লাল জামা নীল ঈদ
প্রকাশিত: অগাস্ট ২২, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 1,646 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

একদিন পরেই ঈদ। চোখে ঘুম আসে না নাজনীনের। জোবায়ের, নাঈম, জাহিদ, মনি, সিমা, বন্যারা ঈদের নতুন জামা কিনেছে। ঈদের আগে সবাই বলে কিনেছি কিন্তু কেউ দেখাতে চায় না। দেখালে না কি নতুন জামা পুরাতন হয়ে যায়। তখন আর ঈদের দিনের বিশেষত্ব কি! নাজনিনও বলেছে তার একটা জামা কিনছে। লাল জামা। তাই তার একটা লাল জামা চাই। দাদি বলত, নাজনীনকে লাল জামায় দারুণ মানায়। ঠিক যেন লাল পরী। চোখছানাবড়া হত নাজনীনের। তার মানে দাদি লাল পরী দেখেছে। আর সেও লাল পরীর মত! মনে ইচ্ছে হয় পরীদের মত আকাশে উড়তে!
বাবা রিক্সা নিয়ে গেছেন সেই সকালে এখনো ফেরেনি। কয়টা বাজে কে জানে? দাদি থাকলে তারা দেখে সময় বলত। তিনিও তো চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দিন হলে দৌড়ে গিয়ে জোবায়েরদের বাড়িতে ঘড়ি দেখে আসত। রাসেল স্যার সেদিন ক্লাসে ঘড়ি এনে শিখিয়েছেন কিভাবে সময় বলতে হয়।
ও মা, আব্বা আইসে নাই?
না, আইসে নাই। তুই এলাও নিদ আসিস নাই ক্যা? নিদ আয়। সালেহা বেগম কাঁদোকাঁদো গলায় বেশ জোড়েই বললেন।
আইচ্ছা মা, আব্বা আইতত নিদ আইসে না ক্যা?
এত বড় ধাঙড়ী হইছিস বুঝিস না ক্যা! যদি নিদ আসিল হয় খাইলঙ হয় কি? ঈদের সময় আইতত ভাড়া পাওয়া যায় বেশি।
সেই সকাল বেলা গেইছে সারাদিন খাইছে কি?
তুই নিদ আয়তো আও কারিস না। সারাদিন প্যানরপ্যানর।
গো মা, আব্বা আইজ মোর নাল জামা নিয়া আইস্পে? যদি আনে মোক ডাকাবু মুই দেখিম হেনা। আর সকালে গাত দেইম। মা সবাই কিনছে নয়া জামা।
আনবে এলা। তুই নিদ আয় মুই নিদ আনু। বলে পাশ ফেরে সালেহা বেগম। নাজনিন ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পরে। সালেহা বেগমের চোখে ঘুম আসে না প্রতিক্ষায় থাকে কখন তার স্বামী ফিরবে।
***
মোকসেদ আলী তার পা চালিত রিক্সা নিয়ে বাস স্ট্যান্ড, রেল স্টেশন, অটো স্ট্যান্ড, কলেজ মোর, স্থান গুলাতে ঘুরে-ফিরেও তেমন ভাড়া পেলেন না! বর্তমানে মানুষ আর এই প্রাচীন রিক্সায় চরতে চান না। সবাই এখন অটো রিক্সায় যাতায়াত করে। মোকসেদ আলীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। লুঙির কোঁচা থেকে বিড়ি-ম্যাচ বাহির করে বিড়ি ধরায়। চিন্তা কমে না। তার একমাত্র মেয়ে বায়না ধরেছে লাল জামার। আজ তাকে কিনে নিয়ে যেতেই হবে। এতকিছু ভাবতেই এক ভদ্রলোক তার রিক্সায় উঠে বসে তার অর্ধেক বয়সের এক মেয়েকে নিয়ে! ওঠেই যেতে বলল। মোকসেদ আলী ছুটলেন গন্তব্যে।
***
রাত দুইটা। তবুও শহরের দোকানগুলোর চাকচিক্য ও মানুষের আনাগোনা দেখে রাত আট টা বললেও মেনে নেয়া যায়। মোকসেদ আলী কয়েকটা দোকানে খোঁজার পর অবশেষে একটা দোকানে খুব সুন্দর একটা লাল জামা পছন্দ করলেন। বউ এর জন্য একটি শাড়ি আর নিজের জন্য একটা পাঞ্জাবি পছন্দ করলেন।
ভাই, এই তিনডার দাম কত?
জামা ১২০০/-, শাড়ি ১৫০০/-, পাঞ্জাবি ১১০০/-
ও আচ্ছা, পাঞ্জাবিটা বাদ দেন। জামা আর শাড়ির দাম কত নিবেন?
ভাই এক রেট! তারপরও আপনার জন্য ২০০/- বাদ ২৫০০/- দেন। মোকসেদ আলী ভেবে পায় না কি করবে! সবমিলিয়ে তার কাছে আছে ৮৪৫ টাকা। এখন সে কি করবে! তার ১৩ বছর আগের বিয়ের পাঞ্জাবিটা ঠিকই আছে। ধুয়ে ইস্ত্রি করলে সেই নতুনই মনে হয়। গায়ে দিলে নিজেকে সেই প্রথম দিনের লাজুক বর মনে হয়। ঠোঁটের কোনে হাসি জমে তার। সেই হাসি বেশিক্ষণ থাকে না বৌয়ের শাড়ি না কিনলে নয়। শাড়ি ছিরে গেছে ঈদ না হয় বাদই দিলাম পরার মতও কিছু নাই কিন্তু কি করার শুধু মেয়ের জন্য লাল জামা কেনার সিদ্ধান্ত নেয় সে। এই নাল জামা গাত দিলে বেটিকে মোর আজকন্যার মত দেখা যাইবে। মনেমনে ভাবে মোকসেদ। দোকানদার বিরক্ত হয় এমন ক্রেতা দেখে।
ভাই কি হলো না কিনলে বলেন! দেখেন না দোকানে কি ভির অন্যরা বসতে পারে না আর আপনি কি ভাবছেন। বেশ ঝাঁঝালো গলায় বিরক্ত মুখে দোকানদার বলেন। মনেমনে দোকানদারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করলেও মুখে কিছু বলে না মোকসেদ আলী।
ভাই এই দুইটা ৮০০ টাকা দেই!
দূর মিয়া আপনি একটার দামও বলেন নাই। যান আপনি কিনতে পাবেন না।
আচ্ছা কাপড়টা আকেন। জামাটার এক দাম কন। কত হইলে দিবেন? পাশে একটা মেয়ে তার গায়ে জামার উপর ধরে বলেন
বেটিটাক খুউব সুন্দর দেখা যাইবে। বেটিটা কি খুঁশি যে হইবে।
এক দাম হাজার টাকা!
ভাই ৬৫০ টাকা দেই।
না ভাই হবে না আপনি যান তো সেই তখন থেকে কি শুরু করছেন?
আচ্ছা আর ৫০ টাকা দেই দেন তো।
আপনার জন্য একদাম ৯০০ টাকা তার কম একটাকা হলেও দিব না!
মালিক দূরে দাঁড়িয়ে এরকম দাম কষাকষি দেখে শেষে ৭৫০ টাকা দিয়ে মোকসেদ আলীকে কিনতে বলল। মোকসেদ আলী কিনে নিলেন। মালিক একটু দোকানের বাইরে পিছনে পিছনে এসে জিজ্ঞাস করলেন,
আচ্ছা ভাই আপনি পাঞ্জাবি আর শাড়ি দাম করলেন কিনলেন না কেন?
হামার বিয়ের যে পাঞ্জাবি আছে ঐটা দিয়ে এবারের ঈদ না হয় পার করলঙ। পরিবারের শাড়ি কেনার ইচ্ছা আছিল টাহা নাই। দেখি ঈদের পর কিনবার পাই কি না!
আসেন আমি দিচ্ছি আপনাকে পাঞ্জাবি-শাড়ি।
না ভাই নাগবে না! বলে হনহন করে চললেন মোকসেদ আলী। সেদিকে চেয়ে থাকল দোকানমালিক। মোকসেদ আলী বাকি টাকা দিয়ে সেমাই চিনি কিনে। তারপর রিক্সার প্যাডেলে পা দিয়ে সোজা বাড়ির দিকে যেতে লাগল। আজ কোন যাত্রী তোলা নয়। মুখের সামনে ভেসে ওঠে বৌ ও মেয়ের মুখ আহা তারা আজ কি খুঁশি যে হবে। বৌটা আসার আগে কত করে বলল, হামার কিছুই কেনা নাগব্যার নয় নাজনিনের একটা জামা আর তোমার একটা পাঞ্জাবি কিনেন!
***
আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম। মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিন এর আজান। ঘুম ভাঙ্গে নাজনিনের। মাকে ডাকে,
গো মা! আব্বা আইসে নাই এলাও? আজ না ঈদ। নাজনিনের ডাকে পানি আসে সালেহা বেগমের। চিন্তায় কাঁতর হয়! লোকটা এলাও নাই। না যাত্রীর ভীর। নাজনিন আবারো ডাকে
মা, আও না কারিস ক্যা! অন্ধকারে চোখের পানি আঁচলে চোখ মুছে সালেহা বেগম।
তুই নিদ আসিস নাই?
আচ্ছিনু তো! আজান শুনি উঠনু। আব্বা আইসে নাই?
না।
তুই নামায পরব্যার নইস?
হ পরিম।
উঠ নামায পর। সে সময় তাদের বাড়িতে শোনা যায় কয়েকজন মানুষের আনাগোনা। কান খারা করেন সালেহা বেগম। বুকটা ধড়ফড় করে উঠে।
ভাবি দরজা খোলোতো। সালেহা বেগম দেরি না করে দরজা খুলে দেয় তাড়াতাড়ি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন। এক জনের হাতে জামা ও সেমাই চিনির প্যাকেট। ভানে শুয়ে আছেন কেউ একজন অদূরে। তারও একটু দূরে ভাঙ্গা রিক্সাটা পরে আছে। তাদের মধ্যে একজন বলা শুরু করল,
মোকসেদ ভাই যখন গলি থাকি মেইন ওডে যাইবে সেই সময় পিছন থাকি এক যাত্রী শালা ডাক দিছে। পিছনে মোকসেদ ভাই দেখতে একটা শুয়রের বাচ্চা জেএস আসি এমন ধাক্কা দিল। হামরা ইক্সা ছাড়ি দৌড়ি গেইলম। ততক্ষণে শুয়রের বাচ্চা উদাও। মোকসেদ ভাই মুখ থুবড়ি পরি আছে। আর একটু দূরে ভাঙ্গা ইক্সা আর প্যাকেট পরি।………….
লোকটা আর কি বলছিল তা কানে যায়না সালেহা বেগমের।
ও আল্লাহ গো এলা হামার কি হইবে? বলে লাশের উপর পরে জ্ঞান হারালেন সালেহা বেগম। নাজনিন জামার প্যাকেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দিয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল,
ও আব্বাগো মুই নাল জামা চাঙ না তোমরা আও কারো।
(লাল জামা নীল ঈদ _ জরীফ উদ্দীন)

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৯ Comments

  1. মতিয়ার রহমান

    শেষে খুব দুঃখ পেলাম। গল্পটা দারুণ। ঈদ বয়ে আনুক আনন্দ

    Reply
  2. আফরোজা আক্তার ইতি

    মন খারাপ হয়ে গেল গল্পটা পড়ে। নাজনিন কত শখ করেছিল তার বান্ধবির মত সেও একটা লাল জামা পড়বে ইদে। শুধু সেই না,প্রতিটি বাচ্চারই ইদ নিয়ে মনে আশা থাকে,আনন্দ থাকে। তাদের বাবা মা’ও চায় তাদের সন্তানের সকল আশা পূরণ করতে, তাদের সন্তানকে পরীর মত রাখতে। কিন্তু নাজনিনের বাবার সেই ভাগ্য হল না, একটা বাস দূর্ঘটনার জন্য তার পরিবারের সাথে ইদ করাও হল না। একটা বাস দুর্ঘটনার জন্য তাদের ঘরে ইদের খুশি আসল না। বানানে কিছু ভুল আছে, ঠিক করে দিচ্ছি।
    জোড়েই- জোরেই।
    কোনে- কোণে।
    ছিরে- ছিঁড়ে।
    ভির- ভিড়।
    খুঁশি- খুশি।
    কাঁতর- কাতর।

    Reply
    • জরীফ উদ্দীন

      ধন্যবাদ আপনাকে। আঞ্চলিক ভাষার কারণে এমনটা মনে হয়েছে আপনার।

      Reply
  3. মতিয়ার রহমান

    দারুণ হয়েছে

    Reply
  4. Mahbub Alom

    খুব সুন্দর একটা গল্প।একজন ছোট্ট পরী তার বাবার বিদায়ে লাল জামা ত্যাগ করে।আসলে পরীর আসল চাওয়াটাতো তার বাবা।
    শুধু এমন বাবারাই হতে পারে না স্বার্থপর।নিজের শেষ স্বম্বলটুকু উজাড় করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনা।তবে লেখক মৃত্যুর পরিণতি না দিলেও পারতেন।তখন একজন ছোট্ট পরিবার,একজন পরীর মুখে হাসি ফোটার গল্প হতো।

    বানানে কিছু ভুল আছে।বাংলাদেশের সব আঞ্চলিক ভাষা জানা নেই।তাই হয়তো চরিত্রগুলোর কথোপকথন পড়তে সমস্যা হয়েছে।

    ধন্যবাদ

    Reply
    • জরীফ উদ্দীন

      ধন্যবাদ আপনাকে । আঞ্চলিক ভাষায় লেখা তাই বানান ভুল মনে হয়েছে।

      Reply
  5. Halima tus sadia

    ভালো লেগেছে।তবে আঞ্চলিক বাসা ব্যবহারের জন্য সব কথা বুঝি নাই।
    নাজনিনের জন্য খারাপ লাগলো।প্রতিটা ছোট মেয়েরেই আশা থাকে নতুন জামা পরার।বাবা মেয়েকে নতুন জামা কিনার জন্য সারা রাত রিক্সা চালালো তবে বাড়ি ফিরলো না।এভাবেই চলে গেলো একটা জীবন।
    নতুন জামা পরার শখ থাকলেও সবাই পরতে পারে না।
    স্বপ্নই থেকে যায়।
    বানানে ভুল আছে

    চোখছানাবড়া—চোখ ছানা বড়
    চরতে-চড়তে
    আজকন্যার–রাজকন্যার
    ভির–ভিড়
    পাবেন না–পারবেন না
    জিজ্ঞাস—জিজ্ঞেস
    শুভ কামনা রইলো।

    Reply
    • জরীফ উদ্দীন

      এটি আঞ্চলিক ভাষায় লেখা তাই বানান ভুল মনে হতে পারে। শুভকামনা

      Reply

Leave a Reply to Halima tus sadia Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *