কারাগার
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 2,462 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

লেখকঃ SHAFIUR RAHMAN
.
—–প্রথম পরিচ্ছেদ———
“আফামনি রাস্তায় যে গাড়ি প্রস্তুত, বাবু মশায় কোথাও কি বেড়াতে যাবে?”
কাজের মেয়ে রাহা এসে বলল কথাটা।
.
এখন বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময়, দক্ষিনের মৃদু হাওয়া আমের মুকূলের সুগন্ধ জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করছে যা কাস্পিয়াকে অজানা এক শিহরণে হারিয়ে ফেলেছে। এমত অবস্থায় রাহার কথায় সে বাস্তবে ফিরে এলো।
সে জানত পরিবারে কিছু দিন ধরে এরকমই কিছু একটার উদ্যোগ চলতেছে কিন্তু সেটা আসলে কি, সে এখন বুঝতে পারলো। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে রাহাকে সে বললো, “কই আমি তো তেমন কোনো খবর পাইনি।”
রাহা আর তাকে কোনো প্রশ্ন না করে নিজের কাজে যোগ দিলো। কাস্পিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালিশটা পাশে নিয়ে শুয়ে পড়ল। যদিও এই পড়ন্ত বিকেলে শুয়ে থাকা আলসেমির লক্ষন ফুটে তোলে তবুও আজ তাকে শুয়ে থাকতে হবে গত কয়েকদিন ধরে তার শরীরটা আরো খারাপ পরেছে। ঘুম ঘুম চোখে অতীতের সব স্মৃতিই আজ তার বর্তমান রূপে ধরা দিচ্ছে।
.
———দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ——–
বগুড়া শহর থেকে প্রায় ৩০ কিমি উত্তরে অবস্থিত পল্লিগ্রাম মহিমাগঞ্জ। অধুনিক সভ্যতার আলো সবেমাত্র ফুটতে শুরু করেছে এ অঞ্চলে। গ্রামটাকে অজ পাড়াগাঁ বললেও সম্মান দেখানো হয়। কারন, পল্লিগ্রাম হলেও এ অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ডাকঘর খুবই প্রসিদ্ধ। শুধু দূঃখের বিষয় গ্রামীণ যোগাযোগ-ব্যবস্থার এমন সুন্দর সময়েও সেখানে পৌঁছাতে হয় গরুর গাড়িতে। বর্ষার সময় নৌকায়, তবে মাঝখানে একটা হাওর পড়ে বলে সেই যাত্রা অগস্ত্যযাত্রার মতো।
এই গ্রামেরই একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে কাস্পিয়া। জন্মের দু’বছর পর পিতার অকাল মৃত্যতে সে পিতৃহীন হলেও বাবার না থাকার শূন্যতা বুঝতে দেননি তার মা ও বড় ভাই। বিশেষকরে কাস্পিয়ার বড় ভাই জাহিম সাহেব তাকে যেমন ভালোবাসিত এমন করে সচরাচর মা’ও মেয়েকে ভালোবাসতে পারেনা। বাল্যকাল হতেই কাস্পিয়া যেমন ছিলো রূপবতী তেমনি ছিলো চঞ্চল ও মিষ্টভাষার অধিকারী। তার এই গুণাবলির খামখেয়ালি লীলায় মুগ্ধ হয়নি এমন লোক গ্রামে খুজে পাওয়া যাবে না। শুধু যে তার শৌখিনতাই পাড়ার লোকেদের মন ভুলিয়েছে একথা বললে তার প্রতি অবিচার করা হয় বটে। তার এমন এক আশ্চর্য কারুনৈপুণ্য ছিলো যে তার চেয়েও উচ্চবংশের ছেলেমেয়ে তার সাথে ভাব জমাতে আসতো। কিন্তু সমষ্যা একটাই ছিলো কি, কোনো একটা কাজে সে বেশিদিন মন দিতে পারতো না। একটা কোনো বিদ্যা আয়ত্ত করলেই সেটা আর ভালো লাগতো না। যেমন, একদিন কাস্পিয়ার সই চম্পা তাকে একটি কাঁথা সেলাই করতে দিয়েছিলো। ততক্ষণাত সে কাঁথা সেলাই করতে বসে গেলো। আপন মনে নানা রঙ্গের সুতা মিলে নানা চিত্রবিচিত্র করে সেটা সেলাই করছিলো। আসলে, গ্রামের মেয়েদের কাঁথা সেলাই করার জন্য নির্দিষ্ট কতগুলো নকশা ছিলো; কিন্তু কাস্পিয়া সমস্তই নিজের মনের রচনা কাঁথায় ফুটে তুলতো। যখন প্রায় কাঁথাটি সেলাই করা শেষ হয়ে আসলো তখনই কাস্পিয়ার বিরক্তি লাগতে থাকলো, তার আর কাঁথা সেলাই সম্পূর্ণ করা হলো না। চম্পা একথা জানার পর কাঁথাটি সম্পূর্ণ করার জন্য কাস্পিয়াকে অনেক অনুরোধ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সেই কাঁথাটি অনেক দিন পর সে রাত ৩টায় ঘুম থেকে উঠে সম্পূর্ণ করে।
.
কাস্পিয়া এমনই বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী। তার উৎপীড়নে গ্রামের মানুষজন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। গ্রাম্য হাটের দিনে যখন গাঁয়ের লোকজন বাড়ি ফেরার পথে মিষ্টির হাঁড়ি,দই নিয়ে বাড়ি ফিরতো; তখন সে রাস্তার ধারে তার সঙ্গীদের নিয়ে গাছে চড়ে বসে থাকতো।
লোকজন এলেই গুলতি দিয়ে হাঁড়ি ফাটাতো। একবার হয়েছিল কি, কোথা থেকে সে যেনো একটা রাবারের সাপ জোগাড় করেছিলো। সেটা দিয়ে রাজুর দাদীকে এমন ভয় দেখিয়েছিলো যে, তিনি অসুস্থ হয়ে এক সপ্তাহ বিছানায় পড়েছিলেন।
.
কাস্পিয়া এমন দুষ্ট হলেও ছিলো বিশাল মনের অধিকারী। গ্রামে কাহারো যদি ঢ়েকিতে ধান ভাঙ্গার প্রয়োজন পড়ে তখন দেখা যায় সেই আগে গিয়ে উপস্থিত। এটা-ওটা এগিয়ে দিয়ে কাজে সাহায্য করছে।
সব বিষয়েই সে ছিলো অনেক অভিজ্ঞ। একবার স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সে “মঞ্চ-নাটকে” অভিনয় করে সবাইকে কাঁদিয়ে দিয়েছিলো।
অর্থাৎ,তাকে দুষ্ট মনে হলেও ভালোবাসায় সে সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিলো।
.
——–তৃতীয় পরিচ্ছদ
———
সময় চলে, দিন যায় সাথে কাস্পিয়ার বয়সও তালে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে।
এই শরতেই সে অষ্টাদশ বয়সে পদার্পণ করবে। চারিদিক হতে বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে বিয়ের সমন্ধ আসা শুরু করেছে। এ ছেলে এটা করে তো, ও ছেলে এটা করে ইত্যাদি ইত্যাদি। কাস্পিয়া চায়’না যে সে এখন বিয়ে করে অন্যের ঘরে চলে যাবে; সে যেমন আছে তাতেই দিব্যি দিন চলে যাবে। কিন্তু তার সই চম্পা, তামান্না সবারই বিয়ে হয়ে গিয়েছে শুধু সেই বাকি আছে; একা একা সময় কাটতেই চায় না।
এদিকে কাস্পিয়ার ভাই জাহিম সাহেব একদিন খবর আনলেন ওপারার মজিদ শিকদারের বড় ছেলে শহর থেকে “আইন” পাশ করে গ্রামে আসার পথে কাস্পিয়াকে দেখে পছন্দ করেছে এবং বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তাকে বিয়ে করে সে শহরে চলে গিয়ে ওকালতি করবে।
.
.
——–চতুর্থ পরিচ্ছেদ——–
আজ কাস্পিয়ার বিয়ে হচ্ছে। তার সই চম্পা, তামান্না, সুজানা সবাই শশুর-বাড়ি থেকে এসেছে কাস্পির বিয়ে উপলক্ষে। খুব সুন্দরভাবে ঘর-বাড়ি সাজানো হচ্ছে; পুরো এলাকাজুড়ে সাজ-সাজ রব জুড়ে বসেছে। এ গেট সাজাচ্ছে তো ও বর পক্ষের প্যান্ডেল সাজাচ্ছে। গ্রামের নয়নের মণির বিয়ে বলে কথা। আর সব কাজে তদারকি করছে রাজু যার দাদীকে সে রাবারের সাপ দিয়ে ভয় দেখিয়েছিল।
.
বিবাহকার্য শেষে যখন কন্যার বিদায়ের সময় এসে গেলো তখন চারিদিক থেকে ক্রন্দনের ঢেউ উঠে গেলো।
শামসুল দাদু এসে বলল,”তুই চলে যাচ্ছিস মা? আমার ক্ষেতের শসাগুলোর এখন কী হবে? কে আমার ক্ষেতের শসা প্রতিদিন চুরি করবে? যখন ক্ষেতে গিয়ে দেখবো গাছে শসা নেই তখন কাকে বকবো বল?
রহিম চাচা এসে বলল,”যখন হাটে থেকে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে ফিরবো তখন কে হাঁড়ি ফাটিয়ে পালাবে?”
আতাহার কাকু বলল,”আমার বাগানের কলা চুরি করে কে এখন বলবে যে, কাকু তোমার বাগানে কাল অনেকগুলো বাঁদর এসেছিলো?
শিলুর মা বলল,”ঢ়েকিতে ধান ভাঙ্গার সময় তোর কথা খুব মনে পড়বে মা, খুব মনে পড়বে।”
এরকম রাজুর দাদী, মোফাজ্জল চাচা এমনকি ছোট্ট রিয়াদ পর্যূন্ত কেঁদে-কেঁদে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেছে।
.
——–পঞ্চম পরিচ্ছেদ———
কাস্পিয়া তার স্বামীর সাথে বিবাহের দু’দিন পরেই ব্যস্তময় শহর ঢাকায় চলে আসে।
তার চোখে-মুখে আনন্দের ছিটে ফোঁটা পর্যুন্ত নেই। তার মন পরে আছে শস্য-শ্যামলা সেই নিজ গ্রামে। যেখানে প্রতি নিয়ত সে মুক্তমনে ঘুরে বেড়াতো। খুব মনে পড়ছে আজ চম্পা, তামান্না, ঝতু, বর্ষা’দের কথা।
শরৎকালের প্রায় মাঝামাঝি সময়। এসময় যদিও গ্রামের আকাশে এখন সাদা-সাদা মেঘ গুচ্ছভাবে ঘুড়ে বেড়ায় কিন্তু ঢাকাতে তার ছিটে-ফোঁটা পর্যন্ত নেই। শুধু সারাক্ষণ যানবাহন চলাচলের শব্দ আর শব্দ। এখানে শরৎকাল আসবে কেমন করে? চারিদিকে যে হারে বায়ু দূষিত হচ্ছে।
কাস্পির স্বামী রাকিব শিকদার প্রতিদিন সকাল ন’টায় অফিস যায় এবং বিকাল পাঁচটায় বাসায় আসে। তিনি থাকা কালীন তবুও এটা-ওটা চেয়ে কাস্পিয়াকে ব্যস্ত রাখেন। কিন্তু তিনি অফিস যাওয়ার পরবর্তী সময়টুকু কাস্পিকে একাকীত্ব গ্রাস করে। সে সময়টুকু তাকে শুয়ে-বসেই কাটাতে হয়।
নিত্যদিনের মতো আজও কলিং বেলের শব্দে কাস্পিয়া দরজা খুলে দিলো। রাকিব সাহেব আজ অফিস থেকে ফেরার সময় একগাদা ফুলের গাছ কিনে এনেছে তা দেখে কাস্পির চোখ ছন্নবড়া।
অস্ফুটনে মুখ থেকে বেড়িয়ে গেলো “এতগুলো ফুলের গাছ!”
রাকিব সাহেব সহাস্যমুখে জবাব দিলো,”হুম। রাত্রে তো ঘুমের ভিতর তো খুব ফুল,ফুলের গাছ বলে বলে আমার মাথাটা নষ্ট করে দাও। এখন কেমন চমকিয়ে দিলাম বলো?”
সব ফুলগাছগুলো তাদের বাসার ছাঁদে সুন্দরভাবে সাজানো হলো। এখন থেকে রাকিব সাহেব অফিসে গেলে ওই সময়টুকু সে গাছের সাথে কথা বলেই সময় কাটায়।
.
——-ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ———-
প্রায় দু’বছর পরের কথা। কাস্পি এখন এই ঢাকার যান্ত্রিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে তবে অতীত গ্রামীণ জীবন এখনো তার মন’কে কাঁদায়। মাঝে-মাঝে গভীর রাতে সে ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে; রাকিব সাহেব ধরপর করে জেগে উঠে তাকে ভালোবাসার বাহুডোরে জড়িয়ে নেন। দু’বছরের মধ্যে তারা গ্রামের বাড়ি থেকেও বেশ কয়েকবার বেড়িয়ে এসেছেন।
.
কাস্পি এখন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা; রাকিব সাহেব এখন তার প্রতি খুবই যত্নশীল। আগে তিনি দু’বেলা অফিস করতেন আর এখন শুধু একবেলা অফিসে যান এবং খুব দ্রুতই চলে আসেন। রান্নাবান্নাসহ, কাপড় কাঁচা সব কাজ এখন তিনিই করেন। একটা কাজের লোক রাখতে বললে বলে,” কি দরকার কাজের লোক রাখার? আমার দু’টা নয় পাঁচটা নয় একটা মাত্র বউ। আর তার অসুখে কাজকর্ম আমি অন্য কাউকে করতে দেবো কেন?”
কাস্পি মুখে নিষেধ করলেও মনে-মনে অনেক খুশি হয়। অন্য সময় হলে তাকে কাছেই পাওয়া যেতো না, এসময় একটু কাছে থাকার জন্য হলেও করুক না কাজকর্মগুলো।
.
——সপ্তম পরিচ্ছেদ——-
রাত দশটায় রাকিব সাহেব চিন্তনরত হাসপাতালে বসে রয়েছে। তার স্ত্রীকে অসহ্য প্রসাব-বেদনায় কাতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার যা বলে গেলেন তা এখনো তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার স্ত্রী মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছেন। পৃথিবীর সবকিছুই এখন তার কাছে অন্ধকারময় মনে হচ্ছে।
.
কাস্পিয়া এখন আগের চেয়ে অনেক চুপচাপ স্বভাবের মানুষে পরিণীত হয়েছে। কাহারো সাথে কোনো কথা নেই শুধু হাতে একটা পুতুল নিয়ে সারাক্ষণ শুধু “কাজল”, ” কাজল” নামে ডাকতে থাকে আর বাঁধাহীনভাবে চোখের পানি ফেলে।
তাকে দেখে কেউই বলতে পারবেনা এই সেই কাস্পি; যে একাই সারাদিন পুরো গ্রাম দুষ্টামিতে মাতিয়ে রাখতো। আর আজ সে স্বপ্নহীন মানবীতে পরিণীত যার দিনের আলোর চেয়ে অন্ধকার ঘরই এখন প্রিয় হয়ে উঠেছে।
.
রাকিব সাহেব ভেবেছিলেন কাস্পিয়া হয়তো দু-চার মাস চলে গেলে এমনিই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। কিন্তু সে যখন ছয় মাসেও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলোনা বরং অতিরিক্ত কান্না করায় আরো চোখের সমষ্যা বাঁধিয়ে ফেললো তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন হয়তো গ্রামের বাড়ি গেলে সে পুরোনো স্মৃতি ভূলে সুস্থ হয়ে উঠবে।
.
——-অষ্টম পরিচ্ছেদ——–
অনেকদিন পর কাস্পিয়া আজ গ্রামে এলো, দু’বছর তো প্রায় হয়েই যাবে। কিন্তু গ্রামের পরিবেশ এখন আর আগের মতো নেই। রাস্তাঘাট পাঁকা হয়েছে, অনেক বাড়ি-ঘরও এখন ইটের হয়েছে, অনেক পুরোনো গাছ-পালাও কেটে ফেলা হয়েছে। ব্যথিত হৃদয়ে এসব কোনো কিছুই আর সাড়া ফেলে না। সে এখন নিজেই নিজেকে চিন্তে পারেনা; মানুষ সময়ের সাথে সাথে এতো পরিবর্তন কিভাবে হন?
.
তার শাশুড়ি এখন তাকে দু’চখে সহ্য করতে পারেনা। সব সময় কথা শুনিয়ে দেয়,”অলুক্ষুনে মেয়ে, যে নিজের সন্তানকে পর্যন্ত সু্স্থভাবে জন্ম দিতে পারেনা। না জানি ছোট বেলায় কতো পাপ করেছিলো! সারাদিন বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতো। কার সাথে কখন কী করতো তার ঠিক আছে। ছিঃছি, রাকিব আমি তোকে আগেই বলেছিলাম এসব মেয়েদের বিয়ে করিস না; কিন্তু শুনলিনা আমার কথা, এখন হলো তো?”
এসব কথা শুনলে কাস্পির চোখ ফেটে জল আসে। এমন এমন কথা শুনতে হচ্ছে যার কারনে নিজেই নিজেকে ঘৃণা করছে। “আল্লাহ তুমিই সব জনো তবে কোন পাপের শাস্তি আমাকে দিচ্ছো বলো?”
.
——-নবম পরিচ্ছেদ———-
কিছুদিন ধরে কাস্পিয়া চোখ দিয়ে ঝাপসা-ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে। রাকিব সাহেব গ্রাম্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি শহরের কোনো ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে শিঘ্রই চিকিৎসা নিতে বললেন। তা শুনে কাস্পি বলল,”ছাড়ো তো ডাক্তারদের কথা, ওরা সামান্য অসুখ হলেও বলে গুরুতর অসুখ। ওদের কথায় তুমি অতো ব্যস্ত হইয়োনাতো।”
এভাবের কিছুদিন চলে গেলো। দেখা গেলো তার চোখের অবস্থা আগের চেয়ে আরো বেশি খারাপ। এখন সবকিছুই সে ঝাপসা দেখতে পায়। অবশেষে রাকিব সাহেব তাকে জোর করেই বগুড়া শহরে নিয়ে গেলো। তার চোখ পরিক্ষা করে ডাক্তাররা বললো,”ওনার চোখের কান্ডিশন খুবই ভয়াবহ, জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে তা না হলে অন্ধ হয়ে যাবে। তবে…. ”
” তবে কি ডাক্তার? চুপ করে থাকবেন না প্লিজ বলুন”
“দেখুন পেশেন্টের অবস্থা খুবই সিরিয়াস তাই এই দূর্বল চোখে অপারেশন করলেও ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা 50-50। তবে আপনারা ভালো কোনো শহর অথবা বিদেশে গিয়ে দেখতে পারেন যদি আল্লাহর রহমতে ঠিক হয়ে যায়।”
.
পরের দিনই কাস্পিয়াকে ঢাকা হসপিতালে ভর্তি করানো হয়। তবে যথা সাধ্য চেষ্টা শর্তেও তাকে অন্ধত্বকে বরণ করে নিতে হয়।
.
—–দশম পরিচ্ছেদ———
কাস্পিয়া পরিবারে এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি অসহ্য হয়ে উঠেছে। তবে রাকিব সাহেব এখন সর্বদাই তার পাশে থাকেন যেটা প্রয়োজন সেটা এনে সাহায্য করেন। স্বামীর এমন কৃতজ্ঞচিত্ত ব্যবহার দেখে মাঝে-মাঝে তার চোখ ফেটে জল বের হয়, হয়তো কোনে এক পুণ্য সে করেছিলো যার কারনে তার ভাগ্যে এরকম এক স্বামী জুটেছে। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া প্রকাশ করে। এভাবেই দিন চলে যায় রাত আসে আবার রাত চলে যায় দিন আসে।
.
বেশ কিছুদিন ধরে কাস্পিয়া দেখছে আজকাল রাকিবও তাকে আর আগের মতো সময় দেয়না, তাই সে এখন থেকে নিজের কাজ নিজেই করে। চোখ নেই তো কি হয়েছে হাত নেড়ে, পা নেড়ে বেশ কয়েকটি কাজ করা যায়।
.
এখন তার মনে হয় চোখ নেই বলেই মনে হয় তার শ্রবণ খুব তীক্ষ্ণ হয়েছে। সে গাছদের কথা শুনতে পায়, পাখিদের কথা শুনতে পায় ইত্যাদি ইত্যাদি। সে এখন নিজেকে অন্ধ মনে করেনা, মানুষেরা তাকে সময় দেয়না তো কি হয়েছে? অনেক জীব-জড় পদার্থই তাকে একাকীত্ব দূর করার জন্য সঙ্গ দেয় যা চোখ থাকলে কি সম্ভব হতো?
.
আজকাল তার শাশুড়ি রাকিবকে মাঝে মাঝেই বলে,”বিয়ে কর, বিয়ে কর। ওই মুখ পোড়া অলুক্ষুণে, অসতী মেয়ের পাল্লা থেকে নিজেকে উদ্ধার কর।”
কাস্পি জানে রাকিক কথাগুলোকে কখনোই পাত্তা দিবে না, কারন সে তাকে কথা দিয়েছে সে অন্ধ হলেও তাকে কখনো ছেড়ে যাবেনা।
তবে আজকাল তাকে ছাড়াই গুপ্ত আলোচনা বসে হয়তো সে বেঁচে থাকতেই তাকে রাকিবের সাথে অন্য মেয়েকে দেখতে হবে।
.
এসব চিন্তা করতে করতে কখনযে সন্ধে পরিয়ে গেছে তার মনেই নেই। কাজের মেয়ে রাহা ঘরে বাতিও জ্বালিয়ে দিয়েছেও হয়তো!
এমন সময় রাকিব এসে বললো,”গ্রামে তো অনেকদিন থাকলাম দেখি শহর থকে কয়েকদিন ঘুরে আসি, তুমি কিছুদিন একা থাকো।”
কাস্পি মনে সাহস নিয়ে বললো, “আমার সাথে ছলনা করে কি লাভ আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে খেয়ে ফেলবো?তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছ।”
রাকিব সাহেব কর্কশ স্বরে বললো”তুমি যদি তাই মনে করো তবে তাই। আমি তোমাকে মিথ্যা কথা বলেছি, আমি বিয়েই করতে যাচ্ছি।”
.
কাস্পিয়া সাথে সাথে রাকিবের পা জড়িয়ে ধরে বললো,” দয়া করে আমাকে এমন শাস্তি দিবেনা, আমি কি ভূল করেছি বল? হয়তো শুধু অন্ধই হয়েছি কিন্তু আমি সর্বদাই মনের চোখ দিয়ে তোমাকে অনুভব করি”
“এমন আজগুবি কথা এখন আমার শোনার সময় নেই, পা ছাড়ো” এই কথা বলে রাকিব সাথে স্বজোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিয়ে চললো নতুন স্বপ্ন বুনতে। আর কাস্পিয়া রইলো অন্ধকার বন্দি কারাগারে।
.
(সমাপ্ত)

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

২ Comments

  1. আফরোজা আক্তার ইতি

    আনকমন থিম। লেখনী খুব সুন্দর। কাস্পিয়ার জীবন সুন্দর হতে পারতো, প্রতিটি মেয়েই স্বপ্ন দেখে ভালো কোন পরিবারে যাওয়ার। কিন্তু কাস্পিয়া শুরু থেকেই দুঃখী ছিল,শেষ পর্যন্তও দুঃখীই ছিল।
    বানানে বেশ কিছু ভুল।
    লক্ষন- লক্ষণ।
    কিমি- কি.মি.
    কারন- কারণ।
    সমন্ধ- সম্বন্ধ।
    ভূল- ভুল।
    পরিয়ে- পেরিয়ে।
    থকে- থেকে।
    স্বজোরে- সজোরে।

    Reply
    • Shafiur Rahman

      ধন্যবাদ ভূল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।
      একদিনের ভিতর লেখার কারণে পোস্ট ইডিট করার সময় ছিলোনা।

      Reply

Leave a Reply to আফরোজা আক্তার ইতি Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *