসের উপস্থাপনার কারণে বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছে।
    শুভ কামনা রইল!

    Reply
  2. Srabon Ahmed

    ধন্যবাদ প্রিয়।

    Reply
  3. Tasfiya Tanha Jhum

    wow…nice.eta ki real naki just kolpona.tobe emon rog jeno Allah karo na dei.

    Reply
  4. Parvej Mosharof

    শেষ অংশ বেশ চমকে দিলো।।। তবে শেষ অংশ আরো একটু বিশ্লেষণ করলে ভালো হতো।

    Reply
  5. মাহফুজা সালওয়া

    ভালো লাগলো।
    রহস্যে ঘেরা ছিলো পুরোটাই।
    তবে,বানান এবং বিরামচিহ্নের ব্যাপারে বিশেষ সচেতনতা অবলম্বন করবেন। বেস্ট অব লাক

    Reply
  6. আফরোজা আক্তার ইতি

    দারুণ লিখেছেন। লেখক এমন লেখার জন্য প্রশংসার দাবী রাখে ঠিকই। লেখনী আর উপস্থাপন অসাধারণ। পাঠক মুগ্ধ হবে সহজেই। শেষের অংশে চমকটা দারুণ ছিল।
    বানানে বেশ কিছু ভুল আছে। সংশোধন করে দেই।
    বিসন্যাস- বিজনেস।
    কাঁছে- কাছে।
    আচড় পড়তো- আছড় পড়তো।
    ঔষুদ- ঔষধ।
    পৌছে- পৌঁছে।
    স্তব্দ- স্তব্ধ।

    Reply
  7. srabon ahmed

    আন্তরিক ধন্যবাদ প্রিয়

    Reply

Leave a Reply to srabon ahmed Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *