কলমে প্রতিবাদ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 1,361 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

লেখিকা: জান্নাতুল মমি
_____
বিদ্যুৎ চমকানি আলো আর তুমুল বয়ে চলা ঝড়েও ইজি চেয়ারে দোল খেয়ে যাচ্ছেন রাসেল বাবু। বয়স আন্দাজ করা যায় বায়ান্ন। আমি ছোট থেকেই তাকে দেখে আসছি। ছোটবেলায় মা জানিয়েছিলেন তিনি আমার সম্পর্কে চাচা হোন। কিন্তু রাসেল বাবু কখনো আমাকে চাচা ডাকতে দিতেন না। তিনি বলতেন, ওতে নাকি তিনি নিজেকে বৃদ্ধ মনে করেন। তাকে ডাকতে হলে রাসেল বাবু বলেই ডাকতে হবে। সে থেকেই আমিসহ আমার বয়সী যারা আছে সকলে রাসেল বাবু বলেই ডাকে তাকে।
আজ উনার কাছে এসেছি এক বিশেষ প্রয়োজনে। ওপাড় গ্রামের এক সাংবাদিক নাকি রাসেল বাবুকে নিয়ে বিরাট করে খবর ছাপিয়েছে পত্রিকায়। আমিও সাংবাদিক লাইনে পড়েছি। সবে মাস্টার্স শেষ করলাম। কিন্তু আজকের যুগে রেফারেন্স ছাড়া চাকরি পাওয়া সোনার হরিণ। আর উপর তলার মানুষের সাথে রাসেল বাবুর নাকি চলাচল। মা বললেন, চাকরির ব্যাপারে উনার সাথে কথা বললে নিশ্চয় আমার জন্য একটা ব্যবস্থা উনি ঠিকই করে দিবেন। আজ সে আশাতেই এসেছি। কিন্তু পথিমধ্যে আকাশের দূর্যোগ শুরু হয়ে গেল। ভেবেছিলাম একবার বাড়ি ফিরে যাব। কিন্তু পরক্ষণে ভাবলাম এর থেকেও তো বড় ঝড় বইছে এ জীবনে। তবে তুচ্ছ এই ঝড়কে মোকাবিলা করা যাবে না!
আমি ছিলাম খুব ভীতু। রাসেল বাবুর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছি অনেকক্ষণ হলো। তবে এতক্ষণেও তাকে ডাকার সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। শেষমেশ গলা খোকর দিলাম। রাসেল বাবু হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিলেন আমার গলা খোকরের শব্দে। মনে হলো, এক ভয় ত্রাসে তিনি নিজেকে নিয়ে ভাবছিলেন।
‘ওরে ব্যাটা তুই? কখন এসেছিস?’
যেন স্বস্তি ফেলে আমাকে প্রশ্ন করলেন রাসেল বাবু।
আমি লজ্জানত হয়ে তাকে উত্তর দিলাম, ‘সে বেশ খানিকক্ষণ।’
রাসেল বাবু উঠে দাঁড়ালেন। এরপর ধীরে ধীরে টেবিলের এক প্রান্তে গিয়ে জগ হতে গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়ে নিলেন এক নিঃশ্বাসে। আমি তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। আসলে আমি সত্যিই ভীতু। বড় কোনো মাপের মানুষের সাথে সোজা হয়ে সটসট করে কথা বলতে পারি না। এ নিয়ে মায়ের বকাও কম খাইনি। হয়ত এ জড়তা আমার থেকেই যাবে।
‘তা ব্যাটা, কোনো আর্জি আছে নাকি তোর?’ খপ করে কথা তুললেন রাসেল বাবু।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। হাত পা রীতিমতো কাঁপছে। রাসেল বাবু ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে কথা বলিস না যে?’
আমি খুবই নম্র আর ধীর গলায় বললাম, ‘মা আপনাকে কিছু জানায়নি?’
উনি তখন মাথার চুলগুলোতে একবার বিলি কেটে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলেন। এরপর মনে না পড়লে আমাকেই মনে করিয়ে দিতে হলো তাকে।
‘আসলে রাসেল বাবু, মা বলেছিল আপনাকে আমার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে।’
তখন যেন তিনি সজোরে বললেন, ‘ওহ হ্যাঁ। চিন্তা করিস না। তোর চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। পাশের গ্রামের কিয়াস আছে না? চিনিসই তো!’
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম, ‘হ্যাঁ।’
‘ওর সাথে কথা হয়েছে। সে বলেছে তোর চাকরি কনফার্ম। বড্ড ভালো ছেলে সে। আজকের পত্রিকা দেখেছিস?’
আমি গুটিসুটি করে নিলাম নিজেকে। উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ।’ রাসেল বাবু তখন তার বাহারি গোঁফ নাড়তে নাড়তে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘তুইও এমন খবর ছাপাবি। কী বলিস?’- বলেই অট্টহাসি দিলেন রাসেল বাবু। আমি তখনও এসব নিয়ে ভাবিনি। শুধু কল্পনায় ভেবে দেখলাম আমার মায়ের মুখে হাসি ফুটেছে, আমার অসুস্থ বাবা আবার সুস্থভাবে জীবনযাপন করছে। এসব ভাবতেও যেন পরম সুখের তৃপ্তি পেলাম। এ কাঠখড় জীবনে আমার চাকরিটার প্রয়োজন ছিল ভীষণ। রাসেল বাবুই যেন সে সুখের চাবিকাঠির সন্ধান দিলেন।
.
দূর্যোগ থেমেছে বহুক্ষণ হলো। কিন্তু রাসেল বাবু রাতের খাবার না খেয়ে আমাকে আসতে দিলেন না। ওদিকে মায়ের চিন্তা যে বেড়েছে তা আমি হলফ করে বলতে পারি। আবার আসার সময় শুনেছি বাবার ঔষধও নাকি শেষ হয়ে গেছে। ফেরার পথে একবার ফার্মেসীতে যেতে হবে। কিন্তু সে খানিকটা দূরের রাস্তা। কিন্তু বিস্ময়কর কথা হলো, রাসেল বাবু নিজেই তার গাড়ি চালককে হুকুম দিলেন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। এমন আদিখ্যেতা আমার অবশ্য সহ্য হয় না। কিন্তু রাসেল বাবুকে আমি কিছু বলতেও পারছি না। সবে চাকরির খবর পেলাম। এরমধ্যে বেয়াদবি অবশ্যই তিনি গ্রাহ্য করবেন না। তাই খুব হেসেই তার দেওয়া কথা আমি মাথা পেতে নিলাম। উনার গাড়ির চালক প্রথমে আমাদের গ্রামের চৌরাস্তার মোড়ে নিয়ে গেল। সেখান থেকে বাবার জন্য তিনশ টাকার ঔষধ কিনে নিলাম। এরপর বাড়ির পথে গাড়ি ছুটলো। এমন আরামদায়ক গাড়িতে বসেও যেন বাড়ি ফিরতে আমার আরাম লাগছিল না। চাকরি পেয়েও যেন এক শঙ্কা আমার মনকে দুমড়ে মুছড়ে ফেলছিল। তবে কিসের সে শঙ্কা, কিসের সেই ভয় তা ঠাহর করতে পারছি না।
এসব ভাবতে ভাবতে গাড়ি এসে পৌঁছালো আমার বাড়ির বড় উঠানে। মায়ের মন বলে কথা! উনি গাড়ির শব্দ পেয়েই উঠানে ছুটে এলেন। এরপর আমাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে আমি স্পষ্ট খেয়াল করলাম, মায়ের বুকে যেন স্বস্তি নেমেছে। আমি এক পা দু’পা করে মায়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। মা পরম স্নেহে আর কান্নারত চোখে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কত চিন্তায় ছিলাম। ফোনটা তো নিয়ে যেতে পারতিস!’
আমি অবাক হলাম। যে মা যাওয়ার আগে বারবার করে শুধু চাকরির কথা বলেছিল সে মা এখন ছেলে চাকরি পেয়েছে কি পায়নি তা জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছে। হয়ত সব মায়েরাই এমন। আমার মা আবার ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন! আমি মাকে শুধু সান্ত্বনা দিলাম। একবার দুইবার হেসে বললাম, ‘আর চিন্তা নেই। তোমার ছেলে এখন স্বশরীরের তোমার সামনে হাজির। কিচ্ছু হয়নি।’
মা যেন তবুও মমতার কম ছোঁয়া দিলেন না। আমিও সে মমতার ছোঁয়ায় নিজেকে সবথেকে সুখী মানুষ হিসেবে বিবেচনা করলাম। ঘরের দিকে যেতে যেতে আমার হাতে থাকা বাবার ঔষধগুলো মায়ের হাতে তুলে দিলাম। এরপর নিজের ঘরে গিয়ে হালকা ভেজা কাপড়গুলো ছেড়ে শুকনো কাপড় গায়ে জড়িয়ে নিলাম। ইতিমধ্যে মা একবার দরজায় কড়া নেড়েছিল। তাই মায়ের ঘরে গেলাম এরপর। মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাকরির কী খবর?’
আমি মাথা নিচু করে বললাম, ‘চাকরিটা নাকি আমি পেয়েছি।’
মা-বাবা দুজনেই আলহামদুলিল্লাহ্‌ পড়লেন। আমি শুধু উনাদের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম।
.
দিন দশেক পরে রাসেল বাবু আমাকে তার বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। এরকম ইঙ্গিতে মা নাকি বুঝে গেছেন আমার চাকরির ব্যাপারটা পাকাপোক্ত করতেই তার ডেকে পাঠানো। আমি অবশ্য সেদিকে বিশেষ নজর দেইনি। কারণ এই দশদিনে অনেকের মনের মতিগতি পাল্টেও যেতে পারে। মাকে বিদায় জানিয়ে আমি রাসেল বাবুর বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। আমাকে দেখা মুহূর্ত উনি হাসতে হাসতে আমার নাম ধরে আমার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগলেন। আমি ব্যাপারটা তখনও বুঝে উঠিনি। রাসেল বাবু পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘কিরে ব্যাটা, মিষ্টি কোথায়? চাকরী তো পেয়ে গেলি, মিষ্টি খাওয়াবি না?’
আমি বড়সড় একটা দম নিলাম। এরপর রাসেল বাবুকে জানালাম, খাওয়াবো। অল্প কথাতে উনার পেট ভরলো না। আমার শার্টের পকেট থেকে কচকচে পাঁচশ টাকার নোট হাতিয়ে নিলেন তিনি। প্রথমে বিরক্তিই লেগেছিল। পরে ভাবলাম, থাক। উনিই তো আমার অনেক বড় উপকার করেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো পকেটের পাঁচশ টাকা ছিল আজকের বাজারের টাকা। মা নিজের জন্য শাড়ি না কিনে টাকাটা জমিয়ে রেখেছিলেন। আজ বাজার করার টাকা নেই। তাই তার গচ্ছিত টাকাটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বাবা নাকি বড় মাছের মাথা খেতে চেয়েছে। অথচ এ কথা মনে করতেই বুকের একপাশটা চিনচিনে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। আমি রাসেল বাবুকে কিছু বলতেও পারছি না। উনার হাসিটাও যেন নির্দয়ের মতো। এ যাত্রায় উনাকে না হয় সহ্য করে নিলাম। কিন্তু বাবা যখন আজকের খাবারের থালায় মাছের মাথা দেখবে না তখন সে দৃশ্য কি সহ্য করতে পারব? আমিও যেন এক চকিতেই অভিনয় করা শিখে গেলাম। এই যে কত সুন্দরভাবে রাসেল বাবুর সাথে হেসে হেসে কথা বলছি!
.
চাকরিটা পেয়েছি। আজ ঢাকা যেতে হচ্ছে আমাকে। জয়েন করতে হবে আজই। মা ব্যাগ ভর্তি খাবার বাধিয়ে দিয়েছেন। বাবা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেননি। তাই আমি নিজেই দোয়া চাইতে তার ঘরে গেলাম। বাবা-মা একসাথে প্রাণ ভরে দোয়া করে দিলেন। আমি মুখের কোণে একটা হাসি দিলাম। যাক, অবশেষে একটু স্বস্তির দেখা পেলাম! তবে এ চাকরির জন্য আমাকে এখনো বড় কিছু হারাতে হয়নি। মানে আর কি মোটা অঙ্কের উপড়ি! রাসেল বাবু শুধু ঐ পাঁচশ টাকার নোটেই হাত দিয়েছিলেন। তবে আমি জানি রাসেল বাবু লোভী স্বভাবের। তার চোখে খুব সহজেই লোভ ধরা পড়ে। আমি ঠিক তার লভ্যাংশের কোথায় আছি সে শঙ্কা নিয়েই আপাতত বাড়ি ছাড়লাম।
.
চাকরির মাস খানেকের মাথায় আমার জীবনের প্রথম ঝুঁকিপূর্ণ একটা খবর ছাপিয়েছি। খবরের হেডলাইনে কিছু মাফিয়া সমাজ যে ভয় পেয়েছে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কারণ খবর ছাপানোর পরদিন থেকে আমি একটার পর একটা হুমকি পেয়ে যাচ্ছি। এতে আমি কিছুটা বিচলিতও হয়ে পড়েছি। পাশের এক বড় ভাই তখন আমাকে সাহস জোগালেন। আমি সাহস সঞ্চয় করতে একটু বেশি সময় নেই। কিন্তু এই সাংবাদিকতা পেশায় আসার পর দেখলাম আমার জড়তা অনেকাংশেই কমে গেছে। তাই ওসব মাফিয়া সমাজের হুমকিতে মোটেও কান দিলাম না। আমি তাদের নিয়ে আরো সোচ্চার হয়ে লিখতে লাগলাম। তিনদিনের মধ্যে আমি হয়ে উঠলাম জনপ্রিয় একজন সাংবাদিক। বাড়িতে এ খবর দিয়েছি। মা-বাবা দু’জনেই খুব খুশি হয়েছে। রাসেল বাবু শুনেও খুশি হয়েছে। মাঝে দুইদিন ছুটি দিলেন আমার অফিসের স্যার। ভাবলাম মা বাবাকে দেখে আসা হবে। তাই দুই দিনের ছুটিকে আপন করতে বাড়ি গেলাম। বাড়ি পৌঁছাতেই মায়ের আদরের শেষ নেই। বাবার মুখে আজ কত বছর পর যে হাসি দেখলাম তার হিসেব নেই!
দেখলাম, মা আজ আমার জন্য অনেক খাবারের আয়োজন করেছেন। দুপুরে গোসল সেরে কেবল মাকে ভাত বাড়তে বলেছি। অমনি রাসেল বাবুর খাস চামচা আমাকে ডাকতে আসলো। আমি বলেছিলাম, বিকেলে যাব। কিন্তু মা নিজেই আটকিয়ে দিলো আমাকে।
‘যত হোক তার উপকারের অবদান ফেলে দেওয়া যায় না। উনার কথা না শুনলে উনাকে অপমান করা হবে।’- মা নির্দিধায় এসব বলে আমাকে রাজি করালেন।
রাসেল বাবুর খাস চামচাও জানাল, রাসেল বাবুর সাথেই খেতে হবে আজকে।
আমি তাই চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। জানি না হঠাৎ আজই কেন তিনি ডেকে পাঠালেন!
.
রাসেল বাবু তার ইজি চেয়ারে বসে আজও দোল খাচ্ছে। চোখমুখের দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ গম্ভীর। উনার চোখাচোখি হতেই সালাম দিলাম আমি। কিন্তু রাসেল বাবু খপ করে আমার কলার চেপে ধরলেন। আমি বিগড়ে গেলাম।
‘সে কি রাসেল বাবু, কী হয়েছে?’
‘ব্যাটা, বড় সাংবাদিক হয়েছিস না? খুব পাখা গজিয়েছে?’- আরক্ত চোখে রাসেল বাবু আমাকে বললেন।
আমি পরিস্থিতি বুঝে উঠার আগেই রাসেল বাবু ঠাস করে দুইটা থাপ্পড় দিলেন আমার গালে। আমি তবুও চুপচাপ ছিলাম। একবার গা ঝাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে উনার সাঙ্গ পাঙ্গরা আমাকে চেপে ধরে ফেলেছে। আমি নড়তেও পারছি না বিন্দুমাত্র। এরপর আমাকে তারা চেয়ারের সাথে রশি দিয়ে বেঁধে হুমকি দিতে লাগল। তবে তখনও আমি আমার দোষ খুঁজে পাইনি। তাদেরকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলেনি। খানিক বাদে রাসেল বাবু বড়সড় একটা রামদা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমি এবার অনেকটাই ভয় পেয়ে গেছি। কী হতে চলেছে আমার সাথে? কেনই বা আমার প্রতি রাসেল বাবুর এই ক্ষোভ?
.
আমি এবার অনুরোধ করলাম রাসেল বাবুকে সবটা খুলে বলতে। এরপর উনি আরও বিরক্ত হলেন।
‘ব্যাটা, যে তোকে নুন খাওয়ালো আর আজ তাকেই জোঁক ভেবে নুনের ছিটে দিলি? তুই জানিস তুই আমার কত বড় ক্ষতি করেছিস?’-রাসেল বাবু ক্ষ্যাপা স্বরে বললেন আমাকে।
আমি স্বজোরে চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করেছি আমি?’
‘চারদিন আগে যে মাফিয়াদের কোটি টাকার ব্যবসার তথ্য ফাঁস করেছিস তুই জানিস সেখানকার গ্যাং লিডার কে?’
আমি তো সত্যিই এই খবর জানি না। তাই উত্তর দিলাম, ‘না, জানি না।’
রাসেল বাবু তার বড় মাথাটা আমার মুখের সামনে এনে চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘আমি…আমি…আমি..।’
উত্তরটা শুনে আমি চমকে গেলাম। এই রাসেল বাবু মাফিয়াগিরি করে? তাহলে সমাজ সেবক কেবলমাত্র নামধারী?
আমি তখন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। উনার হাতের রামদা তখনও চকচক করছে।
আমার মুখ আরও কুঁচকে গেল। ভয়ে গলা দিয়ে আর একটি কথাও বের হচ্ছে না। এমন একটি পরিস্থিতির স্বীকার হবো তা স্বপ্নেও ভাবিনি। জানি না এখন আমার চাকরিটা থাকবে কিনা!
.
‘কিয়াসকে চাকরিটা দিয়েছি শুধুমাত্র আমার নাম ছাপাবে বলে। বড় বড় মানুষেরা আমার সম্পর্কে জানবে বলে। আর তুই নিমক হারাম, চাকরিতে ঢুকতে কি না ঢুকতেই আমার পেটে লাথি মেরেছিস!’ – বলতে বলতেই রাসেল বাবু তার পা দিয়ে জোরে এক লাথি মেরে দিলো আমার বুকে। সে আঘাতে শ্বাস নিতেই আমার কষ্ট হলো। আমি অস্পষ্ট স্বরে রাসেল বাবুকে বললাম, ‘তবে কি আপনি শুধুই লোক দেখানো সমাজসেবক? ‘
রাসেল বাবু আমার প্রশ্নে হাসে । ভীষণ হাসে।
‘তোর কি মনে হয় আমি খুব ভালো? না রে বোকা। আর এই যে তোকে চাকরি দিয়েছি এটার পিছনেও তো আমার স্বার্থ আছে।’
আমি রাসেল বাবুকে ফের জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী সার্থ?’
‘এই যে কিয়াসের মতো তুইও আমার নাম ছাপাবি বড় কাগজে।’
আমি উত্তর দিলাম, অন্যায়কে আমি মেনে নিতে পারব না।
‘চুপ শালা কুত্তার বাচ্চা। এই যে এই রামদা দেখেছিস? ঘ্যাচাং করে তোর বাপ মার মুণ্ড ধড় থেকে আলাদা করে ফেলব।’
আমি আরও ভয় পেলাম আমার বাবা-মার কথা বলাতে। দুনিয়াতে তারাই তো একমাত্র আপনজন। আর আমার জন্য তারা এই রামদার বলি হোক তা আমি কখনোই চাই না। তাই পরাজিত হতে হলো নিজের বিবেকের কাছে, সত্যের কাছে। আমি রাসেল বাবুর কথা মতো সব কাজ করতে রাজি হয়ে গেলাম।
.
ঢাকায় এসে রাসেল বাবুর সম্পর্কে বেশ বড়সড় লেখা ছাপিয়ে দিলাম কয়েকটা। উনি তড়তড় করে বেড়ে উঠলেন সমাজের সবচেয়ে ভালো স্বেচ্ছা সেবক হিসেবে। অন্যদিকে মাফিয়া সমাজেও রাজ করতে লাগলেন। আমি সবটা নিজ চোখে দেখছি কিন্তু কিছু করতে পারছি না। কারণ আমার হাত পা বাঁধা। একের পর এক পত্রিকায় লিখে চলেছি। আমার ভক্তমহল অনেকে মাফিয়াদের নিয়ে লিখতে বলেছে কিন্তু আমি তা এড়িয়ে চলেছি। এভাবে কেটে গেল আরও তিনমাস। হঠাৎ খবরের কাগজে দেখলাম নকল ঔষধে প্রায় তিনশ শিশুর প্রাণ গেছে। খোঁজ নিলাম, ভাবলাম আমিও এই অসহায় শিশুদের নিয়ে কিছু লিখব। কিন্তু গর্তের মুখে যে সাপ ছিল তার নাম জানতে পারলাম। আবার সেই রাসেল বাবু। যিনি সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। ঐ তিনশো শিশুর মুখগুলো মনে পড়তেই আমার রক্ত শিউড়ে উঠলো। জাগ্রত হলো মন। ভাবলাম, কেন আমি পিছুপা হবো? আমার মনুষত্ব কেন বিকিয়ে দিচ্ছি সেই নরপশুর কাছে?
নাহ! আর না। এইবার আমাকে জাগতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে অমন মুখোশধারীদের বিরুদ্ধে। বাঁচাতে হবে আরও প্রাণ। তাতে না হয় নিজের জীবনটা চলে যাবে! তবে এই ভয়কে আমাকে জয় করতেই হবে।
.
আমি লিখলাম সেসব মাফিয়াদের নিয়ে। চারিদিকে হুল্লোড় পড়ে গেল। এক এক করে সবার মুখোশ উন্মোচন করে দিলাম। আর শেষমেশ আসলো রাসেল বাবু। হ্যাঁ যাকে শ্রদ্ধা করতাম, যার জন্য আজ আমি দু’ কলম লিখতে পারছি, যার জন্য আজ খ্যাতির চেয়ারে বসে আছি এবং যাকে নিয়ে গত কয়েকদিন অনেক ভালো এবং সাধু মানুষ সাজিয়েছি খবর ছাপিয়েছি। সবকিছু যখন ফাঁস হয়ে গেল তখন আমার কাঁধে চাপ বাড়লো আরও। আমি এরপর কয়েকদিন অনেক চাপের মধ্যে পড়ে রইলাম। বাড়ির সাথে যোগাযোগও হয়নি তেমন। কিন্তু হঠাৎ একদিন মায়ের ফোন এলো। আমি ওপাশ থেকে কিছু ভাঙার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আর আমার অসুস্থ বাবার গোঙ্গানি। আমি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারলাম এখন বাড়িতে কী হচ্ছে। মা’র সাথে দু’ কথা বলতেই রাসেল বাবু ফোন কেড়ে নিয়ে আমাকে হুমকি দিলেন ফের। আমি ভয় পেয়েছি তবে পিছুপা হইনি। বুকে সাহস নিয়ে উনার মুখের উপর তর্ক করলাম। এতে ক্ষতি হিসেবে যা পেলাম তা হলো আমার বাবার মৃত্যু। বাবা সেদিন বিকেলেই স্ট্রোক করে এ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যান।
.
বাবাকে চিরবিদায় জানালাম। বুকটা খাঁ খাঁ করছে। জানি না এই পেশায় এসে আজ এত অপরাধবোধ কাজ করছে কেন! তবে আমার বাবার এই মৃত্যু আমাকে নাড়িয়ে তুলেছে। ভেঙ্গে পড়েছিলাম ঠিকই কিন্তু মা সাহস জুগিয়েছে। আর সে জুগানো সাজসে নতুন উদ্যমে আবার রুখে দাঁড়ালাম রাসেল বাবুর বিরুদ্ধে।
.
আরও প্রায় দুইমাস চললো লেখালেখি। রাসেল বাবু তিনদিন হলো জেলে ঢুকেছেন। তবে এখানেই আমি ক্ষান্ত নই। আমি জানি রাসেল বাবুর মতো এমন মুখোশধারী জঘন্য মানুষগুলো সমাজে এখনও ওঁত পেতে আছে। আমার দায়িত্ব হলো ওদেরকে বের করে নিয়ে আসা এবং কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দেওয়া। আর আমি সেভাবেই এগিয়ে গেলাম। এখন চলছে আমার লেখালেখি, চলছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাকশক্তির লড়াই। আমি জানি একদিন ঠিকই সফল হবো।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৭ Comments

  1. আরাফাত তন্ময়

    ভালো একটা বিষয় নিয়ে লিখেছেন। পিছনে শব্দটা বোধহয় সাধু ভাষার। শুভ কামনা রইলো।

    Reply
  2. হাসিবুব জামান ইমন

    খুব সুন্দর হয়েছে

    Reply
  3. আখলাকুর রহমান

    সুন্দর লিখেছেন।
    উপস্থাপন ভঙ্গি নজরে লেগেছে।
    লেখনীতে যাদু ছিল।
    সমাপ্তির কথাটুকু বেশি ভালো লেগেছে।
    এগিয়ে চলুক আপনার লেখালেখির প্রয়াস।
    শুভ কামনা রইল।

    Reply
  4. Tasfiya Tanha Jhum

    অনেক ভালো লিখছেন। থ্যাংকস

    Reply
  5. tasfiya tasfiya

    nice

    Reply
  6. মাহফুজা সালওয়া

    জান্নাতুল মমি,আপনার থেকে আরও ভালো কিছু আশা করেছিলাম!
    যাইহোক,তবু যথেষ্ট ভালো হয়েছে, ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবে।
    শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে কিছু সংশোধনী- পরামর্শ দেয়াটা আমার কর্তব্যই বটে!
    ১) তিনদিনের মধ্যে আমি হয়ে উঠলাম জনপ্রিয় একজন সাংবাদিক — এই ব্যাপারটা অতিরঞ্জিত হয়েছে মনে হচ্ছে।
    ২)কিছু ক্ষেত্রে বিরামচিহ্নের স্বতঃস্ফূর্ত প্রয়োগ দেখা যায়নি, যা গল্পের সৌন্দর্য নষ্ট করে।
    ৩)কাহিনীটা খুবই সুন্দর এবং যুগপোযোগী!
    উপন্যাস অথবা বড়গল্প হল,এটা নিঃসন্দেহে পাঠক জনপ্রিয়তা অর্জন করতো, কিন্তু কাহিনীর তুলনায় গল্পটা নিতান্তই ছোট হয়ে গেছে। গল্প পড়ার সময় মনে হচ্ছিল, খুব তাড়াহুড়ো করে লিখা হয়েছে! কিছু একটার অনুপস্থিতি বোধ হয়েছে এই পুরোটা সময়।
    আশা রাখি নেক্সট টাইম আরো যত্ন করে,সময় নিয়ে লিখবেন।
    শুভ কামনা রইল, আপু ????

    Reply
  7. আফরোজা আক্তার ইতি

    অসাধারণ লিখেছেন। গল্পের মতই গল্পের নামকরণও অনেক সুন্দর। “কলম যোদ্ধা”। আমাদের সমাজে এমন অনেক সাংবাদিকই আছে যারা প্রাণের ভয়ে,হত্যার হুমকিতে, আবার অনেকে লোভে পড়েই খারাপকে ভালো সাজাতে বাধ্য হচ্ছে। আবার অনেক সাংবাদিক কোনকিছুর পরোয়া না করেই সত্যের পথে লড়াই করছে।
    এসব রাসেল বাবু নামক সমাজ সেবকদের মুখোশ একদিন খুলতে হবেই।
    বানানে খুব বেশি ভুল নেই।
    আমিসহ- আমি সহ।
    দূর্যোগ- দুর্যোগ।
    গলা খোকর- গলা খাঁকারি।
    লজ্জানত- লজ্জিত।
    বাধিয়ে- বেঁধে।
    নির্দিধায়- নির্দ্বিধায়।
    আমি বিগড়ে গেলাম।- আমি ঘাবড়ে গেলাম।

    Reply

Leave a Reply to হাসিবুব জামান ইমন Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *