লাল গোলাপ
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 2,287 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

লেখা: নিলয় রসুল

এক.
সবাই ছুটাছুটি করছে। এক বৃদ্ধ হাতে রক্তজবা গোলাপ ফুল নিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছে। আর সেই সাথে কালো পিচঢালা কালো রাস্তা এক বৃদ্ধের গাড় লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে।
সবাই ব্যাস্ত হয়ে উঠেছে বৃদ্ধ কে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। তবে সবার মনে একটা খটকার সমাপ্ত ঘটছে না, কেনো বৃদ্ধের হাতে এই লাল গেলাপ…!
ডান হাত ব্যান্ডেজ করে মাথাটার দিকে কয়েকবার ঘুরে ঘুরে দেখলো ডাক্তার সুজিত রয়। ” কি দাদু..! কেমন বোধ করছো এখন.!”
বৃদ্ধ লোকটা ভ্রু কুঁচকে সুজিত এর দিকে তাকালো একবার। সুজিত আবার বলে উঠলো,” দাদু শোন, আমি অপরিচিত মেয়ে মানুষ আর বাপ চাচার বয়সী কাওকে ছাড়া সবাই কে কিন্তু তুমি করেই বলি, সো তুমি কিন্তু রাগ করতে পারবেনা হুঁ!”
বৃদ্ধ লোকটা সুজিত এর মুখের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর পর চোখের পাতা ফেলছে ভয়ের সাথে।
” দাদু কি মাইন্ড করলা আমার ওপর ! ”
বৃদ্ধ লোকটা কিছু বলতে গিয়ে ভাঙা গলায় কাশতে লাগলো।
সুজিত টেবিল এ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে বৃদ্ধ লোকটার দিকে এগিয়ে দিলো। বৃদ্ধ লোকটা পানি খেয়ে যেন মনে হলো হারিয়ে যাওয়া জীবনটা অনেকদিন পর আবার ফিরে পেলো!
চোখমুখে ফুটে উঠলো কৃতজ্ঞতার ছাপ,কিন্তু চোখ থেকে এখনও ভয়ের আভা যায় নি।
বৃদ্ধ লোকটা কেবিন এর বেড এ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আর পাশেই সুজিত ফোন এর স্ক্রিন এর দিকে তাকিয়ে আপন মনে গুনগুন করে গান গাচ্ছে। চারিদিকে পরিবেশটা যেন মনে হচ্ছিল কোন রকম সতর্ক না করেই ভারী হয়ে উঠেছে। কেবিনে মাথার ওপর ফ্যান এর বাতাস ছাড়া আর কোন শব্দ হচ্ছেনা।
হঠাৎ সুজিত বৃদ্ধ লেকটার দিকে তকিয়ে বলল, “বুঝলে দাদু..” বৃদ্ধ লোকটা সুজিত এর গলা শুনে চোখ খুলল কিন্তু ওর দিকে তাকালনা। সুজিত সেটা ভ্রুক্ষেপ না করেই বলল,” বুঝলে দাদু,আজকাল বিয়ের আগে প্রেম করতে হয়না। মাথার ওপর বাড়তি অসহ্য চাপ একটা। এই দেখো তোমার হবু বউমা মেসেজ দিয়েছে এখনই একবার দেখা করবার জন্য। দাদু মনে রাখবা আর যায় হোক বিয়ের আগে খবরদার তুমি প্রেম করবনা,তাহলে লাইফ শেষ। থাকো তাহলে এখন,কখন আসবো ঠিক নাই..!” সুজিত কথাগুলো বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হচ্ছিল এমন সময় বৃদ্ধ লোকটা ভাঙা গলায় বলে উঠলো, “শোনো…!”
সুজিত দাড়িয়ে গেলো। চোখমুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। মনে মনে বলে উঠলো, “যাক তাহলে অভিনয় টা ভালই হইছে,ইয়েস্!”
সুজিত না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছিল,তখন বৃদ্ধ আবার ডাকল,” এই ছেলে শোনো..!”
দুই.
” না..না..! হালকা খাবার পাঠিয়ে দিন। বৃদ্ধ মানুষ বেশি কিছুই সহ্য করতে পারবেনা, আর তারওপর এখনও কথা বলেননি তিনি,কোন সমস্যা আছে কিনা সেটাও তো জানিনা। সো হালকা খাবার পাঠিয়ে দিন। আর রিসিপশনে আমার ফোন আসলে বলবেন আজকে বাড়ি ফিরতে পারবনা হয়তো।” নার্স কে কথাগুলো বলে ফিরে এলো বেডের কাছে সুজিত।
” কী দাদু বাড়ি কোথায়? ছেলে মেয়ে কয়টা? নাতি নাতনিরা কি সব বিদেশে নাকি..? ..! কিছুই তো বলছ না দাদু..!” বৃদ্ধ লোকটা কোন কথায় রেসপন্স না করলেও শেষের প্রশ্ন শুনে অনেকটা চমকে উঠলো। অবাক নয়নে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে ভাঙা গলায় বলল,” তুমি কীভাবে জানলে যে আমার নাতি নাতনি সব বিদেশে..! ” সুজিতের বৃদ্ধর মুখ থেকে কথা শুনে মনে হলো একটা ঠান্ডা জলের ধারা বয়ে গেলো ওর ভিতরে।
বয়েসের ভারে বৃদ্ধ লোকটার শুধু শরীরের হাড় দেখা যাচ্ছে। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল হয়ত কোন হতদরিদ্র পরিবারের কেও হবে হয়ত। কিন্তু এ বয়সে এসেও এমন দৃড় গলার আওয়াজ সুজিত খুব কম শুনেছে জীবনে বা বলতে গেলে দেখেনি কাওকে এরকম। বুঝতে অসুবিধে হলো না যে বৃদ্ধ লোকটা অত্যান্ত ভদ্র ও ধনী পরিবারের। আশ্চর্য হলেও সেটা প্রকাশ না করে সুজিত বলে উঠলো,” দাদু, তোমার চোখ দেখে!”
বৃদ্ধ লোকটার সুজিত এর উত্তর শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো। কিছু মুহূর্ত থেমে হেসে উঠলো। ভাঙা গলায় বৃদ্ধের হাসির আওয়াজ শুনতে সুজিত এর মন্দ লাগলনা,বেশ উপভোগ করল।
হাসত হাসতে বৃদ্ধর কাশি উঠে গেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বৃদ্ধ লোকটা শোয়া থেকে খুব কষ্টে সুজিত এর সহয়তায় উঠে বসল বেডের ওপর। তারপর সুজিত এর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে বলল,” বা রে, চোখ দেখে বুঝি বোঝা যায় নাতি নাতনি কোথায় থাকে?”
” না বোঝার কী আছে! ” বৃদ্ধ লোকটা যতই সুজিত এর কথা শুনছে ততই অবাক হচ্ছে। সাথে উপভোগও করছে সময়টা।
“কীভাবে..!” অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে সুজিতের দিকে চেয়ে বলল বৃদ্ধ লোকটি।
” আরে দাদু.. এ তো সিম্পল বিষয়! ”
” সেটাই তো জানতে চাইছিলাম,কীভাবে! ”
” হাহাহা..! দেখো দাদু তোমার নাতি বাইরের দেশে থাকে। তাদের সাথে তুমি খুব জোর কয়েক মিনিট কথা বলার সুযোগ পাও। হতে পারে সেটা সময়ের স্বল্পতা বা অন্য কিছু। তোমার চোখের কোনায় লাল হয়ে আছে রাতের পর রাত তুমি তাদের ফোনের জন্য যে অপেক্ষা করো সেটা তো বোঝা যাচ্ছেই তাছাড়া.! ”
” কী.!”
” তোমার চোখ ক্ষুধার্ত তোমার নাতি কে দেখার আকাঙ্ক্ষা তে!”
বৃদ্ধ লোকটা আর কথা বাড়লনা। আবারও চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। পাশ ফিরল। শুধু ভেসে আসল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস এর শব্দ। সুজিত কী করবে বুঝতে পারছেনা, আপাতত জানালার পাশে দাড়িয়ে রাতের ব্যাস্ত নগরী ঢাকা কে দেখা কে ই শ্রেয় মনে হলো তার কাছে।
দূরে রাস্তায় শত শত গাড়ি ছুটে চলছে নিজ গন্তব্যের পথে। কেউ বা রয়েছে আনন্দে কেওবা রয়েছে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। তবুও তাদের চলতে হয়। জানালায় হেলান দিয়ে সুজিত বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। দূরে রাস্তায় গাড়ি গুলো ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন বিল্ডিং ডেকোরেট করা হয়েছে। কোথা থেকে একটা হালকা শীতল হাওয়া এসে নরম ভাবে ধাক্কা দিচ্ছে সুজিত এর ওপর। ভালো লাগছে নাকি ভিতরে কোন এক অস্থিরতায় ভুগছে ও,বোঝার উপায় বিন্দুমাত্র নেই।
কারোর হাতের স্পর্শ মাথার ওপর পেয়ে ঘুম ভাঙলো সুজিত এর। চোখ খুলেই আতঙ্কিত ভাবে উঠে বসলো সুজিত। ঘুমজোড়া চোখ মেলে বৃদ্ধ লোকটাকে দেখে অবাক হলো সুজিত। হাসিমাখা মুখে বৃদ্ধ লোকটা বসে আছে। আজকে তাকে আর চেনা যাচ্ছেনা। খুব ফ্রেশ লাগছে।
” কী দাদু কখন উঠলে? ”
“বেশিক্ষণ হয় নি.! ”
” ওহ্! গুড মর্নিং দাদু!”
” ভেরী গুড মর্নিং! ”
বৃদ্ধ লোকটাকে যতই দেখছে আজ ততই অবাক হতে বাধ্য হচ্ছে সুজিত।
” তা দাদু, কেমন লাগছে এখন তোমার? শরীর কি ভালো? না অস্বস্তি বোধ করছ?”
” অস্বস্তি হবে কেনো?”
” না গতকাল কে একটা ঔষধ দিয়েছিলাম সেটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া.. সে বাদ দেও। কী খাবে এখন বলো?”
” কিছুনা। তোমাদের এখানে হাটার ব্যাবস্থা আছে। সকালে না হাটতে বের হলে শরীর টা ম্যাজ ম্যাজ করে খুব।”
” কী বলো দাদু। ঢাকা শহরে হাটার জায়গা! তুমিও না দাদু, কিসব বলো মাঝে মাঝে। তোমার বাড়ির সামনে সকালে মর্নিং ওয়াক করার জন্য জায়গা আছে তাই না।”
” হুঁ, তা আছে বৈ কি ”
” তাহলে একদিন যেতেই হয় তোমার বাড়িতে!”
” আচ্ছা এসো একদিন তাহলে”
” দিদুন কে বলো আমার জন্য ভাল খাবার রান্না করতে কিন্তু..!”
বৃদ্ধ লোকটা উত্তর দিলোনা। শুধু ভাঙা গলায় কিছুক্ষণ হাসল। হাসতে হাসতে কাশি উঠতে লাগল। তারপর থেমে গেল। আর কোন কথা খুঁজে পাচ্ছেনা সুজিত। বৃদ্ধ লোকটাকে নিয়ে সুজিত এর কৌতুহল ক্রমাগত বাড়ছেই। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে খুব দরিদ্র পরিবারের সদস্য, শরীরের দিকে তাকালে যে কেউ বলতে বাধ্য হবে যে, “আহা রে! বৃদ্ধ লোকটা বোধহয় খেতে পায়না। কতদিন ভালমন্দ খাবার মুখে ওঠেনি তার বোধহয় ইয়াত্তা নাই। ইশ্ কে আছিস বৃদ্ধ লোকটার জন্য একটু পেট পুরে খাওয়ার ব্যাবস্থ কর!” হঠাৎ সুজিত কল্পনার জগৎ এ ই একটা বড় হোচট খেলো। “আচ্ছা তখন থেকে দাদুকে সবাই কল্পনার জগৎ এ বৃদ্ধ লোকটা, বৃদ্ধ লোকটা করে ডাকছে কেনো! সত্যি ই তো দাদুর সাথে এতক্ষণ আছি নামটা একবারও জানা হয়নি তো। একবার জানা দরকার তো।” সুজিত বৃদ্ধ লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদু..”
” হুঁ, বলো..” সুজিত আবার ও হোচট খেলো বৃদ্ধের উত্তর নেওয়া দেখে। মনে মনে বলতে লাগল, “কী হল বিষয়টা। এভাবে তো আমি আমার..!” সুজিত নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলল,” তোমার নাম টা তো বললে না দাদু!”
” হা হা! পরে বলব,সময় করে!”
সুজিত আবার কল্পনার জগৎ এ চলে গেলো,” ভেরি ইন্টারেস্টিং বিষয় তো। নাম বলল সময় করে বলবে। কেন, নাম বললে কি জাত যাবে, নাকি সত্যি সত্যি আবার কোন নামও নায়। হতেও পারে আবার না ও হতে পারে। না,না, হতে পারেনা, দাদু কে দেখে মনে হয় হতদরিদ্র পরিবারের কর্তা,আবার কণ্ঠ শুনলে দৃড়তা দেখে মনে হয় প্রচুর শিক্ষিত ব্যাক্তি। একবার কি তবে জিজ্ঞেস করব! উঁ, না থাক্ কী ভাবতে কী ভাববে তখন। দরকার নাই। তার থেকে আমি বরং এখন বাড়ির পথে পা বাড়ায়। দেখি গিয়ে ওদিকে ঝড় কেমন বইছে!” সুজিত মাথার পিছনে চুলকাতে চুলকাতে বৃদ্ধ লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,” দাদু, তুমি এখন থাকো। এই নার্স তোমার সাথে বিকেল পর্যন্ত থাকবে। আমি একটু বাড়ির দিকে যাব।সন্ধ্যার দিকে আবার আসব। তারপর কিন্তু গল্প করব দুজনে অনেক!” বৃদ্ধ লোকটা কিছু বলল না। শুধু শুকনো মুখে হাসার চেষ্টা করল। হাসতে গিয়ে গালের ওপর জড় হয়ে থাকা চামড়া গুলো সরে গিয়ে বৃদ্ধ লোকটার চিকন দাত গুলো বেরিয়ে আসল দ্রুত। গালের ওপর যেখানে একটু গর্ত মত সেখানে চামড়া গুলো জড় হয়ে গেল। অবশ্য বৃদ্ধ লোকটাকে এখন দেখতে আরো সুন্দর লাগল। অনেকটা বড় বড় শিল্পীর তৈল চিত্রে আঁকা ছবির মত।
তিন.
“মানে আপনারা এতটা কেয়ারলেস কীভাবে হন আমাকে একটু বলবেন? কোন কঠিন কাজ তে দিই নি যে আপনারা পারেননি। দুজন মানুষ একজন বৃদ্ধ কে দেখে রাখতে পারলেননা। ইউজ লেস স্টুপিড । ” সুজিত প্রচন্ড ভাবে রেগে গিয়ে নার্সদের বকাবকি করছে।
” স্যরি স্যার। আসলে উনি তো.!”
” একদম চুপ্।একটা কাজ তো পারলেন না করতে ঠিকমত তার ওপর আবার কথা বলে যাচ্ছেন। আপনার সাহস তো কম নয়।”
“বাট স্যার.!”
” চুপ থাকতে বলেছি। বুঝেন নাই, আপনাকে চুপ থাকতে মানে মুখ বন্ধ করে রাখতে বলেছি। কারোর কথা সহ্য হচ্ছেনা।”
সুজিত গিয়ে জানালার পাশে দাড়াল। নিজেকে অসহায় লাগছে। বৃদ্ধ লোকটা এভাবে কাউকে না বলে হুট করে চলে যাবে বুঝতে পারেনি ও। কোথায় আছে এখন,কীভাবে আছে, সুস্থ নাকি আবার কোন রাস্তায় পড়ে আছে কে জানে..! “আল্লাহ বৃদ্ধ লোকটা কে রক্ষা কর।” হঠাৎ কম্পাউন্ডার এর ডাকে সুজিত বিরক্তি নিয়ে তাকাল।
“স্যার, টেবিলের উপরে এই চিডি খানা আছিল মুনে হয়। বাতাসে নিচে পইড়া গেছে গা..!” সুজিত আর বিলম্ব না করে কম্পাউন্ডার এর হাত থেকে চিঠি টা নিয়ে পড়তে লাগল। চিঠিটা দেখে সুজিত স্তম্ভিত হয়ে বসে পড়ল বেডের ওপর।
“সুজিত,
প্রথমেই বলে রাখি ওদের কাউকে তুমি বকাবকি করোনা। ওরা নিজ দায়িত্বে বহাল ছিল। আমিই ছলচাতুরি করে চলে এসেছে ওই কারাগার থেকে আরেকটা কারাগারে। অবাক হচ্ছো তাই না। স্বাভাবিক, অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার এসব কথা বাদ দেও। আমার নাত বৌমা কে বলবা তার হাতের রান্না খুব সুন্দর এবং স্বাদের। তোমার কপাল ভালো তাই এত ভাল একটা মেয়ে পেয়েছ কপালে। আর হ্যা, চিঠিতে দেখ একটা সোনার চেন আছে। ওটা তোমার ছেলের জন্য । খুব শখ ছিল তোমার দিদুনের নিজের হাতে নিজের নাতি নাতনি কে চেন পরাবে। কিন্তু তা কখনোই সম্ভব নয়৷ তুমি ভাবছো নিশ্চয় এত কিছু কে বলল আমাকে? হা হা! তুমি যখন বারবার আমার নাতির কথা বলছিলে একবারও নাতনির কথা বলোনি তখন বুঝতে পেরেছি তোমার মেয়ে নয় ছেলে আছে একটা৷
তোমার মতই কিউট হয়ত সে। আর হ্যা তুমি যে বিবাহিত সেটা আমি আগে থেকেই জানি। ভাবছো নিশ্চয় কীভাবে? সেটা পরে জানতে পারবে। একটা কথা বলে রাখি তোমাকে, তোমার লেখনীর মাধ্যমে তোমাকে বিচার করা যায় না। তুমি খুব সাধারণ আর বোকা একটা ছেলে। ও হ্যা, তুমি ঠিকই ধরেছো, আমি তোমার গল্পের একজন ফ্যান। তোমার লেখা সবকটা বই আমার পড়া হয়ে গেছে। খুব ভাল উপন্যাস লেখতে পারো তুমি। তোমার জন্য রইল শুভ কামনা। আর হ্যাঁ আমার বাড়ির সামনে অনেক বড় জায়গা আছে হাঁটার জন্য। শুধু আমি নই,আমার মতো আরো অনেক বৃদ্ধ সেখানে থাকে,সেখানে রোজ সকালে হাঁটতে বের হয়।
আমার ছেলে মেয়ে কেউ নেই এদেশে। সবাই ক্যারিয়ার তৈরি করতে বিদেশ গেছে। ফিরবে বলে আর মনে হয় না। তাই আমার একাকীত্বের সঙ্গী হল বই। বই পড়েই দিন কাটে। রাত আসে, ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাটানো সুখের মুহূর্ত গুলো ভেবে চোখের জল ফেলে রাত পার হয়। প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আল্লাহ তাআ’লার কাছে দোয়া করি যেন এই ঘুম যেন আর না ভাঙে। আর যেন না জেগে উঠি। কিন্তু প্রতিবারই আমার দোয়া গুলো বিফলে যায়। ঠিক ভোরে আবার জেগে উঠি আগমন ঘটে নতুন প্রভাতর নতুন দিনের, নতুন কিছু একটার। তুমি তোমার সব দেবতার কাছে একটু কষ্ট করে বলবে তো যেন আমি আর জেগে না উঠি। খুব কষ্ট হয় আমার রোজ জেগে ওঠার পর,বারবার ছেলেমেয়েদের কথা মনে হয়ে যায়। তবে আমার এ কষ্ট বেশিদিন থাকবেনা। ওরা বলেছে আমি নাকি বৃদ্ধাশ্রমে বেড়াতে এসেছি। সময় হলে আমাকে নিয়ে যাবে কিন্তু ওদের সময় টা যে কবে হবে..! খুব ইচ্ছে করে নাতির মুখটা দেখতে,একবার কপালে চুমু খেতে! যাই হোক আর কথা বাড়াব না।
ও আরেকটি কথা তোমার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন হয়েছিল বৃদ্ধ মানুষের হাতে লাল গোলাপ ফুল কেন? আসলে ওটা তোমার দিদুনের জন্য। ওইদিন আমাদের বিবাহবার্ষিকী ছিল। সে বছর চারেক হল গত হয়েছে। তাই এ দিন আমি লাল গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ছুটে চলি। আবার সন্ধ্যা হলে আমার বাড়ি,বৃদ্ধাশ্রমে ফিরে যায়। বয়স হয়েছে তাই সেদিন আর তাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে গেছিলাম
অবশ্য ভাল হয়েছে, স্বপ্নের প্রিয় লেখক কে একবার দেখার সুযোগ হল। আমার এ জীবনের গল্প লেখবে তুমি। আমি জানি তুমি পারবে এটা নিয়ে শত শত পৃষ্ঠার উপন্যাস লেখতে। আর আমার নাম উপন্যাসে দিও আবেদালি। এটা আমার নাম না। তোমার দিদুনের প্রিয় নাম। তাই আমাকে এ নাম এ ই ডাকতো সে। হয়ত আর বেশিদিন বাঁচবনা তবে এ নামে একটা উপন্যাস রচিত হলে তোমার দিদুনের প্রিয় নামটা বেঁচে থকবে বছরের পর বছর। এতেই আমার শান্তি। তাছাড়া আর কিছু চাওয়ার নাই আমার। আর হ্যা, সম্ভব হলে উপন্যাস এর নাম দিও ‘ লাল গোলাপ’
ভাল থেক দাদুভাই ।
ইতি
নামটা নাহয় অজানাই থাক”
চিঠিটা পড়তে পড়তে সুজিত এর চোখে জল চলে এসেছে। জল মুছতে মুছতে সুজিত জানালার দিকে তাকাতে দেখলো, সুর্যাস্ত চলছে। সুজিত চোখ বন্ধ করে কল্পনা করল,বৃদ্ধ লোকটা হয়ত এখন বৃদ্ধাশ্রমের ভাঙা বারান্দায় বসে আছেন। হালকা শীতল হাওয়া কোথা হতে এসে বৃদ্ধ লোকটার চুলগুলো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর বৃদ্ধ লোকটা ভাঙা গলায় কাশছে আর আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে সূর্যাস্ত দেখছে..!

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

২ Comments

  1. Parvej Mosharof

    গল্পের লেখনীর ভাব টা অসাধারণ। তবে গল্পের মূল অংশ যে বৃদ্ধাশ্রম সেটা একটু কম ভাবেই ফুটে উঠেছে। আর কিছু কথার মাঝে দিয়ে উপন্যাস লিখা সম্ভব নয়, লিখা যায় বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে। আমাদের দেশে প্রায় অনেকেরই ঠাই এই বৃদ্ধাশ্রমে। আমরা জাতি হিসেবে লজ্জিত যে, স্ত্রী সন্তান সহ এসি রুমে থাকি আর পিতামাতা রাত কাটায় বৃদ্ধাশ্রমে।

    Reply
  2. Rifat

    যায় নি — যায়নি (নি সবসময় শব্দের সাথে যুক্ত থাকে)
    ভীষণ ভালো লাগলো গল্পটি। বর্তমানে বৃদ্ধ মানুষদের জন্য একমাত্র জায়গা হয়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম।
    শুভ কামনা।

    Reply

Leave a Reply to Rifat Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *